এই জগতের একজনই স্রষ্টা,তার নাম শ্রীকৃষ্ণ।তিনিই বিষ্ণু রাম,বলরাম,নৃসিংহ আদি বহুরুপে নিজেকে প্রকাশ করেন। ভগবদ্গীতা ১০/৮ শ্লোকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেন,”আমিই সমস্ত জগতের স্রষ্টা। সব কিছু আমার থেকে সৃষ্টি হয়েছে”(“অহং সর্বস্য প্রভবো মত্তঃ সর্বং প্রবর্ততে।”)। অথর্ববেদের অন্তর্গত গোপালতাপনী উপনিষদ১/২১ মন্ত্রে বলা হয়েছে( “একো বশী সর্বগঃ কৃষ্ণ ঈড্যঃ”)সেই একমাত্র শ্রীকৃষ্ণই পরমেশ্বর ভগবান,তিনিই আরাধ্য।কৃষ্ণ যজুর্বেদের অন্তর্গত নারায়ন উপনিষদ ৪ নং মন্ত্রে বলা হয়েছে “ব্রহ্মন্যো দেবকীপুত্রঃ”দেবকীপুত্র শ্রীকৃষ্ণই পরমেশ্বর ভগবান। শ্রীমদ্ভাগবতের ১/৩/২৮ শ্লোকে বলা হয়েছে,”কৃষ্ণস্তু ভগবান স্বয়ং”শ্রীকৃষ্ণ হলেন স্বয়ং পরমেশ্বর।
এছাড়াও মহাভারত শাস্ত্রে শ্রীকৃষ্ণকে পরমেশ্বর ভগবান বলা হয়েছে, স্বয়ং চতুর্ভুজ বিষ্ণু বলা হয়েছে (“অনুগ্রহার্থং লোকানাং বিষ্ণুলোক নমস্কৃতঃ।বসুদেবাত্তু দেবক্যাং প্রাদুর্ভূতো মহাযশাঃ।।”-“ত্রিজগতের পূজনীয় মহাযশস্বী স্বয়ং বিষ্ণু লোকের প্রতি অনুগ্রহ করিবার জন্য বসুদেব-দেবকীতে আবির্ভূত হইয়া ছিলেন৷” -মহাভারত আদিপর্ব, ৫৮/১৩৮)।
সুতারাং বেদ বা শ্রুতি,অষ্টাদশ পুরান,মহাভারত,পঞ্চরাত্র ইত্যাদি অসংখ্য সনাতনী শাস্ত্র থেকে আমরা জানতে পারি, শ্রীকৃষ্ণ হলেন পরমেশ্বর ভগবান। আমার, আপনার সকলের সৃষ্টিকর্তা হলেন শ্রীকৃষ্ণ। তাই তিনি বৃন্দাবনের গোপীদেরও সৃষ্টির্কতা।তার কাছে স্ত্রী ও পুরুষ কোন বিভেদ নাই।কারন তিনি সকলের প্রভু। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ৪/১১ শ্লোকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেন-
যে যথা মাং প্রপদ্যন্তে তাংস্তথৈব ভজাম্যহম্।
মম বর্ত্মানুবর্তন্তে মনুষ্যাঃ পার্থ সর্বশঃ ।। ১১ ।।
-(গীতাঃ ৪/১১)
অনুবাদঃ যারা যেভাবে আমার কাছে আত্মসমর্পণ করে, আমি তাদের সেভাবেই পুরস্কৃত করে থাকি। হে পার্থ, সকলেই সর্বতোভাবে আমার পথ অনুসরণ করে।
