মহাভারত শাস্ত্রে শ্রীকৃষ্ণকে শ্রীবিষ্ণু বলা হয়েছে,পরমেশ্বর ভগবান বলা হয়েছে।
অনুগ্রহার্থং লোকানাং বিষ্ণু লোক নমস্কৃতঃ।
বসুদেবাত্তু দেবক্যাং প্রাদুর্ভূতো মহাযশাঃ।।
-(মহাভারত আদিপর্ব, ৫৮/১৩৮)
অনুবাদঃ – ত্রিজগতের পূজনীয় মহাযশস্বী স্বয়ং বিষ্ণু লোকের প্রতি অনুগ্রহ করিবার জন্য বসুদেব-দেবকীতে আবির্ভূত হইয়া ছিলেন৷
এছাড়াও মহাভারত শাস্ত্রের ভীষ্মপর্বের ৩৪ তম অধ্যায়ের ৮ নং শ্লোকে অথাৎ গীতা ১০/৮ নং শ্লোকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যখন নিজেকে সমগ্র জগতের সৃষ্টিকর্তা বা ঈশ্বররুপে দাবী করেন,তখন অর্জুন কোনরুপ প্রশ্ন জিজ্ঞাসা না করে মহাভারত, ভীষ্মপর্ব ৩৪/১২-১৩ নং শ্লোকে অথাৎ গীতা ১০/১২-১৩ নং শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণকে পরমব্রহ্ম বা পরমেশ্বর ভগবান বলে সম্বোধন করেন –
অর্জুন উবাচ-
পরং ব্রহ্ম পরং ধাম পবিত্রং পরমং ভবান্ ।
পুরুষং শাশ্বতং দিব্যমাদিদেবমজং বিভুম্ ॥
আহুস্তামৃষয়ঃ সর্বে দেবর্ষির্নারদস্তথা ।
অসিতো দেবলো ব্যাসঃ স্বয়ং চৈব ব্রবীষি মে ॥”
-(গীতাঃ ১০/১২-১৩ঃঅর্জুন)
অনুবাদঃ অর্জুন বললেন- তুমি ( শ্রীকৃষ্ণ) পরম ব্রহ্ম( ঈশ্বর) , পরম ধাম( পরম আশ্রয়), পরম পবিত্র ও পরম পুরুষ৷ তুমি নিত্য, দিব্য, আদি দেব, অজ ও বিভু। দেবর্ষি নারদ, অসিত, দেবল, ব্যাস আদি ঋষিরা তোমাকে সেভাবেই বর্ণনা করছে এবং তুমি নিজেও এখন আমাকে তা বলছ।
এইভাবে সমগ্র সনাতনী শাস্ত্রে শ্রীকৃষ্ণকে পরমেশ্বর ভগবান বলা হয়েছে,বিষ্ণু বলা হয়েছে। কিন্তু তারপরও শাস্ত্র জ্ঞানহীন কিছু মূর্খ আমাদের সমাজে রয়েছে,যারা সনাতনী শাস্ত্রে উল্লেখিত শ্রীকৃষ্ণকে পরমেশ্বর ভগবান রুপে গ্রহণ করতে অস্বীকার করে।শুধু তাই নয় তারা জনসমাজে অপপ্রচার করছে যে,মহাভারতের আশ্বমেধিক পর্বে অজুর্ন যখন দ্বিতীয় বার কৃষ্ণকে গীতার জ্ঞান দান করতে অনুরোধ করেন ,তখন কৃষ্ণ বলছেন আমি গীতার জ্ঞান ভুলে গিয়েছি। তাই এই সমস্ত মূর্খেরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে যে, কৃষ্ণ পরমেশ্বর ভগবান নন,তিনি একজন মানুষ,তাই তিনি ভুলে যাওয়ার কথা বলছেন।
অথচ তারা একবারও চিন্তা করে দেখে না,কৃৃষ্ণ কিভাবে গীতার জ্ঞান ভূলে যাবেন,তিনি নিজে গীতা ৪/১ -৩ নং শ্লোকে বর্ণনা করছেন-
শ্রীভগবানুবাচ–
ইমং বিবস্বতে যোগং প্রোক্তবানহমব্যয়ম্।বিবস্বান্মনবে প্রাহ মনুরিক্ষাকবেহব্রবীৎ ।।এবং পরম্পরাপ্রাপ্তমিমং রাজর্ষয়ো বিদুঃ।স কালেনেহ মহতা যোগো নষ্টঃ পরন্তপ ৷৷ ২৷৷স এবায়ং ময়া তেহদ্য যোগঃ প্রোক্তঃ পুরাতনঃ।ভক্তোহসি মে সখা চেতি রহস্যং হোতদুত্তমম্ ।। ৩ ।।
