মানুষের খাদ্য কি? মানুষ কি শাকাহারি-মাংসাশী নাকি সর্বভুক?

20250614_235335

এর উত্তরে এক কথায় বলতে হয় মানুষ শাকাহারী নিরামিষভোজী প্রাণী। শাক-সবজি, ফল-মূল এবং দুধ-দুগ্ধজাত দ্রব্যাদি হলো মানুষের আদর্শ খাদ্য।

অবশ্যই পশুহিংসা (পশুহত্যা) করে সেই পশুর মাংস আহার করা অন্তত সভ্য মানুষের কাম্য নয়। পশুহত্যা করে পশুমাংস আহারকে নিন্দা জানিয়ে বৈদিক অনুশাসন শাস্ত্র বর্ণনা করছে-

स्वमांसं परमांसेन यो वर्द्धयितुमिच्छति।

अनभ्यर्च्य पितॄन् देवान् ततोऽन्यो नास्त्यपुण्यकृत् ॥

স্বমাংসং পরমাংসেন যো বর্দ্ধয়িতুমিচ্ছতি।

অনভ্যর্চ্য পিতৃন্ দেবান্ ততো’ন্যো নাস্ত্যপুণ্যকৃৎ ॥

যে ব্যক্তি পরকীয় মাংস দ্বারা __ আপনার মাংস বর্ধন করিতে ইচ্ছা করে, তাহা হইতে পাপকারী আর জগতে কেহই নাই। (মনুসংহিতা: ৫/৫২)

मांसभक्षयिताम् उत्र यस्य मांसम् इह अद्म्यहम्।

एतन्मांसस्य मांसत्वं प्रवदन्ति मनीषिणः ॥

মাংসভক্ষয়িতামুত্র যস্য মাংসমিহাদ্ম্যহম্।

এতন্মাংসস্য মাংসত্বং প্রবদন্তি মনীষিণঃ ॥

ইহলোকে আমি যাহার মাংস ভোজন করিতেছি, পরলোকে সে আমাকে ভক্ষণ করিবে। পণ্ডিতেরা মাংস শব্দের অর্থ (‘মাং’ আমায়, ‘সঃ’ সে ভোজন করিবে) এইরূপ প্রতিপন্ন করিয়াছেন। (মনুসংহিতা: ৫/৫৫)

প্রকৃতির ৮৪ লক্ষ প্রজাতির জীব যোনি রয়েছে৷ এই সমস্ত জীবগণ স্ব স্ব প্রকৃতিতে নির্ধারিত খাদ্যই গ্রহণ করেন। তারা কেউই প্রকৃতির আইন অমান্য করে নির্ধারিত খাদ্য ব্যতিরেকে ভিন্ন খাদ্য গ্রহণ করেন না। যেমন- মাংসাশী প্রাণী বাঘ বা’ সিংহ যতই ক্ষুধার্ত থাকুক না কেন, সে কখনোই জঙ্গলের ফলমূল খেতে যাবে না। কিংবা শাকাহারী প্রাণী হরিণ, হাতি, ঘোড়া, খরগোশ, জিরাফ এরাও কখনো ক্ষুধার্ত থাকলে মাংস খায়না। প্রকৃতপক্ষে মানুষ ব্যতীত অন্য সকল জীব প্রকৃতির আইন বাধ্য হয়েই মেনে নেয়। আরেকটু বুঝিয়ে বললে- তাদের চেতনা সেই নির্ধারিত খাদ্যবস্তু ব্যতীত অন্য খাদ্যের কথা চিন্তাই করতে পারে না। ঠিক যেমন বর্তমান রোবটিক্স সিস্টেমের মতো, যেমনটি প্রোগ্রামিং করে দিবেন সেই অনুযায়ী কার্য সম্পাদন করবে।