বৃন্দাবনের গোপীরা শ্রীকৃষ্ণকে তাদের জগৎ পতি বা জগৎ স্বামীরুপে ভালোবাসতে বা আরাধনা করতে চেয়েছিল। শ্রীমদ্ভাগতের বর্ণনা অনুযায়ী, তারা কাত্যায়নী দেবীর (দুর্গাদেবী) পূজা করে তাঁর কাছে শ্রীকৃষ্ণকে তাদের পতিরুপে প্রাপ্ত হওয়ার জন্য পূজা এবং বিনীত প্রার্থনা নিবেদন করেছিলেন-
কাত্যায়নী মহামায়ে মহাযোগিন্যধীশ্বরী।
নন্দগোপসূতং দেবী পতিং মে কুরুতে নমঃ।
ইতি মন্ত্রং জপন্ত্যস্ত্যঃ পূজাং চত্রুুঃ কুমারিকাঃ।।
-(শ্রীমদ্ভাগবতঃ ১০/২২/৪)
অনুবাদ – হে কাত্যায়নী, মহামায়া, মহাযোগীগণের অধীশ্বরী, আমি আপনার শ্রীচরণকমলে প্রণতি নিবেদন করি। এবং এ প্রার্থনা করি যে,নন্দগোপসূতকে (শ্ৰীকৃষ্ণ)-যেন আমি পতি রূপে ( স্বামী) লাভ করতে পারি, এই বর প্রদান করুন। এই মন্ত্র জপ করতে করতে কুমারী কন্যাগন প্রত্যেকে তাঁর( কাত্যায়নীর দেবী) পূজা করেছিলেন।
শ্রীকৃষ্ণ তাদের এই প্রীতিপূর্ণ ভাবকে শ্রীমদ্ভাগবতের দশম স্কন্দে বর্ণিত রাসনৃত্য আয়োজনের মাধ্যমে স্বীকার করেছিলেন।শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা অনুসারে,যদিও ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অসংখ্য বৃন্দাবনের গৃহ বধুদের সাথে নৃত্য করেছিলেন, তথাপি তিনি সম্পূর্নরুপে কাম বা যৌন কামনা বাসনা থেকে মুক্ত( গীতা৭/১২)।কারন শ্রীকৃষ্ণ হলেন সমগ্র জগতের স্রষ্টা,পরম ঈশ্বর,পরম প্রভু, পরমেশ্বর ভগবান।
ভগবদ্গীতা ৩/৩৭ শ্লোক অনুসারে কাম বা যৌন কামনা বাসনা শুরু হয় রজোগুন থেকে (” কাম এষ ক্রোধ এষ রজোগুন সমুদ্ভব “)।এ রজোগুন থেকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ মুক্ত।
শ্রীমদ্ভাগবত পুরান শাস্ত্রের দশম স্কন্দের বর্ননা থেকে আমরা জানতে পারি, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বৃন্দাবনের অসংখ্য ব্রজবধুদের জোর করে ঘর থেকে তুলে আনেন নি। তারা স্বইচ্ছায় শ্রীকৃষ্ণের বংশীধ্বনিতে তার কাছে ছুটে এসেছিলেন।
শ্রীমদ্ভাগবত ১০/২৯/১৭-২৭ শ্লোক অনুযায়ীঃ
তা দৃষ্টান্তিকমায়াতা ভগবান্ ব্রজযোষিতঃ ।
অবদদ্বদতাং শ্রেষ্ঠো বাচঃ পেসৈর্বিমোহয়ন ॥ ১৭ ॥
শ্রীমদ্ভাগবত ১০/২৯/১৭
অনুবাদঃ শুকদেব গৌস্বামী বললেন, ব্রজনারীদের উপস্থিত দর্শন করে বাগ্মীশ্রেষ্ঠ শ্রীকৃষ্ণ মনোহর বাক্যে তাঁদের সম্ভাষণ করলে তাঁদের হৃদয় বিমোহিত হল।১৭।