-(গীতা ৪/১ -৩)
অনুবাদঃ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বললেন,আমি পূর্বে সূর্যদেব বিবস্বানকে এই অব্যয় জ্ঞানযোগ / গীতার জ্ঞান বলেছিলাম। বিবস্বান তা মানবজাতির জনক মনুকে বলেছিলেন এবং মনু তা ইক্ষাকুকে বলেছিলেন।হে পরন্তপ, এভাবেই পরম্পরাক্রমে প্রাপ্ত এই পরম বিজ্ঞান রাজর্ষিরা লাভ করেছিলেন। কিন্তু কালের প্রভাবে পরম্পরা ছিন্ন হয়েছিল এবং তাই সেই যোগ নষ্টপ্রায় হয়েছে।সেই সনাতন যোগ(গীতার জ্ঞান) আজ আমি তোমাকে বললাম, কারণ তুমি আমার ভক্ত ও সখা এবং তাই তুমি এই বিজ্ঞানের অতি গূঢ় রহস্য হৃদয়ঙ্গম করতে পারবে।
তখন অর্জুন গীতা ৪/৪ শ্লোকে আমাদের হয়ে(যারা শ্রীকৃষ্ণের পরমেশ্বরত্ব সম্পর্কে অজ্ঞাত) শ্রীকৃষ্ণকে জিজ্ঞেস করলেন-
অর্জুন উবাচ-
অপরং ভবতো জন্ম পরং জন্ম বিবস্বতঃ।
কথমেতদ বিজানীয়াং ত্বমাদৌ প্রোক্তবানিতি ।।
-(গীতা ৪/৪)
অনুবাদঃ অর্জুন বললেন,সূর্যদেব বিবস্বানের জন্ম হয়েছিল তোমার অনেক পূর্বে। তুমি যে আদিকালে তাঁকে এই জ্ঞান উপদেশ করেছিলে, তা আমি কেমন করে বুঝব?
এর উত্তরে শ্রীকৃষ্ণ গীতা ৪/৫-৮ শ্লোকে বললেন,
শ্রীভগবানুবাচ-
বহুনি মে ব্যতীতানি জন্মানি তব চার্জুন।তান্যহং বেদ সর্বাণি ন ত্বং বেথ পরন্তপ ।। ৫।।অজোহপি সন্নব্যয়াত্মা ভূতানামীশ্বরোহপি সন্।প্রকৃতিং স্বামধিষ্ঠায় সম্ভবাম্যাক্সমায়য়া ।। ৬।।যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত।অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্।। ৭।॥পরিত্রাণায় সাশূন্যা বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম।ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে ।। ৮।।
-(গীতা ৪/৫-৮)
অনুবাদঃ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বললেন,হে পরন্তপ অর্জুন! আমার ও তোমার বহু জন্ম অতিবাহিত হয়েছে। আমি সেই সমস্ত জন্মের কথা স্মরণ করতে পারি, কিন্তু তুমি পার না।যদিও আমি জন্মরহিত, আমার চিন্ময় দেহ অব্যয় এবং যদিও আমি সর্বভূতের ঈশ্বর, তবুও আমার অন্তরঙ্গা শক্তিকে আশ্রয় করে আমি আমার আদি চিন্ময় রূপে যুগে যুগে অবতীর্ণ হই।হে ভারত, যখনই ধর্মের গ্লানি হয় এবং অধর্মের অভ্যুত্থান হয়, তখন আমি নিজেকে প্রকাশ করে অবতীর্ণ হই।সাধুদের পরিত্রাণ এবং দুষ্কৃতকারীদের বিনাশ করার জন্য এবং ধর্ম সংস্থাপনের জন্য আমি যুগে যুগে অবতীর্ণ হই।
