বৈদিক শাস্ত্রে কোথায় শ্রীমতি রাধারাণীর উল্লেখ রয়েছে?
বেদ সনাতন ধর্মের প্রধান ধর্মগ্রন্থ। বেদ বা শ্রুতি শাস্ত্র প্রধানত চার প্রকার- ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ ও অথর্ববেদ। প্রত্যেক বেদ-এর চারটি করে অংশ থাকে। যথা- সংহিতা, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক এবং উপনিষদ।
সনাতন শাস্ত্রে শ্রীমতি রাধারাণীকে ‘বৃষভানুনন্দিনী’, ‘বার্ষভানবী’ ‘গান্ধর্ব্বী’ ইত্যাদি নামে সম্বোধন করা হয়েছে।
শ্রুতি বা বেদ শাস্ত্রে বিশেষ করে ঋগ্বেদ, সামবেদ এবং অথর্ববেদীয় গোপালতাপনী উপনিষদে শ্রীমতি রাধারাণীর বহু উল্লেখ দেখা যায়। এছাড়াও নারদীয় মহাপুরাণ, পদ্ম মহাপুরাণ, শ্রীমদ্ভাগবত মহাপুরাণ, ব্রহ্মবৈবর্ত মহাপুরাণ, বরাহপুরাণ, স্কন্দ পুরাণ, মৎস্য পুরাণ, ব্রহ্মান্ড পুরাণ, গর্গ-সংহিতা, সনৎকুমার সংহিতা ও নারদ-পঞ্চরাত্র ইত্যাদি শাস্ত্রেও বিশেষভাবে শ্রীমতি রাধারাণীর মহিমা বর্ণিত রয়েছে।
শ্রুতি বা বেদ শাস্ত্রে শ্রীমতি রাধারাণী –
স্তোত্রং রাধানাং পতে গির্বাহো বীর যস্য তে। বিভূতিরস্তু সূনৃতা ॥
[ ঋগ্বেদ সংহিতা ১।৩০।৫; সামবেদ সংহিতা, উত্তরার্চিক ১৬।৩।৮ ; সামবেদ-১৬০০ ]
বঙ্গানুবাদ:
হে রাধাপতি (ঐশ্বর্যের পতি), হে বীর! প্রশস্তি দ্বারা স্তুত, যে তোমার স্তুতি করে সে সমৃদ্ধি ও আনন্দ লাভ করে। অর্থাৎ তাঁর সত্য রূপা প্রিয় সমৃদ্ধি লাভ হয়।
ইদং হ্যন্বোজসা সুতং রাধানাং পতে।
পিবা ত্বাস্য গিৰ্বণঃ ॥
[ ঋগ্বেদ সংহিতা ৩।৫১।১০; সামবেদ সংহিতা, উত্তরার্চিক ২।৩।১ ; সামবেদ-৭৩৭ ]
বঙ্গানুবাদ:
হে রাধাপতি (ঐশ্বর্যের পতি), হে স্তুতিপ্রিয়! তেজ দ্বারা সম্পন্ন এই মধুর সোমরস তোমার পানের জন্য। তুমি এসে পান কর।
তস্য মধ্যে হি শ্রেষ্ঠা গান্ধর্ব্বীত্যুবাচ।
তং হি বৈ তাভিরেরং বিচার্য্য।।
[ অথর্ববেদীয় গোপালতাপনী উপনিষদ, উত্তরবিভাগ, মন্ত্র ৯ ]
বঙ্গানুবাদ:
গোপীদিগের মধ্যে গান্ধর্ব্বী ( রাধারাণীর একটি নাম) নামে এক প্রধানা গোপী তাঁদের সাথে বিচার করে জিজ্ঞাসা করলেন।
দ্বে পার্শ্বে চন্দ্রাবলী রাধিকা চেতি যস্যাংশেন লক্ষ্মীদুর্গাদিকা শক্তিরিতি।
[ অথর্ববেদ, পুরুষবোধিনী উপনিষদ, ১ম প্রপাঠক ]
বঙ্গানুবাদ:
“তাঁর(শ্রীকৃষ্ণের) দুই পাশে চন্দ্রাবলী ও রাধিকা। এই রাধিকা হলেন কৃষ্ণের স্বরূপশক্তি যার অংশে লক্ষ্মী দুর্গাদি শক্তি।”
এ শ্রুতি মন্ত্রে লক্ষ্মী,দূর্গা প্রাকৃত দেবী নন। ইনারা চিন্ময়ধামস্থিত মহালক্ষ্মী, মহাদূর্গাদি দেবী।
