কৃষ্ণভক্তিতে আহার একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। আমরা যেরকম খাদ্য গ্রহণ করি, সেইরকম কোষ দ্বারা আমাদের শরীরও গঠিত হয়। আর এটি অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই যে- খাদ্যাভ্যাস সরাসরি আমাদের চেতনাকে প্রভাবিত করে। আমরা যদি প্রকৃতির দিকে তাকাই, তাহলে খুব সহজেই বুঝতে পারবো যে- শাকাহারী প্রাণীদের আচরণ, মাংসাশী প্রাণীদের আচরণ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। পশুকূলেও খাদ্যের প্রভাবে আচরণে ভিন্নতা দেখা যায়।
প্রশ্ন: তাহলে মনুষ্য সমাজের মধ্যে যারা পরমেশ্বরকে সবসময় হৃদয়ে ধারণ করতে চান তাদের আহার কেমন হওয়া উচিত,?
উত্তর: আহার সর্বদাই সাত্বিক হওয়া উচিত। কেননা সত্ত্বগুণ সুখপ্রদ, রজগুণ সুখ-দুঃখ প্রদায়ক, তমগুণ কেবলই দুঃখদায়ক। বৈদিক শাস্ত্রে বর্ণিত হয়েছে-
आहारशुद्धौ सत्त्वशुद्धिः। सत्त्वशुद्धौ ध्रुवा स्मृतिः।
स्मृतिलम्भे सर्वग्रन्थीनां विप्रमोक्षः॥
আহারশুদ্ধৌ সত্ত্বশুদ্ধিঃ, সত্ত্বশুদ্ধৌ ধ্রূবা স্মৃতিঃ।
স্মৃতিলম্ভে সর্বগ্রন্থীনাং বিপ্রমোক্ষঃ।।
আহার শুদ্ধ হলে,তার ফলে জীবের সত্তা শুদ্ধ হয়। সত্ত্বা শুদ্ধ হলে স্মৃতি শুদ্ধ হয় এবং তখন সে মোক্ষ বা জড় জগৎ থেকে মুক্তি লাভের পথ খুজে পায়❞ (ছান্দোগ্য উপনিষদ: ৭/২৬/২)
শাস্ত্রে প্রকৃতির তিন গুণ অনুসারে আহারকেও তিনটি শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয়েছে। প্রধানত তমগুণ থেকে প্রমাদ আলস্য উৎপন্ন হয়; রজগুণ থেকে কাম; সত্ত্বগুণ থেকে জ্ঞান। আর তাই ইন্দ্রিয়সমূহে যদি জ্ঞানের প্রকাশ না ঘটে তবে কি করে পরমেশ্বর ভগবানকে জানতে পারা যায়? এজন্য যেসকল পরমার্থবাদীগণ পরমেশ্বর ভগবানকে জানতে ইচ্ছা করেন কিংবা তাঁর নিকট শরণাগত হন তারা অবশ্যই সাত্বিক আহার গ্রহণ করেন। অন্যথায় রজ ও তম গুণ সম্পন্ন হলে জ্ঞানের বিপরীত প্রকাশের কারণে পরমেশ্বরকে সর্বদা হৃদয়ে অনুভব করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়।
প্রশ্ন: যদি আহার শুদ্ধ সাত্বিক হলেই আহার গ্রহণকারীর ইন্দ্রিয়ে জ্ঞানের প্রকাশ ঘটে, ফলে ভগবানকে জানা যায়, তাহলে আহার কিরূপে শুদ্ধ করতে হয় বলুন?
