আমাদের সনাতনী শাস্ত্র বিশেষ করে বেদ,মহাভারত, শ্রীমদভগবদগীতা, অষ্টাদশ পুরান, পঞ্চরাত্র ইত্যাদি শাস্ত্র অনুসারে শ্রীকৃষ্ণ হলেন সকলের প্রভু,পরম ঈশ্বর ভগবান।
ইন্দ্রারিব্যাকুলং লোকং মৃড়য়ন্তি যুগে যুগে।।
–(শ্রীমদ্ভাগবত পুরান ১/৩/২৮)
অনুবাদঃ পূর্বোল্লেখিত সমস্ত অবতারেরা পুরুষাবতারের অংশ বা অংশের অংশ।কিন্তু শ্রীকৃষ্ণই স্বয়ং ভগবান।ইন্দ্রের শত্রুদের দ্বারা যখন পৃথিবী ভারাক্রান্ত হয়, তখন তিনি যুগে যুগে অবতীর্ণ হন।
ভগবদ্গীতা ৩/৩৭ শ্লোকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বর্ননা করেন কাম বা যৌন কামনা বাসনা শুরু হয় রজোগুন থেকে (” কাম এষ ক্রোধ এষ রজোগুন সমুদ্ভব “)।ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ভগবদ্গীতা ৭/১২ শ্লোকে আরো বর্ননা করেন, যদিও রজোগুন( কামের উদ্ভব) আমার থেকে সৃষ্টি, কিন্তু রজগুন ( কাম)আমাতে অবস্থিত নয়(” যে চৈব সাত্ত্বিকা ভাবা রাজসাস্তামসাশ্চ যে।মত্ত এবৈতি তান বিদ্ধি ন ত্বহং তেষু তে ময়ি।।”)।
গোপীরা কৃষ্ণের ভক্ত।তারা সকলে সর্বোচ্চ লোক গোলক বৃন্দাবন ধাম থেকে এ জগতে জীবকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য আবির্ভুত হয়েছেন।কৃষ্ণ যেহেতু এই জগতের সকল জীবের স্রষ্টা,তাই তার কাছে মেয়ে ছেলে কোন বিভেদ নেই।তাই তিনি স্বয়ং নিজে অথবা বিভিন্ন অবতাররুপ পরিগ্রহ করে যেকোন পরিস্থিতিতে যেকোন স্থানে আবির্ভুত হয়ে জগতের জীবকে শিক্ষা প্রদান করেন।
শ্রীমদ্ভাগবতের দশম স্কন্দের তথ্য অনুসারে ভগবান কৃষ্ণ যখন বৃন্দাবনের গোপীদের বস্ত্র হরন করেছিলেন তখন তার বয়স মাত্র ৬ বছর(কারন কৃষ্ণ ৭ বছর বয়সে গোবর্ধন পর্বত তার কনিষ্ঠ আঙ্গুলে ধারন করেছিলেন, তাই কৃষ্ণ কতৃর্ক গোপীদের বস্ত্রহরন তার পূর্বের ঘটনা)। স্বাভাবিকভাবে ৬ বছর বয়সে কোন ছেলের যৌন কামনা থাকে না।
তাই কৃষ্ণ কতৃর্ক গোপীদের বস্ত্রহরন কখনো রজোগুন থেকে জাত যৌন কামনা নয়।বরং পরমেশ্বর ভগবান রুপে জগৎবাসীকে গোপীদের মাধ্যমে বিবস্ত্র অবস্থায় জলে স্নান না করার একটি অসাধারন শিক্ষা। কারন জলের দেবতা বরুন দেব। তিনি সর্বদা জলে অবস্থান করেন।আর জলের উদ্ধদিকে রয়েছেন স্বর্গের অন্যান্য দেবতারা,যারা প্রতিনিয়ত আমাদের কার্যকলাপ পর্যবেক্ষন করছেন। তাই জলে হোক বা স্থলে হোক কখনো উল্লঙ্গ অবস্থায় থাকা উচিত নয়,তাতে দেবতাদের চরনে অপরাধ হয়।বৃন্দাবনের গোপীরা যেহেতু কাত্যয়নী ব্রত উৎযাপন কালে উল্লঙ্গ হয়ে স্নান করছিলেন,তাই কৃষ্ণ তাদের বস্ত্র চুরি করে তাদের শিক্ষা দিয়েছিলেন যে, বিবস্ত্র অবস্থায় তোমাদের জলে স্নান করা দেবতাদের চরনে অপরাধ হয়েছে।তাই কৃষ্ণ তাদের উপদেশ দিয়েছিলেন দুই হাত জোড় করে উদ্ধদিকে প্রণতি নিবেদন করে দেবতাদের কাছ থেকে ক্ষমা ভিক্ষা প্রার্থনা করার জন্য । তাই শ্রীমদ্ভাগবত পুরান শাস্ত্রে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ স্নানরতা বিবস্ত্রা বৃন্দাবনের গোপীদের উদ্দেশ্য বললেন….
যয়ুম বিবস্ত্রা যদপো দৃঢ়ব্রতা
ব্যগাহতৈতত্তদু দেবহেলনম।
বদ্ধাঞ্জলিং মূধ্ন্যপনুত্তয়েহংহসং
কৃত্বা নমমোহধোবসনং প্রগৃহ্যতাম।।
-(শ্রীমদ্ভাগবত পুরান ১০/২২/১৯,ভগবান শ্রীকৃষ্ণ)
অনুবাদঃ তোমরা কুমারীগন ব্রতপালন কালে নগ্ন হয়ে স্নান করেছ এবং সেটি নিঃসন্দেহে দেবতাদের প্রতি অপরাধ।তোমাদের পাপের প্রতিকারের জন্য তোমাদের মস্তকের উপরে হাত জোড় করে তোমাদের প্রনাম করা উচিত।তারপর তোমরা তোমাদের অধোবসন ফিরিয়ে নাও।
এরপরও আবার কেউ প্রশ্ন করতে পারে, কৃষ্ণ যদি ঈশ্বর হন,তাহলে তার তো ক্ষমতা ছিল স্নানরতা অবস্থায় গোপীদের শিক্ষা না দিয়ে পরে তা তাদের বুঝিয়ে বলার।এর উত্তরে শ্রীমদ্ভাগতের বর্ণনা করা হয়েছে , বৃন্দাবনের গোপীগণ পরমাত্মা শ্রীকৃষ্ণকে পতিরুপে পাওয়ার জন্য ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মহান ভক্ত কাত্যয়নীর দেবীর(দুর্গা) পূজা করেছিলেন।
কাত্যায়নী মহামায়ে মহাযোগিন্যধীশ্বরী।
নন্দগোপসূতং দেবী পতিং মে কুরুতে নমঃ।
ইতি মন্ত্রং জপন্ত্যস্ত্যঃ পূজাং চত্রুুঃ কুমারিকাঃ।।
-(শ্রীমদ্ভাগবতঃ ১০/২২/৪)
অনুবাদ – হে কাত্যায়নী, মহামায়া, মহাযোগীগণের অধীশ্বরী, আমি আপনার শ্রীচরণকমলে প্রণতি নিবেদন করি। এবং এ প্রার্থনা করি যে,নন্দগোপসূতকে (শ্ৰীকৃষ্ণ)-যেন আমি পতি রূপে ( স্বামী) লাভ করতে পারি, এই বর প্রদান করুন। এই মন্ত্র জপ করতে করতে কুমারী কন্যাগন প্রত্যেকে তাঁর( কাত্যায়নীর দেবী) পূজা করেছিলেন।
পরমাত্মা ও পরমপ্রভুরুপে শ্রীকৃষ্ণ সকল জীবের সৎ আশা পূর্ণ করেন। শ্রীমদ্ভাগতের বর্ণনা অনুযায়ী, বৃন্দাবনের গোপীগণ যেহেতু পরমাত্মা শ্রীকৃষ্ণকে তাদের পতিরুপে পাওয়ার জন্য গভীর আশা পোষণ করেছিলেন,তাই শ্রীকৃষ্ণ যমুনায় স্নানরতা অবস্থায় গোপীদের আদর্শ পতিরুপে শাসন করেছিলেন,যাতে করে তারা দেবতাদের কৃপা গ্রহণের পরিবর্তে তাদের অভিশাপের পাত্র না হন।
হরে কৃষ্ণ। প্রনাম।