তস্যাদ্যা প্রকৃতী রাধিকা নিত্যা নির্গুণা সর্বালঙ্কারশোভিতা প্রসন্নাশেষলাবণ্যসুন্দরী । অস্মদাদীনাং জন্ম তদধীনং অস্যাংশাদ বহুবো বিষ্ণুরুদ্রাদয়ো ভবন্তি ।
[ অথর্ববেদ, পুরুষবোধিনী শ্রুতি, ৩য় প্রপাঠক ]
বঙ্গানুবাদ:
সেই পরমপুরুষের আদ্যা প্রকৃতি রাধিকা। তিনিও শ্রীকৃষ্ণের নিত্যা অর্থাৎ কেবল দ্বাপরে কুব্জাদির ন্যায় কৃষ্ণ লীলা সঙ্গিনী নন। শ্রীকৃ্ষ্ণের ন্যায় তিনিও নির্গুণা অর্থাৎ গুণাতীত। সর্ব অলঙ্কারে সুশোভিতা, প্রসন্না অশেষলাবণ্যবতী আমাদের সকলের আদি, তাঁর অংশে কোটি বিষ্ণুরুদ্রাদির জন্ম হয়।
.
পুরাণ শাস্ত্রে শ্রীমতি রাধারাণী:
অথর্ববেদীয় ছান্দোগ্য উপনিষদ-৭।১।২ মন্ত্রে, পুরাণ ও ইতিহাস শাস্ত্রকে পঞ্চম বেদ বলা হয়েছে, “ইতিহাসপুরাণং পঞ্চমং বেদানাং”।
দেবী কৃষ্ণময়ী প্রোক্তা রাধিকা পরদেবতা।
সর্বলক্ষ্মীস্বরূপা সা কৃষ্ণাহ্লাদস্বরূপিণী।।
[ পদ্মপুরাণ, পাতালখন্ড, ৫০।৫৩ ]
বঙ্গানুবাদ:
দেবী রাধিকা কৃষ্ণময়ী। তাই তিনি পরদেবতা রূপে কথিতা হন। তিনি সর্বলক্ষ্মীরূপিণী এবং কৃষ্ণের হ্লাদিনী স্বরূপা।
.
পদ্মপুরাণে আরো উল্লেখ রয়েছে –
কথিতুং তৎফলং পুণ্যং ন শক্নোত্যপি নারদ ।
কোটিজন্মাৰ্জ্জিতং পাপং ব্রহ্মহত্যাদিকং মহৎ।
কুৰ্ব্বন্তি যে সকৃদ্ভক্ত্যা তেষাং নশ্যতি তৎক্ষনাৎ।।
[ পদ্মপুরাণ, ব্রহ্মখণ্ড ৭।৭]
বঙ্গানুবাদ:
যে সকল মানুষ ভক্তিভরে একবার মাত্র এই মহাপবিত্র শ্রীরাধাষ্টমী ব্রত পালন করে থাকেন, সেই সকল মানুষের কোটি জন্মের ব্রহ্মহত্যাদি সমস্ত মহাপাপ তৎক্ষনাৎ বিনাশ হয়ে যায়।
.
পদ্মপুরাণে আরো উল্লেখ হয়েছে –
বামপার্শ্বে স্থিতাং তস্য রাধিকাঞ্চ স্মরেত্ততঃ।
নীলচোলকসংবীতাং তপ্তহেমসমপ্রভাম্।।
পট্টাঞ্চলেনাবৃতার্দ্ধ-সুস্মেরাননপঙ্কজাম্।
কান্তবক্তে ন্যস্তনেত্রাং চকোরীর চলেক্ষণাম।।
[ পদ্মপুরাণ, পাতালখন্ড, অধ্যায় ৫০, শ্লোক ৪৪,৪৫ ]
বঙ্গানুবাদ:
ভক্ত স্মরণ করবে- পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণের বামভাগে রাধিকা বিরাজমান রয়েছেন, তাঁর পরিধান-নীলবসন, উত্তপ্ত স্বর্ণের ন্যায় তাঁর দেহপ্রভা; তাঁর ঈষৎ হাসিযুক্ত মুখপদ্ম আঁচলে অর্ধাবৃত। চকোরী পাখি যেমন চন্দ্রের অমৃত কিরণ পান করেন, তেমনি শ্রীমতি রাধিকা তার চঞ্চল নেত্রযুগল দ্বারা নিজ কান্ত(স্বামী) কৃষ্ণের মুখচন্দ্রের দিকে তাকিয়ে তার রূপমাধুর্য্যসুধা আস্বাদন করছেন।
.
