শ্রীবিষ্ণুঃ
সমগ্র সনাতনী শাস্ত্র অনুসারে শ্রীবিষ্ণু হলেন স্বয়ং পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ।তিনি জড় জগতের বিপরীতে চিন্ময় জগত শ্রীবৈকুন্ঠ ধামে নিত্য বিরাজমান।শ্রীবিষ্ণু এবং শ্রীকৃষ্ণ হলেন অভিন্ন এক পরমাত্মা। শ্রীকৃষ্ণ তাঁর অপ্রাকৃত লীলাকে বর্ধন করতে ইচ্ছা করলে চিন্ময় জগতের সর্বোচ্চ লোক গোলক বৃন্দাবনে তিনি শ্রীবিষ্ণু রুপে আবির্ভূত হন।।তাই শাস্ত্রে শ্রীকৃষ্ণকে শ্রীবিষ্ণু বলা হয়েছে, আবার শ্রীবিষ্ণুকে শ্রীকৃষ্ণ বলা হয়েছে।
শ্রীবিষ্ণুর আবির্ভাবঃ
সনাতনী শাস্ত্র সমন্ধে পূর্ণাঙ্গ ধারনা না থাকার ফলে আমাদের সমাজে কিছু ব্যক্তি মনে করেন শ্রীবিষ্ণু থেকে শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব। শ্রীকৃষ্ণ হলেন বসুদেব এবং দেবকীর সন্তান।শ্রীবিষ্ণু শ্রীকৃষ্ণরুপে দ্বাপরযুগে অবতীর্ণ হয়েছেন। কিন্তু আমাদের সনাতনী শাস্ত্র অনুসারে এ ধরনের ধারনা সঠিক নয়।তার কারন হিসেবে সনাতনী শাস্ত্রে বর্ণনা করা হয়েছে, শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং পরমেশ্বর ভগবানরুপে চিন্ময়জগত গোলক বৃন্দাবনে নিত্য বিরাজমান। তাঁর থেকে আবির্ভূত হন বিষ্ণু। যদিও তিনি তার নিত্যধাম গোলক বৃন্দাবনে নিত্য বিরাজমান,তথাপি প্রতিটি ব্রহ্মান্ডে ব্রহ্মার প্রতি কল্পে বা প্রতি দিনে ১ বার অথাৎ মনুষ্যজীবের ১ হাজার চতুর্যুগের মধ্যে একবার অষ্টাবিংশ চতুর্যুগ দ্বাপরের শেষভাগে আবির্ভূত হন।
পূর্ন ভগবান কৃষ্ণ ব্রজেন্দ্রকুমার।
গোলোকে ব্রজের সহ নিত্য বিহার।।
ব্রহ্মার এক দিনে তিহোঁ অবতার।
অবতীর্ণ হঞা করেন প্রকট বিহার।
সত্য,ত্রেতা,দ্বাপর,কলি চারিযুগ জানি।
সেই চারিযুগ দিব্য একযুগ মানি।।
একাত্তর চতুর্যুগে এক মন্বন্তর।
চৌদ্ধ মন্বন্তর ব্রহ্মার দিবস ভিতর।।
” বৈবস্বত” – নাম এই সপ্তম মন্বন্তর।
সাতাইশ চতুর্যুগ তাহার ভিতর।।
অষ্টাবিংশ চতুর্যুগে দ্বাপরের শেষে।
ব্রজের সহিতে হয় কৃষ্ণের প্রকাশে।।
-(শ্রীচৈতন্য চরিতামৃতঃ আদি.৩/৫-১০)
অনুবাদঃ ব্রজরাজের পুত্র শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবান। তিনি ব্রজধাম সহ তার নিত্য আলয় গোলক বৃন্দাবনে নিত্য লীলাবিলাস করছেন।ব্রহ্মার একদিনে একবার তিনি তার অপ্রাকৃত লীলা প্রকট করার জন্য এই জড়জগতে অবতীর্ণ হন। আমরা জানি যে সত্য, ত্রেতা,দ্বাপর ও কলি এই চারটি যুগ রয়েছে। এই চারটি যুগকে একত্রে এক দিব্যযুগ বলা হয়। একাত্তরটি দিব্যযুগে এক মন্বন্তর হয়। ব্রহ্মার এক দিনে চৌদ্ধটি মন্বন্তর রয়েছে। বর্তমান সপ্তম মন্বন্তরে মনু হচ্ছেন বৈবস্বত।তার আয়ুষ্কালের সাতাশ দিব্যযুগ গত হয়েছে। অষ্টাবিংশতি দিব্য যুগের দ্বাপর যুগের শেষভাগে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তার নিত্য ব্রজধামের সমস্ত উপকরণসহ এই জড় জগতে আবির্ভূত হন।
