ওঁ নমো ভগবতে বাসুদেবায়
প্রারম্ভঃ
পরব্রহ্ম, পুরুষোত্তম, অধোক্ষজ, পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জন্মাষ্ঠমী তিথিতে স্বধর্মম্ পরিবারে পক্ষ থেকে সবাইকে জানাই কৃষ্ণপ্রীতি ও শুভেচ্ছা।
“পরমেশ্বরের জন্ম তিথি” এই বাক্যটা শুনলে অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগে “পরমেশ্বরের আবার জন্ম হয় নাকি? তিনি তো অজ, নিত্য শ্বাশ্বত”।
হ্যাঁ, সেই অজ পরমেশ্বর কিভাবে তাঁর দিব্য জন্ম-কর্ম (জন্ম কর্ম চ মে দিব্যম্, গীঃ ৪/৯) সম্পাদন করেন এবং কেন করেন তার উওর ভক্তদের অজানা নয়(পরিত্রাণায় সাধুনাম..বিনাশায় চ..)। এসব কথা বলা আজকের অভিপ্রায় নয়।
আজকে আমরা তাদের জন্যই এই লেখা উৎসর্গ করছি যারা যুগ যুগ ধরে পৌণ্ড্রক, শিশুপালের মতো শ্রীকৃষ্ণের প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে তাঁর ভগবত্তাকে অস্বীকার করার নিত্য নতুন ফন্দি আঁটছে।
শ্রীকৃষ্ণের প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ এই পাখণ্ডদের কিছু দাবি খণ্ডণ করাই এই লেখনীর উদ্দেশ্য।
পাখণ্ড দাবিঃ
পাখণ্ডদের দাবি শ্রীকৃষ্ণ পরমেশ্বর নন, তিনি কেবলই একজন মানব/মহামানব বা মহাপুরুষ(জীব) এবং একজন যোগী ছিলেন। তিনি পরমেশ্বরের সাথে যোগযুক্ত অবস্থায় কুরুক্ষেত্রের রণাঙ্গনে অর্জুনের সামনে ভগবদ্গীতার জ্ঞান প্রদান করেছিলেন। অর্থাৎ কেবল একজন বার্তাবাহকের মতো পরমেশ্বরের জ্ঞানকে শ্রীকৃষ্ণ উচ্চারণ বা আবৃত্তি করেছিলেন মাত্র। তাই তিনি “যোগেশ্বর” অর্থাৎ “যোগ যুক্ত ঈশ্বর”।
এই দাবির স্বপক্ষে তারা কিছু যুক্তি উপস্থাপন করে। যেমনঃ
১) পরমেশ্বর ভগবান অজ, অশরীরী, নিরাকার। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণের জন্ম-মৃত্যু সব আছে। তাই তিনি পরমেশ্বর হতে পারেন না।
২) ভগবদ্গীতায় তাঁকে বহু জায়গায় “যোগেশ্বর” বলা হয়েছে।
৩) ভগবদ্গীতার ১৮/৬২ নং শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ নিজে অর্জুনকে পরমাত্মার শরণ গ্রহণ কথা বলেছেন।
৪) শ্রীকৃষ্ণ, কুরুক্ষত্রের যুদ্ধের পর ভগবদ্গীতার জ্ঞান ভুলে গিয়েছিলেন। যা মহাভারতে বর্ণিত আছে।
যুক্তি খণ্ডণঃ
এখানে বলে নেওয়া ভালো যে, পাখণ্ডদের উক্ত দাবি অনুযায়ী শ্রীকৃষ্ণ হয় নিজে জীবরূপে/যোগীরূপে (বিপক্ষের দাবী অনুযায়ী) ভগবদ্গীতার ৫৭৪টি শ্লোক বলেছেন। নয়তো যদি তাঁকে পরমেশ্বর হিসেবে স্বীকার করে নেওয়া হয় তবে এই ৫৭৪টি শ্লোক তাঁর অর্থাৎ পরমেশ্বর ভগবান কতৃক উক্ত হয়েছে।
এর মাঝামাঝি অর্থাৎ যদি বলা হয় “তিনি কিছু শ্লোক জীব স্বরূপ হয়ে আবার কিছু শ্লোক পরমেশ্বরের হয়ে বলেছেন” এমন দাবি নিতান্তই অযৌক্তিক এবং বালখিল্য। কেননা এমন ধারণা তাদের মনোধর্মপ্রসূত।
এই দাবি মানলে আমাদেরকে স্পষ্ট করে বলতে হবে যে তিনি এই শ্লোক থেকে এই পর্যন্ত যোগযুক্ত ছিলেন। আর এই শ্লোক থেকে এই পর্যন্ত যোগবিযুক্ত অবস্থায় বলেছেন। ক্ষণে যোগযুক্ত হয়েছেন আর ক্ষণেই যোগবিযুক্ত হয়েছেন এমন দাবি হাস্যকর।
এইসব হাস্যকর, রম্য দাবি শুনে মনে হয় যেন “শ্রীকৃষ্ণ পরমাত্মার সঙ্গে যোগযুক্ত হওয়ার জন্য যে Internet Connection Providers/Device ব্যবহার করতেন তার সিগন্যাল খুবই দুর্বল ছিল!। তা নাহলে তিনি কখন যে যোগযুক্ত হচ্ছেন (Connected) আর কখন যোগমুক্ত (Disconnected) হচ্ছেন তা বুঝা খুব মুশকিল।” 😀 😀
আমরা শ্রীকৃষ্ণকে পরমেশ্বর জ্ঞানেই ভগবদ্গীতার “ভগবান উবাচ” দ্বারা যে ৫৭৪টি শ্লোক স্বীকার করবো এবং পাখণ্ডদের দাবি খণ্ডণ করবো।
————————————————————————————————————————-
১ম দাবিঃ পরমেশ্বর ভগবান অজ, অশরীরী, নিরাকার। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণের জন্ম-মৃত্যু সব আছে। তাই তিনি পরমেশ্বর হতে পারেন না।
খণ্ডণঃ
পরমেশ্বর ভগবান যে অজ হয়েও দিব্য জন্ম লাভ করেন তার কথা তিনি নিজেই বলেছেন।
অজোহপি সন্নব্যয়াত্মা ভূতানামীশ্বরোহপি সন্ ।
প্রকৃতিং স্বামধিষ্ঠায় সম্ভবাম্যাত্মমায়য়া ।।
