বেদে কি রাধারাণীর কথা বলা হয়েছে ? ‎

20250826_130407

 বেদের বর্ণনায় শ্রীমতি রাধারাণীঃ

অনেকে বেদসংহিতাকে বেদ বলে মনে করে।কিন্তু বেদের পরিধি আরো অনেক বিস্তৃত। বেদের অপর নাম শ্রুতি।বেদ প্রধানত চার প্রকার- ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ ও অথর্ববেদ। প্রত্যেকটি বেদের আবার চারটি করে অংশ আছে। যথা- সংহিতা, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক এবং উপনিষদ।

বেদসহ‎ সনাতন শাস্ত্রে শ্রীমতি রাধারাণীকে  ‘বৃষভানুনন্দিনী’, ‘বার্ষভানবী’ ‘গান্ধর্ব্বী’,’রাধা’, ‘রাধসা’, ‘রাধে’,’রাধিকা’ইত্যাদি নামে সম্বোধন করা হয়েছে।

‎বেদের বর্ণনায় ইন্দ্র, বরুণ,শিব,রুদ্র, বিষ্ণু ইত্যাদি শব্দ দ্বারা পরমেশ্বরকে নির্দেশ করা হয়।আর বেদের বিভিন্ন বিভাগের মতো অথর্ববেদের গোপালতাপনী  উপনিষদ ১/২ বলা হয়েছে,”একো বশী সর্বগঃ কৃষ্ণ ঈড্যঃ”-সেই একমাত্র শ্রীকৃষ্ণই  পরম পুরুষোত্তম ভগবান,তিনিই আরাধ্য।

সুতরাং বেদ অনুসারে শ্রীকৃষ্ণ হলেন পরমেশ্বর। এবং বেদে বর্ণিত ইন্দ্র, বরুণ,শিব,রুদ্র, বিষ্ণু ইত্যাদি শব্দ দ্বারা পরমেশ্বররুপে শ্রীকৃষ্ণকে নির্দেশ করা হয়েছে।এ বিষয়ে আরো স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা এবং মহাভারত শাস্ত্রে। গীতা ১৫/১৫ শ্লোকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেন,আমি সমস্ত  বেদের জ্ঞাতব্য  (“বেদৈশ্চ সর্বৈরহমেব বেদ্যো)।অথাৎ সমগ্র বেদে সর্বত্র শ্রীকৃষ্ণের কথা আলোচনা করা হয়েছে।আর  মহাভারত, শান্তিপর্ব, মোক্ষধর্ম ৩২৭/৮-১০,৩৭-৪০ শ্লোকে অর্জুনের জিজ্ঞাসায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেন, বেদে বর্ণিত বিষ্ণু,বাসুদেব,অগ্নি ইত্যাদি নাম আমারই।অথাৎ পরমাত্মা শ্রীকৃষ্ণের উক্তি অনুসারে বেদে বর্ণিত বিষ্ণু, শিব,রুদ্র,বাসুদেব সবই তারই নাম।এ বিষয় আরো বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে নিমোক্ত লিংকে-

‎https://svadharmam.com/is-the-vedas-mentioned-sri-krishna-according-to-the-vedas-sri-krishna-is-godhead/

‎সুতরাং যেখানে শ্রীকৃষ্ণ থাকবেন, সেখানে তারই পত্নি শ্রীমতি রাধারাণী থাকবেন।আর বিশেষ করে বেদে যখন রাধারাণীকে বিষ্ণুপত্নি অথবা রাধানাম পতে অথাৎ রাধানাম্নী পতি দ্বারা শ্রীকৃষ্ণকে সম্বোধন করা হয়,তখন স্পষ্টভাবে এ শব্দ দ্বারা বুঝা  যায় বেদে স্পষ্টভাবে রাধারাণীর নাম আছে।

‎পরমেশ্বরের অগ্নি, ইন্দ্র,বরুণ, শিব,রুদ্র,বাসুদেব ইত্যাদি বহুবিধ শব্দের বিবিধ অর্থ আছে।যেমন শিব শব্দের অর্থ মঙ্গল,রুদ্র শব্দের অর্থ গর্জনকারী, অগ্নি শব্দের অর্থ আগুন ইত্যাদি।কিন্তু বেদে এ সমস্ত শব্দ উপস্থিত হলে  তা দ্বারা যদি পরমেশ্বরকে ইঙ্গিত করে তাহলে তা পরমেশ্বরকে নির্দেশ করে। তখন আর এসমস্ত শব্দ দ্বারা লৌকিক অর্থ প্রকাশ করে না।ঠিক তেমনই পরমেশ্বরের পত্নি বা বিষ্ণুপত্নিরুপে যখন রাধা নামটি উচ্চারিত হয় তখন তা দ্বারা শ্রীমতি রাধারাণীকে নির্দেশ করে,অন্যকোন অর্থকে নয়।

