নরকঃ
মনুষ্য জীবের পাপকর্মের ফল স্বরুপ যে স্থান পরমেশ্বর ভগবান কতৃর্ক নির্ধারিত আছে, তাকে নরক বলা হয়। শ্রীমদ্ভাগবতের ৫/২৬/৫ নং শ্লোকের বর্ণনা অনুসারে, গর্ভোদক সমুদ্রের উপরে অথাৎ ব্রহ্মান্ডের ৭ টি অধঃলোকের মধ্যবর্তী স্থানে নরকের অবস্থান।
“অন্তরাল এব ত্রিজগত্যাস্ত দিশি দক্ষিণস্যামধস্তাত্তুমেরু পরিষ্টাচ্চ জলাদ্যস্যামগ্নিষ্বাত্তাদয়ঃ পিতৃগণা দিশি স্বানাং গোত্রাণাং পরমেণ সমাধিনা সত্যা এবাশিষ আশাসানা নিবসন্তি ॥”৫ ॥
-(শ্রীমদ্ভাগবতের ৫/২৬/৫)
অনুবাদ-সমস্ত নরক ত্রিলোকের অন্তরালে অবস্থিত। দক্ষিণ দিকে ভূমণ্ডলের অধঃভাগে এবং গর্ভোদক সমুদ্রের উপরিভাগে নরকের অবস্থান। পিতৃলোকও সেই প্রদেশে অর্থাৎ গর্ভোদক সমুদ্র এবং নিম্নলোকের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত। অগ্নিষ্বাত্তা আদি পিতৃগণ পরম সমাধিযোগে ভগবানের ধ্যান করেন এবং তাঁদের গোত্রভূত ব্যক্তিদের মঙ্গল কামনা করেন।
শ্রীমদ্ভাগবত পুরান সহ অষ্টাদশ পুরান,বেদ, উপনিষদ, রামায়ন, মহাভারত,গীতা ইত্যাদি বহুবিধ সনাতনী শাস্ত্রে নরক সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। ভগবদগীতা ১/৪১ এবং ৪৩ নং শ্লোকে নরক সম্পর্কে বলা হয়েছে…
সঙ্করো নরকায়ৈব কুলঘ্নানাং কুলস্য চ।
পতন্তি পিতরো হ্যেষাং লুপ্তপিন্ডোদকক্রিয়াঃ।।৪১।।
-(গীতা ১/৪১ঃ অর্জুন)
অনুবাদঃ বর্ণসঙ্কর উৎপাদন বৃদ্ধি হলে কুল ও কুলঘাতকেরা নরকগামী হয়।সেইকুলে পিন্ডদান ও তর্পণক্রিয়া লোপ পাওয়ার ফলে তাদের পিতৃপুরুষেরাও নরকে অধঃপতিত হয়।
উৎসন্নকুলধর্মাণাং মনুষ্যাণাং জনার্দন।
নরকে নিয়তং বাসো ভবতীত্যনুশুশ্রুম।।৪৩।।
-(গীতা ১/৪৩ঃ অর্জুন)
অনুবাদঃ হে জনার্দন!আমি পরম্পরাক্রমে শুনেছি যে, যাদের কুলধর্ম বিনষ্ট হয়েছে, তাদের নিয়ত নরকে বাস করতে হয়।
শ্রীমদ্ভাগবত ৫/২৬/৭ শ্লোকে ২৮ টি নরকের কথা শ্রীল শুকদেব গোস্বামী বর্ণনা করেন।
তত্র হৈকে নরকানেকবিংশতিং গণয়ন্তি অথ তাংস্তেরাজন্নামরূপলক্ষণতোহনুক্রমিষ্যামস্তামিম্রোহ ন্ধতামিম্রো রৌরবো মহারৌরবঃ কুন্তীপাকঃ কালসূত্রমসিপত্রবনং সূকরমুখমন্ধকূপঃ কৃমিভোজনঃ সন্দংশস্তপ্তসূর্মিবজ্রকণ্টকশাল্মলী বৈতরণী পৃয়োদঃ প্রাণরোধো বিশসনং লালাভক্ষঃ সারমেয়াদনমবীচিরয়ঃপানমিতি। কিঞ্চ ক্ষারকদমো রক্ষোগণভোজনঃ শূলপ্রোতো দন্দশূকোহ বটনিরোধনঃ পর্যাবর্তনঃ সূচীমুখমিত্যষ্টাবিংশতির্নর কাহবিবিধযাতনাভূময়ঃ ॥
-(শ্রীমদ্ভাগবত ৫/২৬/৭)
অনুবাদঃ কেউ কেউ বলেন যে, ২১টি নরক রয়েছে, এবং অন্য কেউ বলেন ২৮টি। হে রাজন, আমি তাদের নাম, রূপ এবং লক্ষণ অনুসারে বর্ণনা করব। সেগুলি হচ্ছে-তামিস্র, অন্ধতামিস্র, রৌরব, মহারৌরব, কুম্ভীপাক, কালসূত্র, অসিপত্রবন, সূকরমুখ, অন্ধকূপ, কৃমিভোজন, সন্দংশ, তপ্তসূর্মি, বজ্রকণ্টক-শাল্মলী, বৈতরণী, পূয়োদ, প্রাণরোধ, বিশসন, লালাভক্ষ, সারমেয়াদন, অবীচি, অয়ঃপান, ক্ষারকর্দম, রক্ষোগণ-ভোজন, শূলপ্রোত, দন্দশূক, অবটনিরোধন, পর্যাবর্তন এবং সূচীমুখ। এইগুলি জীবের দণ্ডভোগের স্থান।
এরপর শ্রীমদ্ভাগবত ৫/২৬/৮-৩৬ নং শ্লোকে মুক্তপূরুষ শ্রীল শুকদেব গোস্বামী কিরুপ পাপকর্মে যুক্ত হওয়ার ফলে পাপীগণকে যমদূতগন কোন কোন নরকে নিক্ষেপ করে কঠিন শাস্তি প্রদান করেন তার বিস্তীত বিবরণ প্রদান করেন। নিম্নে তা আলোচনা করা হল-