তো এই ৮৪ লাখ জীব প্রজাতির মধ্যে কেবল মনুষ্য প্রজাতিতে কিঞ্চিৎ স্বতন্ত্রতা (স্বাধীনতা) রয়েছে সেই স্বাধীনতার ব্যবহার করে সে প্রকৃতির আইন মানতেও পারে অথবা ভাঙতেও পারে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, রাষ্ট্র প্রণীত আইন কেউ মানছে আবার কেউ ভাঙছে। যিনি মানছেন তিনি রাষ্ট্রের সুনাগরিক আর যিনি ভঙ্গ করছেন রাষ্ট্র তাকে শাস্তি দিচ্ছে। ঠিক তেমনি পরমেশ্বর ভগবান কর্তৃক প্রণীত এই প্রকৃতি আইন (বৈদিক ধর্ম) যিঁনি মানছেন তিঁনি ভক্ত, অন্যদিকে যিনি অবজ্ঞা করছেন! তিনি কি পার পেয়ে যাচ্ছেন ভাবছেন!?না। একটি প্রচলিত প্রবাদ আছে- ❝পাগলে কি না বলে; আর ছাগলে কি না খায়?❞ বর্তমান সমাজের মানুষের অবস্থাও ঠিক তেমনি। যা খাওয়া উচিত নয় তাই আইন অমান্যপূর্বক ভক্ষণ করছে। এদের মধ্যে অনেকে আবার ব্যঙ্গাত্মকভাবে বলে থাকেন শাকাহারী ভোজনে শক্তি থাকে না, প্রয়োজনীয় সকল পুষ্টি না থাকায় শরীর রোগা হয়ে যাবে ইত্যাদি ইত্যাদি। আসলে এটা তাদের অজ্ঞানতা, নইলে এতো বড় শাকাহারী “প্রাণী” হাতি তাদের দৃষ্টির অগোচরে রয়ে গেলো কিভাবে আমার বোধগম্য নহে! না-কি অজ্ঞানতা এভাবেই অন্ধ করে রাখে?

এদের আরেকটি অতিজ্ঞানী দল আবার বৈজ্ঞানিক যুক্তিতর্ক দ্বারা বোঝাতে চান যেহেতু শাকসবজি উদ্ভিদেরও প্রাণ আছে, তাই খাওয়ার জন্য যেহেতু প্রাণের হত্যা হবেই, সেহেতু পশুহত্যা করে মাংস খেলে অসুবিধা কোথায়!

তাদের জন্য বেদান্তসূত্রের অকৃত্রিম ভাষ্য শ্রীমদ্ভাগবত (১/১৩/৪৭) পূর্ব হতেই বর্ণনা করেছেন, যেখানে-

अहस्तानि सहस्तानामपदानि चतुष्पदाम् ।

फल्गूनि तत्र महतां जीवो जीवस्य जीवनम् ॥

❝जीवो जीवस्य जीवनम्__জীবো জীবস্য জীবনম্❞ অংশটি তাৎপর্যপূর্ণ অর্থাৎ, এক জীব অন্য জীবের খাদ্য। তাই, যদি খাদ্যের নির্ভরশীলতার কথা চিন্তা করি, তবে কি মানুষ খাদ্য হিসেবে মানুষের মাংস খায়? অবশ্যই না। সর্ব-উপরিউক্ত মনুসংহিতার উদ্ধৃতি আমাদেরকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে খাদ্য গ্রহণের জন্য পশুহত্যা কতটা গর্হিত এবং গুরুতর শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তাই যাদের হৃদয়ে মনুষ্যত্ববোধ আছে, যারা সভ্য তারা কখনও পশুমাংস আহার করে নিজেদের ইন্দ্রিয় (জিহ্বা) তৃপ্তির জন্য নিরীহ পশুদের হত্যা করেন না।

তাহলে মানুষের খাদ্য কি? প্রথমেই বলা বাহুল্য পবিত্র বেদে বলা হয়েছে “সর্বং খলিদং ব্রহ্ম” সবকিছুতেই প্রাণের অস্তিত্ব বিদ্যমান [ছান্দোগ্য উপনিষদ- ৩/১৪/১]। তাই ৮৪ লক্ষ প্রকার জীবের, প্রত্যেকেরই চেতনানুসারে তার বেদনার অনুভূতি হয়ে থাকে। যে জীব যতবেশি উন্নত চেতনা সম্পন্ন সেই জীবকে ততই উন্নত মানা হয় এবং তার অনুভূতিও ততই প্রখর। যেমন- মানুষ। এভাবেই চেতনানুসারে জীবের শ্রেণীবিন্যাস করা হয়েছে।