আমরা গীতা ৪/১-৮ নং শ্লোক থেকে স্পষ্ট দেখতে পাই,অর্জুনকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যে গীতার জ্ঞান প্রদান করছেন, শ্রীকৃষ্ণের উপদেশ অনুসারে তা বহু পূর্বে সূর্যদেব বিবস্বানকে প্রথমে তিনি তা দান করেন।সূর্যদেব বিবস্বান তা মনুকে দান করেন,মনু তা ইক্ষাকুকে দান করেন।এইভাবে এই জ্ঞান গুরু শিষ্য পরম্পরায় প্রবাহিত হতে থাকে।কিন্তু কালের প্রভাবে এই জ্ঞান নষ্ট হলে শ্রীকৃষ্ণ পুনরায় তা অর্জুনকে দান করেন। (মহাভারত,শান্তিপর্ব ৩৪৮/৫১-৫২ শ্লোক অনুসারে, সূর্যদেব ত্রেতাযুগের শুরুতে অথাৎ ২০ লক্ষ ৫ হাজার বছর পূর্বে মনুকে গীতার জ্ঞান দান করেন।) তখন অর্জুন আমাদের হয়ে প্রশ্ন করছেন,সূর্যদেব বিবস্বানের জন্ম হয়েছিল তোমার অনেক পূর্বে। তুমি যে আদিকালে তাঁকে এই জ্ঞান উপদেশ করেছিলে, তা আমি কেমন করে বুঝব?তখন শ্রীকৃষ্ণ গীতা ৪/৫-৮ শ্লোকে বলছিলেন,তোমার ও আমার এই জগতে বহুবার জন্ম হয়েছে।সে সকল জন্মের কথা তোমার মনে নেই,কিন্তু আমার সবকিছু মনে আছে।কারন আমি সমস্ত জীবের ঈশ্বর (ভূতানামীশ্বরোহপি সন),ঈশ্বররুপে আমি অজ অথাৎ আমার জন্ম নাই (অজোহপি),তবুও আমি যুগে যুগে দুষ্টের দমন,শিষ্টের পালন এবং ধর্মসংস্থাপন করার জন্য অবতীর্ণ হই(সম্ভবামি যুগে যুগে)।
এখন সেসমস্ত মূর্খদের উদ্দেশ্য আমাদের প্রশ্ন, গীতা ৪/১ শ্লোকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন,আমি পূর্বে সূর্যদেবকে এই গীতার জ্ঞান দান করছি।গীতা৪/৫-৮ শ্লোক অনুসারে শ্রীকৃষ্ণ কৃষ্ণ এই পৃথিবীতে দুষ্টের দমন, সন্তের রক্ষা এবং ধর্ম সংস্থাপনের জন্য বহুবার বিভিন্ন অবতাররুপে আবির্ভূত হয়েছেন।সেসমস্ত আবির্ভাব বা দিব্য জন্মের কথা সবই কৃষ্ণের মনে আছে। অথচ অর্জুনের বর্তমান জীবনে কিছুদিন পূর্বে কুরুক্ষেত্রের রণাঙ্গনে ভগবদগীতার জ্ঞান ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অজুর্নকে দান করলেন, সে জ্ঞানের একটা লাইনও কৃষ্ণের মনে নাই,এ ধরনের কথা বলার পেছনে কি কারন হতে পারে? এ সমস্ত মূর্খরা এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে না।অথচ যেকোন জ্ঞানবান ব্যক্তি বুঝতে পারবে পরমেশ্বর ভগবানরুপে শ্রীকৃষ্ণ যে এ ধরনের কথা বলছেন তাঁর পেছনে কোন হেতু বা কারন আছে।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যদি গীতার জ্ঞান ভুলে যাবেন, তাহলে সে একই কৃষ্ণের পক্ষে অজুর্নকে বহু প্রাচীন ইতিহাসের মাধ্যমে হুবহু ভগবদ্গীতা ১৮ টি অধ্যায়ের মতো মহাভারতের আশ্বমেধিক পর্ব, ১৭- ৬৬ অধ্যায় অথাৎ ৫০ টি অধ্যায়ে অনুগীতা দান করা কিভাবে সম্ভব হল?বস্তুত পক্ষে পরমাত্মা কৃষ্ণের উদ্দেশ্য ছিল জড় জগতে পুনরায় সিদ্ধ ব্রাহ্মণ এবং মহর্ষি কশ্যপ,ব্রাহ্মণ এবং ব্রাহ্মণী, গুরু এবং শিষ্যের তত্ত্ব জ্ঞান আলোচনার মাধ্যমে গীতার জ্ঞান প্রদান করা,যাকে মহাভারতে অনুগীতা বলা হয়েছে।
মূল ঘটনাঃ
মহাভারতের ১৪ তম আশ্বমেধিক পর্বের ১৭তম অধ্যায়ে অর্জুনের প্রশ্ন ছিল, হে কৃষ্ণ! তুমি যে যুদ্ধক্ষেত্রে গীতার জ্ঞান আমাকে দান করেছ তা আমি এখন ভুলে গেছি, সে জ্ঞান পুনরায় আমাকে দান কর।
বিদিতং মে মহাবাহো! সংগ্রামে সমুপস্থিতে।
মাহাত্ম্যং দেবকীপুত্র! তচ্চ তে রূপমৈশ্বরম্ ॥৫॥
যত্তু তদ্ভবতা প্রোক্তং পুরা কেশব! সৌহৃদাৎ।
তৎসর্ব্বং পুরুষব্যাঘ্র! নষ্টং মে ব্যগ্রচেতসঃ ॥৬॥
মম কৌতূহলং স্বস্তি তেষর্থেষু পুনঃ পুনঃ।
ভবাংস্তু দ্বারকাং গন্তা নচিরাদিব মাধব! ॥৭॥
-(মহাভারত,অশ্বমেধিক পর্ব ১৭/৫-৭)
অনুবাদঃ মহাবাহু দেবকীপুত্র! যুদ্ধ উপস্থিত হইলে আপনার মাহাত্ম্য আমি জানিয়াছি। তদানীন্তন আপনার সেইরূপ-ঈশ্বরেরই রূপ ॥৫পুরুষশ্রেষ্ঠ কেশব! তুমি সৌহাদ্যবশতঃ পূর্ব্বে যে সকল কথা বলেছিলে, আমি যুদ্ধে আসক্তচিত্ত হওয়ায় সে সমস্তই আমার লুপ্ত হয়ে গিয়াছে(ভূলে গিয়েছি)। হে মাধব,সেই সকল বিষয় পুনরায় শ্রবণ করার জন্য আবার আমার কৌতুহল হচ্ছে,কেননা তুমি খুব শীঘ্রই দ্বারকায় গমন করবে।
কৃষ্ণ চিন্তা করলেন, অর্জুনের মতো আমার পরম ভক্ত যদি এ গীতার জ্ঞান ভুলে যায় তাহলে সাধারণ মানুষের আর কি কথা।তখন পরমাত্মা শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনের এরুপ কথাতে ভীষণ অসন্তুষ্ট হন এবং বাণীরুপে ভগবদ্গীতার জ্ঞান দান করতে অস্বীকার করে ক্ষোভ থেকে সৃষ্ট অসত্য উক্তি দ্বারা বলেছিলেন,হে অর্জুন তোমার মত আমিও তা এখন বলতে পারব না।
বাসুদেব উবাচ।
শ্রাবিতত্ত্বং ময়া গুহ্যং জ্ঞাপিতশ্চ সনাতনম্।
ধৰ্ম্মং স্বরূপিণং পার্থ! সর্ব্বলোকাংশ্চ শাশ্বতান্ ॥৯৷৷ অবুদ্ধ্যা নাগ্রহীর্যত্বং তন্মে সুমহদপ্রিয়ম্।
ন চ সাদ্য পুনর্ভু’য়ঃ স্মৃতিমে সংভবিষ্যতি ॥১০॥
–(মহাভারত,অশ্বমেধিক পর্ব ১৭/৯-১২)
অনুবাদঃ কৃষ্ণ বলিলেন- ‘পৃথানন্দন! আমি তোমাকে গোপনীয় বিষয় শুনিয়েছি এবং লক্ষণযুক্ত সনাতন ধর্ম ও শাশ্বত সমস্ত লোকের বিষয় জানিয়েছি। তুমি যে বৈমত্যবশতঃ সে সকল মনে রাখিতে পার নি, তা আমার খুব অপ্রিয় হইয়াছে(তাতে আমি খুব অসন্তুষ্ট হয়েছি)। এখন সেই স্মৃতি পুনরায় আমার হইবে না।
এরপর ঘটনাটি ঘটল অন্যরকম।ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে সরাসরি বাণীর মাধ্যমে গীতার জ্ঞান দান না করে এক সিদ্ধ ব্রাহ্মন কৃত মহর্ষি কশ্যপকে উপদেশরুপ তত্ত্বজ্ঞান বর্ননা করেন, যাকে মহাভারতের আশ্বমেধিক পর্বে-অনুগীতা বলা হয়েছে,যেখানে মহর্ষি কশ্যপের প্রতি সিদ্ধ ব্রাহ্মনের উপদেশ- ১৭ অধ্যায় থেকে ২১ তম অধ্যায়, এই ৫ টি অধ্যায়ে বর্ণনা করা হয়েছে।
পরং হি ব্রহ্ম কথিতং যোগযুক্তেনতন্ময়া।
ইতিহাসং তু বক্ষ্যামি তস্মিন্নর্থে পুরাতনম।।
-(মহাভারত,আশ্বমেধিক পর্ব-১৭/ ১৩)
অনুবাদঃ তৎকালে আমি যোগযুক্ত হইয়া(একাগ্রতার সহিত) পরব্রহ্মের বিষয় বলিয়াছিলাম, এখন সেই বিষয়ে প্রাচীন বৃত্তান্ত বলিতেছি॥১৩॥
(“যোগযুক্ত” বলতে বোঝানো হয়েছে— “একাগ্রতার সহিত”। যোগযুক্তেন ঐক্যাগ্রসমন্বিতেন -ভারতকৌমুদী টীকা,বিশ্ববাণী প্রকাশনী, অনুবাদক-শ্রীহরিসিদ্ধান্ত বাগীশ)
মহাভারতে বর্ণিত শ্রীকৃষ্ণ কতৃর্ক অর্জুনকে বর্ণিত সে পুরাতন ইতিহাস, যাকে মহাভারতে অনুগীতা বলা হয়েছে, তা হুবহু কুরুক্ষেত্রের রণাঙ্গনে অর্জুনকে প্রদানকারী ভগবদ্গীতার অনুরুপ।অনুগীতা নামক পুরাতন ইতিহাসটিতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বর্ননা করেন,যেখানে এক সিদ্ধ ব্রাহ্মন মর্হষি কশ্যপকে আত্মা সম্বন্ধে উপদেশ দিচ্ছেন, যা ভগবদগীতায় বর্নিত হুবহু দ্বিতীয় অধ্যায় সংখ্যা যোগ বা আত্মার জ্ঞান। এরপর মহাভারতের সেই অনুগীতাতে কর্মযোগ,
জ্ঞানযোগ,সন্ন্যাসযোগ,ভক্তিযোগের কথা বলা হয়েছে,যা হুবহু শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা।
সিদ্ধ উবাচ।বিবিধৈঃ কৰ্ম্মভিস্তাত! পুণ্যযোগৈশ্চ কেবলৈঃ। গচ্ছন্তীহ গতিং মর্ত্য। দেবলোকে চ সংস্থিতিম্ ॥২৯৷৷
-(মহাভারতঃঅশ্বমেধিক পর্ব ১৭/২৯)
অনুবাদঃ সিদ্ধ ব্রাহ্মণ বলিলেন-‘বৎস কাশ্যপ, মানুষ নানা রকম সৎকর্ম এবং শুধুমাত্র পুণ্য দ্বারা উত্তম গতি ও স্বর্গলোকে স্থিতি লাভ করিয়া থাকে।।
কাশ্যপ উবাচ।
কথং শরীরাচ্চ্যবতে কথঞ্চৈবোপপদ্যতে।
কথং কষ্টাচ্চ সংসারাৎ সংসরন্ পরিমুচ্যতে ॥২॥
-(মহাভারতঃঅশ্বমেধিক পর্ব ১৮/২)
অনুবাদঃ কাশ্যপ বলিলেন- আত্মা কি প্রকারে শরীর হইতে নির্গত(বের) হয়, কি প্রকারেই বা শরীরান্তর(একটির পর অন্য একটি শরীর) গ্রহণ করে এবং গমনাগমনকারী আত্মা কি প্রকারে কষ্টজনক সংসার হইতে মুক্তি লাভ করে থাকে?