পদ্মপুরাণে আরও বলা হয়েছে-
ততঃ সারিশুকানাঞ্চ শ্রুত্বা বাগাহবং মিথঃ।
নির্গচ্ছতস্ততঃ স্থানাদগন্তুকামৌ গৃহং প্রতি ॥
কৃষ্ণঃ কান্তামনুজ্ঞাপ্য গবামভিমুখং ব্রজেৎ।
সা তু সূর্যাগৃহৎ গচ্ছেৎ সখীমণ্ডলসংযুতা ॥
[ পদ্মপুরাণ, পাতালখন্ড, অধ্যায় ৫২, শ্লোক ৭৬,৭৭ ]
বঙ্গানুবাদ:
রাধার ভ্রূভঙ্গী দর্শন ও কৃষ্ণের প্রতি তিরস্কার বাক্য শ্রবণ করার নিমিত্ত শুক-সারিকা- পক্ষিগণ সেখানে উপস্থিত হয়ে নিজেরাই আবার বাগ্যুদ্ধ বাধিয়ে দিলো। রাধা- কৃষ্ণ তাদের বাগযুদ্ধ শ্রবণ করে গৃহগমনাভিলাষে সেখান হতে বহির্গত হন। কৃষ্ণ তার কান্তা(পত্নী) শ্রীমতি রাধিকার অনুমতি নিয়ে গাভীবৃন্দের অভিমুখে গমন করেন। শ্রীমতি রাধা সখীগণসমভিব্যাহারে সূর্য্য পূজা করার জন্য সূর্য্য-গৃহে গমন করেন।
.
নারদীয় মহাপুরাণে উল্লেখ রয়েছে –
কদাচিৎ তয়া সার্দ্ধ স্থিতস্য মুনিসত্তম কৃষ্ণস্য।
বামভাগাৎ জাতো নারায়ণঃ স্বয়ম্।।
রাধিকায়াশ্চ বামাংগান্মহালক্ষ্মীভূব হ।
ততঃ কৃষ্ণো মহালক্ষ্মীং দত্ত্বা নারায়ণায় চ।।
বৈকুন্ঠ স্থাপযামাস শশ্বত্পালনকর্মণি।।
[ নারদীয় মহাপুরাণ, পূর্বভাগ, ৩।৮৩।১২-১৪ ]
বঙ্গানুবাদ:
হে মুনিসত্তম, কোনো এক সময় অর্ধাঙ্গিনী রাধা সহিত অবস্থানকালে কৃষ্ণের বামাঙ্গ থেকে নারায়ণ জাত হলো আর শ্রীমতি রাধিকার বামাঙ্গ হতে মহালক্ষ্মীর আবির্ভাব হলো। কৃষ্ণ তখন মহালক্ষ্মী নারায়ণকে প্রদান করলেন এবং বৈকুণ্ঠে স্থিতি প্রদান করে নিত্য পালনকার্যে নিযুক্ত করলেন।
.
স্কন্দপুরাণে উল্লেখ রয়েছে –
বৃষভানুসুতাকান্তবিহারে কীর্ত্তনশ্রিয়া।
সাক্ষাদিব সমাবৃত্তে সর্ব্বেহনন্যদৃশোহভবন।।
[ স্কন্দপুরাণ, বিষ্ণুখন্ড, শ্রীমদ্ভাগবতমাহাত্ম্যম, অধ্যায় ২
৩১ ]
বঙ্গানুবাদ:
বৃষভানুর কণ্যা শ্রীমতি রাধিকার কান্ত(পতি) সাক্ষাৎ কৃষ্ণের বিহারভূমি কীর্ত্তনসমৃদ্ধিতে পরিপূর্ণ হলো এবং সকলেই যেন অনন্য নয়ন হয়ে সেই উৎসব দর্শন করিতে লাগিলেন।
শিব পুরাণে বলা হয়েছে-
কালবতীসুতা রাধা সাক্ষাদগোলোকবাসিনী।
গুপ্তস্নেহানিবদ্ধা সা কৃষ্ণপত্নী ভবিষ্যতি।।
[ শিব মহাপুরাণ, রুদ্রসংহিতা, পার্বতীখন্ড, অধ্যায় ২ শ্লোক ৪০; সনদকুমার উক্তি]
বঙ্গানুবাদ:
সাক্ষাৎ গোলকনিবাসিনী রাধা কলাবতীর কণ্যা হয়ে শ্রীকৃষ্ণের সহিত গোপণে স্নেহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে ভবিষ্যতে কৃষ্ণপত্নী হবেন।
.
ব্রহ্মবৈবর্ত মহাপুরাণে উল্লেখ রয়েছে –
স্বয়ং রাধা কৃষ্ণপত্নী কৃষ্ণবক্ষঃস্থলস্থিতা ।
প্রাণাধিষ্ঠাতৃদেবী চ তস্যৈব পরমাত্মনঃ।।
[ ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ, প্রকৃতিখন্ড, অধ্যায় ৪৮, শ্লোক ৪৭ ]
বঙ্গানুবাদ:
শ্রীমতী রাধিকা স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণের পত্নীরূপে অবস্থিতা। নিরন্তর তিনি পরমব্রহ্ম কৃষ্ণের বক্ষঃস্থলে স্থিতি করেন, ফলতঃ সেই রাধা পরাৎপর কৃষ্ণের প্রাণাধিষ্ঠাত্রী দেবীরূপে নির্দিষ্টা আছেন।
.
ব্রহ্মবৈবর্ত মহাপুরাণে আরো উল্লেখ রয়েছে –
তদা ব্রহ্মা তয়োর্মধ্যে প্রজ্বাল্য চ হুতাশনম্ । হরিং সংস্মৃত্য হবনং চকার বিধিনা বিধিঃ ॥উত্থায় শয়নাৎ কৃষ্ণ উবাস বহ্নিসন্নিধৌ । ব্ৰহ্মণোক্তেন বিধিনা চকার হবনং স্বয়ম্ ॥প্রণম্য চ হরিং রাধাং দেবানাং জনকঃ স্বয়ম্।
[ ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ, কৃষ্ণজন্মখণ্ড ১৫।১২৪-১২৬ ]
বঙ্গানুবাদ:
ব্রহ্মা ভক্তিপূর্ব্বক রাধাকৃষ্ণকে প্রণাম করলেন এবং তাঁদের মধ্যে অগ্নি প্রজ্বলিত করে শ্রীকৃষ্ণকে স্মরণ করে বিবিধক্রমে হোম করতে লাগলেন । তখন কৃষ্ণ শয্যা হতে উত্থান করে অগ্নি সমীপে উপবেশনপূর্ব্বক ব্রহ্মোক্ত বিধিক্রমে স্বয়ং হোম করতে আরম্ভ করলেন। এরপর বেদকর্ত্তা ব্রহ্মা শ্রীকৃষ্ণ ও রাধিকাকে প্রণাম করলেন।
.
ব্রহ্মবৈবর্ত মহাপুরাণে আরো উল্লেখ রয়েছে –
মূঢ়া রায়াণপত্নী ত্বাং বক্ষ্যন্তি জগতীতলে’
[ শ্রীব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ, কৃষ্ণজন্মখন্ড, অধ্যায় ৩, শ্লোক ১০৩ ]
বঙ্গানুবাদ:
ভূতলে যারা মূঢ় (মূর্খ), তারাই শ্রীমতি রাধিকাকে রায়াণ(আয়ান) এর পত্নী বলে মনে করে।
.