বৈদিক শাস্ত্রের বর্ণনায় চেতনানুসারে সেই বিন্যাস তালিকায় মানুষের পরেই গোরুর স্থান, এভাবে সর্বনিম্ন চেতনাসম্পন্ন জীব হচ্ছে উদ্ভিদ-বৃক্ষ আদি। উদ্ভিদ যেহেতু নিম্ন চেতনাসম্পন্ন জীব তাই উদ্ভিদের অনুভূতিও অতি সামান্য। তাই বলে উদ্ভিজ্জ খাদ্যদ্রব্য গ্রহণ করলেও সম্পূর্ণভাবে প্রাণীহত্যা জনিত অপরাধ থেকে মুক্ত থাকা যায় না, যতটা বেদনা সেই উদ্ভিদ মৃত্যুর সময়ে প্রাপ্ত হয়েছে ঠিক ততটাই বেদনা (দুঃখ) সেই উদ্ভিদকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণকারীকে পেতে হবে। নিউটনের তৃতীয় সূত্রের সংজ্ঞা আমাদের কি শেখাচ্ছে? ❝প্রত্যেক ক্রিয়ার একটি সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া রয়েছে।

❝Every action, there is an equal and opposite reaction.❞

এটি মূলত বৈদিক শাস্ত্রের ❝কর্মফল❞ তত্ত্বকে নির্দেশ করে অর্থাৎ, যেমন কর্ম তেমন ফল।

যখন কোনো প্রাণী যখন শরীরের কোনো অংশে ব্যাথা অনুভব করে তখন সেই ব্যাথা সম্পূর্ণ শরীরে বিস্তৃত হয়ে থাকে। ব্যাথার পরিমাণ কম হলে তা শরীরের সর্বত্র পৌঁছানোর পূর্বেই প্রশমিত হয়ে যায়। কিন্তু মৃত্যুর মতো যন্ত্রণা সম্পূর্ণ শরীরে বিস্তৃত হয়।

তাই যখন খাদ্যের জন্য কোনো প্রাণীকে হত্যা করা হলো তখন সেই প্রাণী যে যন্ত্রণা অনুভব করে সেই যন্ত্রণা সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। আর আপনি যখন সেই শরীরের অংশ (মাংস) খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করছেন তার মানে আপনি খাদ্যের সহিত সেই যন্ত্রণাকেও গ্রহণ করছেন।

অপরপক্ষে উদ্ভিজ্জ খাদ্য গ্রহণ করতে গেলে সবসময় আপনাকে সেই উদ্ভিদকে হত্যা করতে হয়না। যেমন ঢেড়স গাছ থেকে ঢেড়স পাড়লে গাছ মরে যায়না। লাউগাছ থেকে লাউ পাড়লে গাছ মরে যায় না, এভাবে অসংখ্য উদাহরণ দেওয়া যাবে।

যদি ধরেও নিই উদ্ভিদ জাতীয় খাদ্য খেলে উদ্ভিদের হত্যা হয়, তবুও আপনি কিভাবে ভাবতে পারেন সবধরনের হত্যার শাস্তি একরকম হবে? মূলা চুরি করলে কি আপনি ফাসি দিয়ে দিবেন নাকি!

মানুষ হত্যা আর একটি মুরগী হত্যা যদি সমান অপরাধ না হয়, তাহলে কোন যুক্তিতে পশুহত্যা আর উদ্ভিদ হত্যা সমান অপরাধের হবে?

পরমেশ্বর ভগবান যিঁনি সকল জীবের আশ্রয়দাতা, যাঁকে পরম করুণাময় বলে সম্বোধিত করা হয় তিঁনি নিশ্চই নিষ্ঠুর নন। তাই তিঁনি পবিত্র বেদের মাধ্যমে আমাদের শিক্ষা দিচ্ছেন কোন পদ্ধতিতে সেই সমস্ত উদ্ভিজ্জ আহার গ্রহণ করলেও উদ্ভিদ হত্যাজনিত অপরাধ আমাদের স্পর্শ করবে না।

पत्रं पुष्पं फलं तोयं यो मे भक्त्या प्रयच्छति।

तदहं भक्त्युपहृतम् अश्नामि प्रयतात्मनः॥

যে বিশুদ্ধচিত্ত নিষ্কাম ভক্ত ভক্তি সহকারে আমাকে পত্র, পুষ্প, ফল ও জল অর্পন করেন, আমি তাঁর সেই ভক্তিপ্লুত উপহার প্রীতি সহকারে গ্রহণ করি। (ভ:গী: ৯/২৬)