উত্তর: ❝যজ্ঞ বৈ বিষ্ণু❞ যজ্ঞই বিষ্ণু। শতপথ ব্রাহ্মণ: ১|১|৪|৫ পরমেশ্বর ভগবান শ্রীবিষ্ণুর আরেক নাম যজ্ঞ। যে প্রক্রিয়ায় পরমেশ্বর ভগবান শ্রীবিষ্ণুর উদ্দেশ্যে কোনোকিছু নিবেদন করা হয় সেটিকেও যজ্ঞ বলা হয়। তাই এভাবে ভোগ্যবস্তু নিবেদনের ফলে বস্তুর জড় কলুষ বিদূরিত হয়ে শুদ্ধ হয়, অর্থাৎ খাদ্যদ্রব্য যখন পরমেশ্বর ভগবানকে উৎসর্গ করে তাঁর প্রসাদরূপে গ্রহণ করা হয় তখন সেই বস্তুর জড় গুণ ভোক্তাকে স্পর্শ করে না। পরমেশ্বর যেরূপ নির্গুণ ঠিক সেরূপ তাঁর নিকট অর্পিত বস্তুও তাঁর প্রভাবে নির্গুণ হয়ে চিন্ময়ত্ব প্রাপ্ত হয়। আর এভাবেই যদি কেউ বিষ্ণুকে কেন্দ্র করে জীবিকা নির্বাহ করেন তবে তিঁনি এই জড় জগতে বাস করলেও জড় গুণ তাঁকে স্পর্শ করতে পারে না, তিঁনি গুণাতীত হয়েন।
প্রশ্ন: যদি এমন ব্যক্তির রন্ধন আহার করি যে- পরমেশ্বর ভগবান শ্রীবিষ্ণুকে কেন্দ্র করে জীবিকা নির্বাহ করে না এবং যা পরমেশ্বরের উদ্দেশ্যে নিবেদিত হয়নি, তাহলে সেই আহার কি গ্রহণকারীকে ত্রিগুণে আবদ্ধ করে?
উত্তর: হ্যাঁ, অবশ্যই। শুধু রন্ধনেই যে রন্ধনকারীর গুণের প্রভাব পড়ে এমন না, বরং ঐ ব্যক্তির সমস্ত আচরণেই তা প্রকাশ পায় এবং ঐ ব্যক্তিকে অনুসরণ করলে সেই ব্যক্তি যে গুণের স্থিতিতে অবস্থিত আছেন সেটাও অনুসরণকারীকে প্রভাবিত করে। এই গুণের বিনিময় অতি সুক্ষ্মভাবে সংঘটিত হয়ে থাকে। ব্রহ্মজ্ঞ তথা আত্মজ্ঞানী ব্যক্তিগণ তা স্পষ্টত দেখতে পান। বিশেষ করে শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত: অন্ত্যলীলা- ০৬|২৭৮ শ্লোকে বর্ণিত হয়েছে-
বিষয়ীর হাতে অন্ন খাইলে মলিন হয় মন।
মলিন মন হৈলে, নহে কৃষ্ণের স্মরণ।।
বিষয়ীর হাতে রান্না করা খাবার গ্রহন করলে মন মলিন হয়, তখন পরমাত্মা শ্রীকৃষ্ণকে স্মরণ করা অসম্ভব হয়ে যায়।
চৈতন্য মহাপ্রভু বলেছেন, যদি কেউ কোনো জড় বিষয় আসক্ত ব্যক্তির রন্ধনকৃত খাবার গ্রহণ করে, তবে সেই ব্যক্তির হৃদয়েও বিষয় আসক্তি জাগরিত হবে।
কারণ, চিন্তা-চেতনার বহিঃপ্রকাশ ব্যাক্তির কার্যে প্রকাশিত হয়। এভাবেই কেউ যখন রন্ধন করে, তখন সেই ব্যাক্তি কোন মনোভাব নিয়ে রান্না করছে সেটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সেই রাঁধুনি কি কৃষ্ণের ভোগের জন্য রান্না করছে এবং সে কি কৃষ্ণকে খুশি করার জন্য রান্না করছে এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিক। কেননা কৃষ্ণ পরমেশ্বর ভগবান, জড়-চেতন সমস্ত কিছুর উৎস। তাঁর কোনো কিছুর প্রয়োজন নেই। কিন্তু তিঁনি ভক্তের ভাবটা অনুভব করেন। তিঁনি কেবল ভক্তের প্রেমময়ী ভাবের ভক্তিপ্লুত উপহার গ্রহণ করেন। যে ব্যক্তি ভগবানকে বাদ দিয়ে কেবল নিজের জিহ্বার স্বাদের কথা চিন্তন করতে করতে রান্না করে, তাঁর সেই রান্না ভগবান কেন গ্রহণ করবেন? যেহেতু তা ভগবান গ্রহণ করেন না, সেহেতু তাঁর ভক্তরা কিভাবে তা গ্রহণ করতে পারেন? কারণ ভগবদ্ভক্তরা ভগবদ্প্রসাদ ব্যতীত অন্য কিছু গ্রহণ করেন না।
আর তাই যখনই কোনো ব্যক্তির বিষয়ের প্রতি আসক্তি জন্মায় এর বিপরীতে সেই ব্যক্তির কৃষ্ণের প্রতি বিরক্তিও জন্মায়। কেননা বিষয় আসক্তি জীবকে ভোগবাসনায় প্রলুব্ধ করে। আর ভোগবাসনা জীবকে কৃষ্ণ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়।
তাই দেখা যাচ্ছে আহারের গুণগত অবস্থা অবশ্যই আহারকারীকে প্রভাবিত করে।
প্রশ্ন: এই যে আহারের মাধ্যমে এক ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তিতে প্রকৃতির ত্রিগুণের স্থানান্তর ঘটে, এটা কি দার্শনিক বা বৈজ্ঞানিক উপায়ে ব্যাখ্যা করা যায়?