১/ তামিস্র নরকঃ
তত্র যস্তু পরবিত্তাপত্যকলত্রাণ্যপহরতি স হি কালপাশবদ্ধো যম- পুরুষৈরতিভয়ানকৈস্তামিস্রে নরকে বলান্নিপাত্যতে অনশনানুদপানদণ্ডতাড়ন-
সন্তর্জনাদিভির্যাতনাভির্যাত্যমানো জন্তুর্যত্র কশ্মলমাসাদিত একদৈব মূর্ছামুপযাতি
তামিস্রপ্রায়ে ॥ ৮।।
–(শ্রীমদ্ভাগবত ৫/২৬/৮)
অনুবাদঃ হে রাজন, যে ব্যক্তি অপরের ধন, স্ত্রী ও পুত্র অপহরণ করে, অত্যন্ত ভয়ঙ্কর যমদূতেরা তাকে কালপাশে বেঁধে বলপূর্বক তামিস্র নরকে নিক্ষেপ করে। এই তামিস্র নরক ঘোর অন্ধকারে আচ্ছন্ন; সেখানে যমদূতেরা পাপীকে ভীষণভাবে প্রহার, তাড়ন এবং তর্জন করে। সেখানে তাকে অনশনে রাখা হয় এবং জল পান করতে দেওয়া হয় না। এইভাবে ক্রুদ্ধ যমদূতদের দ্বারা নির্যাতিত হয়ে সে মূর্ছিত হয়।
২/ অন্ধতামিস্র নরকঃ
এবমেবান্ধতামিস্রে যস্তু বঞ্চয়িত্বা পুরুষং দারাদীনুপযুঙক্তে যত্র শরীরী নিপাত্যমানো যাতনাস্থো বেদনয়া নষ্টমতির্নষ্টদৃষ্টিশ্চ ভবতি যথা বনস্পতিবৃশ্চমানমূলস্তস্মাদগ্ধতামিস্রং
তমুপদিশন্তি।। ৯ ॥
-(শ্রীমদ্ভাগবত ৫/২৬/৯)
অনুবাদঃ যে ব্যক্তি পতিকে বঞ্চনা করে তার স্ত্রী-পুত্র উপভোগ করে, সে অন্ধতামিস্র নরকে পতিত হয়। বৃক্ষকে ভূপাতিত করার পূর্বে যেমন তার মূল ছেদন করা হয়, তেমনই সেই পাপীকে ঐ নরকে নিক্ষেপ করার পূর্বে যমদূতেরা নানা প্রকার যন্ত্রণা প্রদান করে। এই যন্ত্রণা এতই প্রচণ্ড যে, তার ফলে তার বুদ্ধি এবং দৃষ্টি নষ্ট হয়ে যায়। সেই জন্যই সেই নরককে পণ্ডিতেরা অন্ধতামিস্র বলেন।
৩/রৌরব নরকঃ
যত্ত্বিহ বা এতদহমিতি মমেদমিতি ভূতদ্রোহেণ কেবলং স্বকুটুম্বমেবানুদিনং প্রপুষ্ণাতি স তদিহ বিহায় স্বয়মেব তদণ্ডভেন রৌরবে নিপততি ॥১০৷৷
যে ত্বিহ যথৈবামুনা বিহিংসিতা জন্তবঃ পরত্র যমযাতনামুপগতং ত এব রুরবো ভূত্বা তথা তমেব বিহিংসন্তি তস্মাস্ত্রেীরবমিত্যাহুঃ রুরুরিতি সর্পদিতিক্রুরসত্ত্বস্যাপদেশঃ ॥ ১১ ॥
-(শ্রীমদ্ভাগবত ৫/২৬/১০-১১)
অনুবাদঃযে ব্যক্তি তার জড় দেহটিকে তার স্বরূপ বলে মনে করে, তার নিজের দেহ এবং দেহের সম্পর্কে সম্পর্কিত আত্মীয়-স্বজনদের ভরণ-পোষণের জন্য দিনের পর দিন অপর প্রাণীর হিংসা করে, সেই ব্যক্তি মৃত্যুর সময় তার দেহ এবং আত্মীয়-স্বজনদের পরিত্যাগ করে, প্রাণী হিংসাজনিত পাপের ফলে রৌরব নরকে নিপতিত হয়।এই জীবনে যে হিংসা-পরায়ণ ব্যক্তি অন্য প্রাণীদের যন্ত্রণা দেয়, মৃত্যুর পর যখন সে তার কৃত কর্মের ফলে যম-যাতনা প্রাপ্ত হয়, তখন সেই সমস্ত প্রাণীসমূহ, যাদের হিংসা করা হয়েছে, তারা ‘রুরু’ হয়ে তাকে পীড়া দেয়। এই জন্য পণ্ডিতেরা সেই নরককে রৌরব নরক বলেন। রুরু প্রাণীকে এই পৃথিবীতে দেখা যায় না, তারা সর্পের থেকেও হিংস্র।
৪/মহারৌরব নরকঃ
এবমেব মহারৌরবো যত্র নিপতিতং পুরুষং ক্রব্যাদা নাম রুরবস্তং ক্রব্যেণ ঘাতয়ন্তি যঃ কেবলং দেহন্তরঃ ॥ ১২।।
–(শ্রীমদ্ভাগবত ৫/২৬/১২)
অনুবাদঃ যারা অন্যদের কষ্ট দিয়ে নিজেদের দেহ ধারণ করে, তাদের মহারৌরব নরকে দণ্ডভোগ করতে হয়। সেই নরকে ক্রব্যাদ নামক রুরু পশুরা তাদের যন্ত্রণা দিয়ে মাংস আহার করে।
৫/কুম্ভিপাক নরকঃ
যস্ত্বিহ বা উগ্রঃ পশুন পক্ষিণো বা প্রাণত উপরন্ধয়তি তমপকরুণং পুরুষাদৈরপি বিগর্হিতমমূত্র যমানুচরাঃ কুম্ভীপাকে তপ্ততৈলে উপরন্ধয়ন্তি । ১৩ ॥
