দয়াঃ
সনাতন ধর্মের চারটি স্তম্ভের মধ্যে ‘দয়া’ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ।আমাদের চারপাশে মানব, পশু, পাখি আদি যত জীব আমরা দেখতে পাই, তাদের দুঃখকে দর্শন করে, তাদের সে দুঃখ থেকে পরিত্রাণ করাকে ‘দয়া’ বলা হয়। মানবের দয়া দুই প্রকার: ১. মানবের প্রতি মানবের দয়া এবং ২. পশু-পাখির প্রতি মানবের দয়া।
১. মানবের প্রতি মানবের দয়া: (মানুষের প্রতি মানুষের দয়া)
মানবের প্রকৃত দুঃখের কারন হল কৃষ্ণবিস্মৃতি। পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নির্দেশকে পরিত্যাগ করে পাপপূর্ন জীবন যাপন করার ফলে মানুষ এ সংসারে দুঃখ পায়। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেন-
मच्चित्त: सर्वदुर्गाणि मत्प्रसादात्तरिष्यसि ।
अथ चेत्त्वमहङ्कारान्न श्रोष्यसि विनङ्क्ष्यसि ॥
মচ্চিত্তঃ সর্বদুর্গাণি #মৎপ্রসাদাত্তরিষ্যসি।
অথ চেত্ত্বমহঙ্কারান্ন শ্রোষ্যসি বিনঙ্ক্ষ্যসি।।
– (শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ১৮/৫৮)
অনুবাদঃ এভাবেই মদ্গতচিত্ত হলে তুমি আমার_প্রসাদে_সমস্ত_প্রতিবন্ধকতা_থেকে_উত্তীর্ণ হবে। কিন্তু তুমি যদি অহঙ্কারবশত আমার কথা না শোন, তা হলে বিনষ্ট হবে।
এ সম্পর্কে শ্রীচৈতন্য চরিতামৃত শাস্ত্রে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু বলেন-
কৃষ্ণ ভুলি যে জীব অনাদি বহির্মুখ।
অতএব মায়া_তারে_দেয়_সংসার_দুঃখ।।
– (শ্রীচৈতন্য চরিতামৃতঃমধ্যলীলা ২০/১১৭)
কিন্তু সে জীব যদি সাধু ও শাস্ত্রের কৃপায় পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শ্রীচরণকমলে শরণাগত হয়, অর্থাৎ তাঁর নির্দেশ অনুসারে জীবন-যাপন করে তাহলে সে মায়া থেকে মুক্তি লাভ করে, অর্থাৎ তার দুঃখের পরিসমাপ্তি হয়। এর ফলে জীব এই জীবনের পর এ জড় জগৎ থেকে মুক্ত হয়ে চিন্ময় ভগবদ্ধাম প্রাপ্ত হয়।
সাধু_শাস্ত্র_কৃপায়_যদি_কৃষ্ণোন্মুখ_হয়।
সেই জীব নিস্তারে, মায়া তাহারে ছাড়য়।।
– (শ্রীচৈতন্য চরিতামৃত, মধ্যলীলা ২০/১২০)
दैवी ह्येषा गुणमयी मम माया दुरत्यया ।
मामेव ये प्रपद्यन्ते #मायामेतां_तरन्ति_ते ॥
দৈবী হ্যেষা গুণময়ী মম মায়া দুরত্যয়া।
মামেব যে প্রপদ্যন্তে #মায়ামেতাং_তরন্তি_তে।।
– (শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ৭/১৪)
অনুবাদঃ আমার এই দৈবী মায়া ত্রিগুণাত্মিকা এবং তা দুরতিক্রমণীয়া। কিন্তু যাঁরা আমাতে প্রপত্তি করেন (শরনাগত হন),তাঁরাই_এই_মায়া_উত্তীর্ণ_হতে_পারেন।
তাই, মানবের প্রতি প্রকৃত দয়া হলো, জীবকে কৃষ্ণ বিমুখতা বা অজ্ঞানতা থেকে মুক্ত করে কৃষ্ণপথে নিয়ে আসার জন্য শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা, শ্রীমদ্ভাগবত, বেদ আদি শাস্ত্র থেকে কৃষ্ণভক্তির শিক্ষা দান করা। তাই শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু বলেন-
ভারত ভূমিতে মনুষ্য জন্ম হৈল যার।
জন্ম সার্থক করি কর #পরোপকার।।
– (শ্রীচৈতন্য চরিতামৃত, আদিলীলা ৯/৪১)
অনুবাদঃ এই পৃথিবীতে যার জন্ম হল, সেই সমস্ত মনুষ্যের কর্তব্য হল কৃষ্ণভক্তির অনুশীলন করে তার নিজের জন্মকে সার্থক করা,এবং সাথে সাথে কৃষ্ণভক্তির অনুশীলন করার জন্য অপরকে উৎসাহিত করে তাদের উপকার সাধন করা।
২. অসহায় পশুপাখীদের প্রতি মানবের দয়া:
মানবের কর্তব্য হল অসহায় পশু-পাখীদের খাবার, বাসস্থান, চিকিৎসা দ্বারা প্রতিপালন করা। নিজের জিহ্বা তৃপ্তির জন্য নির্মমভাবে পশুদের হত্যা করে তাদের মাংস ভোজন করা উচিত নয়। একে বলা হয় অসহায় পশুপাখীর প্রতি মানবের দয়া।
অসহায় প্রানীদের হত্যা করে তাদের মাংস ভোজন করা সভ্য মানবের কর্ম নয়। ঈশ্বর মানবের আহার হিসেবে শাক-সবজি, ফল, দুধ আদি খাবারের বিধান রেখেছেন। কেননা শাক-সবজি আদি বৃক্ষের চেতনা আচ্ছাদিত। তাই ছাগল, ভেড়া আদি পশুদের হত্যা করলে তারা যেরূপ কষ্ট পায়, বৃক্ষাদি সেরূপ কষ্ট পায় না। তাই, শাস্ত্রে নির্দেশিত খাবার পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে নিবেদন করে প্রসাদরূপে গ্রহণ করতে শাস্ত্রে উপদেশ দেয়া হয়েছে।
বেদ, মনুস্মৃতি, শ্রীমদ্ভাগবত আদি অষ্টাদশ পুরাণ, মহাভারত ইত্যাদি শাস্ত্র অধ্যয়ন করলে আমরা বুঝতে পারবো যে পশু-পাখিদের হত্যা করে তাদের মাংস ভোজন করা মহাপাপ। এই মহাপাপের ফল হলো কুম্ভিপাক নরক।
यस्त्विह वा उग्र: #पशून्_पक्षिणो_वा_प्राणत_उपरन्धयति तमपकरुणं पुरुषादैरपि विगर्हितममुत्र यमानुचरा: कुम्भीपाके तप्ततैले उपरन्धयन्ति ॥
যস্ত্বিহ বা উগ্রঃ পশূণ_পক্ষিণো_বা_প্রাণত_উপরন্ধয়তি তমপকরুনং পুরুষাদৈরপি বিগর্হিতমমুত্র যমানুচরা কুম্ভীপাকে তপ্ততৈলে উপরন্ধতি।।
– (শ্রীমদ্ভাগবত ৫।২৬।১৩)
অনুবাদঃ যে নিষ্ঠুর ব্যক্তি অসহায় পশু-পাখীদের হত্যা করে তাদের মাংস রন্ধন করে ভক্ষণ করে তারা রাক্ষসদের দ্বারাও নিন্দিত।সে নিষ্ঠুর ব্যাক্তিকে যমপুরুষগণ কুম্ভীপাক নরকে তপ্ততৈলে রন্ধন করেন।
अनुमन्ता विशसिता निहन्ता क्रयविक्रयी ।
संस्कर्ता चोपहर्ता च खादकश्चेति #घातकाः ॥
অনুমন্তা বিশসিতা নিহন্তা ক্রয়বিক্রয়ী।
সংস্কর্ত্তা চোপহর্ত্তা চ খাদকশ্চেতি ঘাতকাঃ।।
– (মনুসংহিতা ৫/৫১)
অনুবাদঃ পশু বধ করার জন্য যিনি আজ্ঞা করেন, যিনি মাংস কর্তন করেন, যিনি পশু বধ তথা হত্যা করেন, যিনি মাংস ক্রয় করেন এবং যিনি মাংস বিক্রয় করেন, যিনি মাংস রন্ধন করেন, যিনি মাংস পরিবেশন করেন এবং যিনি সে মাংস ভোজন করেন,তারা সকলে ঘাতক অর্থাৎ হত্যাকারী আর পাপী।
सनादग्ने मृणसि यातुधानान्न त्वा रक्षांसि पृतनासु जिग्युः ।
अनु दह सहमूरान्क्रव्यादो मा ते हेत्या मुक्षत दैव्यायाः ॥
– (ঋগ্বেদ ১০/৮৭/১৯)
পাষন্ড তারা যারা প্রানি-মাংস ভোজন করে। তারা যেন প্রকারান্তরে বিষপান করে। ঈশ্বর তাদের যেন উপযুক্ত শাস্তি প্রদান করেন।
इमं मा #हिसीरेकशफं_पशुं कनिक्रदं वाजिनं वाजिनेषु। गौरमारण्यमनु ते दिशामि तेन चिन्वानस्तन्वो निषी॑द। गौरं ते शुगृच्छतु यं द्विष्मस्तं ते शुगृच्छतु ॥
ইমং মা হিংসীরেকশফং_পশুং কনিক্রদং বাজিনং বাজিনেষু ।গৌরমারণ্যমনু তে দিশামি তেন চিন্বানস্তন্বো নি ষীদ ।গৌরং তে শুগৃচ্ছতু॒ যং দ্বিষ্মস্তং তে শুগৃচ্ছতু ॥
– (শুক্ল যজুর্বেদ ১৩/৪৮)
অনুবাদঃ অশ্বাদি ক্ষুরবিশিষ্ট পশুদের কখনো হত্যা করো না, তাদের পালন করা কর্তব্য। উপকারী পশুদের সর্বদা সংরক্ষণ করবে। আপদকালে গৌরমৃগাদি ক্ষতিকর পশুদের হত্যা করা অনুচিত নয়।
अनागोहत्या वै भीम कृत्य मा नो गमस्वाङ्ग पुरुषशंग बधि:।
অনাগোহত্যা বৈ ভীমা কৃত্য মা নো গামশ্বং পুরুশং বধীঃ।
– অথর্ববেদ ১০/১/২৯
অনুবাদঃ নিরীহের হত্যা অতি ভয়ংকর এক কর্ম, কখনো মানুষ বা গো-অশ্বাদি প্রাণীদের কে হত্যা করো না।
यो यस्य मांसमश्नाति स तन्मांसाद उच्यते ।
मत्स्यादः सर्वमांसादस्तस्मान् मत्स्यान् #विवर्जयेत् ॥
যো যস্য মাংসমশ্নানি স তন্মাংসাদ উচ্যতে।
মৎস্যাদঃ সর্বমাংসাদস্তস্মান্মৎস্যান বিবকর্জেয়ৎ।।
-( মনুসংহিতা ৫/১৫)
অনুবাদঃ যে যার মাংস খাই তাকে তার মাংসভোজী বলে।কিন্তু যে মৎস্যাদ অথাৎ মৎস্যভোজী তাকে সর্বমাংসভোজী বলা হয়। অতএব, মৎস্য ভোজন পরিত্যাগ করবে।
হরে কৃষ্ণ।প্রনাম।
©️ স্বধর্মম্ ™️