শ্রীভগবানুবাচ-
স্বাগতং বো মহাভাগাঃ প্রিয়ং কিং করবাণি বঃ । ব্রজস্যানাময়ং কচ্চিদ ব্রুতাগমণকারণম্ ॥ ১৮ ॥
রজন্যেষা ঘোররূপা ঘোরসত্ত্বনিষেবিতা।
প্রতিযাত ব্রজং নেহ স্থেয়ং স্ত্রীভিঃ সুমধ্যমাঃ ॥ ১৯ ।
মাতরঃ পিতরঃ পুত্রা ভ্রাতরঃ পতয়শ্চ বঃ।
বিচিন্বন্তি হ্যপশ্যন্তো মা কৃঢ়ং বন্ধুসাধ্বসম্ ॥ ২০ ॥
দৃষ্টং বনং কুসুমিতং রাকেশকররঞ্জিতম্।
যমুনানিল লীলৈজত্তরুপল্লব শোভিতম্ ॥ ২১
 তদযাত মা চিরং গোষ্ঠং শুশ্রূষধ্বং পতীন্ সতীঃ ।
ক্রন্দন্তি বৎসা বালাশ্চ তান্ পায়য়ত দুহ্যত ॥ २२॥
অথ বা মদভিস্নেহাদ্ভবত্যো যন্ত্রিতাশয়াঃ ।
আগতা হ্যুপপন্নং বঃ প্রীয়ন্তে ময়ি জন্তবঃ ॥ ২৩
ভর্তুঃ শুশ্রূষণং স্ত্রীণাং পরো ধর্মো হ্যমায়য়া।
তদ্বন্ধুনাং চ কল্যাণঃ প্রজানাঞ্চানুপোষণম্ ॥ ২৪ ॥
দুঃশীলো দুর্ভগো বৃদ্ধো জড়ো রোগ্যধনোহপি বা।
পতিঃ স্ত্রীভির্ন হাতব্যো লোকেম্পুভিরপাতকী ৷ ২৫ ॥
অস্বর্গ্যমযশস্যঞ্চ ফল্গু কৃস্প্রং ভয়াবহম্।
জুগুপ্সিতং চ সর্বত্র হ্যৌপপত্যং কুলস্ত্রিয়ঃ ॥ ২৬ ॥
শ্রবণাদ্দর্শনাদ্ধ্যনাৎ ময়ি ভাবোহনুকীর্তনাৎ।
ন তথা সন্নিকর্ষেণ প্রতিযাত ততো গৃহান্ ॥ ২৭ ॥
-(শ্রীমদ্ভাগবত ১০/২৯/১৮-২৭)
অনুবাদঃ ভগবান কৃষ্ণ বললেন-হে পরম সৌভাগ্যবতী রমণীগণ, স্বাগতম। আমি তোমাদের প্রীতির জন্য কি করব? ব্রজের সকল কুশল তো? তোমাদের আগমনের কারণ কি বল?১৮।এই রাত্রি অতি ভয়ঙ্কর এবং ভয়ঙ্কর প্রাণীরা চারিদিকে ওত পেতে আছে। ব্রজে ফিরে যাও, হে সুমধ্যমা, সুন্দরীগণ। এই স্থানটি নারীদের জন্য উপযুক্ত নয়।১৯।
তোমাদের গৃহে না পেয়ে, তোমাদের মাতা, পিতা, পুত্র, ভ্রাতা ও পতিগণ অবশ্যই তোমাদের অন্বেষণ করবে। তোমাদের পরিবারের সদস্যদের উদ্বেগের কারণ হয়ো না।২০।এখন তোমরা চন্দ্রকিরণে রঞ্জিত, বৃন্দাবনের পুষ্পপূর্ণ বন দর্শন করেছ। তোমরা যমুনা থেকে আগত শান্ত বাতাসে কম্পমান পল্লব-যুক্ত বৃক্ষের শোভা দর্শন করেছ। এখন তাই গোষ্ঠে ফিরে যাও। বিলম্ব কর না। হে সতী নারীগণ, তোমাদের পতিদের সেবা কর এবং ক্রন্দনরত শিশু ও গোবৎসদের দুগ্ধ পান করাও।২১-২২।