–(শ্রীমদ্ভাগবত ৫/২৬/১৩)
অনুবাদঃ যে সমস্ত নিষ্ঠুর মানুষ তাদের দেহ ধারণের জন্য এবং জিহ্বার তৃপ্তি সাধনের জন্য নিরীহ পশু-পক্ষীকে হত্যা করে রন্ধন করে, সেই প্রকার ব্যক্তিরা নর- মাংসভোজী রাক্ষসদেরও ঘৃণিত। মৃত্যুর পর যমদূতেরা কুন্তীপাক নরকে ফুটন্ত তেলে তাদের পাক করে।
৬/কালসূত্র নরকঃ
যস্ত্বিহ ব্রহ্মধ্রুক্ স কালসূত্রসংজ্ঞকে নরকে অযুতযোজনপরিমণ্ডলে তাম্রময়ে তপ্তখলে উপর্যধস্তাদগন্যর্কাভ্যামতিতপ্যমানেহভিনিবেশিতঃ ক্ষুৎপিপাসাভ্যাং চ দহ্যমানান্তবহিঃশরীর আস্তে শেতে চেষ্টতেহবতিষ্ঠতি পরিধাবতি চ যাবন্তি পশুরোমাণি তাবদ্বর্ষসহস্রাণি ॥ ১৪ ॥
-(শ্রীমদ্ভাগবত ৫/২৬/১৪)
অনুবাদঃ ব্রহ্মঘাতীকে কালসূত্র নামক নরকে নিক্ষেপ করা হয়, যার পরিধি ৮০,০০০ মাইল এবং যা তাম্রনির্মিত। নীচ থেকে অগ্নি এবং উপর থেকে প্রখর সূর্যের তাপে সেই তাম্রময় ভূমি অত্যন্ত উত্তপ্ত হয়। সেখানে ব্রহ্মঘাতীকে অন্তরে এবং বাইরে দগ্ধ করা হয়। অন্তরে সে ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় দগ্ধ হয় এবং বাইরে সে প্রখর সূর্যকিরণ ও তপ্ত তাম্রে দগ্ধ হতে থাকে। তাই যে কখনও শয়ন করে, কখনও উপবেশন করে, কখনও উঠে দাঁড়ায় এবং কখনও ইতস্তত বিচরণ করে। এইভাবে একটি পশুর শরীরে যত লোম রয়েছে, তত হাজার বছর ধরে তাকে যন্ত্রনা ভোগ করতে হয়।
৭/অসিপত্রবন নরকঃ
যস্ত্বিহ বৈ নিজবেদপথাদনাপদ্যপগতঃ পাখগুং চোপগতস্তমসিপত্রবনং প্রবেশ্য কশয়া প্রহরস্তি তত্র হাসাবিতস্ততো ধাবমান উভয়তোধারৈস্তালবনাসিপত্রৈশ্ছিদ্যমানসর্বাঙ্গো হা হত্যেহম্মীতি পরময়া বেদনয়া মূর্ছিতঃ পদে পদে নিপততি স্বধর্মহা পাখণ্ডানুগতং ফলং ভুঙক্তে ।। ১৫৪।।
–(শ্রীমদ্ভাগবত ৫/২৬/১৫)
অনুবাদঃআপৎকাল উপস্থিত না হলেও যে ব্যক্তি স্বীয় বেদমার্গ থেকে ভ্রষ্ট হয়ে পাষণ্ড ধর্ম অবলম্বন করে, যমদূতেরা তাকে অসিপত্রবন নামক নরকে নিক্ষেপ করে বেত্রাঘাত করতে থাকে। প্রহারের যন্ত্রণায় সে যখন সেই নরকে ইতস্তত ধাবিত হয়, তখন উভয় পার্শ্বের অসিতুল্য তালপত্রের ধারে তার সর্বাঙ্গ ক্ষত-বিক্ষত হয়। তখন সে “হায়, আমি এখন কি করব। আমি এখন কিভাবে রক্ষা পাব।” এই বলে আর্তনাদ করতে করতে পদে পদে মূর্ছিত হয়ে পড়তে থাকে। স্বধর্ম ত্যাগ করে পাষণ্ড মত অবলম্বনের ফল এইভাবে ভোগ করতে হয়।
৮/সূকরমূখ
যস্ত্বিহ বৈ রাজা রাজপুরুষো বা অদণ্ড্যে দণ্ডং প্রণয়তি ব্রাহ্মণে বা শরীরদণ্ডং স পাপীয়ান্নরকেহ মুত্র সুকরমুখে নিপততি তত্রাতি- বলৈবিনিষ্পিষ্যমাণাবয়বো যথৈবেহেক্ষুখণ্ড আর্তস্বরেণ স্বনয়ন্ কচিক্ষুর্জিতঃ কশ্মলমূপগতো যথৈবেহাদৃষ্টদোষা উপরুদ্ধাঃ ॥ ১৬ ॥
-(শ্রীমদ্ভাগবত ৫/২৬/১৬)
অনুবাদঃ ইহলোকে যে রাজা বা রাজপুরুষ দণ্ডদানের অযোগ্য ব্যক্তিকে দণ্ড প্রদান করে, কিংবা অদন্ডনীয় ব্রাহ্মণকে শরীরদণ্ড প্রদান করে, সেই পাপীকে যমদূতেরা সূকরমূখ নরকে নিয়ে যায়। সেখানে অত্যন্ত বলশালী যমদূতেরা তাকে ইক্ষুদণ্ডের মতো নিষ্পেষণ করে। তখন সে আর্তস্বরে রোদন করতে থাকে, এবং নির্দোষ ব্যক্তি দণ্ডিত হলে যেমন মোহগ্রস্ত হয়ে মূর্ছাপ্রাপ্ত হয়, সেও সেইভাবে মূর্ছিত হয়। নির্দোষ ব্যক্তিকে দণ্ডদান করার এই ফল।
৯/অন্ধকূপ নরকঃ
যত্ত্বিহ বৈ ভূতানামীশ্বরোপকল্পিবৃত্তীনাম
বিবিক্তপরব্যথানাং স্বয়ং পুরুষোপকল্পিত
বৃত্তির্বিবিক্তপরব্যথো ব্যথামাচরতি স পরত্রান্ধকূপে তদভিদ্রোহেণ নিপততি তত্র হাসৌ তৈর্জন্তুভিঃ পশুমৃগপক্ষিসরীসৃপৈ- মশকযূকামৎকু ণমক্ষিকাদিভির্যে কে চাভিদ্রুগ্ধাস্তৈঃ সর্বতোহভিদ্রু হ্যমাণস্তমসি বিহতনিদ্রানিবৃতিরলব্ধাবস্থানঃ পরিক্রামতি যথা কুশরীরে জীবঃ ॥ ১৭ ॥
–(শ্রীমদ্ভাগবত ৫/২৬/১৭)
অনুবাদঃভগবানের আয়োজনে ছারপোকা, মশা ইত্যাদি নিম্নস্তরের প্রাণীরা মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণীদের রক্ত পান করে। এই প্রকার নগণ্য প্রাণীদের কোন ধারণা নেই যে, তাদের দংশনের ফলে মানুষের কষ্ট হয়। কিন্তু, ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ইত্যাদি উচ্চ শ্রেণীর মানুষদের চেতনা উন্নত, এবং তাই তারা জানে মৃত্যু কত বেদনাদায়ক। বিবেক সমন্বিত মানুষ যদি বিবেকহীন তুচ্ছ প্রাণীদের হত্যা করে অথবা যন্ত্রণা দেয়, তার নিশ্চয়ই পাপ হয়। সেই প্রকার মানুষকে ভগবান অন্ধ্রকূপ নামক নরকে নিক্ষেপ করে দণ্ডদান করেন, এবং সে যে-সমস্ত পশু, পক্ষী, সরীসৃপ, মশক, উকুন, কীট, মাছি ইত্যাদি প্রাণীদের যন্ত্রণা দিয়েছিল, তাদের দ্বারা আক্রান্ত হয়। তারা তাকে সবদিক থেকে আক্রমণ করে এবং তার ফলে তার নিদ্রা-সুখ একেবারেই নষ্ট হয়ে যায়। যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে সে কোথাও বিশ্রাম করতে না পেরে অন্ধকারে নিরন্তর ছুটাছুটি করতে থাকে। এইভাবে অন্ধকূপে সে একটি নিম্নস্তরের প্রাণীর মতো যন্ত্রণা ভোগ করে।
১০/কৃমিভোজন নরকঃ
যত্ত্বিহ বা অসংবিভজ্যাশ্বাতি যৎ কিঞ্চনোপনতমনির্মিত পঞ্চযজ্ঞো বায়সসংস্তুতঃ স পরত্র কৃমিভোজনে নরকাধমে নিপততি তত্র শতসহস্রযোজনে কৃমিকুণ্ডে কৃমিভূতঃ স্বয়ং কৃমিভিরেব ভক্ষ্যমাণঃ কৃমিভোজনো যাবত্ত দপ্রত্তাপ্রভৃতাদোহ নির্বেশমাত্মানং
যাতয়তে ।। ১৮ ॥
–(শ্রীমদ্ভাগবত ৫/২৬/১৮)
অনুবাদঃ যে বাক্তি কোন ভক্ষ্যদ্রব্য প্রাপ্ত হলে অতিথি, বালক বা বৃদ্ধদের তার যথাযথ অংশ না দিয়ে নিজেই ভোজন করে, অথবা যে ব্যক্তি পঞ্চবিধ যজ্ঞের অনুষ্ঠান করে না, সে কাকতুল্য বলে বর্ণিত হয়। তার মৃত্যুর পর তাকে কৃমিভোজন নামক একটি নিকৃষ্ট নরকে নিক্ষেপ করা হয়। সেই নরকের বিস্তার ১,০০,০০০ যোজন এবং তা কৃমিতে পূর্ণ। সেখানে সেই কৃমিকুণ্ডে একটি কৃমি হয়ে সে কৃমি ভক্ষণ করে এবং সেখানকার কৃমিরা তাকে ভক্ষণ করে। তার মৃত্যুর পূর্বে সে যদি তার অপকর্মের জন্য প্রায়শ্চিত্ত না করে, তা হলে সেই পাপীকে সেই কুণ্ডের বিস্তার যত যোজন তত বছর সেখানে থাকতে হয়।
১১/ সন্দংশ নরকঃ
যত্ত্বিহ বৈ স্তেয়েন বলাদ্বা হিরণ্যরত্নাদীনি ব্রাহ্মণস্য বাপহরত্যন্যস্য বানাপদি পুরুষস্তমমুত্র রাজন যমপুরুষা অয়স্ময়ৈরগ্নিপিণ্ডেঃ সন্দংশৈস্ত্বচি নিষ্কৃষন্তি ৷। ১৯ ॥
-(শ্রীমদ্ভাগবত ৫/২৬/১৯)
অনুবাদঃহে রাজন, যে ব্যক্তি সঙ্কট উপস্থিত না হলেও ব্রাহ্মণ অথবা অন্য কোন ব্যক্তির স্বর্ণ-রত্ন ইত্যাদি ধন চৌর্যবৃত্তির দ্বারা অথবা বল প্রয়োগের দ্বারা অপহরণ করে, তাকে সন্দংশ নামক নরকে নিক্ষেপ করা হয়। সেখানে লৌহময় অগ্নিপিণ্ড এবং সাঁড়াশির দ্বারা তার ত্বক ছিন্নভিন্ন করা হয়। এইভাবে তার সারা শরীর কেটে টুকরো টুকরো করা হয়।
১২/ তপ্তসূমি নরকঃ
যস্ত্বিহ বা অগম্যাং স্ত্রিয়মগম্যং বা পুরুষং যোষিদভিগচ্ছতি তাবমুত্র কশয়া তাড়য়ন্তস্তিগ্ময়া সূর্য্যা লোহময্যা পুরুষমালিঙ্গয়ন্তি স্ত্রিয়ং চ পুরুষরূপয়া সূর্ম্যা ॥ ২০।।
–(শ্রীমদ্ভাগবত ৫/২৬/২০)
অনুবাদঃ যে ব্যক্তি অগম্যা স্ত্রীতে এবং যে স্ত্রী অগম্য পুরুষে অভিগমন করে, পরলোকে যমদূতেরা তাদের তপ্তসূর্মি নামক নরকে নিয়ে গিয়ে চাবুক দিয়ে প্রহার করে এবং তারপর পুরুষকে তপ্ত লৌহময় স্ত্রীমূর্তি ও স্ত্রীকে সেই প্রকার পুরুষ-মূর্তির দ্বারা আলিঙ্গন করায়। এটিই অবৈধ যৌন সঙ্গের দণ্ড।”
১৩/বজ্রকন্টক শাল্মলী নরকঃ
যস্ত্বিহ বৈ সর্বাভিগমস্তমমূত্র নিরয়ে বর্তমানং বজ্রকণ্টকশাল্মলীমারোপ্য নিষ্কর্যন্তি ॥ ২১ ॥
-(শ্রীমদ্ভাগবত ৫/২৬/২১)
অনুবাদঃ যে ব্যক্তি পশুতেও অভিগমন করে, তার মৃত্যুর পর তাকে বজ্রকণ্টক-শাল্মলী নামক নরকে নিক্ষেপ করা হয়। সেই নরকে একটি শাল্মলী বৃক্ষ রয়েছে, যার কাঁটা বজ্রের মতো। যমদূতেরা সেই পাপীকে তার উপর চড়িয়ে টানতে থাকে এবং তার ফলে সেই কাঁটার দ্বারা তার সারা দেহ ছিন্নভিন্ন হয়।
১৪/ বৈতরণী নরকঃ
যে ত্বিহ বৈ রাজন্যা রাজপুরুষা বা অপাখণ্ডা ধর্মসেতুন ভিন্দন্তি তে সম্পরেত্য বৈতরণ্যাং নিপতন্তি ভিন্নমর্যাদাস্তস্যাং নিরয়পরিখাভূতায়াং নদ্যাং যাদোগণৈরিতস্ততো ভক্ষ্যমাণা আত্মনা ন বিযুজ্যমানাশ্চাসুভিরুহ্য- মানাঃ স্বাঘেন কর্মপাকমনুস্মরন্তো বিণ্মূত্রপুয়শোণিতকেশন খাস্থিমেদো- মাংসবসাবাহিন্যামুপতপ্যন্তে ॥ ২২॥
–(শ্রীমদ্ভাগবত ৫/২৬/২২)
অনুবাদঃ যে সমস্ত রাজন্য বা রাজপুরুষ ক্ষত্রিয় আদি দায়িত্বশীল পরিবারে জন্মগ্রহণ করা সত্ত্বেও ধর্মনীতির অবহেলা করে এবং তার ফলে অধঃপতিত হয়, তারা মৃত্যুর পর বৈতরণী নামক নরকের নদীতে পতিত হয়। নরক বেষ্টনকারী পরিখাসদৃশ এই নদীটি ভয়ঙ্কর জলচর প্রাণীতে পূর্ণ। পাপী ব্যক্তি যখন এই বৈতরণী নদীতে নিক্ষিপ্ত হয়, তখন সেখানকার হিংস্র জলচরেরা তাকে ভক্ষণ করতে শুরু করে। কিন্তু তার ভয়ঙ্কর পাপকর্মের ফলে তার প্রাণ বহির্গত হয় না। সে তার পাপকর্মের কথা স্মরণ করতে করতে বিষ্ঠা, মূত্র, পুঁজ, রক্ত, কেশ, নখ, অস্থি, মেদ, মাংস এবং চর্বিপূর্ণ সেই নদীতে যন্ত্রণাভোগ করতে থাকে।
১৫/পূয়োদ নরকঃ
যে ত্বিহ বৈ বৃষলীপতয়ো নষ্টশৌচাচারনিয়মাস্ত্যক্তলজ্জাঃ পশুচর্যাং চরন্তি তে চাপি প্রেত্য পৃয়বিণ্মূত্রশ্লেষ্মমলাপূর্ণার্ণবে নিপতন্তি তদেবাতিবীভৎ- সিতমশ্বস্তি ॥ ২৩ ॥
-(শ্রীমদ্ভাগবত ৫/২৬/২৩)
অনুবাদঃ শূদ্রা-রমণীদের নির্লজ্জ পতিরা ঠিক একটি পশুর মতো জীবন যাপন করে, এবং তাই তাদের জীবন সদাচার, শৌচ এবং নিয়মবিহীন। মৃত্যুর পর তাদের পূয়োদ নামক নরকে নিক্ষেপ করা হয়, যা পুঁজ, মূত্র, শ্লেষ্মা, লালা ইত্যাদি ঘৃণিত বস্তুতে পূর্ণ একটি সমুদ্র। সেখানে তারা এই সমস্ত অতি ঘৃণিত পদার্থ ভক্ষণ করতে বাধ্য হয়।
১৬/প্রাণরোধ নরকঃ
যে ত্বিহ বৈ শ্বগর্দভপতয়ো ব্রাহ্মণাদয়ো মৃগয়াবিহারা অতীর্থে চ মৃগান্নিঘ্নস্তি তানপি সম্পরেতাঁল্লক্ষ্যভূতান্ যমপুরুষা ইযুভির্বিধ্যন্তি ॥২৪৷৷
-(শ্রীমদ্ভাগবত ৫/২৬/২৪)