উত্তর: ধরুন একজন চিত্রশিল্পী তার হাত দিয়ে চিত্র অংকন করে কোনো এক চিত্র দেওয়ালে কিংবা কাগজে ফুটিয়ে তুলছে, কিন্তু তোলার পূর্বে চিত্রটি সে তার চিন্তায় চেতনায় অবশ্যই অংকন করে। সেই ব্যক্তির মননে চিত্র সম্পর্কিত যেরূপ ধারণা চিত্রিত হয়, সে তার চিত্রকর্মে তা প্রকাশ করে, আর তখন সেই চিত্র দেখেই আমরা আকর্ষিত বা বিকর্ষিত হই। এভাবেই সমস্ত ক্রিয়া সাধনের পূর্বে প্রত্যেক জীবের চিন্তা- চেতনায় সুক্ষ্মভাবে সেই ক্রিয়া তৈরি হয়, পরে ক্রিয়া কর্তার ইচ্ছায় তা বাস্তবে রূপ নেয়।
রন্ধনের বেলায়ও একই ব্যবস্থা অব্যাহত থাকে, রন্ধনকারী যেইরূপ চিন্তা নিয়ে রান্না করবেন সেইরপ গুণ সম্পন্নভাবেই তা প্রস্তুত হবে। আর সেই রন্ধনকৃত খাদ্য গ্রহণের ফলে আহারকারী ব্যক্তিও খাদ্যের গুণগত (সত্ব, রজ, তম) অবস্থার দ্বারা সাত্বিকী, রাজসিকী, তামসিকী এই তিন প্রকারে প্রভাবিত হয়ে পড়েন।
পরিশেষে এটাই বলা যায় যে, এই জড় জগতের ত্রিগুণ (সত্ত্ব, রজ, তম) জীবকে এজগতে আবদ্ধ করে রাখে। পক্ষান্তরে, যদি কেউ এই জগত থেকে মুক্তি লাভের প্রয়াসী হয়, তবে তাকে অবশ্যই ত্রিগুণ থেকে মুক্ত হতে হবে। আর তাই সেই স্তরে উন্নীত হতে হলে অবশ্যই সমস্ত গুণের অতীত, ইন্দ্রিয়ের অধীশ্বর, পরম বাস্তব বস্তু, আদিপুরুষ পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শরণাগত হতে হবে। তবেই সেই গুণাতীত চৈতন্য অবস্থায় প্রকাশিত হবে। তখন প্রকৃত বাস্তবতা দর্শন করা সম্ভব। ঈশ্বর, জীব, প্রকৃতি, কাল ও কর্ম সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ সম্ভব। এজন্য বিবেকী ব্যক্তিগণ শ্রীকৃষ্ণ’কে পরমেশ্বর ভগবান হিসেবে স্বীকার করে তাঁর শরণাগত হন।
✍️ প্রবীর চৈতন্য চন্দ্র দাস
© স্বধর্মম্ ™