ব্রাহ্মণ উবাচ।
শুভানামশুভানাঞ্চ নেহ নাশোহস্তি কৰ্ম্মণাম্।
প্রাপ্য প্রাপ্যানুপচ্যন্তে ক্ষেত্রং ক্ষেত্রং তথা তথা ॥১॥
(মহাভারত,অশ্বমেধিক পর্ব ১৯/১)
অনুবাদঃসিদ্ধ ব্রাহ্মণ বলিলেন-‘কাশ্যপ। এই দেহে ভোগব্যতীত শুভ বা অশুভ কর্ম্মের ধ্বংস হয় না। প্রাণীরা সেই কৰ্ম্ম অনুসারে বিভিন্ন প্রকার শরীর লাভ করে সুখ বা দুঃখ অনুভব করে ॥১॥
যথা চ দীপঃ শরণে দীপ্যমানঃ প্রকাশতে।
এবমেব শরীরাণি প্রকাশযতি চেতনা ॥১১৷৷
যদ্যচ্চ কুরুতে কৰ্ম্ম শুভং বা যদি বা শুভম্।
পূর্ব্বদেহকৃতং সর্বমবশ্যমুপভুজ্যতে ॥১২৷৷
-(মহাভারত,অশ্বমেধিক পর্ব ১৯/১১-১২)
অনুবাদঃ দীপ যেমন গৃহে দীপ্তি প্রকাশ করিয়া সমস্ত গৃহকে প্রকাশ করে(আলোকিত), ঠিক সেইরূপ আত্মা গর্ভশরীরে প্রবেশ করিয়া সকল শরীরকেই চৈতন্য সমন্বিত করে। জীব পূর্ব্বদেহে শুভ বা অশুভ যে যে কৰ্ম্ম করেছিল, বর্তমান দেহে সেই পূর্ব্বদেহকৃত কর্ম্মের ফল অবশ্যই ভোগ করিয়া থাকে।
আত্মবৎ সর্বভূতেষু যশ্চরেন্নিষতঃ শুচিঃ।
অমানী নিরভীমানঃ সর্বতো মুক্ত এব সঃ ॥৩॥
জীবিতং মরণং চোভে সুখদুঃখে তথৈব চ।
লাভালাভে প্রিয়দ্বেষ্যে যঃ সমঃ স চ মুচ্যতে ॥৪॥
ন কস্যচিৎ স্পৃহযতে নাবজানাতি কিঞ্চন।
নির্দ্বন্দ্বো বীতরাগাত্মা সর্বথা মুক্ত এব সঃ ॥৫॥
অনমিত্রশ নির্বন্ধুরনপত্যশ্চ যঃ কচিৎ।
ত্যক্তধর্মার্থকামশ্চ নিরাকাঙ্ক্ষী চ মুচ্যতে ॥৬॥
নৈব ধৰ্ম্মী ন চাধৰ্ম্মী পূর্ব্বোপচিতহায়কঃ।
ধাতুক্ষয়প্রশান্তাত্মা নির্দ্বন্দ্বঃ স বিমুচ্যতে ॥৭॥
-(মহাভারতঃঅশ্বমেধিক পর্ব ২০/৩-৭)।
অনুবাদঃ যিনি শাস্ত্রোক্ত নিয়মসম্পন্ন ও পবিত্র থাকিয়া নিজের ন্যায় সমস্ত প্রাণীতে ব্যবহার করেন এবং ক্রোধ, অভিমানশূন্য হন, সেই ব্যক্তি মুক্ত। যিনি জীবনে ও মৃত্যুতে, সুখে ও দুঃখে, লাভে ও ক্ষতিতে এবং প্রিয় ও অপ্রিয়ে সমান থাকেন, তিনি মুক্তিলাভ করেন। যিনি কোন বস্তুরই প্রতি স্পৃহা করেন না, কাউকেও অবজ্ঞা করেন না,শীত ও উষ্ণ প্রভৃতি দ্বন্ধে সহিষ্ণু হন এবং যাঁর চিত্তে কোন বিষয়েরই অনুরাগ থাকে না, তিনি সর্ব্বপ্রকাবেই মুক্ত পুরুষ।যাঁর শত্রু নেই, মিত্র নেই, অপত্য স্নেহ নেই এবং যিনি ধৰ্ম্ম, অর্থ ও কাম পরিত্যাগ করেছেন, আর যাঁর কোন আকাঙ্ক্ষা নাই, তিনিই মুক্তিলাভ করেন।
নৈনং শস্ত্রাণি বিধ্যন্তে ন মৃত্যুশ্চাস্য বিদ্যতে।
নাতঃ সুখতরং কিঞ্চিল্লোকে কচন দৃশ্যতে ॥২৯৷৷
সম্যগ যুক্তা স আত্মানমাত্মন্যেব প্রতিষ্ঠতে। বিনিবৃত্তজরাদুঃখঃ সুখং স্বপিতি চাপি সঃ ॥৩০॥
-(মহাভারতঃঅশ্বমেধিক পর্ব ২০/২৯-৩০)