এভাবে ভগবানের প্রতি শরণাগত থেকে উদ্ভিজ্জ খাদ্যদ্রব্যকে ভগবানের নিকট নিবেদন করার পর তার আশির্বাদ (প্রসাদ) রূপে গ্রহণ করতে হয়, এটাই খাদ্য গ্রহণের পদ্ধতি। আমরা জীবন ধারণের জন্য যা কিছু ব্যবহার করে থাকি তা প্রথমে ভগবানকে নিবেদন করলে সেই বস্তুর ভোগজনিত অপরাধ থেকে ভগবান আমাদের মুক্ত রাখেন। পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আমাদেরকে সেই অভয় অবশ্যই দান করেছেন-

सर्वधर्मान् परित्यज्य मामेकं शरणं व्रज।

अहं त्वां सर्वपापेभ्यो मोक्षयिष्यामि मा शुचः

সর্ব প্রকার ধর্ম পরিত্যাগ করে কেবল আমার শরণাগত হও। আমি তোমাকে সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত করবো শোক করো না। (ভ:গী: ১৮/৬৬)

অতএব, পরিশেষে বলতে হয় যার যেরকম লক্ষ্য, সেই লক্ষ্য অনুযায়ী তার খাদ্যতালিকা ভিন্ন-ভিন্ন হয়ে থাকে।

উদাহরণস্বরূপ একজন ব্যক্তি যদি ওয়েট লিফ্টার/বডি বিল্ডার হওয়ার জন্য অনুশীলন করে তার খাদ্য তালিকা হবে তদানুসারে হাই প্রোটিন সমৃদ্ধ। অথবা কেউ যদি সাতারু/খেলোয়াড় ইত্যাদি হতে চায়, সে কি সেই ভারি খাবার খাবে? তার খাদ্য হতে হবে হালকা-পাতলা তবে শক্তিবর্ধক, বিশেষত যেন শরীরে ফ্যাট না জমে। অপরপক্ষে রয়েছেন একজন কৃষ্ণভক্ত! যিঁনি বৈদিক শাস্ত্রের নির্দেশনা অনুযায়ী নিজেকে পরিচালনা করেন, যাদের এক এবং একমাত্র লক্ষ্য কৃষ্ণভক্তি! তাহলে তাদের খাদ্য তালিকা কেমন হওয়া উচিত? অবশ্যই ভগবানকে নিবেদিত সাত্ত্বিক খাবার।

তাই আপনার লক্ষ্য এবং পছন্দ আপনার হাতেই।

“Your Goal, Your Wish”

নিচের ছক আপনাকে বিষয়টি আরও পরিস্কারভাবে বুঝতে সাহায্য করবে।

Screenshot 20250615 023528 Svadharmam

⛔ সর্বভুক প্রাণী: অনেকে মানুষকে সর্বভুক প্রাণী বলে থাকেন। কিন্তু সর্বভুক প্রাণীর বৈশিষ্ট্যের সাথে মানুষের মিল পাওয়া যায় না। যেমন- সর্বভুক প্রাণী শাকাহারী ভোজন অথবা শুধু মাছ-মাংস খেয়েও সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে পারে। অথচ মানুষ শাকসব্জী আদি সম্পূর্ণভাবে পরিত্যাগ করে শুধুমাত্র মাছ মাংসের উপর ভিত্তি করে বেঁচে থাকতে পারে না।

🔖 হ্যাঁ! আপনি যদি পারেন তাহলে আলুপটলাদি শাক-সবজি সম্পূর্ণভাবে বর্জন করে শুধুমাত্র মাছমাংস খেয়ে নিরামিষভোজী শাকাহারীদের মতো সুস্থভাবে ১ (এক) বছর বেঁচে দেখান? না পারলে পবিত্র বেদের এই সত্যকে সর্বাত্মকভাবে গ্রহণ করুন। ধন্যবাদ। হরেকৃষ্ণ।

✍️ প্রবীর চৈতন্য চন্দ্র দাস।

©স্বধর্মম্™

Prakash

Writer & Admin

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments