মানব জীবনে পরমেশ্বর ভগবান জগন্নাথদেবের রথযাত্রা মহোৎসব এক মহা সৌভাগ্যের নাম। জগন্নাথ শব্দের অর্থ হল জগতের নাথ।নাথ শব্দের অর্থ হল প্রভু বা ঈশ্বর।সমগ্র শাস্ত্রের ন্যায় শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ১০/৮ শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ নিজেকে সমগ্র জগতের ঈশ্বররুপে অর্জুনকে শিক্ষা প্রদান করেন(“অহং সর্বস্য প্রভবো মত্তঃ সর্বং প্রবর্ততে। ইতি মত্বা ভজন্তে মাং বুধা ভাব-সমন্বিতাঃ॥”)।সে শ্রীকৃষ্ণই হলেন স্বয়ং জগন্নাথ।
সাধারণত ঈশ্বররুপে জগন্নাথ মন্দিরে তার ভক্তদের দ্বারা সেবা গ্রহণ করেন।মন্দিরে কেউ তাঁর দর্শনাকাঙ্খী হলে তিনি তাঁকে দর্শন দান করে ভক্তের মনোভিলাষ পূর্ণ করেন।ভক্ত জগন্নাথকে দর্শন করে আনন্দ লাভ করেন।কিন্তু জগন্নাথদেবের রথযাত্রা হল সে এক আনন্দঘন দিন,যে সময় জগন্নাথ স্বয়ং সকলকে দর্শন দান করতে মহাশোভাযাত্রা সহকারে রাস্তায় নেমে আসেন।তখন যারা কখনো জগন্নাথকে দর্শন করতে মন্দিরে যান নি,তাঁরাও ভগবানের এই অসাধারন রুপ দর্শন করে ক্ষনিকের জন্য বিস্মিত হন।ইচ্ছা বিহীন এসমস্ত মানুষেরাও জগন্নাথের কৃপা লাভ করেন।
আর সে সময় সৌভাগ্যবান ভক্তগণ তাঁকে দর্শন করে মৃদঙ্গ,করতাল,শঙ্খ ধ্বনির মাধ্যমে উচ্চস্বরে হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্র কীর্তন করতে করতে নৃত্য করেন।এছাড়াও ভক্তরা তখন জগন্নাথ ভগবানকে রথের দঁড়ি দিয়ে টেনে গুন্ডিছা মন্দিরে নিয়ে যান।
স্কন্দ পুরাণ,বিষ্ণুক্ষেত্র, পুরুষোত্তমক্ষেত্র মাহাত্ম্য, ত্রয়ত্রিংশ (৩৩ তম) অধ্যায়ে পরমেশ্বর ভগবান জগন্নাথদেবের রথযাত্রার বিধান প্রদত্ত হয়েছে। স্কন্দ পুরাণ,বিষ্ণুক্ষেত্র, পুরুষোত্তমক্ষেত্র মাহাত্ম্য,প্রথম অধ্যায় ৬-৮ নং শ্লোকের বর্ণনা অনুযায়ী, জৈমিনি ঋষি মন্দর পর্বতে কার্তিকের মুখপদ্ম থেকে এ বিষয়ে শ্রবণ করেন।এবং কার্তিক তার পিতা মহাদেব শিবের কাছে তা শ্রবণ করেছিলেন।
মুদা পরময়া ভক্ত্যা যুত কুর্যাৎ মহোৎসব।।৩৪।।
আষাঢ়স্য সিতে পক্ষে দ্বিতীয়া পুষ্যসংযুতা।৩৫।।
(স্কন্দ পুরাণঃবিষ্ণুক্ষেত্র, পুরুষোত্তমক্ষেত্র মাহাত্ম্য, ৩৩ /৩৪-৩৫)
অনুবাদঃ জৈমিনি বললেন,হে মুনিগণ, আষাঢ়মাসের শুক্লপক্ষের পুষ্যানক্ষত্রযুক্ত দ্বিতীয়াতে পরম ভক্তিসহকারে সানন্দচিত্তে ভগবানের রথযাত্রা মহোৎসব পালন করবেন।
সত্যং সত্যং পুনঃ সত্যং প্রতিজানে দ্বিজোত্তমাঃ।
নাতঃ শ্রেয়ঃ পরো বিষ্ণোরুৎসবঃ শাস্ত্রসম্মতঃ।
যথা রথবিহারোহয়ং মহাবেদী মহোৎসবঃ।।
–স্কন্দ পুরাণঃবিষ্ণুক্ষেত্র,পুরুষোত্তমক্ষেত্র মাহাত্ম্য,৩৩ /১-২