অনুবাদঃ উচ্চ বর্ণের মানুষ (ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্য) যদি কুকুর, গর্দভ ইত্যাদি পশু পালনে আসক্ত হয় এবং অনর্থক মৃগয়ায় গিয়ে পশু হত্যা করে, তা হলে মৃত্যুর পর তাকে প্রাণরোধ নামক নরকে নিক্ষেপ করা হয়। সেখানে যমদূতেরা তাকে তাদের লক্ষ্য বানিয়ে বাণের দ্বারা বিদ্ধ করে।
১৭/ বিশসন নরকঃ
যে ত্বিহ বৈ দাম্ভিকা দম্ভযজ্ঞেষু পশূন্ বিশসন্তি তানমুষ্মিঁল্লোকে বৈশসে নরকে পতিতান্নিরয়পতয়ো যাতয়িত্বা বিশসন্তি ॥ ২৫ ॥
-(শ্রীমদ্ভাগবত ৫/২৬/২৪)
অনুবাদঃ যে ব্যক্তি ইহলোকে ধন এবং প্রতিষ্ঠার গর্বে গর্বিত হয়ে, দম্ভ প্রকাশ করার জন্য যজ্ঞে পশু বলি দেয়, তাকে মৃত্যুর পর বিশসন নামক নরকে নিক্ষেপ করা হয়। সেখানে যমদূতেরা তাকে অশেষ যন্ত্রণা দিয়ে বধ করে।
১৮/লালাভক্ষ নরকঃ
যত্ত্বিহ বৈ সবৰ্ণাং ভার্যাং দ্বিজো রেতঃ পায়য়তি কামমোহিতস্তং পাপকৃতমমূত্র রেতঃকুল্যায়াং পাতয়িত্বা রেতঃ সম্পায়য়ন্তি ॥ ২৬ ॥
-(শ্রীমদ্ভাগবত ৫/২৬/২৪)
অনুবাদঃ যে মূর্খ দ্বিজ (ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্য) তার সবর্ণা পত্নীকে বশে রাখার জন্য নিজের শুক্র পান করায়, পরলোকে যমদূতেরা তাকে লালাভক্ষ নামক নরকে নিক্ষেপ করে এবং সেখানে শুক্রনদীর মধ্যে তাকে শুক্র পান করায়।
১৯/সারমেয়াদন নরকঃ
যে ত্বিহ বৈ দস্যবোহগ্নিদা গরদা গ্রামান সার্থাত্ বা বিলুম্পন্তি রাজানো বাজাওটা বা তাশ্চাপি হি পরেত্য যমদূতা বজ্রদংষ্ট্রাঃ শ্বানঃ সপ্তশতানি বিংশতিশ্চ সরভসং খাদন্তি ।। ২৭ ॥
-(শ্রীমদ্ভাগবত ৫/২৬/২৪)
অনুবাদঃ ইহলোকে যে সমস্ত ব্যক্তি দস্যুবৃত্তি করে পরগৃহে অগ্নি দেয় অথবা বিষ প্রদান করে, অথবা যে সমস্ত রাজা বা রাজপুরুষ আয়কর আদায়ের নামে অথবা অন্যান্য উপায়ে বণিক সম্প্রদায়কে লুণ্ঠন করে, মৃত্যুর পর সেই সমস্ত অসুরদের সারমেয়াদন নামক নরকে নিক্ষেপ করা হয়। সেখানে ৭২০টি বজ্রের মতো দন্ত সমন্বিত কুকুর রয়েছে। যমদূতের নির্দেশে সেই কুকুরগুলি অত্যন্ত তৃপ্তির সঙ্গে সেই সমস্ত পাপীদের ভক্ষণ করে।
২০/অবীচিমৎ নরকঃ
যত্ত্বিহ বা অনূতং বদতি সাক্ষ্যে দ্রব্যবিনিময়ে দানে বা কথঞ্চিৎ স বৈ প্রেত্য নরকেহবীচিমত্যধঃশিরা নিরবকাশে যোজনশতোষ্ট্রায়াদ গিরিমূর্ধ্নঃ সম্পাত্যতে যত্র জলমিব স্থলমশ্মপৃষ্ঠমবভাসতে তদবীচিমত্তিলশো বিশীর্ষমাণশরীরো ন ম্রিয়মাণঃ পুনরারোপিতো
নিপততি ॥ ২৮॥
-(শ্রীমদ্ভাগবত ৫/২৬/২৮)
অনুবাদঃ যে ব্যক্তি ইহলোকে সাক্ষ্য প্রদান করার সময়, ক্রয়-বিক্রয় করার সময় এবং দান করার সময় কোন প্রকার মিথ্যা কথা বলে, পরলোকে যমদূতেরা তাকে শত যোজন উন্নত পর্বত শিখর থেকে মাথা নীচের দিকে করে অবীচিমৎ নামক নরকে নিক্ষেপ করে। সেই নরকের কোন অবলম্বন স্থান নেই, এবং প্রস্তর নির্মিত পৃষ্ঠস্থল জলের মতো প্রতীত হয়। কিন্তু সেখানে কোন জল নেই। তাই তাকে বলে অবীচিমৎ (জলহীন)। সেই পাপীদের বার বার পাহাড়ের উপর থেকে নিক্ষেপ করা হলেও, এবং তাদের দেহ তিল তিল করে বিদীর্ণ হলেও, তাদের মৃত্যু হয় না এবং তারা নিরন্তর সেই যন্ত্রণা ভোগ করতে থাকে।
২১/অয়ঃপান নরকঃ
যস্তিহ বৈ বিপ্রো রাজন্যো বৈশ্যো বা সোমপীস্তৎকলত্রং বা সুরাং ব্রতস্থোহপি বা পিবতি প্রমাদতস্তেষাং নিরয়ং নীতানামুরসি পদক্রেমাস্যে বহ্নিনা দ্রবমাণং কার্ষ্ণায়সং নিষিঞ্চন্তি।।২৯।।
-(শ্রীমদ্ভাগবত ৫/২৬/২৯)