শ্রীকৃষ্ণ থেকে যে গোলক বৃন্দাবনে শ্রীবিষ্ণুর আবির্ভাব হয়েছে এ বিষয়ে শ্রীমদ্ভাগবত, স্কন্ধ পুরাণ, পদ্ম পুরাণ, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ সহ অসংখ্য পুরাণ, ব্রহ্মসংহিতা ইত্যাদি সনাতনী শাস্ত্রে বর্ণনা করা হয়েছে।
দৃষ্টা শূন্যময়ং বিশ্বমলোকঞ্চ ভয়ঙ্করম্।
নির্জন্তু নির্জ্জলং ঘোরং নির্ব্বাতং তমসাবৃতম্ ॥১
বৃক্ষ শৈলসমুদ্রাদিবিহীনং বিকৃতাকৃতম্।
নির্মূর্ত্তিকঞ্চ নির্ব্বাতং নিঃশস্যং নিস্তৃণং দ্বিজ ॥২
আলোক্য মনসা সর্ব্বমেক এবাসহায়বান্।
স্বেচ্ছয়া স্রষ্টুমারেভে সৃষ্টিং স্বেচ্ছাময়ঃ প্রভুঃ ॥৩
আবির্ব্বভূবঃ সর্ব্বাদৌ পুংসো দক্ষিণপার্শ্বতঃ।
ভবকারণরূপাশ্চ মূর্তিমন্তস্ত্রয়ো গুণাঃ ।। ৪
ততো মহানঙ্কার পঞ্চতন্মাত্রমেব চ।
রূপরসগন্ধস্পর্শশব্দশ্চৈবতিসংজ্ঞকম্ ॥ ৫
আবির্ব্বভূত তৎপশ্চাৎ স্বয়ং নারায়ণঃ প্রভুঃ।
শ্যামো যুবা পীতবাসা বনমালী চতুর্ভুজঃ ॥ ৬
শঙ্খচক্রগদাপদ্মধরঃ স্মেরমুখাম্বুজঃ।
রত্নভূষণভূষাটঃ শাঙ্গী কৌস্তুভভূষণঃ ॥ ৭
শ্রীবৎসবক্ষাঃ শ্রীবাসঃ শ্রীনিধিঃ শ্রীবিভাবনঃ।
শারদেন্দুপ্রভামুষ্টমুখেন্দুঃ সুমনোহরঃ ॥ ৮
কামদেব প্রভা মুষ্টরূপলাবণ্যসুন্দরঃ।
শ্রীকৃষ্ণপুরতঃ স্থিত্বা তুষ্টাব তং পুটাঞ্জলিঃ ॥ ৯
-(ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণঃ ব্রহ্মখন্ড৩/১-৯)
অনুবাদঃ হে দ্বিজবর। এরপর সেই স্বেচ্ছাময় পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সমগ্র বিশ্বকে প্রাণিশূন্য, জলহীন, নির্ব্বাত ঘোর অন্ধকারাচ্ছন্ন, বৃক্ষ, শৈল, সমূদ্রাদিবিহীন শস্য-তৃণ বিবর্জিত ভয়ঙ্কর শূণ্যময় অবলোকন করে মানসিক আলোচনা পূর্ব্বক স্বেচ্ছাক্রমে সৃষ্টি করতে আরম্ভ করলেন। তৎক্ষণাৎ তাঁর দক্ষিণপাশ্ব থেকে সৃষ্টির কারণরূপ মূর্ত্তিমান গুণত্রয় সর্ব্বাগ্রে আবির্ভূত হল। পরে সেই গুণত্রয় হতে মহান্ (মহৎ)ও মহান্ হতে অহঙ্কার এবং অহঙ্কার হতে রূপ, রস, গন্ধ, স্পর্শ ও শব্দ এই পঞ্চতন্মাত্রের উৎপত্তি হয়। তারপর পুনরায় তাঁর(শ্রীকৃষ্ণ)থেকে শ্যামকলেবর, যুব’, পীতবসন ও বনমাল্যধারী চতুর্ভুজ প্রভু স্বয়ং নারায়ণ আবির্ভূত হন। তাঁর মুখকমলে হাস্য এবং হস্তচতুষ্টয়ে শঙ্খ, চক্র, গদা এবং পদ্ম বিরাজ করছে। তিনি রত্নভূষণ ও হার কৌস্তভমণিদ্বারা বিভূষিত এবং শৃঙ্গময় চাপবিশিষ্ট। তাঁর মনোহর মুখকান্তি শরচ্চন্দসদৃশ প্রভাবিশিষ্ট এবং বক্ষঃস্থল শ্রীবৎসচিহ্নে সুশোভিত। সেই শ্রীনিবাসের সুন্দর রূপলাবণ্য কামদেবের তুল্য। তখন তিনি শ্রীকৃষ্ণের সম্মুখীন হইয়া কৃতাঞ্জলিপুটে স্তব করতে আরম্ভ করলেন।”