ভঃগীঃ ৪/৬
অনুবাদ: যদিও আমি জন্মরহিত এবং আমার চিন্ময় দেহ অব্যয় এবং যদিও আমি সর্বভূতের ঈশ্বর, তবুও আমার অন্তরঙ্গা শক্তিকে আশ্রয় করে আমি আমার আদি চিন্ময় রূপে যুগে যুগে অবতীর্ণ হই।
এবং তারপরেই ভগবান তাঁর বহুল পঠিত, আলোচিত শ্লোক দুটি উচ্চারণ করলেন। যথাঃ যদা যদা হি ধর্মস্য..(ভঃগীঃ ৪/৭) এবং পরিত্রাণায় সাধূনাং..(ভঃগীঃ ৪/৮)।
শ্রীকৃষ্ণের জন্ম যে সাধারণ মানুষের মতো নয়; তার অচিন্ত্য এবং দিব্য তার প্রমাণ তিনি তার পরের শ্লোকেই দিয়েছেন।
জন্ম কর্ম চ মে দিব্যমেবং যো বেত্তি তত্ত্বতঃ ।
ত্যক্ত্বা দেহং পুনর্জন্ম নৈতি মামেতি সোহর্জুন ।।
ভঃগীঃ ৪/৯
অর্থ:- হে অর্জুন ! যিনি আমার এই প্রকার দিব্য জন্ম ও কর্ম যথাযথভাবে জানেন, তাঁকে আর দেহত্যাগ করার পর পুনরায় জন্মগ্রহণ করতে হয় না, তিনি আমার নিত্য ধাম লাভ করেন।
[একটা মজার বিষয় হলো, পাখণ্ড’রা ভগবদ্গীতার এই শ্লোকগুলিকেও স্বীকার করে না। ’প্রক্ষিপ্ত’ অথবা ‘বেদ বিরোধীব’ দাবি করে পশ্চাৎগমন করে।]
অন্যভাবে এও বলা যায় যে বৈদিক শাস্ত্রে জীবাত্মাকেও অজ (অজো নিত্যঃ শাশ্বতোহয়ং পুরাণো, ভঃগীঃ ২/২০) বলা হচ্ছে। তথাপি জীবের জন্ম-মৃত্যু হয়। তবে জীবের এবং পরমাত্মার জন্ম-মৃত্যুর মধ্যে পার্থক্যও আছে।
বহূনি মে ব্যতীতানি জন্মানি তব চার্জুন ।
তান্যহং বেদ সর্বাণি ন ত্বং বেত্থ পরন্তপ ।।
ভঃগীঃ ৪/৫
অনুবাদঃ হে পরন্তপ অর্জুন ! আমার ও তোমার বহু জন্ম অতীত হয়েছে ৷ আমি সেই সমস্ত জন্মের কথা স্মরণ করতে পারি, কিন্তু তুমি পার না।
তাই পরমেশ্বরকে জড় চক্ষু দ্বারা দেখা যায় না বলে তাঁকে অশরীরী, অকায়ম্ যেমন বলা হয় তেমনি তার রূপ, তনু ইত্যাদির কথাও কিন্তু বৈদিক শাস্ত্রে আছে।
যমেবৈষ বৃণুতে তেন লভ্যঃ ।
তস্য এষ আত্মা বিবৃণুতে তনূং স্বাম্ ।।
কঠ উঃ ১/২/২৩
অনুবাদঃ ইনি(পরমেশ্বর) যাকে স্বীকার করেছেন তার কাছেই তাঁর প্রকৃত স্বরূপ প্রকটিত করেন।
হিরণ্ময়েন পাত্রেণ সত্যস্যাপিহিতং মুখম্।
তৎ ত্বং পূষন্নপাবৃণু সত্যধর্মায় দৃষ্টয়ে॥
– (ঈশোপনিষদ মন্ত্র ১৫)
“হে ভগবান, হে সর্বজীব পালক, আপনার উজ্জ্বল জ্যোতির দ্বারা আপনার প্রকৃত মুখারবিন্দ আচ্ছাদিত। কৃপা করে সেই আচ্ছাদন দূর করুন এবং আপনার শুদ্ধ ভক্তের নিকট নিজেকে প্রদর্শন করুন।”
তদ্ দিব্যমচিন্ত্যরূপম্
-(মুণ্ডকোপনিষদ্ ৩/১/৭)
“তাঁর(পরমব্রহ্মের) সেই রূপ দিব্য, অচিন্তনীয়”
যৎ তে রূপং কল্যাণতমং তৎ তে পশ্যামি
যোহসাবসৌ পুরুষঃ সোহহমস্মি॥
– (ঈশোপনিষদ মন্ত্র ১৬)
“কৃপা করে আপনার অপ্রাকৃত রশ্মির জ্যোতি অপসারণ করুন যাতে আপনার আনন্দময় রূপ আমি দর্শন করতে পারি। আপনি সনাতন পুরুষোত্তম ভগবান।”
কেনোপনিষদে পরব্রহ্ম দেবতাদের মিথ্যা অভিমান চূর্ণ করার জন্য তাদের সামনে যক্ষরূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন।
তদ্ধৈষাং বিজজ্ঞৌ তেভ্যো হ প্রাদুর্বভূব তন্ন ব্যজানত কিমিদং যক্ষমিতি।।
কেনোপনিষদ্ঃ ৩/২
সেই পরব্রহ্ম (দেবতাদের যুদ্ধজয়ের মিথ্যা অভিমান সম্পর্কে) এই বিষয়ে অবগত হয়ে তাঁদের(অগ্নি, বায়ু, ইন্দ্র আদি দেবতা) সামনে যক্ষরূপে আবির্ভূত হলেন।
ত্রীণি পদা বি চক্রমে বিষ্ণু র্গোপা অদাভ্যাঃ।
অতো ধর্মাণি ধারয়ন্॥
– (ঋগ্বেদ ১/ ২২/১৮)
“বিষ্ণু রক্ষক, তাঁকে কেহ আঘাত করতে পারে না, তিনি ধর্ম সমুদয় ধারণ করে তিন পদ পরিক্রমা করেছিলেন।”
সর্বতঃ পাণিপাদন্তৎ সর্বতোহক্ষিশিরোমুখম্।
সর্বতঃ শ্রুতিমল্লোকে সর্বমাবৃত্য তিষ্ঠতি।।
-শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ ৩/১৬,শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ১৩/১৪
অনুবাদঃ তাঁর (ঈশ্বর) হস্ত, পদ, চক্ষু, মস্তক ও মুখ সর্বত্রই এবং তিনি সর্বত্রই কর্ণযুক্ত। জগতে সব কিছুকেই পরিব্যাপ্ত করে তিনি বিরাজমান।
পরমেশ্বর সাকার নাকি নিরাকার এই আলোচনা এখানে করে এই লেখাকে দীর্ঘায়িত করতে চাই না। তবে এই সংক্রান্ত আমাদের অন্যান্য লেখাগুলো পড়তে পারেন।