অনুবাদঃআত্মাকে অস্ত্র বিদ্ধ করিতে পারে না, তাঁর মৃত্যু নাই এবং জগতে কোথাও তা অপেক্ষা অধিক সুখজনক কিছুই দেখা যায় না। যোগী সমীচীনভাবে জীবাত্মাকে পরমাত্মাতে যুক্ত করে পরমাত্মাতেই অবস্থান করেন এবং তাঁর বার্ধক্য জনিত দুঃখের নিবৃত্তি হয়,ফলে তিনি সুখে নিদ্রা যাইতে পারেন।
এছাড়াও পরমাত্মা শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে মহাভারত,আশ্বমেধিক পর্ব, ২২ -৩৯অধ্যায় পর্যন্ত ব্রাহ্মণ এবং ব্রাহ্মণির প্রশ্নোত্তর নিয়ে শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার বিভিন্ন বিষয়কে বিভিন্ন প্রাচীন উপাখ্যান আলোচনার মাধ্যমে উপস্থাপন করেন।ব্রাহ্মণ বললেন-
কৃণাশাঃ সুব্রতাঃ শান্তাস্তপসা দগ্ধকিল্বিষাঃ।
আত্মন্যাত্মানমা বেশ্য ব্রাহ্মণাস্তমুপাসতে ॥২৩৷৷
-(মহাভারত,অশ্বমেধিক পর্ব ৩১/২৩)
অনুবাদঃ অল্প আশাযুক্ত, সমীচীন নিয়মসমন্বিত, শান্তচিত্ত ও তপস্যার প্রভাবে পাপ- বিহীন ব্রাহ্মণেরা পরমাত্মাতে জীবাত্মাকে প্রবেশ করিয়ে পরমেশ্বরের উপাসনা করেন ॥
এরপর পরমব্রহ্ম শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে মহাভারত,আশ্বমেধিক পর্ব, ৪০-৬৬ অধ্যায় পর্যন্ত গুরু ও শিষ্যের প্রশ্নোত্তর নিয়ে শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার বিভিন্ন বিষয়কে প্রাচীন উপাখ্যান আলোচনার মাধ্যমে উপস্থাপন করেন।
তমো রজস্তথা সত্ত্বং গুণানেতান্ প্রচক্ষতে।
অন্যোন্য মিথুনাঃ সর্বে তথান্যোন্যানুজীবিনঃ ॥৪॥
-(মহাভারত,অশ্বমেধিক পর্ব ৪৩/৪)
অনুবাদঃ পণ্ডিতগণ সত্ত্ব, রজ ও তম এই তিনটি গুণের কথা বর্ণনা করিয়া থাকেন। এই সকল গুণই পরস্পর সংযুক্ত এবং পরস্পরোপজীবী।
ঊর্দ্ধং গচ্ছন্তি সত্ত্বস্থা মধ্যে তিষ্ঠন্তি রাজসাঃ। জঘন্যগুণসংযুক্তা যান্ত্যধস্তামসা জনাঃ ॥১০৷৷
–(মহাভারত,অশ্বমেধিক পর্ব ৪৬/১০)
অনুবাদঃসাত্ত্বিক লোকেবা উর্দ্ধে গমন করেন, রাজসিক ব্যক্তিরা মধ্যে অবস্থান করেন (পৃথিবী) এবং তামসিক ব্যক্তিগণ নিকৃষ্টগুণ সংযুক্ত হইয়া নীচের দিকে (নরকে) গমন করেন।
এরপর মহাভারতের আশ্বমেধিক পর্ব ৬৬ অধ্যায়ের অনুগীতার আলোচনা সমাপ্ত হলে, ৬৭ তম অধ্যায়ে বর্ণনা করা হয়েছে,মহাভারতের উপদেশরুপ ইতিহাস
অনুগীতা ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কাছ থেকে অর্জুন শ্রবণ করার করার পর অজুর্নের মনে কোন সন্দেহ ছিল না যে কৃষ্ণ পরমেশ্বর ভগবান নন।বরং অর্জুনের ভাষায় শ্রীকৃষ্ণ হলেন পরমাত্মা পরমেশ্বর ভগবান,তিনিই ছিলেন পান্ডবদের বিজয়ের মূল কারন।অর্জুন বললেন-
ত্বংপ্রসাদাজ্জয়ঃ প্রাপ্তো রাজ্ঞা বৃষ্ণিকুলোদ্বহ।।
নিহতাঃ শত্রবশ্চাপি প্রাপ্তং রাজ্যমকণ্টকম্ ॥৬৷৷
নাথবন্তশ্চ ভবতা পান্ডবা মধুসূদন!