তা ছাড়া, সম্ভবত আমার প্রতি প্রবল প্রেমবশত তোমাদের চিত্ত বশীভূত হওয়াতে তোমরা এখানে আগমন করেছ। তোমাদের জন্য এটি অবশ্যই যথেষ্ট প্রশংসনীয়, কারণ স্বভাবত সকল প্রাণীই আমার প্রতি প্রীতিভাবযুক্ত হয়ে থাকে।২৩।নারীর পরম ধর্ম-ঐকান্তিকভাবে তাঁর স্বামীর সেবা করা, স্বামীর পরিবারের প্রতি সুব্যবহার করা এবং তাঁর সন্তানদের লালন-পালন করা।২৪।
যে সকল নারী পরজন্মে সদ্গতি লাভ করতে চান, তাঁদের স্বামী ধর্মাচরণ থেকে পতিত না হলে, শুধুমাত্র বিরক্তিকর, ভাগ্যহীন, বয়োবৃদ্ধ, বুদ্ধিহীন, ব্যাধিগ্রস্ত বা ধনহীন হলেই তাঁকে ত্যাগ করা কখনই উচিত নয়।২৫।কুলনারীর উপপতি সংক্রান্ত তুচ্ছ সুখ স্বর্গবিরোধী, যশনাশক, দুঃখোৎপাদক, ভয়াবহ এবং সকল সময়েই তা নিন্দিত হয়ে থাকে।২৬।
আমার কথা শ্রবণ, আমার বিগ্রহ দর্শন, আমার ধ্যান এবং আমার মহিমা কীর্তন দ্বারা আমার জন্য যেমন অপ্রাকৃত প্রেমের উদয় হয়, নিকটে অবস্থানের দ্বারা তেমন হয় না। তাই তোমাদের গৃহে তোমরা ফিরে যাও।২৭।
শ্রীমদ্ভাগবত ১০/২৯/২৮-৩০ শ্লোকের বর্ণনা অনুযায়ীঃ
শুকদেব গৌস্বামী বললেন,এইভাবে গোবিন্দ কথিত অপ্রিয় বাক্য শ্রবণ করে, গোপীগণ বিষাদগ্রস্ত ও বিফল মনোরথ হয়ে অপার উদ্বেগ অনুভব করলেন।২৮।দুঃখিত দীর্ঘনিঃশ্বাসে তাঁদের বিম্বাধর(ঠোট) শুষ্ক হলে তাঁরা অবনত মস্তকে তাঁদের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দিয়ে ভূমিতে আঁচড় কাটছিলেন। তাঁদের দু’চোখ দিয়ে কাজলযুক্ত অশ্রুধারায় স্তনে লিপ্ত কুঙ্কুম ধৌত হয়েছিল। এইভাবে দুঃখভারাক্রান্ত হয়ে তাঁরা নীরবে দাঁড়িয়ে রইলেন। ২৯।কৃষ্ণ তাঁদের প্রিয়তম হওয়া সত্ত্বেও এবং তাঁর জন্য তাঁরা সকল কামনা পরিত্যাগ করলেও, তিনি তাঁদের প্রতি অপ্রিয় বাক্য বলছিলেন। তৎ সত্ত্বেও তাঁরা দৃঢ়ভাবে কৃষ্ণের প্রতি আসক্তচিত্তা রইলেন। রোদন বন্ধ করে চোখ মার্জন করে তাঁরা ঈষৎ কোপের সঙ্গে গদগদ স্বরে বলতে লাগলেন।৩০।
শ্রীমদ্ভাগবত ১০/২৯/৩১- ৪১ শ্লোক অনুযায়ীঃ
শ্রীগোপ্য উচুঃ-
মৈবং বিভোহর্হতি ভবান্ গদিতুং নৃশংসং
সন্ত্যজ্য সর্ববিষয়াংস্তব পাদমূলম্।
ভক্তা ভজস্ব দূরবগ্রহ মা ত্যজাম্মান্
 দেবো যথাদিপুরুষো ভজতে মুমুক্ষুন্ ॥ ৩১।।
যৎ পত্যপত্যসুহৃদামনুবৃত্তিরঙ্গ
 স্ত্রীণাং স্বধর্ম ইতি ধর্মবিদা ত্বয়োক্তম্। অস্ত্বেবমেতদুপদেশপদে ত্বয়ীশে
প্রেষ্ঠো ভবাংস্তনুভূতাং কিল বন্ধুরাত্মা ৷৷ ৩২ ॥
কুর্বন্তি হি ত্বয়ি রতিং কুশলাঃ স্ব আত্মন্
নিত্যপ্রিয়ে পতিসুতাদিভিরার্তিদৈঃ কিম্।
তন্নঃ প্রসীদ পরমেশ্বর মা স্ম ছিন্দ্যা
আশাং ধৃতাং ত্বয়ি চিরাদরবিন্দনেত্র ৷ ৩৩ ॥
চিত্তং সুখেন ভবতাপহৃতং গৃহেষু
যন্নির্বিশত্যুত করাবপি গৃহ্যকৃত্যে।
পাদৌ পদং ন চলতস্তব পাদমূলাদ
যামঃ কথং ব্রজমথো করবাম কিং বা ॥ ৩৪ ॥
সিঞ্চাঙ্গ নস্ত্বদধরামৃতপুরকেণ
হাসাবলোক-কলগীতজ-হৃচ্ছয়াগ্নিম্।
নো চেদ্বয়ং বিরহজাগ্ন্যুপযুক্তদেহা
 ধ্যানেন যাম পদয়োঃ পদবীং সখে তে ৷৷ ৩৫ ॥
যর্হ্যম্বুজাক্ষ তব পাদতলং রমায়া
দত্তক্ষণং ক্বচিদরণ্যজনপ্রিয়স্য।
অস্ত্রাক্ষ্ম তৎ প্রভৃতি নান্যসমক্ষমঞ্জঃ
 স্থাতুং ত্বয়াভিরমিতা বত পারয়ামঃ ॥ ৩৬ ॥
শ্রীর্ষৎ পদাম্বুজরজশ্চকমে তুলস্যা
লক্কাপি বক্ষসি পদং কিল ভৃত্যজুষ্টম্।
যস্যাঃ স্ববীক্ষণ উতান্যসুরপ্রয়াস্
তদ্বদ্বয়ং চ তব পাদরজঃ প্রপন্নাঃ ॥ ৩৭ ॥
তন্নঃ প্রসীদ বৃজিনার্দন তেংখ্রিমূলং
প্রাপ্তা বিসৃজ্য বসতীস্ত্বদুপাসনাশাঃ।
ত্বৎ সুন্দরস্মিত নিরীক্ষণ তীব্রকাম-
 তপ্তাত্মনাং পুরুষভূষণ দেহি দাস্যাস্ ॥ ৩৮
বীক্ষ্যালকাবৃতমুখং তব কুণ্ডলশ্রী-
গণ্ডস্থলাধরসুধং হসিতাবলোকম্।
দত্তাভয়ং চ ভুজদণ্ডযুগং বিলোক্য
বক্ষঃ শ্রিয়ৈকরমণং চ ভবাম দাস্যঃ ৷৷ ৩৯ ॥
 -(শ্রীমদ্ভাগবত ১০/২৯/৩১-৩৯)
অনুবাদঃ গোপীরা বললেন-হে সর্বব্যাপী সর্বশক্তিমান পুরুষ, আপনার এভাবে নিষ্ঠুর কথা বলা উচিত নয়। আমরা যারা আপনার পাদপদ্মমূলে সমস্ত ইন্দ্রিয় পরিতৃপ্তির বিষয়াদি পরিত্যাগ করেছি, তাদের বর্জন করবেন না। হে কৃপাপরাঙ্মুখ, যেমন আদিপুরুষ নারায়ণ মুমুক্ষু মুক্তিকামী ভক্তদের সাথে বিনিময় করেন, সেইভাবে আমাদের সাথে প্রেম বিনিময় করুন।৩১।
হে প্রিয় কৃষ্ণ, ধর্মজ্ঞ রূলে আপনি আমাদের উপদেশ প্রদান করেছেন যে, পতি, পুত্র ও আত্মীয় বন্ধুগণের সেবা করাই স্ত্রীগণের ধর্ম। আমরা তা মান্য করি, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আপনার প্রতিই এই সেবা করা উচিত; কারণ আপনিই সকল প্রাণীর পরম বন্ধুস্বরূপ, আপনিই তাদের আত্মীয়, পতি ও আত্মা।৩২।
দক্ষ আত্মহিতৈষীগণ, নিত্যপ্রিয়, আত্মরূপী আপনার প্রতিই সর্বদা তাঁদের ভক্তি চালিত করেন। আমাদের পতি, পুত্র ও আত্মীয়-বন্ধুদের দ্বারা কি লাভ হয়, যাঁরা কেবল পীড়া দান করেন? অতএব, হে পরমেশ্বর, আমাদের কৃপা করুন। হে কমলনয়ন, আপনার সঙ্গ লাভের জন্য আমাদের চিরকালের আশা দয়া করে ছিন্ন করবেন না।৩৩।
আমাদের যে মন ও হাত এতাবৎ কাল গৃহকর্মে মগ্ন ছিল, তা আপনি সহজেই অপহরণ করেছেন। এখন আমাদের পা দুখানি এক পা-ও আপনার পাদপদ্মমূল থেকে চালিত হতে চায় না। আমরা কিভাবে ব্রজে ফিরে যাব? আর সেখানে গিয়েই বা আমরা কি করব? ৩৪।
হে শ্রীকৃষ্ণ, আপনার সহাস্য অবলোকন ও বাঁশীর সুমধুর সঙ্গীতে আমাদের হৃদয়ের অভ্যন্তরে যে অগ্নি প্রজ্বলিত হয়েছে, সেখানে আপনার অধরামৃত সিঞ্চন করুন। তা যদি না করেন, হে সখে, আপনার বিরহানলে আমাদের দেহকে ন্যস্ত করে ধ্যান যোগে যোগীর ন্যায় আপনার চরণকমল লাভ করব।৩৫।
হে কমললোচন, আপনার পদতলের স্পর্শ লক্ষ্মী দেবীর কাছেও উৎসব স্বরূপ। অরণ্যবাসীজন-প্রিয় আপনার ঐ পাদপদ্মদ্বয় আমরাও স্পর্শ করব। যতক্ষণ না আমরা আপনার দ্বারা পূর্ণরূপে সন্তুষ্ট হচ্ছি, ততক্ষণ আমরা অন্য কোন মানুষের সামনে অবস্থান করতেই অক্ষম হয়ে থাকব।৩৬।
লক্ষ্মীদেবী, যাঁর কটাক্ষ লাভের জন্য দেবতারাও প্রবল প্রয়াস করেন, যিনি ভগবান নারায়ণের বক্ষবিলাসিনী, সেই তিনিও তুলসীদেবী ও ভগবানের অন্যান্য ভৃত্যগণের সঙ্গে একত্রে সেই পদযুগলের রেণুলাভের আকাঙ্ক্ষা করেন, তেমনি আমরাও আপনার চরণ কমলদ্বয়ের রেণুর আশ্রয় গ্রহণের শরণাপন্ন হয়েছি।৩৭।
অতএব, হে দুঃখহারিণ, যারা গৃহ ও পরিবার পরিত্যাগ করে শুধু আপনার উপাসনার আশায় আপনার পাদমূলে আগমন করেছে, সেই আমাদের প্রতি প্রসন্ন হোন। আপনার সুন্দর হাস্যময় কটাক্ষপাতে আমাদের চিত্ত গভীর কামনায় দগ্ধ হচ্ছে। হে পুরুষরত্ন, দয়া করে আমাদের আপনার দাস্য প্রদান করুন।৩৮।
আপনার অলঙ্কৃত মুখমণ্ডল, আপনার কর্ণকুগুলের সৌন্দর্য-মণ্ডিত গণ্ডস্থল, আপনার অধরের সুধা, ঈষৎ হাস্যযুক্ত অবলোকন, অভয়প্রদানকারী বাহুযুগল এবং লক্ষ্মীদেবীর আনন্দের একমাত্র উৎস স্বরূপ আপনার বক্ষস্থল দর্শন করে আমরা আপনার দাসী হয়েছি। ৩৯।
এরপর শ্রীমদ্ভাগবত ১০/২৯/৪২,৪৮ শ্লোকের বর্ণনা অনুযায়ীঃ
গোপীদের এই সকল বাক্য শ্রবণ করে মহাযোগীগণেরও অধীশ্বর ভগবান কৃষ্ণ স্বয়ং নিত্য-তৃপ্ত হয়েও সহাস্যে গোপীগণের সঙ্গে আনন্দ উপভোগ করেন।ভগবান কেশব গোপীগণের সৌভাগ্যজনিত অত্যন্ত গর্বভাব দর্শন করে, তাঁদের সেই গর্ব প্রশমনের জন্য, তাঁদের প্রতি আরও কৃপাবশত তৎক্ষণাৎ অন্তর্হিত হলেন।
শ্রীমদ্ভাগবত ১০/৩০ /১-৪৪ শ্লোকের বর্ণনা অনুযায়ীঃ
শ্রীকৃষ্ণ যখন গোপীদের গর্ব নাশ করার জন্য অন্তর্হিত হলেন তখন তারা চারদিকে শ্রীকৃষ্ণকে অন্বেষণ করছিলেন।এর পরের অধ্যায় অথাৎ শ্রীমদ্ভাগবত ১০/৩১/১-১৯ শ্লোকে গোপীদের বিরহ গীতি বর্ণনা করা হয়েছে।এবং শ্রীমদ্ভাগবত ১০/৩২ /১-২২ শ্লোকের বর্ণনায় গোপীদের কৃষ্ণ প্রাপ্তি অথাৎ শ্রীকৃষ্ণ গোপীদের দর্শন দানের কথা বর্ণনা করা হয়েছে।
এবং সর্বশেষ শ্রীমদ্ভাগবতের দশম স্কন্ধের ৩৩ তম অধ্যায়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের গোপীগণের রাসনৃত্যের কথা বর্ণনা করা হয়েছেঃ
শ্রীশুক উবাচ
ইত্থং ভগবতো গোপ্যঃ শ্রুত্বা বাচঃ সুপেশলাঃ । জহুর্বিরহজং তাপং তদঙ্গোপচিতাশিষঃ ৷৷ ১ ৷৷
তত্রারভত গোবিন্দো রাসক্রীড়ামনুব্রতৈঃ ।
স্ত্রীরত্বৈরন্বিতঃ প্রীতৈরন্যোন্যাবদ্ধবাহুভিঃ ॥২॥
– (শ্রীমদ্ভাগবত ১০/৩৩ /১-২)
অনুবাদঃ শুকদেব গোস্বামী বললেন-গোপীগণ ভগবানের এরূপ মনোহর বাক্য শ্রবণ করে কৃষ্ণ বিরহজনিত দুঃখ পরিত্যাগ করলেন। তাঁর চিন্ময় অঙ্গসমূহ স্পর্শ করে তাঁদের মনস্কামনা পূর্ণ হল।অতঃপর যমুনার তীরে নারীগণের মধ্যে রত্নসদৃশা, আনন্দে পরস্পর বাহুপাশে আবদ্ধা, বিশ্বস্ত গোপীগণের সঙ্গে ভগবান গোবিন্দ রাসনৃত্য আরম্ভ করলেন।
 রাসোৎসবঃ সম্প্রবৃত্তো গোপীমণ্ডলমণ্ডিতঃ । যোগেশ্বরেণ কৃষ্ণেন তাসাং মধ্যে দ্বয়োর্দ্বয়োঃ ॥
প্রবিষ্টেন গৃহীতানাং কণ্ঠে স্ব-নিকটং স্ত্রিয়ঃ।
 যং মন্যেরন্নভস্তাবদ্বিমানশতসঙ্কুলম্।
দিবৌকসাং সদারাণামৌৎসুক্যাপহৃতাত্মনাম্ ॥ ৩ ॥