যদিও শ্রীকৃষ্ণকে যাঁরা পরমেশ্বর হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছেন(বাসুদেব সর্বমিতি স মহাত্মা সুদুর্লভ। ভঃগীঃ ৭/১৯) তাঁরা ইতিমধ্যেই সমস্ত বেদান্তের সার জেনে গিয়েছেন কেননা শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং বলেছেন –
বেদৈশ্চ সর্বৈরহমেব বেদ্যো
বেদান্তকৃদ্ বেদবিদেব চাহম্ ॥
ভঃগীঃ ১৫/১৫
অনুবাদ : আমিই সমস্ত বেদের জ্ঞাতব্য এবং আমিই বেদান্তকর্তা ও বেদবিৎ।
অতএব পরমেশ্বরের সাকার রূপ যে শাস্ত্রসম্মত তার প্রমাণ দেওয়া হলো এবং শ্রীকৃষ্ণ অজো হয়েও কিভাবে জন্মগ্রহণ করতে পারেন তা প্রমাণিত হল।
————————————————————————————————————————-
২য় দাবিঃ
পাখণ্ডীদের ২য় দাবি “শ্রীকৃষ্ণকে ভগবদ্গীতার ৯/৫, ১১/৮-৯; ১৮/৭৮ এছাড়াও আরও কয়েকটি শ্লোকে তাঁকে যোগেশ্বর অর্থাৎ যোগযুক্ত ঈশ্বর বলা হয়েছে”।
খণ্ডণঃ
ত এর উত্তরে আমরা প্রথমেই বিশ্ব প্রামাণিক আচার্যরা “যোগেশ্বর” শব্দের কি অর্থ করেছেন তা দেখে নিব।
শ্রীল এ.সি.ভক্তিবেদান্ত স্বামী – সমস্ত যোগ শক্তির ঈশ্বর
শ্রীমধ্বাচার্য – সর্বযজ্ঞভাগহারিত্বাৎ(সমস্ত যজ্ঞভাগ হরণকারী অথবা অধিকারী)~গীতা ১১/৯
শ্রীরামানুজাচার্য – সর্বেষাম যোগানাম্ ঈশ্বর(সমস্ত যোগ সমূহের ঈশ্বর)~গীতা ১৮/৭৮
শ্রীশঙ্করাচার্য – সর্ব যোগানাম্ ঈশ্বর(সকল যোগের ঈশ্বর)~গীতা ১৮/৭৮
এখন আমরা দেখবো শ্রীকৃষ্ণকে কেন যোগেশ্বর বলা যৌক্তিক।
শ্রীকৃষ্ণ সমস্ত যোগ শক্তির অধীশ্বরঃ
যেহেতু পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অণিমা-মহিমাদি অষ্টসিদ্ধি ও সমস্ত শক্তির প্রবর্তক –
♦মত্তঃ সর্বং প্রবর্ততে; গীতা ১০/৮
~ আমার থেকেই সমস্ত কিছু প্রবর্তিত হয়েছে
তাই শ্রীকৃষ্ণই সমস্ত যোগ শক্তির অধীশ্বর অর্থাৎ যোগেশ্বর।
যেমন শ্রীমদ্ভাগবতের বহু জায়গায় শ্রীকৃষ্ণকে ‘যোগেশ্বর’(১০/১৪/২১, ১/৮/১৪, ১/৮/৪৩), ‘যোগাধীশ’(১০/১৯/১২), ‘যোগবীর্যং’(১০/১৯/১৪) সম্বোধন করা হয়েছে।
—————————————————————————————————————————
শ্রীকৃষ্ণই সকল জীবের হৃদ্যন্তস্থ পরমাত্মাঃ
যারা অণিমা, মহিমা আদি বিভিন্ন যোগশক্তি লাভের আশায় যম, নিয়ম প্রাণায়াম আদি অষ্টাঙ্গ যোগ অনুশীলন করেন তাঁদেরও অন্তিম লক্ষ্য বিষয়ে উপদেশ প্রদান করে শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন–
♦যোগীনামাপি সর্বেষাম মদ্গতেন অন্তরাত্মনা
গীতা ৬/৪৭
~যোগীদের মধ্যে যিনি সর্বশ্রেষ্ঠ তিনি অত্যন্ত শ্রদ্ধা সহকারে আমার(শ্রীকৃষ্ণের) ভজনা করেন।
♦সর্বস্য চাহং হৃদি সন্নিবিষ্টো
গীতা ১৫/১৫
আমি(শ্রীকৃষ্ণ) সকলের হৃদয়ে অবস্থান করি।
তাই সেইসব যোগীদের তথা সকল জীবের হৃদয়ে অবস্থিত অন্তরাত্মা শ্রীকৃষ্ণই।
——————————————————————————————————————————
শ্রীকৃষ্ণের চেয়ে উত্তম যোগী কেউ নেইঃ
যেহেতু পরম পুরুষ শ্রীকৃষ্ণ এই জগতে ধর্ম সংস্থাপনের জন্য যুগে যুগে অবতরণ করেন তাই তিনি লোকশিক্ষার জন্য (যদ্ যদাচরতি শ্রেষ্ঠ, গীতাঃ৩/২১) বহুবিধ যাগ-যজ্ঞ, তপস্যা, বিদ্যানুশীলন, গুরুগ্রহণ ও নানা সামাজিক অনুষ্ঠান করেন। এবং যেহেতু তাঁর আরেক নাম অসমোর্ধ তাই তিনি যে আচরণই করেন না কেন তা নিঃসন্দেহে শ্রেষ্ঠ।
তাই তিনি শ্রেষ্ঠ শিক্ষক, শ্রেষ্ঠ বন্ধু, শ্রেষ্ঠ সন্তান, শ্রেষ্ঠ শিষ্য এবং শ্রেষ্ঠ যোগীও।
কৃষ্ণ কৃষ্ণ মহাযোগিন্ বিশ্বাত্মন্ বিশ্বভাবন।
প্রপন্নাং পাহি গোবিন্দ শিশুভিশ্চাবসীদতীম্ ৷৷
শ্রীমদ্ভাগবত ১০।৪৯।১১
অনুবাদঃ কৃষ্ণ, কৃষ্ণ। হে পরম যোগী! হে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের পরমাত্মা ও রক্ষক। হে গোবিন্দ! দয়া করে আপনার শরণাগত আমাকে রক্ষা করুন।
সর্বং নরবরশ্রেষ্ঠৌ সর্ববিদ্যাপ্রবর্তকৌ।
সকৃন্নিগদমাত্রেণ তৌ সঞ্জগৃহতুনূপ ॥
শ্রীমদ্ভাগবত ১০।৪৫।৩৫
অনুবাদঃ হে রাজন, সেই পুরুষ শ্রেষ্ঠ কৃষ্ণ ও বলরাম, তাঁরা স্বয়ং সকল প্রকার জ্ঞানের আদি উদ্দ্গাতা হওয়ায় প্রতিটি বিষয়ের ব্যাখ্যা একবার মাত্র শ্রবণ করেই তৎক্ষণাৎ সেই বিষয়সমূহ আয়ত্ত করছিলেন।