ব্রহ্মাণ্ড পুরাণে উল্লেখ রয়েছে –
রাধাকৃষ্ণেতি দ্বেনাম সুস্মৃতোগোপ নন্দিনী।
মহাপাপোপ পাপৌঘ কোটিশো যাস্তি সংক্ষয়ং।
মৎসাযুজ্য পদমিতো মোদতে দেববৎ সদা।।
[ ব্রহ্মাণ্ড পুরাণ, উত্তরখণ্ড, রাধাহৃদয় ১৩।৭৪ ]
বঙ্গানুবাদ:
শ্রীকৃষ্ণ বললেন, হে গোপনন্দিনী রাধে, রাধা-কৃষ্ণ এই দুুই নাম যে ব্যাক্তি স্মরণ করেন,মহাপাপ ও উপপাপ প্রভৃতি কোটিপাপ তাঁর বিনষ্ট হবে। মৃত্যুর পর ইহলোক ত্যাগ করে তিনি আমার ধাম (চিন্ময় জগতের গোলক বৃন্দাবন ধাম) প্রাপ্ত হয়ে দেবতার মতো পরমানন্দে দিন যাপন করবেন।
শ্রীমদ্ভাগবত মহাপুরাণে উল্লেখ রয়েছে –
অনয়ারাধিতো নূনং ভগবান হরিরীশ্বরঃ।
যন্ নো বিহায় গোবিন্দঃ প্রীতো যামনয়দ্রহঃ।।
[ শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণ ১০।৩০।২৮]
বঙ্গানুবাদ:
এই বিশেষ গোপী নিশ্চয়ই যথার্থভাবে সর্বশক্তিমান ভগবান গোবিন্দের আরাধনা করেছিলেন।তাই তাঁর প্রতি অত্যন্ত প্রীত হয়ে তিনি অবশিষ্ট আমাদের পরিত্যাগ করে তাঁকে নির্জন স্থানে নিয়ে গিয়েছেন।
উপরোক্ত শ্রীমদ্ভাগবত১০/৩০/২৮ নং শ্লোকের ‘অনয়ারাধিতো নূনং ভগবান”, এই শ্লোকের বৈষ্ণব তোষনী টীকায় শ্রীল সনাতন গোস্বামী ‘অনয়ারাধিতঃ’ বাক্যের মধ্যেই শ্রীমতি রাধারাণীকে দর্শন করেছেন “রাধেতি নামকরণঞ্চ দর্শিতং”। শ্রীল বিশ্বনাথ চক্রবর্তী ঠাকুরও “অনয়ারাধিতঃ” শব্দটি দিয়ে শ্রীমতি রাধারাণীকে নির্দেশ করেন। এভাবে শ্রীমদ্ভাগবত শাস্ত্রেও শ্রীমতি রাধারাণীর কথা উল্লেখ রয়েছে।
.
মৎস্য পুরাণে উল্লেখ রয়েছে –
শিবকুন্ডে শিবানন্দা নন্দিনী দেবিকাতটে।
রুক্ষ্মিণী দ্বারবত্যাস্তু রাধা বৃন্দাবনে বনে।।
[ মৎস্য পুরাণ ১৩।৩৮ ]
বঙ্গানুবাদ:
শিবকুন্ডে শিবানন্দ, দেবিকাতটে নন্দিনী, দ্বারকাতে রুক্ষ্মিনী এবং বৃন্দাবনে শ্রীমতি রাধারাণী বিরাজমান।
.
বরাহ পুরাণে উল্লেখ রয়েছে –
তত্র রাধা সমাশ্লিষ্য কৃষ্ণমক্লিষ্টকারনম।
স্বনাম্না বিদিতং কুন্ডং কৃতং তীর্থমদূরতঃ।।
রাধাকুন্ডমিতি খ্যাতঃ কর্ব্বপাপহরং শুভং।
অরিষ্টরাধাকুন্ডাভ্যাং স্নানাৎ ফলমবাপুয়াৎ।।
[ বরাহ পুরাণ ১৬৪।৩৩,৩৪ ]
বঙ্গানুবাদ:
তারপর রাধিকা কে জিজ্ঞাসা করলেন হে ভদ্রে এখন কি করতে হবে? তখন রাধা অক্লিষ্টকর্মা কৃষ্ণ কে আলিঙ্গন করে অদূরে নিজের নামে একটি কুন্ড রচনা করলেন। তার নাম রাধাকুন্ড। এই কুন্ড সর্ব্বপাপনাশক ও সর্ব্বশুভদায়ক।
.