শ্রীশুক উবাচ
ইত্যুদ্ধবেনাত্যনুরক্তচেতসা পৃষ্টো জগৎক্রীড়নকঃ স্বশক্তিভিঃ।। গৃহীতমূর্তিত্রয় ঈশ্বরেশ্বরো জগাদ সপ্রেমমনোহরস্মিতঃ ।। ৭
– (শ্রীমদ্ভাগবতঃ১১/২৯/৭)
অনুবাদঃ শ্রীশুকদেব বললেন- হে পরীক্ষিৎ! ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ব্রহ্মাদি ঈশ্বরদেরও ঈশ্বর। তিনিই সত্ত্ব, রজ আদি গুণসকল দ্বারা ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং রুদ্রের রূপ ধারণ করে জগতের সৃষ্টি স্থিতি আদি ক্রীড়ায় যুক্ত থাকেন। যখন উদ্ধব সানুরাগ চিত্তে তাঁকে এই প্রশ্ন করলেন তখন তিনি অধরে মৃদুমন্দ হাস্য ধারণ করে বলতে শুরু করলেন ।।
অহং সর্ব্বস্য প্রভবো মত্তো দেবাঃ সবাসবাঃ।
আদিত্যা বসবো রুদ্রাঃ সাধ্যা বিশ্বে মরুদগণাঃ।৬২
ব্রহ্মা রুদ্রশ বিষ্ণুশ্চ সনকাদ্যা মহর্ষয়ঃ।
ইন্দ্রিয়াণি মনো বুদ্ধিস্তথা সত্ত্বং রজস্তময়ঃ।। ৬৩
কামঃ ক্রোধ, লোভশ্চ মোহোহঙ্কার এব চ।
এতেৎ সর্ব্বোমশেষেণ মতো গোপ্যঃ প্রবর্ত্ততে।। ৬৪
-(শ্রীস্কন্দপুরাণ, প্রভাসখন্ড-দ্বারকামাহাত্ম্যম, ১২।৬২-৬৪)
অনুবাদঃ নন্দনন্দন শ্রীকৃষ্ণ গোপীদের বললেন, “আমি সকলের প্রভু; আমার থেকেই সকলের উৎপত্তি। হে গোপিকাগণ! ইন্দ্র, আদিত্য, বসু, রুদ্রগণ, সাধ্যা, বিশ্বদেবগণ, মরুদগণ, ব্রহ্মা, রুদ্র (শিব), #বিষ্ণু প্রভৃতি দেবতা ও সনকাদি মহর্ষিগণ এবং ইন্দ্রিয়, মন, বুদ্ধি, সত্ত্ব, রজঃ, কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, অহঙ্কার- এ সমস্তই আমার থেকে প্রবর্তিত হয়।”
শ্রীবৃহস্পতি উবাচ
ঈক্ষাঞ্চক্রে যদা কৃষ্ণো মায়াপুরুষক্বপধ্বক্।
ব্রহ্মা বিষ্ণুঃ শিবশ্চাপি রজঃসত্ত্বতমোগুণৈঃ।।২১
পুরুষান্ত্রয় উত্তস্থরধিকারাৎস্তদাদিশৎ।
উৎপত্তৌ পালনে চৈব সংহারে প্রক্রমেণ তাম্।। ২২
-(স্কন্ধপুরাণ, বিষ্ণু খন্ড, শ্রীমদ্ভাগবতমাহাত্ম্যম্; ৩য় অধ্যায়; শ্লোক ২১-২২)
অনুবাদঃ শ্রীবৃহস্পতি বলিলেন – মায়াপুরুষরূপী কৃষ্ণ যখন দৃষ্টিনিক্ষেপ করিলেন,তৎকালে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিব সমুদ্ভূত হন। কৃষ্ণ সেই পুরুষত্রয়কে যথাক্রমে রজঃ সত্ত্ব ও তমোগুণাশ্রিত দেখিয়া তাঁহাদিগের স্ব স্ব অধিকার নির্দেশ করেন। তিনি সৃষ্টি, স্থিতি ও সংহার যথাক্রমে এই কার্য্যত্রয়ে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিবকে নিয়োজিত করিলেন।
ব্রহ্মবিষ্ণুমহেশাদ্যাঃ সর্ব্বদৈবতসঞ্চয়াঃ।
যস্যাংশভূতা দেবস্য ত্বয়ি তস্মিন্মনোহস্তু মে।।
– (পদ্মপুরাণ, ক্রিয়াযোগসার, ১৭।৩০)
অনুবাদঃ ব্রহ্মা, বিষ্ণু, রুদ্রাদি সমস্ত দেবতারা যাঁর অংশভূত, সেই তোমাতে (শ্রীকৃষ্ণতে) আমার মন নিবিষ্ট হউক।
প্রহ্লাদ উবাচ-
নমো ব্রহ্মণ্যদেবায় গোব্রাহ্মণহিতায় চ।
জগদ্ধিতায় কৃষ্ণায় গোবিন্দায় নমো নমঃ ।।৬৫ ৷৷৷ ব্রহ্মত্বে সৃজতে বিশ্বং স্থিতৌ পালয়তে পুনঃ।
রুদ্ররূপায় কল্পান্তে নমস্তুভ্যং ত্রিমূর্তয়ে।। ৬৬ ৷৷
-(বিষ্ণুপুরাণ, ১ম অংশ, অধ্যায়-১৯; শ্লোক-৬৫-৬৬)
অনুবাদঃ শ্রীপ্রহ্লাদ বলতে লাগলেন, গো, ব্রাহ্মণ হিতকারী ব্রহ্মণ্যদেব ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে নমস্কার। জগৎহিতকারী শ্রীগোবিন্দকে বারবার নমস্কার। আপনি ব্রহ্মারূপে বিশ্বরচনা করেন, আবার তার স্থিতি হলে বিষ্ণুরূপে পালন করেন এবং অন্তকালে রুদ্ররূপে সংহার করেন এরূপ ত্রিমূর্তিধারী আপনাকে নমস্কার।।
যস্যৈকনিশ্বাসিতকালমথাবলম্ব্য
জীবন্তি লোমবিলোজা জগাদগুনাথাঃ।
বিষ্ণুর্মহান্ স ইহ যস্য কলাবিশেষো।
গোবিন্দমাদিপুরুষং তমহং ভজামি ।।
-(ব্রহ্মসংহিতাঃ৫/৪৮)
অনুবাদঃ মহাবিষ্ণু, যাঁর মধ্যে অসংখ্য ব্রহ্মাণ্ড প্রবেশ করছে এবং কেবল মাত্র যাঁর শ্বাস প্রশ্বাসের প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সেগুলি আবার তাঁর মধ্য থেকে প্রকাশিত হচ্ছে, তিনিও হচ্ছেন শ্রীকৃষ্ণের অংশ প্রকাশ।
এষ বোহভিহিতো মার্গো গয়া বৈ মুনিসত্তমাঃ।
তং দৃষ্টা সর্ব্বশো দেবং দৃষ্টাঃ স্যুঃ সুরসত্তমাঃ ॥৫১৷৷ মহাবরাহং তং দেবং সর্ব্বলোকপিতামহম্।
অহং চৈব নমস্যামি নিত্যমেব জগৎপতিম্ ।।৫২।।
তত্র চ ত্রিতয়ং দৃষ্টং ভবিষ্যতি ন সংশয়ঃ ।
সমস্তা হি বয়ং দেবান্তস্য দেহে বসামহে ॥৫৩
-(মহাভারতঃ অনুশাসন পর্ব, অধ্যায়-১২৫; শ্লোক- ৫১-৫৩)
অনুবাদঃ মুনিশ্রেষ্ঠগণ! এই আমি আপনাদের নিকটে উৎকৃষ্ট পথ বলিলাম। সেই বাসুদেবকে সর্বপ্রকারে দর্শন করিলে সমস্ত দেবশ্রেষ্ঠগণকেই দেখা হয়।মহাবরাহরূপধারী, সমস্ত লোকের পিতামহ ও জগদীশ্বর সেই বাসুদেবকে আমিও সর্বদাই নমস্কার করি ।সেই বাসুদেবকে দর্শন করিলে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিব এই তিনজনকেই দেখা হইবে, এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। কারণ, আমরা সমস্ত দেবতারাই তাঁহার শরীরে বাস করিয়া থাকি।
হরে কৃষ্ণ। প্রনাম
স্বধর্মম: Connect to the inner self.