অনুবাদঃ” যে ব্রাহ্মণ অথবা ব্রাহ্মণী সুরা পান করে, কিংবা যে ক্ষত্রিয় কিংবা বৈশ্য ব্রতপরায়ণ হয়ে প্রমাদবশত সোমরস পান করে, যমদূতেরা তাদের অয়ঃপান নরকে নিয়ে যায়। অয়ঃপান নরকে যমদূতেরা তাদের পা দিয়ে পাপীদের বক্ষঃস্থল চেপে ধরে তাদের মুখে অত্যন্ত উত্তপ্ত তরল লোহা ঢেলে দেয়।”
২২/ ক্ষারকর্দম নরকঃ
অথ চ যস্ত্বিহ বা আত্মসম্ভাবনেন স্বয়মধমো জন্মতপোবিদ্যাচারবর্ণাশ্রম- বতো বরীয়সো
ন বহু মন্যেত স মৃতক এব মৃত্বা ক্ষারকর্দমে নিরয়েহ্বাকশিরা নিপাতিতো দুরন্তা
যাতনা হ্যশ্নুতে ॥ ৩০ ॥
–(শ্রীমদ্ভাগবত ৫/২৬/৩০)
অনুবাদঃ যে নীচ কুলোদ্ভূত এবং অধম হওয়া সত্ত্বেও ‘আমি বড়’ বলে মিথ্যা অহঙ্কারপূর্বক জন্ম, তপস্যা, বিদ্যা, আচার, বর্ণ অথবা আশ্রমে তার থেকে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিকে যথাযথভাবে সম্মান প্রদর্শন করে না, সে জীবিত অবস্থাতেই মৃত এবং মৃত্যুর পর তাকে ক্ষারকদম নামক নরকে নিক্ষেপ করা হয়। সেখানে সে যমদূতদের দ্বারা প্রচণ্ডভাবে নির্যাতিত হয়ে অত্যন্ত দুঃখ-যন্ত্রণা ভোগ করে।
২৩/রক্ষোগণ ভোজনঃ
যে ত্বিহ বৈ পুরুষাঃ পুরুষমেধেন যজন্তে যাশ্চ স্ত্রিয়ো নৃপশূন খাদন্তি তাংশ্চ তে পণব ইব নিহতা যমসদনে যাতয়ন্তো রক্ষোগণাঃ সৌনিকা ইব স্বধিতিনাবদায়াসৃক পিবন্তি নৃত্যন্তি চ গায়ন্তি চ হৃষ্যমাণা
যথেহ পুরুষাদাঃ ॥ ৩১।।
-(শ্রীমদ্ভাগবত ৫/২৬/৩১)
অনুবাদঃ এই পৃথিবীতে অনেক পুরুষ এবং স্ত্রী রয়েছে, যারা ভৈরব অথবা ভদ্রকালীর কাছে নরবলি দিয়ে তাদের মাংস খায়। যারা এই ধরনের কার্য করে, তাদের মৃত্যুর পর যমালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়, এবং তারা যাদের বলি দিয়েছিল তারা সুতীক্ষ্ণ অস্ত্রের দ্বারা সেখানে তাদের খণ্ড খণ্ড করে কাটে। ইহলোকে যে ব্যক্তি যেভাবে নরবলি দিয়ে তার রক্ত পান করে আনন্দে নৃত্য গীত করে, হিংসিত ব্যক্তিরাও তেমন পরলোকে যজ্ঞকারীর রক্ত পান করে আনন্দে নৃত্যগীত করে।
২৪/শূলপ্রোত নরক
যে ত্বিহ বা অনাগসোহরণ্যে গ্রামে বা বৈশ্রম্ভকৈরুপসৃতানুপবিশ্রস্তয্য জিজীবিষুন্ শূলসূত্রাদিষুপপ্রোতান্ ক্রীড়নকতয়া যাতয়ন্তি হেপি চ প্রেত্য যমযাতনাসু শূলাদিষু প্রোতাত্মানঃ ক্ষুত্তড়ভ্যাং চাভিহতাঃ কঙ্কবটাদিভিশ্চেত স্ততস্তিগ্মতুণ্ডৈরাহন্যমানা আত্মশমলং স্মরন্তি ॥ ৩২।।
-(শ্রীমদ্ভাগবত ৫/২৬/৩২)
অনুবাদঃ যে সমস্ত মানুষ ইহলোকে গ্রামে বা অরণ্যে জীবন রক্ষার্থে আগত পশু-পাখিদের আশ্রয় দান পূর্বক বিশ্বাস জন্মিয়ে শূল অথবা সূত্রের দ্বারা তাদের বিদ্ধ করে এবং তারপর ক্রীড়নকের মতো ক্রীড়া করে প্রবল যন্ত্রণা দেয়, তারা মৃত্যুর পর যমদূতদের দ্বারা শূলপ্রোত নামক নরকে নীত হয় এবং তাদের শরীর তীক্ষ্ণ শূল ইত্যাদির দ্বারা বিদ্ধ করা হয়। সেখানে তারা ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় পীড়িত হয়, এবং চতুর্দিক থেকে বক, শকুন প্রভৃতি তীক্ষ্ণ-চঞ্চু পক্ষী এসে তাদের দেহ ছিন্নভিন্ন করতে থাকে। এইভাবে যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে তারা তখন তাদের পূর্বকৃত পাপকর্মের কথা স্মরণ করতে থাকে।
২৫/দন্দশূক নরকঃ