অনুবাদঃ ওহে সর্বোৎকৃষ্ট ব্রাহ্মণগণ,আমি সত্য বলছি, সত্য এবং পুনঃ সত্যরুপে ঘোষণা করছি, শাস্ত্রানুসারে ভগবান বিষ্ণুর যত উৎসব আছে, রথযাত্রার সাথে তাদের কোনো তুলনা করা যায় না। সেই উৎসব যেখানে ভগবান মহাবেদীতে গমনের উদ্দেশ্যে রথের ওপর আরোহণ করেন।
যত্রাগত্য দিবো দেবাঃ স্বর্গং যান্ত্যাধিকারিণঃ।
কিং বচমি তস্য মাহাত্ম্যমুৎসবস্য মুরদ্বিষঃ।।৫৭।।
যস্য সঙ্কীর্তনাৎ পাপং নশ্যেজন্মশতোদভয়ং।।৫৮।।
মহাবেদীং ব্রজন্তং তং রথস্থং পুরুষোত্তমম।
বলভদ্রং সুভদ্রাঞ্চ জন্মকোটিশতোদ্ভবম।
দৃষ্ট্বা পাপং নাশয়তি নাত্র কার্য্যা বিচারণা।।৫৯।।
রথচ্ছায়াং সমাক্রম্য ব্রহ্মহত্যাং ব্যাপোহতি।
তন্দ্রেনুসংসক্তবপুস্ত্রিবিধাং পাপসংহতিম।
নাশয়েৎ স্বর্গগঙ্গায়াং স্নানজং ফলমাপ্লুয়াৎ।।৬০।।
–স্কন্দ পুরাণঃবিষ্ণুক্ষেত্র, পুরুষোত্তমক্ষেত্র মাহাত্ম্য, ৩৩ /৫৭-৬০
অনুবাদঃ ভগবান মুরারির (জগন্নাথদেবের) সেই উৎসব মাহাত্ম্য (রথযাত্রা) সম্পর্কে আর অধিক কি বলব,ঐ দিন দেবগণ স্বর্গ হতে ঐ উৎসবে আগমন করে স্বর্গবাসের অধিকারী হন এবং তার ফলে তারা পুনরায় স্বর্গে গমন করতে পারেন।ঐ উৎসবে নামসংকীর্তন করলে শতজন্মের পাপ বিনষ্ঠ হয়।মহাবেদীতে গমনের সময়, রথের উপর পুরুষোত্তম( জগন্নাথ), বলদেব এবং সুভদ্রাকে দর্শন করে মানবের যে কোটিশত জন্মার্জ্জিত পাপ বিনষ্ট হয়,তা বিচার করার নয়।ভগবানের রথচ্ছায়া স্পর্শ করলেই ব্রহ্মহত্যার পাপ বিদূরিত হয়।এবং শরীরে রথরেণু স্পর্শ হলে ত্রিবিধ পাপরাশি বিনষ্ঠ হয় এবং স্বর্গগঙ্গা স্নানের ফল লাভ হয়।
ঘনাম্বুবৃষ্টিযোগেন রথমার্গে তু পঙ্কিলে।
দিব্যদৃষ্ট্যা চ কৃষ্ণস্য সমস্তমলহারিনি।।৬১।।
তত্র যে প্রণিপাতাংস্তু কুর্ব্বতে বৈষ্ণবোত্তমাঃ।
অনাদিব্যুঢ়পঙ্কাংস্তে হিত্বা মোক্ষবাপ্লুয়ুঃ।।৬২।।
গবাং কোটিপ্রদানস্য কন্যানামযুতস্য চ।
বাজিমেধসহস্রস্য ফলং প্রাপ্নোত্যাসংশয়।।৬৩।।
–স্কন্দ পুরাণঃবিষ্ণুক্ষেত্র, পুরুষোত্তমক্ষেত্র মাহাত্ম্য, ৩৩ /৬১-৬৩
অনুবাদঃ ঘন বৃষ্টিপাতে রথযাত্রার পথ পঙ্কিল(কষ্ঠসাধ্য) হলে, সে পঙ্কিল পথ শ্রীকৃষ্ণের দিব্যদৃষ্টিপাতে সুগম হয়।সে সময় বৈষ্ণবগণ পথে মস্তক স্থাপনপূর্বক ভগবানকে প্রনাম নিবেদন করলে তাদের অসীম পাপরাশি বিনষ্ঠ হয়ে মোক্ষ প্রাপ্তি হয়।এবং তারা কোটি গো-দান,অযুত কন্যা দান,সহস্র অশ্বমেধ যজ্ঞের ফল লাভ করেন,এতে সংশয় নাই।
অনুগচ্ছন্তি কৃষ্ণং যে যাত্রা কৌতুহলাদপি।
অনুব্রজন্তি নিত্যং তান দেবা শত্রুপুরোগমাঃ।।৬৪।।
-স্কন্দ পুরাণঃবিষ্ণুক্ষেত্র,পুরুষোত্তমক্ষেত্র মাহাত্ম্য৩৩ /৬৪
অনুবাদঃ ভগবানে ভক্তি না থাকলেও যারা কৌতুকবশত জগন্নাথদেবের রথযাত্রায় ( কৃষ্ণং যে যাত্রা) গমন করেন, ইন্দ্রাদি দেবগণ সর্বদা তাদের পিছনে পিছনে গমন করেন।
জয় জগন্নাথ। হরে কৃষ্ণ। প্রণাম
©️ স্বধর্মম্ : Connect to the inner self