বায়ু পুরাণে উল্লেখ রয়েছে –
রাধাবিলাসরসিকং কৃষ্ণাখ্যাং পুরুষং পরম।
শ্রুতবানস্মি বেদোভ্যো যতস্তদেগাচরোর্হভবৎ।।
[ বায়ুপুরাণ ১০৪।৫২ ]
বঙ্গানুবাদ:
পরমপুরুষ অর্থাৎ পরমেশ্বর ভগবান যাকে শ্রীকৃষ্ণ বলা হয়, তিনি সর্বদা শ্রীমতি রাধারাণীর ইচ্ছা পূর্ণ করে তাঁর আনন্দবিধান করেন। বেদ শাস্ত্রে তাঁর কথা শোনা যায়। তাই আমরা তাঁর কথা শ্রবণ করছি।
পঞ্চরাত্র শাস্ত্রে শ্রীমতি রাধারাণী:
পঞ্চরাত্র শাস্ত্র সম্পর্কে মহাভারতের শান্তিপর্বে উল্লেখ রয়েছে-
ইদম্ মহোপনিষদম্ চতুর্বেদ সমন্বিতম্ ।
সাঙ্খ্য যোগ কৃতান্তেন পঞ্চরাত্রানুশব্দিতম্ ॥
নারায়ণমুখোদগীতং নারদোঽশ্রাবয়ৎ পুনঃ।
[ মহাভারত, শান্তিপর্ব ৩৪৮।৬২-৬৩ ]
বঙ্গানুবাদ:
প্রসিদ্ধ মহোপনিষৎ, চতুর্ব্বেদ, ও সাংখ্যযোগ সমন্বিত হয়ে পঞ্চরাত্র নামে খ্যাত হয়েছে। এই শাস্ত্রের সর্বপ্রথম বক্তা নারায়ণ, ও দ্বিতীয় বক্তা শ্রীনারদ।
.
গর্গ সংহিতাতে উল্লেখ রয়েছে –
বৃষভানুসুতা রাধা যা জাতা কীর্ত্তিমন্দিরে।
তস্যাঃ পতিরয়ং সাক্ষাত্তেন রাধাপতিঃস্মৃত।।
পরিপূর্ণতমঃ সাক্ষাৎ শ্রীকৃষ্ণো ভগবান স্বয়ম।
অসংখ্যব্রহ্মাণ্ডপতির্গোলকে ধাম্নি রাজতে।।
[ গর্গসংহিতা, গোলকখন্ড, অধ্যায় ১৫, শ্লোক-৩৪,৩৫ ]
বঙ্গানুবাদ:
বৃষভানুর কণ্যা রাধা যিনি কীর্ত্তিদার গৃহে আবির্ভূত হয়েছিলেন, শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং তাঁহার পতি বলিয়া ‘রাধাপতি’ নামে অভিহিত। অসংখ্য ব্রহ্মান্ডের অধিপতি পরিপূর্ণতম সাক্ষাৎ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গোলকধামের অধিশ্বর।
.
নারদপঞ্চরাত্র শাস্ত্রে বলা হয়েছে-
শ্রীকৃষ্ণো জগতাং তাত জগন্মাতা চ রাধিকা।
পিতুঃ শতগুণ মাতা বন্দ্যা পূজা গরীয়সী ॥
[ নারদপঞ্চরাত্র ২য় রাত্র, অধ্যায় ৬, শ্লোক ৭ ]
বঙ্গানুবাদ:
শ্রীকৃষ্ণ জগতের পিতা, শ্রীরাধা জগতের মাতা। পিতা অপেক্ষা মাতা শতগুণে বন্দনীয়া, পূজনীয়া এবং শ্রেষ্ঠা।
.
সনৎকুমার সংহিতায় উল্লেখ রয়েছে-
শ্রীভূলীলা যোগমায়া চিন্ত্যাচিন্ত্যা তথৈব চ । মোহিনী কৌশলীত্যষ্টৌবহিরঙ্গাশ্চ শক্তয়ঃ ।। ২৯৫।। লীলা প্রেমস্বরূপা চ স্থাপত্যাকর্ষিণী তথা । সংযোগিনী বিয়োগিন্য আহ্লাদিনীত্যন্তরঙ্গিকা।। ২৯৬।। ব্রজে শ্রীকৃষ্ণচন্দ্রস্য সন্তি ষোড়শ শক্তয়ঃ । পোষিকামধুরস্যৈব তস্যৈতা বৈ সনাতনাঃ ।। ২৯৭।। হ্লাদিনী যা মহাশক্তিঃ সর্বশক্তি বরীয়সী । তৎ সারভাবরূপা শ্রীরাধিকা পরিকীর্তিতা।। ২৯৮।।
[ সনৎকুমার সংহিতা, শ্লোক ২৯৫-২৯৮ ]
বঙ্গানুবাদ:
শ্রী(মহালক্ষ্মী), ভূ, লীলা(নীলা), যোগমায়া, চিন্ত্যা, অচিন্ত্যা, মোহিনী, কৌশলী- এই অষ্টশক্তি শ্রীকৃষ্ণেত বহিরঙ্গা শক্তি। অপরদিকে লীলা প্রেমস্বরূপা, স্থাপনী, আকর্ষণী, সংযোগিনী, বিয়োগিনী ও আহ্লাদিনী – এই অষ্টশক্তি শ্রীকৃষ্ণের অন্তরঙ্গা শক্তি। ব্রজে শ্রীকৃষ্ণচন্দ্রের এ ষোড়শ সনাতনী শক্তি বিরাজ করেন যাদের দ্বারা তিনি মাধুর্য্য পোষণ করেন। সমস্ত শক্তির মধ্যে মহাশক্তি হ্লাদিনীশক্তি সর্বশ্রেষ্ঠা। এর সারভাবরূপ শ্রীমতি রাধিকা নামে পরিকৃষ্টরূপে কীর্তিত হন।
.