‎যাস্ক রাধা শব্দে নিরুক্ত করেছেন ধন সম্পদ।কিন্তু ব্যাসদেব রাধা বা রাধস পদের ভূৎপত্তিগত অর্থ করেছেন,  পরমেশ্বর ভগবানের ষড়ৈশ্বর্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবীকে রাধস বা রাধা বলা হয়।

‎ বেদ শাস্ত্রের পাশাপাশি  নারদীয় মহাপুরাণ, পদ্ম মহাপুরাণ, শ্রীমদ্ভাগবত মহাপুরাণ, ব্রহ্মবৈবর্ত মহাপুরাণ, বরাহপুরাণ, স্কন্দ পুরাণ, মৎস্য পুরাণ, ব্রহ্মান্ড পুরাণ, গর্গ-সংহিতা, সনৎকুমার সংহিতা ও নারদ-পঞ্চরাত্র ইত্যাদি শাস্ত্রেও বিশেষভাবে শ্রীমতি রাধারাণীর মহিমা বর্ণিত রয়েছে।আমরা এখন বিস্তৃত আলোচনার মাধ্যমে বেদে বর্ণিত রাধারাণী সমন্ধে জানব।

‎স্তোত্রং রাধানাং পতে গির্বাহো বীর যস্য তে।বিভূতিরস্তু সূনৃতা ॥

‎[ ঋগ্বেদ সংহিতা ১।৩০।৫; সামবেদ সংহিতা, উত্তরার্চিক ১৬।৩।৮  ]

‎অনুবাদঃ হে রাধাপতি , হে বীর! প্রশস্তি দ্বারা স্তুত, যে তোমার স্তুতি করে সে সমৃদ্ধি ও আনন্দ লাভ করে। অর্থাৎ তাঁর সত্য রূপা প্রিয় সমৃদ্ধি লাভ হয়।

‎ইদং হ্যন্বোজসা সুতং রাধানাং পতে।পিবা ত্বাস্য গিৰ্বণঃ ॥

[ ঋগ্বেদ সংহিতা ৩।৫১।১০; সামবেদ সংহিতা, উত্তরার্চিক ২।৩।১  ]

‎অনুবাদঃ ‎হে রাধাপতি , হে স্তুতিপ্রিয়! তেজ দ্বারা সম্পন্ন এই মধুর সোমরস তোমার পানের জন্য। তুমি এসে পান কর।

‎যা বিশপত্নীন্দ্রমসি প্রতীচী সহস্রস্তুকাভিয়ন্তী দেবী। বিষ্ণোঃ পত্নি তুভ্যং রাতা হবীংষি পতিং দেবি রাধসে চোদয়স্ব।।

অন্বয়ঃ যা -যিনি,বিশপত্নি-পোষন করেন,ইন্দ্রম অসি অভিয়ন্তি-পরম ঐশ্বর্যশালী  পরমেশ্বর তার অভিমুখে ধাবমানা,সহস্রস্তুকা দেবী-যে দেবী সহস্র স্তুতি দ্বারা স্তুতমানা,প্রতীচি-আপনি পূর্ণ জ্ঞানসম্পন্ন,বিষ্ণোঃ পত্নি তুভ্যং-আপনি বিষ্ণুপত্নি,রাতা-দান করি,হবীংষি-হবিযোগ্য বস্তু,দেবী রাধসে-দেবী রাধাকে,পতিং চোদয়স্ব-আপনার পতিকে চালিত /প্রেরিত করুন।

‎[অথর্ববেদ সংহিতাঃ কান্ড৭/অনুবাক৪/সুক্ত২/মন্ত্র৪
‎ অথবা অথর্ববেদ সংহিতাঃকান্ড ৭/সুক্ত৪৭/মন্ত্র২]

অনুবাদঃহে বিষ্ণুপত্নী,আপনি পরম ঐশ্বর্যশালী  পরমেশ্বরের  অভিমুখে ধাবমানা,সহস্র স্তুতি দ্বারা স্তুতমানা,আপনি পূর্ণ জ্ঞানসম্পন্ন।আপনার জন্য হবিযোগ্য বস্তু দান করছি। হে দেবি রাধা আপনার পতিকে (শ্রীকৃষ্ণকে) আমাদের প্রতি চালিত করুন।

‎এ মন্ত্রটি দেবপত্নি সুক্ত নামে পরিচিত।এ মন্ত্রে উল্লেখিত “দেবি রাধসে” শব্দ দুটি গুরুত্বপূর্ণ। “দেবি রাধসে ” এ দুটি শব্দ দ্বারা কখনো ধনসম্পদকে নির্দেশ করে না।

‎কেউ বলতে পারে,এ মন্ত্রে তো বিষ্ণুপত্নী বলা হয়েছে, তিনি তো কৃষ্ণপত্নী নন।এর উত্তর হল, বিষ্ণু হল শ্রীকৃষ্ণের একটি নাম।মহাভারত শান্তিপর্ব ৩২৭ অধ্যায়ে অজুর্নের জিজ্ঞাসায় শ্রীকৃষ্ণ তার একটি নাম বলেছেন বিষ্ণু।

‎গতিশ্চ সর্বভূতানাংপ্রজনশ্চাপি ভারত।
‎ব্যাপ্তা মে রোদসী পার্থ কান্তিশ্চাভ্যধিকা মম।। ৩৯ অধিভূতানি চান্তেষু তদিচ্ছংশ্চাস্মি ভারত!