ততো দুন্দুভয়ো নেদুর্নিপেতুঃ পুষ্পবৃষ্টয়ঃ।
জগুর্গন্ধর্বপতয়ঃ সস্ত্রীকান্তদযশোংমলম্ ॥ ৪ ॥- (শ্রীমদ্ভাগবত ১০/৩৩ /৩-৪)
অনুবাদঃ গোপীমণ্ডলে মণ্ডিত হয়ে রাসনৃত্য উৎসব শুরু হল। যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ নিজেকে বিস্তার করে প্রত্যেক দু’জন গোপীর মাঝখানে প্রবেশ করে তাঁদের কণ্ঠে তাঁর হস্ত স্থাপন করলে, প্রত্যেক গোপীই ভাবলেন যে, তিনি একমাত্র তাঁর কাছেই অবস্থান করছেন। সস্ত্রীক অভিভূত দেবতাগণ সেই রাসনৃত্য দর্শনের আগ্রহে শীঘ্রই তাঁদের শত শত বিমানে আকাশ পরিব্যাপ্ত করেছিলেন।তখন আকাশ হতে পুষ্পবৃষ্টি সহকারে দুন্দুভি বেজে উঠল এবং সস্ত্রীক গন্ধর্বপতিগণ শ্রীকৃষ্ণের নির্মল মহিমা গান করতে লাগলেন।
শ্রীমদ্ভাগবত ১০/৩৩/৩৭-৩৮ শ্লোক অনুযায়ীঃ
ব্রহ্মরাত্র উপাবৃত্তে বাসুদেবানুমোদিতাঃ।
অনিচ্ছন্ত্যো যযুর্গোপ্যঃ স্বগৃহান্ ভগবৎপ্রিয়াঃ ॥ ৩৮
 – (শ্রীমদ্ভাগবত ১০/৩৩/৩৮)
অনুবাদঃ ব্রহ্মরাত্র অতিবাহিত হলে বা রাসনৃত্য সমাপ্ত হলে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গোপীগণকে গৃহে ফিরে যেতে উপদেশ দিলেন। অনিচ্ছা সত্ত্বেও ভগবৎপ্রিয়াগণ (গোপীগণ)তাঁর আদেশ মেনে নিলেন।
নাসূয়ন্ খলু কৃষ্ণায় মোহিতাস্তস্য মায়য়া।
মন্যমানাঃ স্বপার্শ্বস্থান্ স্বান্ স্বান্ দারান্ ব্রজৌকসঃ ৷৷ ৩৭ ॥
– (শ্রীমদ্ভাগবত ১০/৩৩/৩৭)
অনুবাদঃ শ্রীকৃষ্ণের মায়াশক্তির দ্বারা বিভ্রান্ত হয়ে গোপগন ভেবেছিল তাদের পত্নীরা তাদের পাশে আছে।তাই তারা তাদের স্ত্রীদের প্রতি কোনরুপ অসূয়া( হিংসা) প্রকাশ করেন নি।
হরে কৃষ্ণ।প্রনাম।
গ্রন্থ সহায়তাঃ
১/শ্রীমদ্ভাগবত
অনুবাদঃ শ্রীল ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদের শিষ্যবৃন্দকৃত।প্রকাশনা- বিবিটি।
 
								 
															 
					 
					 
					 
					 
					 
															 
															 Views Today : 412
 Views Today : 412 Total views : 119293
 Total views : 119293 Who's Online : 0
 Who's Online : 0 Your IP Address : 216.73.216.107
 Your IP Address : 216.73.216.107