সনৎকুমার সংহিতায় আরো উল্লেখ রয়েছে-
দেবী কৃষ্ণময়ী প্রোক্তা রাধিকা পরদেবতা।
সর্বলক্ষ্মী স্বরুপা সা কৃষ্ণাহ্লাদ সর্ব রুপিনী।।৭২।।
ততঃ সা প্রোচ্যতে বিপ্র হ্লাদিনীতি মনীষিভিঃ।
তত্ কলা কোটি কোট্য়শা দুর্গাদ্যাসত্তিগুণাত্মিকাঃ।।৭৩।।
সাতু সাক্ষাত্ মহালক্ষ্মী কৃষ্ণোনারায়ণঃ প্রভুঃ।
ন তোবিদ্যাতে ভেদঃ স্বল্পো ভি মুনিসত্তম।।৭৪।।
[ সনৎকুমার সংহিতা, শ্লোক ৭২-৭৪ ]
বঙ্গানুবাদ:
দেবী কৃষ্ণময়ী রাধিকাকে পরদেবতা বলা হয়, তিনি স্বয়ং সর্বলক্ষ্মীময়ী সর্বলক্ষ্মী স্বরুপ এবং সে কৃষ্ণের আনন্দ প্রদায়িনী (হ্লাদিনী) শক্তি স্বরূপ। সে সাক্ষাৎ মহালক্ষ্মী এবং শ্রীকৃষ্ণ সাক্ষাৎ প্রভু নারায়ণ। তাদের মধ্যে কোনো ভেদ নেই। শ্রীমতি রাধিকাকে মনিষীগণ হ্লাদিনী শক্তি বলে থাকে এবং তার অংশ কলা কোটি থেকেই ত্রিগুণাত্মিকা দূর্গাদি শক্তির প্রকাশ।
.
সনৎকুমার সংহিতায় আরো উল্লেখ রয়েছে-
শ্রীসদাশিব উবাচ-
শক্তি সংযোগিনী কামা বামাশক্তি বিয়োগিনী।
হ্লাদিনী কীর্তিদা পূত্রী চৈবং রাধাত্রয়ং বজে।।
[ সনৎকুমার সংহিতা, শ্লোক ৩০৩ ]
বঙ্গানুবাদ:
সদাশিবজী বললেন- তিন প্রকার শক্তি রয়েছে, কাম,বাম ও হ্লাদিনী। কাম কে সংযোগিনী শক্তি, বাম কে বিয়োগিনী শক্তি এবং হ্লাদিনী কে আনন্দ প্রদায়িনী শক্তি বলা হয়। কীর্তিদার কন্যা রাধিকা হ্লাদিনী শক্তি হওয়ার পরেও ব্রজে রাধারাণী তিন শক্তি যুক্ত।
এছাড়াও শাস্ত্রে আরো বহু স্থানে শ্রীমতি রাধারাণীর মহিমা বর্ণিত রয়েছে। যারা বলে থাকেন, যে সনাতন শাস্ত্রে শ্রীমতি রাধারাণীর উল্লেখ নেই, তারা অপপ্রচার করে থাকেন মাত্র। তাদের এসব অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হওয়া উচিত নয়।
।। হরে কৃষ্ণ ।।
[ বি:দ্র: স্বধর্মম্-এর অনুমোদন ব্যাতীত এই গবেষণামূলক লেখার কোনো অংশ পুনরুৎপাদন, ব্যবহার, কপি পেস্ট নিষিদ্ধ। স্বধর্মম্-এর সৌজন্যে শেয়ার করার জন্য উন্মুক্ত ]
নিবেদক-
° স্বধর্মম্: প্রশ্ন করুন | উত্তর পাবেন °