নমঃ কৃষ্ণায় শুদ্ধায় ব্রহ্মণে পরমাত্মনে ।
যোগেশ্বরায় যোগায় ত্বামহং শরণং গতা ॥
শ্রীমদ্ভাগবত ১০।৪৯।১৩
অনুবাদঃ পরম শুদ্ধ, পরম ব্রহ্ম ও পরমাত্মা, যোগেশ্বর ও সকল জ্ঞানের উৎস স্বরূপ হে কৃষ্ণ, আমি আপনাকে প্রণাম নিবেদন করি। আপনার কাছে আশ্রয়ের জন্য আমি উপস্থিত হয়েছি
——————————————————————————————————————————
তবে যেহেতু তাঁর থেকে শ্রেষ্ঠ আর কোন বস্তু নেই এবং সাধারণ জীবের মতো তাঁর অন্তরে অন্য কোন পরমাত্মা নেই তাই তিনি নিজেরই ধ্যান করেন।
(বসুদেব কর্তৃক শ্রীকৃষ্ণের স্তব)
অনাবৃতত্বাদ বহিরন্তরং ন তে
সর্বস্য সর্বাত্মন আত্মবস্তুনঃ।।
শ্রীমদ্ভাগবতঃ ১০/৩/১৭
অনুবাদঃ আপনি বাহ্য ও অন্তরশূন্য। আপনি কখনও দেবকীর গর্ভে প্রবেশ করেননি; পক্ষান্তরে, আপনি পূর্বেই সেখানে বিদ্যমান ছিলেন।
দেহদেহিবিভাগােহয়ং নেশ্বরে বিদ্যতে ক্বচিৎ
কূৰ্ম্মপুরাণ ৫/৩/৪২
অনুবাদঃ পরমেশ্বরের দেহ ও দেহী(আত্মা) তে কখনও কোন পার্থক্য নেই। অর্থাৎ, তাঁর দেহ জড় নয়। দেহ ও আত্মা উভয়ই জড়াতীত বিশুদ্ধ চিন্ময় তত্ত্ব(সচ্চিদানন্দ)।
——————————————————————————————————————————
শ্রীকৃষ্ণই যোগেশ্বরেশ্বরঃ
অনেক সময় সিদ্ধ যোগী (কর্দম মুনি, শুকদেব গোস্বামী) বা পরমেশ্বর ভগবানের শক্ত্যাবেশ অবতার (নারদ, ব্যসদেব, পরশুরাম) অথবা ভগবানের শুদ্ধভক্ত (যাঁরা ইতিমধ্যেই ব্রহ্মভূত স্তর প্রাপ্ত হয়েছেন) তাঁদের ক্ষেত্রেও (ভক্তিযোগেন, সেবতে…..ব্রহ্মভূয়ায়, কল্পতে; গীতাঃ১৪/২৬) “যোগেশ্বর” সম্বোধন ব্যবহৃত হয়। কারণ তাঁরা বিশেষ কার্যসিদ্ধির জন্য পরমেশ্বরের দ্বারা কৃপাপ্রাপ্ত।
তাই তাঁরাও পরমেশ্বরের অনন্ত যোগশক্তির ক্ষীয়োদংশ প্রতিফলিত করেন। যেমন শ্রীমদ্ভাগবতের তৃতীয় স্কন্ধে বর্ণিত আছে যে, কর্দম মুনি নিজেকে নয়টি রূপে বিভক্ত করেছিলেন।
আবার কখনও শিব, ব্রহ্মা আদি মহান দেবতাদেরকেও মহান যোগী, পরম যোগী, যোগেশ্বর বলা হয়। কেননা তাঁরাও নিরন্তর শ্রীহরির ধ্যানে মগ্ন(যোগ যুক্ত) থাকেন।
কপর্দ্দী জটীলো মুণ্ডঃ শ্মশানগৃহসেবকঃ॥
উগ্রব্রতধরো রুদ্রো যোগী পরমদারুণঃ।
দক্ষক্রতুহরশ্চৈব ভগনেত্রহরস্তথা॥
নারায়ণাত্মকো জ্ঞেয়ঃ পাণ্ডবেয় যুগে যুগে॥
মহাভারত, শান্তিপর্ব ৩২৭।১৮-২১
অনুবাদ: যিনি বিশাল জটাজুটযুক্ত, শ্মশানবাসী, কঠোরব্রতপরায়ণ, পরমযোগী রুদ্র যিনি দক্ষযজ্ঞ নাশ করেছিলেন, ভগের চোখ উৎপাটন করেছিলেন তিনি নারায়ণের অংশস্বরূপ।
দিষ্ট্যা জনার্দন ভবানিহ নঃ প্রতীতো
যোগেশ্বরৈরপি দুরাপগতিঃ সুরেশৈঃ।
শ্রীমদ্ভাগবত ১০/৪৮/২৭
অনুবাদঃ হে জনার্দন, আমাদের মহা সৌভাগ্যের দ্বারা এখন আপনি আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়েছেন, কারণ যোগেশ্বরগণ এবং দেবেন্দ্রগণও অতি কষ্টের দ্বারা কেবল এই লক্ষ্য অর্জন করতে পারেন।
তাই পরমেশ্বর ভগবান এই সমস্ত যোগেশ্বরগণেরও ঈশ্বর। যেমনটা বলা হচ্ছে শ্রীমদ্ভাগবতমে—
ন চৈবং বিস্ময়ঃ কার্যো ভবতা ভগবত্যজে।
যোগেশ্বরেশ্বরে কৃষ্ণে যত এতদ্বিমুচ্যতে ॥
শ্রীমদ্ভাগবত ১০/২৯/১৬
অনুবাদঃ জন্মরহিত যোগেশ্বরেশ্বর পরম পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সম্বন্ধে তোমার বিস্মিত হওয়া উচিত নয়। শেষ পর্যন্ত এই ভগবানই জগতকে মুক্তি প্রদান করেন।
বীক্ষ্য তান্ বৈ তথাভূতান্ কৃষ্ণো যোগেশ্বরেশ্বরঃ।
ঈক্ষয়ামৃতবর্ষিণ্যা স্বনাথান্ সমজীবয়ৎ ॥
শ্রীমদ্ভাগবত ১০/১৫/৫০
অনুবাদঃ সেই যোগেশ্বরগণেরও ঈশ্বর শ্রীকৃষ্ণ সেই সমস্ত ভক্তদের প্রতি অনুকম্পা অনুভব করেছিলেন। এভাবেই তিনি তাঁদের প্রতি তাঁর অমৃতবৎ কৃপাদৃষ্টি বর্ষণের দ্বারা তৎক্ষণাৎ তাঁদের পুনর্জীবিত করেছিলেন।
নাসাং দ্বিজাতিসংস্কারো ন নিবাসো গুরাবপি।
ন তপো নাত্মমীমাংসা ন শৌচং ন ক্রিয়াঃ শুভাঃ ।
তথাপি হু্যত্তমঃশ্লোকে কৃষ্ণে যোগেশ্বরেশ্বরে।
ভক্তির্দৃঢ়া ন চাম্মাকং সংস্কারাদিমতামপি ॥
শ্রীমদ্ভাগবত ১০/২৩/৪৩-৪৪
অনুবাদঃ এই নারীগণের কখনও উপনয়নাদি সংস্কার হয়নি, তারা ব্রহ্মচারীরূপে গুরুর আশ্রমে বাস করেনি, তারা কোনও তপশ্চর্যার অনুষ্ঠান করেনি, তারা আত্মার বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে বিচার-বিশ্লেষণ করেনি, শৌচাচার অথবা পুণ্য ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানেও যুক্ত নয়, তবুও উত্তমশ্লোক ও যোগেশ্বরেরও ঈশ্বর শ্রীকৃষ্ণের প্রতি তাদের দৃঢ় ভক্তি রয়েছে। পক্ষান্তরে, এই সমস্ত প্রক্রিয়ার অনুষ্ঠান করেও ভগবানের প্রতি আমাদের এরূপ ভক্তি নেই।
যুধিষ্ঠির উবাচ
কিং ন আচরিতং শ্রেয়ো ন বেদাহমধীশ্বর।
যোগেশ্বরাণাং দুর্দর্শো যন্নো দৃষ্টঃ কুমেধসাম্ ॥
শ্রীমদ্ভাগবত: ১০/৫৮/১১
অনুবাদঃ রাজা যুধিষ্ঠির বললেন-হে অধীশ্বর, আমি জানি না, আমরা মূর্খেরা কোন্ পুণ্যকর্ম করেছি যার ফলে যোগেশ্বরগণেরও দুর্লভদর্শন আপনাকে আমরা দর্শন করতে পারছি।
নৃগ রাজার প্রার্থনা
সত্বং কথং মম বিভোেহক্ষিপথঃ পরাত্মা
যোগেশ্বরৌঃ শ্রুতিদৃশামলহৃদ্বিভাব্যঃ ।
সাক্ষাদধোক্ষজ উরুব্যসনান্ধবুদ্ধেঃ
স্যান্মেহনুদৃশ্য ইহ যস্য ভবাপবর্গঃ ৷৷
শ্রীমদ্ভাগবত: ১০/৬৪/২৬
অনুবাদঃ হে সর্বশক্তিমান, এখানে আমার সামনে আমার দু’নয়ন আপনাকে দর্শন করছে, এটা কিভাবে সম্ভব হল? আপনি পরমাত্মা, যাকে মহা-যোগেশ্বরগণ তাঁদের শুদ্ধ-অন্তরে কেবলমাত্র চিন্ময় বেদনয়নের মাধ্যমেই ধ্যান করেন। তা হলে, হে অধোক্ষজ, জাগতিক জীবনের দুঃসহ দুর্বিপাকে আমার বুদ্ধি অক্ষম হয়ে পড়লেও কিভাবে আপনি প্রত্যক্ষরূপে আমার দৃষ্টি গোচর হলেন? যিনি এই পৃথিবীতে তাঁর জড় জাগতিক বন্ধন ছিন্ন করেছেন, কেবলমাত্র তিনিই তো আপনাকে দর্শনে সমর্থ হন।
অতএব শ্রীকৃষ্ণ যুগপৎভাবে যোগেশ্বর এবং যোগেশ্বরেশ্বর।
——————————————————————————————————————————
৩য় দাবিঃ
পূর্বপক্ষের দাবি “ভগবদ্গীতার ১৮/৬২ নং শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ নিজে অর্জুনকে পরমাত্মার শরণ গ্রহণ কথা বলেছেন। যেহেতু তিনি উক্ত শ্লোকে অর্জুনকে পরমাত্মার শরণ গ্রহণ করার কথা বলেছেন অতএব তিনি পরমাত্মা বা পরমেশ্বর নন।”
খণ্ডণঃ
প্রথমেই শ্লোকটি অনুবাদসহ দেখে নেয়া যাক।
তমেব শরণং গচ্ছ সর্বভাবেন ভারত ।
তৎপ্রসাদাৎ পরাং শান্তিং স্থানং প্রাপ্স্যসি শাশ্বতম্ ॥
গীতা ১৮/৬২
অনুবাদঃ ‘হে ভারত! সর্বোতভাবে তাঁর শরণাগত হও। তাঁর প্রসাদে তুমি পরা শান্তি এবং নিত্য ধাম প্রাপ্ত হবে।’
স্বাভাবিকভাবেই মনে প্রশ্ন জাগে “ভগবদগীতায় শ্রীকৃষ্ণ এখানে অর্জুনকে কার শরণাগত হওয়ার কথা বলছেন?”
উপরিউক্ত শ্লোকের ঠিক আগের অর্থাৎ ১৮/৬১ শ্লোক যদি দেখি—
ঈশ্বরঃ সর্বভূতানাং হৃদ্দেশেহর্জুন তিষ্ঠতি ।
ভ্রাময়ন্ সর্বভূতানি যন্ত্রারূঢ়ানি মায়য়া ॥৬১॥
“হে অর্জুন! পরমেশ্বর ভগবান সমস্ত জীবের হৃদয়ে অবস্থান করছেন।”
এবং এর পরের শ্লোক অর্থাৎ ১৮/৬২ এ শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে নিশ্চয়ই সেই পরমেশ্বরের শরণ গ্রহণ করার কথা বলেছেন যিনি সকলের হৃদয়ে বিরাজ করছেন। তাই নয় কি?
এখন প্রশ্ন আসতে পারে, তবে তো শ্রীকৃষ্ণ পরমেশ্বর নন, যদি হতেন তবে তিনি কেন অর্জুনকে
—>”আমার(কৃষ্ণের) শরণাগত হও”<—
না বলে পরমেশ্বরের শরণ গ্রহণ করার কথা বলেছেন?
এবার একটু পিছনে তাকানো যাক। আমরা শ্রীমদ্ভগবদগীতার ১৫/১৫ শ্লোকটি যদি দেখি, সেখানে বলা আছে —
সর্বস্য চাহং হৃদি সন্নিবিষ্টো
“আমি সমস্ত জীবের হৃদয়ে অবস্থিত”।
এবার চিন্তা করে দেখুন তো ১৮/৬১ এবং ১৮/৬২ নং শ্লোক যদি শ্রীকৃষ্ণ বলে থাকেন নিশ্চয়ই এই শ্লোকটিও তিনিই বলেছেন।
অতএব শ্রীকৃষ্ণ আগেই পঞ্চদশ অধ্যায়ে বলে গেলেন যে “আমিই সমস্ত জীবের হৃদয়ে বিরাজ করি”। আর পরবর্তীতে অষ্টাদশ অধ্যায়ের ৬১,৬২ নং শ্লোকে বললেন “হে অর্জুন! তুমি সকলের হৃদয়ে বিরাজমান পরমেশ্বরের শরণ গ্রহণ কর”।
আবার শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং একটু পরেই অর্থাৎ ১৮/৬৬ শ্লোকে বলছেন
সর্বধর্মান্ পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ ।
“সকল প্রকার ধর্ম পরিত্যাগ করে কেবল আমার শরণ গ্রহণ করো।”
কি, দ্বন্ধ লাগছে?
একবার বলছেন “আমার শরণ গ্রহণ করো” অন্যত্র বলছেন “তাঁর(পরমেশ্বর) শরণ গ্রহণ করো”। এরকম দ্বৈততা কেন?
ভগবদগীতার ১৫/১৫ অনুযায়ী এবং ১৮/৬১ শ্লোক অনুযায়ী দুজনই যেহেতু একই ব্যক্তি অতএব শ্রীকৃষ্ণই হচ্ছেন পরমেশ্বর। অতঃপর তাঁর এই দ্বৈত উক্তিতে আমাদের আর সন্দেহ থাকার কথা নয়। কারণ পরমেশ্বর যে একইসাথে এক এবং সর্বব্যাপক(পরমাত্মা) রূপে নিজেকে প্রকাশ করতে পারেন তা বৈদিক শাস্ত্র থেকে আমরা জানতে পারি।
একো বহূনাং যো বিদধাতি কামান্ ।।
(কঠ উপঃ ২/২/১৩, শ্বেতাশ্বতর উপঃ ৬/১৩)
” যিনি এক হইয়াও বহু জীবের কাম সকল বিধান করিয়া থাকেন”।
বায়ুর্যথৈকো ভুবনং প্রবিষ্টো রূপং রূপং প্রতিরূপো বভূব।
একস্তথা সর্বভূতান্তরাত্মা রূপং রূপং প্রতিরূপো বহিশ্চ ॥
– কঠোপনিষদ ২/২/১০
“সর্বভূতের একই অন্তরাত্মা নানা বস্তুভেদে তদ্বস্তুরূপ হইয়াছেন এবং সকল প্রাণীর বাহিরেও অবস্থান করেন।”
যদেবেহ তদমুত্র যদমুত্র তদন্বিহ
– কঠোপনিষদ ২/১/১০
(যৎ)যে পরব্রহ্ম (ইহ)এখানে[জড় জগতে] আছেন, (তৎ এব অমুত্র)তিনিই ওখানে[পরলোকে] আছেন। (যৎ অমুত্র)যিনি ওখানে আছেন, (তৎ অনু ইহ)তিনি এখানেও আছেন।
আসীনো দূরং ব্রজতি শয়ানো যাতি সর্বতঃ
– কঠোপনিষদ ১/২/২১
সেই পরমেশ্বর বসে থেকেই দূরে চলে যান, আবার শুয়ে থেকেই সর্বত্র চলাফেরা করেন।
‘তদন্তরস্য সর্বস্য তদু সর্বাস্যাস্য বাহ্যতঃ
(ঈশোপনিষদ ৫)
তিনি সকল বস্তুর ভিতরে বিরাজ করেন, তিনি সকল বস্তুর বাহিরেও অবস্থান করেন।
যো যোনিং যোনিমধিতিষ্ঠত্যেকো
বিশ্বানি রূপাণি যোনীশ্চ সর্বাঃ।
ঋষিং প্রসূতং কপিলং যস্তমগ্রে
জ্ঞানৈর্বিভর্ত্তি জায়মানঞ্চ পশ্যেৎ।।
(শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ ৫/২)
অনুবাদ:- যিনি এক হয়েও প্রত্যেক বস্তুর ও সমষ্টিভূত বিশ্বরূপের উৎপত্তিস্থানে অন্তর্যামী রূপে অবস্থান করেন, যিনি কল্পের আদিতে সৃষ্ট হিরন্যগর্ভ ব্রহ্মাকে জ্ঞানের দ্বারা পুষ্ট করেছিলেন ও পরে তার জায়মান দশায় কৃপাকটাক্ষ করেছিলেন, তিনি জীব হতে ভিন্ন পুরুষ, অর্থাৎ পরমেশ্বর।
বৃহচ্চ তদ্ দিব্যমচিন্ত্যরূপং সূক্ষ্মাচ্চ তৎ সূক্ষ্মতরং বিভাতি।
দূরাৎ সুদূরে তদিহান্তিকে চ পশ্যৎস্বিহৈব নিহিতং গুহায়াম্।।
-(মুণ্ডকোপনিষদ্ ৩/১/৭)
ওই পরব্রহ্ম মহান, দিব্য ও অচিন্ত্যরূপসমন্বিত। তিনি সূক্ষ্ম থেকেও অধিক সূক্ষ্মরূপে প্রকাশিত হন, দূর থেকেও অত্যন্ত দূরে; এই (শরীরের) থেকেও অতি নিকটে এইসকল দ্রষ্টাদের মধ্যে, তাঁদের ঋদয়রূপ গুহায় বাস করেন।
——————————————————————————————————————————
পরমেশ্বরের একইসাথে এক এবং বহুভাবে নিজেকে বিস্তারের যে অচিন্ত্য তত্ত্ব তা আমাদের বোধগম্য হওয়া যদিও কঠিন তবুও শাস্ত্রে কিছু উদাহরণ এর মাধ্যমে আমাদের সেই অচিন্ত্য শক্তির কিঞ্চিত ধারণা দেওয়া হয়েছে।
একদেশস্থিতস্যাগ্নের্জ্যোৎস্না বিস্তারিণী যথা ।
পরস্য ব্রহ্মণঃ শক্তিস্তথেদমখিলং জগৎ ।।
(বিষ্ণু পুরাণ ১/২২/৫৩)
অনুবাদ: একই স্থানে অবস্থিত অগ্নির প্রভা বা আলোক যেমন সর্বত্র ব্যাপ্ত হয়, সেই রকম পরব্রহ্মের শক্তি অখিল জগৎ জুড়ে ব্যাপ্ত হয়ে আছে।
দীপার্চিরেব হি দশান্তরমভ্যুপেত্য
দীপায়তে বিবৃতহেতুসমানধর্মা ।
(ব্রহ্মসংহিতা ৫/৪৬)
অনুবাদ: এক মূল প্রদীপের জ্যোতি অন্য বর্তি বা বাতিগত হয়ে বিবৃত (বিস্তার) হেতু সমান ধর্মের সঙ্গে পৃথক প্রজ্জ্বলিত হয়।
——————————————————————————————————————————
এই তত্ত্বটি আরও স্পষ্ট হয় শ্রীমদ্ভাগবতে, যেখানে কুন্তিদেবী মহারাজ পরীক্ষিতের প্রাণরক্ষার জন্য কৃষ্ণের কাছে প্রার্থনা করছিলেন—
অন্তঃস্থঃ সর্বভূতানামাত্মা যোগেশ্বরো হরিঃ।
স্বমায়য়াবৃণোদ্গর্ভং বৈরাট্যাঃ কুরুতন্তবে ৷।
শ্রীমদ্ভাগবতঃ ১/৮/১৪
অনুবাদঃ পরম যোগ রহস্যের নিয়ন্তা যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ সর্ব জীবের হৃদয়ে পরমাত্মারূপে বিরাজ করেন। তাই কুরুবংশ রক্ষা করার জন্য তাঁর যোগমায়ার দ্বারা তিনি উত্তরার গর্ভ আবৃত করলেন।
——————————————————————————————————————————
কেবল মূর্খদরাই দাবি করে যে “শ্রীকৃষ্ণের অন্তরস্থ পরমেশ্বর ভগবদ্গীতার জ্ঞান প্রদান করেছিলেন”। এই দাবি একেবারেই মিথ্যা কেননা শ্রীকৃষ্ণই স্বয়ং পরমব্রহ্ম, পরমাত্মা। তাঁর অন্তর বাহির বলে কিছুই নেই।
(বসুদেব কর্তৃক শ্রীকৃষ্ণের স্তব)
অনাবৃতত্বাদ বহিরন্তরং ন তে
সর্বস্য সর্বাত্মন আত্মবস্তুনঃ।।
শ্রীমদ্ভাগবতঃ ১০/৩/১৭
অনুবাদঃ আপনি বাহ্য ও অন্তরশূন্য। আপনি কখনও দেবকীর গর্ভে প্রবেশ করেননি; পক্ষান্তরে, আপনি পূর্বেই সেখানে বিদ্যমান ছিলেন।
অতএব এটা প্রমাণিত হলো পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণই বাহ্যিকভাবে অর্জুনের সামনে মূর্তিমান হয়ে ভগবদ্গীতার জ্ঞান প্রদান করেছিলেন এবং.১৮/৬২ নং শ্লোকে সর্বব্যাপী, হৃদিঅন্ত্যস্থ পরমাত্মারূপে তাঁরই শরণ গ্রহণ করার বলেছেন অর্জুনকে।
——————————————————————————————————————————
৪র্থ দাবিঃ শ্রীকৃষ্ণ; কুরুক্ষত্রের যুদ্ধের পর ভগবদ্গীতার জ্ঞান ভুলে গিয়েছিলেন। যার দরুণ যুদ্ধের পর অর্জুন যখন শ্রীকৃষ্ণকে আবার সেই জ্ঞান প্রদান করার কথা বলেছিলেন শ্রীকৃষ্ণ তখন বলেছিলেন যে, তখন তিনি যোগযুক্ত অবস্থায় ছিলেন। কিন্তু এখন তার সেই জ্ঞান মনে নেই।
খণ্ডণঃ
এস্থলে এই ঘটনার প্রেক্ষাপট উত্থাপন করছি –
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পর অর্জুন শ্রীকৃষ্ণের কাছে নিবেদন জানালেন যে যুদ্ধে আসক্ত হওয়ায় তিনি পূর্বে শ্রুত গীতার জ্ঞান বিস্মৃত হয়েছেন এবং তা পুনরায় শুনতে চান।
অনুবাদঃ মহাবাহু দেবকীপুত্র! যুদ্ধ উপস্থিত হইলে আপনার মাহাত্ম্য আমি জানিয়াছি। তদানীন্তন আপনার সেইরূপ-ঈশ্বরেরই রূপ ॥৫পুরুষশ্রেষ্ঠ কেশব! তুমি সৌহাদ্যবশতঃ পূর্ব্বে যে সকল কথা বলেছিলে, আমি যুদ্ধে আসক্তচিত্ত হওয়ায় সে সমস্তই আমার লুপ্ত হয়ে গিয়াছে(ভূলে গিয়েছি)। হে মাধব,সেই সকল বিষয় পুনরায় শ্রবণ করার জন্য আবার আমার কৌতুহল হচ্ছে,কেননা তুমি খুব শীঘ্রই দ্বারকায় গমন করবে।
-(মহাভারত,অশ্বমেধিক পর্ব ১৭/৫-৭)
এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয় যে শ্রীকৃষ্ণ কিন্তু অর্জুনের এই নিবেদনে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছিলেন।
অনুবাদঃ কৃষ্ণ বলিলেন- ‘পৃথানন্দন! আমি তোমাকে গোপনীয় বিষয় শুনিয়েছি এবং লক্ষণযুক্ত সনাতন ধর্ম ও শাশ্বত সমস্ত লোকের বিষয় জানিয়েছি। তুমি যে বৈমত্যবশতঃ সে সকল মনে রাখিতে পার নি, তা আমার খুব অপ্রিয় হইয়াছে(তাতে আমি খুব অসন্তুষ্ট হয়েছি)। এখন সেই স্মৃতি পুনরায় আমার হইবে না।
–(মহাভারত,অশ্বমেধিক পর্ব ১৭/৯-১২)
বিষয়টি লক্ষ্য করুন। মনে করুন আপনার কোন বন্ধুকে আপনি ক্লাসে একটি কঠিন গণিত বুঝিয়ে দিলেন। কিন্তু সে তা অন্যমনষ্ক হয়ে ভুলে গেল এবং একটু পরে এসেই তা আবার জিজ্ঞাসা করলো। তখন আপনি তাকে খানিকটা অভিমান নিয়ে বললেন “যা, এখন পারব না। এখন আমার মনে নেই বা সময় নেই ”।
ত শ্রীকৃষ্ণ এবং অর্জুনের মধ্যে যে বন্ধুসুলভ আচরণ ছিল তাতে গীতার জ্ঞান পুনরায় প্রদানের ক্ষেত্রেও এমনটা না হওইয়াটা অস্বাভাবিক নয়।
এবং শ্রীকৃষ্ণের এমন মনোভাবই প্রকাশ পেয়েছিল। যেমনঃ
পরং হি ব্রহ্ম কথিতং যোগযুক্তেনতন্ময়া।
ইতিহাসং তু বক্ষ্যামি তস্মিন্নর্থে পুরাতনম।।
-(মহাভারত,আশ্বমেধিক পর্ব-১৭/ ১৩)
অনুবাদঃ তৎকালে আমি যোগযুক্ত হইয়া(একাগ্রতার সহিত) পরব্রহ্মের বিষয় বলিয়াছিলাম, এখন সেই বিষয়ে প্রাচীন বৃত্তান্ত বলিতেছি॥
উল্লেখ্য যে, এখানে বিশ্ববাণী প্রকাশনীর ভারত কৌমুদী টীকায় অনুবাদক হরিসিদ্ধান্তবাগীশ “যোগযুক্তেন” শব্দটির অনুবাদ করেছেন “একাগ্রতার সহিত”। যথাঃ “যোগযুক্তেন ঐক্যাগ্রসমন্বিতেন”
এরপর অর্জুনের অনুরোধে সেই অষ্টাদশ অধ্যায়রুপী ভগবদগীতার হুবহু জ্ঞান প্রদান করার জন্য ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আশ্বমেধিক পর্ব, ১৭/১৪ থেকে ৬৬ অধ্যায়, অথাৎ মোট ৫৩ টি অধ্যায়ে এক প্রাচীন ইতিহাস আলোচনা করেন,যাকে মহাভারতে অনুগীতা বলা হয়।
মহাভারতের আশ্বমেধিক পর্ব ৬৬ অধ্যায়ের অনুগীতার আলোচনা সমাপ্ত হলে, ৬৭ তম অধ্যায়ে বর্ণনা করা হয়েছে,মহাভারতের উপদেশরুপ ইতিহাস অনুগীতা ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কাছ থেকে অর্জুন শ্রবণ করার করার পর অজুর্নের মনে কোন সন্দেহ ছিল না যে কৃষ্ণ পরমেশ্বর ভগবান নন।অথবা মূর্খদের মতো অর্জুন বলেন নি, শ্রীকৃষ্ণ একজন যোগী, তিনি যোগস্থ হয়ে গীতার জ্ঞান আমাকে প্রদান করছেন,কিন্তু তিনি ঈশ্বর নন।
বরং অর্জুনের ভাষায় শ্রীকৃষ্ণ হলেন পরমাত্মা পরমেশ্বর ভগবান,তিনিই ছিলেন পান্ডবদের বিজয়ের মূল কারন।অর্জুন বললেন-
ত্বংপ্রসাদাজ্জয়ঃ প্রাপ্তো রাজ্ঞা বৃষ্ণিকুলোদ্বহ।।
নিহতাঃ শত্রবশ্চাপি প্রাপ্তং রাজ্যমকণ্টকম্ ॥৬৷৷
নাথবন্তশ্চ ভবতা পান্ডবা মধুসূদন!
ভবন্তং প্লবমাসাদ্য তীর্ণাঃ স্ম কুরুসাগরম্ ॥৭॥
বিশ্বকৰ্ম্মন্! নমস্তেহস্তু বিশ্বাত্মন্! বিশ্বসত্তম।।
তথা স্বামভিজানামি যথা চাহং ভবান্ মতঃ ॥৮॥
ত্বত্তেজঃসম্ভবো নিত্যং হুতাশো মধুসূদন।।
রতিঃ ক্রীড়াময়ী তুভ্যং মায়া তে রোদসী বিভো! ॥৯৷৷
ত্বয়ি সর্বমিদং বিশ্বং যদিদং স্থাণু জঙ্গমম্।
ত্বং হি সর্বং বিকুরুষে ভূতগ্রামং চতুর্বিধম্ ॥১০॥
পৃথিবীং চান্তরিক্ষঞ্চ দ্যাঞ্চৈব মধুসুদন।।
হসিতং তেহমলা জ্যোৎস্না ঋতবশ্চেন্দ্রিয়াণি তে ॥১১৷
-(মহাভারত,আশ্বমেধিক পর্ব,৬৭/৬-১১)
অনুবাদঃ হে বৃষ্ণিবংশশ্রেষ্ঠ। রাজা যুধিষ্ঠির তোমারই অনুগ্রহে জয়লাভ করিয়াছেন, শত্রুগণকে সংহার করিয়াছেন এবং নিষ্কণ্টক রাজ্য পাইয়াছেন। হে মধুসূদন, একমাত্র তুমিই পাণ্ডবগণের প্রভু এবং পাণ্ডবেরা তোমাকেই নৌকারূপে পাইয়া কৌরবসমুদ্র পার হইয়াছেন। হে বিশ্বকৰ্ম্মন,হে সমগ্র বিশ্বের পরমাত্মা(বিশ্বাত্মন), হে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ, হে প্রভু মধুসুদন,তোমাকে নমস্কার। আমি মনে মনে তোমাকে যেরূপ ধারণা করি, কার্য্য দ্বারাও তোমাকে সেইরূপই জানিতেছি। অগ্নি সর্ব্বদাই তোমার তেজ হইতে উৎপন্ন হয় এবং রতি তোমারই ক্রীড়াস্বরূপা, আর স্বর্গ ও মর্ত্য তোমারই মায়া।হে দেবকীনন্দন,
তুমি সন্তুষ্ট হইয়া আমাকে যা যা কিছু বলিতেছ সে সমস্তই ‘আমি করিব, এবিষয়ে আমার কোন বিবেচনা নাই।
পরিশেষে, মহাভারতের অনুগীতা প্রদান প্রসঙে স্বয়ং অর্জুনের স্বীকারোক্তি-ই প্রমাণ করে যে শ্রীকৃষ্ণ ভগবদ্গীতার জ্ঞান ভুলতে পারেন না। কারণ তিনি ত্রিকালজ্ঞ। নাহলে কিভাবে তিনি সূর্যদেব বিবষ্বানকে সেই একই জ্ঞান প্রদান করেছিলেন কোটি কোটি বছর আগে?(ইমং বিবস্বতে যোগং প্রোক্তবানহমব্যয়ম্…গীতা ৪/১ -৩ )
————————————————————————————————————————-
শেষকথাঃ সকলের প্রতি তাই এই আহ্বান রইলো, সেই পরমাত্মা, পরমব্রহ্ম, যোগেশ্বর, যোগেশ্বরেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে তত্ত্বত জানার, যাঁকে জানলে সমস্ত কিছুকেই হৃদয়ঙ্গম করা যায়।
কস্মিন্ ভগবোবিজ্ঞাতে সর্বম্ ইদং বিজ্ঞাতং ভবতি
মুণ্ডক উপনিষদ(১/৩)
নমস্তে সর্বভাবায় ব্রহ্মণেহনন্তশক্তয়ে।
কৃষ্ণায় বাসুদেবায় যোগানাং পতয়ে নমঃ ॥
শ্রীমদ্ভাগবত ১০।৬৪।২৯
অনুবাদঃ বসুদেব পুত্র শ্রীকৃষ্ণ, আপনাকে আমি বারংবার আমার প্রণতি নিবেদন করি। আপনি সকল জীবের উৎস, পরম ব্রহ্ম, অনন্ত শক্তিরাশির অধিকারী, যোগের সকল পন্থার অধীশ্বর।
হরে কৃষ্ণ।
Views Today : 213
Total views : 118880
Who's Online : 0
Your IP Address : 216.73.216.136