যে ত্বিহ বৈ ভূতান্যুদ্বেজয়ন্তি নরা উল্বণস্বভাবা যথা দন্দশূকাস্তেহপি প্রেত্য নরকে দন্দশূকাখ্যে নিপতন্তি যত্র নৃপ দন্দশূকাঃ পঞ্চমুখাঃ সপ্তমুখা উপসৃত্য গ্রসন্তি যথা বিলেশয়ান্ ॥ ৩৩ ॥
–(শ্রীমদ্ভাগবত ৫/২৬/৩৩)
অনুবাদঃ যারা ইহলোকে সর্পের মতো ক্রোধপরায়ণ হয়ে অন্য প্রাণীদের যন্ত্রণা দেয়, তারা পরলোকে দন্দশূক নামক নরকে পতিত হয়। হে রাজন, সেই নরকে পঞ্চমুখ ও সপ্তমুখ সর্পেরা তাদের মুষিকের মতো গ্রাস করে।
২৬/অবটনিরোধন নরকঃ
যে ত্বিহ বা অন্ধাবটকূসূলগুহাদিধূ ভূতানি নিরুদ্ধপ্তি তথামুত্র তেষেবোপবেশ্য সগরেণ বহ্নিনা ধূমেন নিরুদ্ধপ্তি ।।৩৪।।
-(শ্রীমদ্ভাগবত ৫/২৬/৩৪)
অনুবাদঃ যারা ইহলোকে অন্য প্রাণীদের অন্ধকূপে, গোলায় বা পাহাড়ের গুহার রুদ্ধ করে কষ্ট দেয়, মৃত্যুর পর তাঁদের অবটনিরোধন নামক নরকে নিক্ষেপ করা হয়। সেখানে অন্ধকূপ আদিতে বিষাক্ত ধূম এবং বহ্নির দ্বারা শ্বাসরোধ করে তাদের কঠোরভাবে যন্ত্রণা দেওয়া হয়।
২৭/পর্যাবর্তন নরকঃ
যস্ত্বিহ বা অতিথীনভ্যাগতান বা গৃহপতিরসকৃদূপগতমন্যুর্দিধঞ্চুরিব পাপেন চক্ষুষা নিরীক্ষতে তস্য চাপি নিরয়ে পাপদৃষ্টেরক্ষিণী বজ্রতণ্ডা গদ্রাঃ কঙ্ককাকবটাদয়ঃ
প্রসহ্যোরুবলাযুৎপাটয়ন্তি।। ৩৫ ॥
-(শ্রীমদ্ভাগবত ৫/২৬/৩৫)
অনুবাদঃ যে গৃহপতি অতিথি অভ্যাগত দেখলে ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে এবং পাপকুটিল দৃষ্টি দ্বারা যেন তাদের ভস্মীভূত করতে উদ্যত হয়, তাকে পর্যাবর্তন নামক নরকে নিক্ষেপ করা হয়, যেখানে বজ্রের মতো কঠিন চক্ষুবিশিষ্ট শকুন, বক, কাক ইত্যাদি পক্ষীরা সেই পাপদৃষ্টি ব্যক্তির চক্ষু সহসা বলপূর্বক উৎপাটন করে।
২৮/ সূচীমুখ নরকঃ
যত্ত্বিহ বা আঢ্যাভিমতিরহস্কৃ তিস্তির্যপ্রেক্ষণঃ সর্বতোহ ভিবিশঙ্কী অর্থব্যয়নাশচিন্তয়া পরিশুষ্যমাণহৃদয়বদনো নিবৃতিমনবগতো গ্রহ ইবার্থমভিরক্ষতি স চাপি প্রেত্য তদুৎপাদনোৎকর্ষণসংরক্ষণশমলগ্রহঃ সূচীমুখে নরকে নিপততি যত্র হ বিত্তগ্রহং পাপপুরুষং ধর্মরাজপুরুষা বায়কা ইব সর্বতোহঙ্গেযু সূত্রৈঃ পরিবয়ন্তি ৷৷ ৩৬ ॥
-(শ্রীমদ্ভাগবত ৫/২৬/৩৬)
অনুবাদঃ যে ব্যক্তি ইহলোকে তার ধনের গর্বে গর্বিত, সে মনে করে, “আমি কত ধনী। কে আমার সমকক্ষ হতে পারে?” এইভাবে অহঙ্কারে বক্রদৃষ্ট হয়ে সে সব সময় শঙ্কিত থাকে যে, অন্যেরা তার ধন অপহরণ করে নেবে। এমনকি সে তার গুরুজনদেরও সন্দেহ করে। এইভাবে ধন হারানোর ভয়ে তার হৃদয় ও বদন শুষ্ক হয়ে যায়, এবং তার ফলে তাকে ঠিক একটি পিশাচের মতো দেখতে লাগে। সে কখনই সুখ পায় না এবং দুশ্চিন্তাহীন জীবন বলতে যে কি বোঝায়, তা সে জানতে পারে না। ধন উপার্জন, বর্ধন ও রক্ষণের জন্য যেহেতু তাকে পাপকর্ম করতে হয়, তার ফলে তাকে সূচীমুখ নামক নরকে নিক্ষেপ করা হয়, সেখানে যমদূতেরা তার সর্বাঙ্গে তাঁতীর মতো সূত্র বয়ন করে।
পরিশেষে শ্রীমদ্ভাগবত শাস্ত্র অনুসারে বহু বহু নিম্নতর জীবনের পর আমরা মনুষ্য জীবন প্রাপ্ত হয়েছি।সুতারাং এ মনুষ্য জীবন প্রাপ্ত হয়ে আমাদের কখনো শাস্ত্রবিরুদ্ধ পাপকর্ম করা উচিত নয়।আমাদের উচিত শাস্ত্র অনুসারে কর্ম সম্পাদন পূর্বক পরমাত্মা শ্রীকৃষ্ণের প্রেমময়ী সেবায় যুক্ত থাকা যার প্রভাবে আমরা ভগবদ্ধাম চিন্ময় জগতে ফিরে যেতে পারি।
।। হরে কৃষ্ণ। প্রনাম।।
প্রচারে- স্বধর্মম্ : Connect to the inner self.