ভবন্তং প্লবমাসাদ্য তীর্ণাঃ স্ম কুরুসাগরম্ ॥৭॥
বিশ্বকৰ্ম্মন্! নমস্তেহস্তু বিশ্বাত্মন্। বিশ্বসত্তম।।
তথা স্বামভিজানামি যথা চাহং ভবান্ মতঃ ॥৮॥
ত্বত্তেজঃসম্ভবো নিত্যং হুতাশো মধুসূদন।।
রতিঃ ক্রীড়াময়ী তুভ্যং মায়া তে রোদসী বিভো! ॥৯৷৷
ত্বয়ি সর্বমিদং বিশ্বং যদিদং স্থাণু জঙ্গমম্।
ত্বং হি সর্বং বিকুরুষে ভূতগ্রামং চতু্র্বিধম ॥১০॥
পৃথিবীং চান্তরিক্ষঞ্চ দ্যাঞ্চৈব মধুসুদন।।
হসিতং তেহমলা জ্যোৎস্না ঋতবশ্চেন্দ্রিয়াণি তে ॥১১৷
-(মহাভারত,আশ্বমেধিক পর্ব,৬৭/৬-১১)
অনুবাদঃ হে বৃষ্ণিবংশশ্রেষ্ঠ। রাজা যুধিষ্ঠির তোমারই অনুগ্রহে জয়লাভ করিয়াছেন, শত্রুগণকে সংহার করিয়াছেন এবং নিষ্কণ্টক রাজ্য পাইয়াছেন। হে মধুসূদন, একমাত্র তুমিই পাণ্ডবগণের প্রভু এবং পাণ্ডবেরা তোমাকেই নৌকারূপে পাইয়া কৌরবসমুদ্র পার হইয়াছেন। হে বিশ্বকৰ্ম্মন,হে সমগ্র বিশ্বের পরমাত্মা(বিশ্বাত্মন), হে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ, হে প্রভু মধুসুদন,তোমাকে নমস্কার। আমি মনে মনে তোমাকে যেরূপ ধারণা করি, কার্য্য দ্বারাও তোমাকে সেইরূপই জানিতেছি। অগ্নি সর্ব্বদাই তোমার তেজ হইতে উৎপন্ন হয় এবং রতি তোমারই ক্রীড়াস্বরূপা, আর স্বর্গ ও মর্ত্য তোমারই মায়া।হে দেবকীনন্দন,
তুমি সন্তুষ্ট হইয়া আমাকে যা যা কিছু বলিতেছ সে সমস্তই ‘আমি করিব, এবিষয়ে আমার কোন বিবেচনা নাই।
উপরোক্ত আলোচনায় মহাভারতের আশ্বমেধিক পর্বে অর্জুন বলেছিল,হে কৃষ্ণ (কেশব) কুরুক্ষেত্রের রণাঙ্গনে তুমি যে গীতার জ্ঞান দান করেছিলে বর্তমানে আমি তা ভূলে গেছি, সে জ্ঞান পুনরায় আমাকে দান কর।তখন পরমাত্মা শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনের এরুপ কথাতে ভীষণ অসন্তুষ্ট হন এবং বাণীরুপে ভগবদগীতার জ্ঞান দান করতে অস্বীকার করে সিদ্ধ ব্রাহ্মণ এবং কশ্যপ,ব্রাহ্মণ এবং ব্রাহ্মণী,গুরু এবং শিষ্যের আলোচনার মাধ্যমে ভগবদ্গীতার জ্ঞান দান করেন,যাকে মহাভারতের আশ্বমেধিক পর্বে অনুগীতা বলা হয়েছে।
গ্রন্থ সহায়তাঃ
১/মহাভারত – অনুবাদকঃ শ্রীহরিদাস সিদ্ধান্ত বাগীশ ভট্টাচার্য্য,বিশ্ববাণী প্রকাশনী।
২/শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা- অনুবাদকঃ শ্রীল এ.সি.ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ, বিবিটি প্রকাশনী।
হরে কৃষ্ণ। প্রনাম