ক্রমণাচ্চাপ্যহং পার্থ বিষ্ণুরিত্যভিসংজ্ঞিতঃ।। ৪০

‎    (মহাভারত, শান্তিপর্ব ৩২৭/৩৯-৪০)

অনুবাদঃ হে ভরতবংশীয় পৃথানন্দন! আমি সর্বভূতের গতি বলে ” বিষ্ণু”; কিংবা আমা হতেই সর্বভূত উৎপন্ন হয় বলে আমি “বিষ্ণু”; অথবা আমি স্বর্গ ও মর্ত্য ব্যাপিয়া রয়েছি বলে “বিষ্ণু” কিংবা প্রলয়কালে আমি নিজদেহে সমস্ত ভূত প্রবেশ করাতে ইচ্ছা করি বলে আমি “বিষ্ণু”; অথবা আমি বামন রূপে সমগ্র জগৎ আক্রমণ করেছিলাম বলে আমি বিষ্ণু নামে অভিহিত হয়ে থাকি।

এছাড়াও শ্রীমদ্ভাগবতে শ্রীল শুকদেব গোস্বামী   ব্রজবাসী গোপীদের সাথে রাসনৃত্যকারী শ্রীকৃষ্ণকে বিষ্ণু বলে সম্বোধন করছেন।

‎বিক্রীড়িতং ব্রজবধূভিরিদং চ বিষ্ণোঃ শ্রদ্ধান্বিতোহনুশৃণুয়াদথ বর্ণয়েদ যঃ।
‎ভক্তিং পরাং ভগবতি প্রতিলভ্য কামং হৃদ্রোগমাশ্বপহিনোত্যচিরেণ ধীরঃ ॥ ৩৯ ॥

‎     – (শ্রীমদ্ভাগবত ১০/৩৩/৩৯)
অনুবাদঃ যিনি অপ্রাকৃত শ্রদ্ধান্বিত হয়ে এই রাস পঞ্চাধ্যায়ে ব্রজবধূদের সঙ্গে শ্রীবিষ্ণুর (শ্রীকৃষ্ণের) রাসনৃত্য বিশিষ্ট  ক্রীড়া বর্ণনা শ্রবণ করেন বা বর্ণনা করেন, সেই ধীর পুরুষ ভগবানের যথেষ্ট পরাভক্তি লাভ করে হৃদরোগ রূপ জড় কামকে শীঘ্রই দূর করেন।

সুতারাং উপরোক্ত বেদমন্ত্রটি যেহেতু দেবপত্নি সুক্ত নামে পরিচিত।এবং উল্লেখিত মন্ত্রে “বিষ্ণুপত্নি” এবং “দেবি রাধসে” শব্দ গুলো দ্বারা শ্রীমতি রাধারাণীকে নির্দেশ করা হয়েছে, যাস্ক নিরুক্ত অনুসারে ধনসম্পদকে নয়।

বেদ সংহিতা বিভাগ ছাড়াও বেদের উপনিষদ বিভাগেও রাধারাণীর কথা উল্লেখ পাওয়া যায়।

‎     স্য মধ্যে হি শ্রেষ্ঠা গান্ধর্ব্বীত্যুবাচ
‎      তং হি বৈ তাভিরেরং বিচার্য্য।।

‎  -অথর্ববেদীয় গোপালতাপনী উপনিষদঃ  উত্তরবিভাগ, মন্ত্র ৯ (অথর্ববেদ)

অনুবাদঃ গোপীদিগের মধ্যে গান্ধর্ব্বী (রাধারাণীর একটি নাম) নামে এক প্রধানা গোপী তাঁদের সাথে বিচার করে জিজ্ঞাসা করলেন।

‎দ্বে পার্শ্বে চন্দ্রাবলী রাধিকা চেতি যস্যাংশেন লক্ষ্মীদুর্গাদিকা শক্তিরিতি।

‎- অথর্ববেদীয় পুরুষবোধিনী উপনিষদ, ১ম প্রপাঠক

‎অনুবাদঃ তাঁর(শ্রীকৃষ্ণের) দুই পাশে চন্দ্রাবলী ও রাধিকা। এই রাধিকা হলেন কৃষ্ণের স্বরূপশক্তি যার অংশে লক্ষ্মী দুর্গাদি শক্তি।

‎                 হরে কৃষ্ণ। প্রনাম।

‎তথ্য সহায়তাঃ
‎১/অথর্ববেদ সংহিতাঃকান্ড ৭/সুক্ত৪৭/মন্ত্র২।
‎মন্ত্রার্থ প্রদান এবং বিশ্লেষন – শ্রীমান অর্জুনসখা দাস।

Sadgun Madhav Dash

Writer & Admin

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments