শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য মহাপ্রভু যে স্বয়ং শ্রীহরি, তার ৩২ টি প্রামাণিক শাস্ত্রীয় প্রমাণ:
কি পন্ডিত, কি তপস্বী, কিবা গৃহী, যতি।
চৈতন্য-বিমুখ যেই, তার নাই গতি।।
[ শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত, আদিলীলা ১২।৭২ ]
কৃষ্ণভক্তিবিহীনানাং পাপ্মনা গ্রসিতাত্মনাম্ ॥ ৬০ ॥ কলৌ নষ্ট দৃশাং নৈব জনানাং কুত্রচিদ্ গতিঃ । ইতি মত্বা কৃপাসিন্ধুরংশেন কৃপযা হরিঃ ॥ ৬১ ॥ প্রচ্ছন্নো ভক্তরূপেণ কলাববতরিষ্যতি । ভুবং প্রাপ্তে তু গোবিন্দশ্চৈতন্যাখ্যো ভবিষ্যতি ॥ ৬২ ॥ তস্য কর্মাণি মনুজাঃ কীর্তযিষ্যন্তি কেচন । বহির্মুখা নমংস্যন্তে প্রচ্ছন্নং পরমেশ্বরম্ ॥ ৬৩।। গৌরাঙ্গো নাদগম্ভীরঃ স্বনামামৃতলালসঃ । দয়ালুঃ কীর্তনগ্রাহী ভবিষ্যতি সচীসুতঃ ॥ ৬৪ ॥
[ কৃষ্ণযামল তন্ত্র, অধ্যায় ২৮, শ্লোক ৬০-৬৪]
অনুবাদ:
কলিযুগ কৃষ্ণভক্তিবিহীন এবং লোকেদের পাপ দ্বারা গ্রস্থ, তাই কলিহত জীবের দুর্গতির কথা চিন্তা করে কৃপাসিন্ধু ভগবান স্বয়ং অবতীর্ণ হয়ে ভক্তরূপে নিজেকে প্রচ্ছন্নভাবে লীলা করবেন। পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়ে তিনি ‘চৈতন্য’ নামে বিখ্যাত হবেন এবং তাঁর কর্মাদি বিভিন্ন লোকেরা কীর্তন করবে। বহির্মুখ লোকেরাও সে প্রচ্ছন্ন পরমেশ্বরকে নমস্কার করবে। সে ভগবান ‘গৌরাঙ্গ‘ নিজ নামের অমৃত আস্বাদনের লালসায় সংকীর্তন ধর্ম প্রচারের জন্য ভবিষ্যতে শচীমাতার পুত্ররূপে আবির্ভূত হবেন।
কৃষ্ণ নাহি মানে, তাতে দৈত্য করি মানি ।
চৈতন্য না মানিলে তৈছে দৈত্য তারে জানি।।
[ শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত, আদিলীলা, ৮।৯ ]
শ্লোকার্থ:
যদি কেউ শ্রীকৃষ্ণকে পরমেশ্বর ভগবান বলে না মানে, তবে সে একটি দৈত্য। তেমনই, যে শ্রীচৈতন্যদেবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলে মানতে না চায়, তাকেও একটি দৈত্য বলেই জানতে হবে।
৩২ টি প্রামাণিক শাস্ত্রীয় প্রমাণ:
প্রমাণ-(১)
দিবিজা ভুবি জায়ধ্বং জায়ধ্বং ভক্তরূপিণঃ। কলৌ সঙ্কীর্তনারম্ভে ভবিষ্যামি শচীসুতঃ।। কৃতে জপৈ মংম প্রীতি স্ত্রেতায়াং হোম-কর্মভিঃ । দ্বাপরে পরিচর্য্যাভিঃ কলৌ সংকীর্ত্তনৈরপি ॥ ২৬॥
[ বায়ুপুরাণ,শেষখন্ড ১৪।২৮ ] [বারানশি চুম্বিকা এডিশান]
অনুবাদ:
হে দেবগণ, তোমরা সকলে ভক্তরূপ ধারণ করে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়ে হরিনাম সঙ্কীর্তন আরম্ভ করো। তোমাদের সঙ্কীর্তনে আমি শচীগর্ভ হতে জন্মগ্রহণ করবো। সত্যযুগে জপ-ধ্যান, ত্রেতাযুগে হোম, দ্বাপর যুগে পূজাদি এবং কলিযুগে সংকীর্তনের দ্বারাই আমি প্রীত হই।
.
প্রমাণ-(২)
তদাপ্যহং ভবিষ্যামি গঙ্গাদ্বারে কলের্ধুরি।।
[ বায়ুপুরাণ ২৩।৫১] [নবভারত]
অনুবাদ:
তখন কলির প্রথমে আমি (ভগবান) গঙ্গাধারে আবির্ভূত হইব।
.
প্রমাণ-(৩)
মহেন্দ্র তব যা পত্নী শচী নাম্না মহোত্তমা।
দদৌ তস্যৈ বরং বিষ্ণুভবিতাস্মি সুতঃ কলৌ।।
তদাজ্ঞয়া চ সা দেবীং পুরীং শান্তিময়ীং শুভাম্।
গৌড়দেশে চ গঙ্গায়া কূলে লোকনিবাসিনীম্।।
[ ভবিষ্যপুরাণ, দ্বিতীয়খণ্ড, ১৭।৬০,৬১ ]
অনুবাদ:
জীব বললেন- হে মহেন্দ্র, ভগবান বিষ্ণু আপনাকে বর দান স্বরূপ উত্তম শচী দিয়েছিলেন, আপনার আদেশে তিনি গৌড়দেশে গঙ্গাতীরে জন্ম লাভ করবে এবং আমি পুত্ররূপে কলিযুগে তোমার কাছে আবির্ভূত হব।
.
প্রমাণ-(৪)
ভবিষ্যামি শচীপুত্রঃ কলৌ সংকীর্ত্তনাগমে।
হরিনাম প্রদানেন লোকান্ সংতারয়াম্যহম।।
[ ব্রহ্মযামলঃ তন্ত্র, ১।২১ ]
অনুবাদ:
কলিতে সংকীর্তন যজ্ঞের প্রারম্ভে শচীপুত্র রূপে আবির্ভূত হইয়া আমি হরিনাম প্রদান করত জনসমূহকে নিস্তার করিয়া থাকি।
.
প্রমাণ-(৫)
অহমেব দ্বিজশ্রেষ্ঠ নিত্যং প্রচ্ছন্নবিগ্রহঃ।
ভগবদ্ভক্তরূপেণ লোকান্ রক্ষামি সর্ব্বদা।।৩৫।
[ বৃহন্নারদীয়পুরাণ ৫।৩৫ ]
অনুবাদ:
ভগবান বলিলেন,”হে দ্বিজশ্রেষ্ঠ! আমিই ভগবানের ভক্তরূপে (ভক্তাবতার শ্রীচৈতন্য) দেহ গোপনপূর্ব্বক সর্ব্বদাই লোকসমূহের রক্ষা করি।”
.
প্রমাণ-(৬)
কৃষ্ণবর্ণং ত্বিষাকৃষ্ণং সাঙ্গোপাঙ্গাস্ত্রপার্ষদম্।
যজ্ঞৈঃ সংকীৰ্তনপ্রায়ৈজন্তি হি সুমেধসঃ ৷৷
[ শ্রীমদ্ভাগবত ১১।৫।৩২ ]
অনুবাদ:
যে পরমেশ্বর ভগবান ‘কৃষ’ ও ‘ণ’ শব্দাংশ দুটি নিরন্তর উচ্চারণ করেন, কলিযুগের বুদ্ধিমান মানুষেরা তাঁর উপাসনার নিমিত্ত সমবেতভাবে নাম-সংকীর্তন করে থাকেন। যদিও তাঁর গাত্রবর্ণ অ-কৃষ্ণ, তবুও তিনি স্বয়ং কৃষ্ণ। তিনি সর্বদা তাঁর পার্ষদ, সেবক, সংকীর্তনরূপ অস্ত্র ও ঘনিষ্ঠ সহচর পরিবৃত থাকেন।
.
প্রমাণ-(৭)
উর্দ্ধাম্নায় তন্ত্রে গৌর মন্ত্র ও গৌর উপাসনা বিধি বর্ণিত আছে-
শ্রী নারদ উবাচ।
কৃষ্ণরূপেন ভগবান্ কলৌ পাপপ্রণাশকৃৎ।
গৌররূপেন ভগবান্ ভাবিতঃ পূজিতস্তথা।।
ওঁ গৌরায় নম ইত্যেষ মন্ত্রো লোকেষু পূজিতঃ।
[ উর্দ্ধাম্নায় সংহিতা, ৩য় অধ্যায় ]
অনুবাদ:
শ্রী নারদ বললেন! শ্রীকৃষ্ণ নামের দ্বারা ভগবান পাপ সমূহ নাশ করেন, ও গৌর রূপে ভগবান পূজিত হন। ‘ওঁ গৌরায় নমঃ’– এই মন্ত্র দ্বারা তিনি সর্বলোক দ্বারা পূজিত হন।
.
প্রমাণ-(৮)
পূণ্য ক্ষেত্রে নবদ্বীপে ভবিষ্যামি শচীসূতঃ।
[ কৃষ্ণযামল তন্ত্র, ২৮।৬২,৬৩,৬৪,৬৫,৬৬ ]
অনুবাদ:
পূন্যক্ষেত্রে নবদ্বীপে আমি শচীদেবীর পুত্ররূপে আবির্ভূত হব।
.
প্রমাণ-(৯)
শ্যামঞ্চ গৌরং বিদিতং দ্বিধা মহস্তবৈ সাক্ষাৎ পুরুষোত্তমোত্তম৷ গোলকধামাধিপতিং পরেশং পরাৎপরং ত্বাং শরণং ব্রজাম্যহম্।।
[ গর্গসংহিতা,গোলকখণ্ড ১৬।২৭ ]
অনুবাদ:
হে সাক্ষাৎ পুরুষোত্তম! শ্যাম ও গৌর তোমার দ্বিবিধ তেজ, তুমি গোলোকধামপতি পরেশ পরাৎপর; আমি তোমার শরণ লইলাম।
.
প্রমাণ-(১০)
গঙ্গায়া দক্ষিণেভাগে নবদ্বীপে মনোরমে।
কলিপাপ বিনাশায় শচীগর্ভে সনাতনি।।
জনিষ্যতি প্রিয়ে! মিশ্রপুরন্দরগৃহে স্বয়ম্।
ফাল্গুনে পৌণমাস্যাঞ্চনিশায়াংগৌরবিগ্রহঃ।।
[ বিশ্বসার তন্ত্র, উত্তরাখন্ড, ১১ পটল ]
অনুবাদ:
দেব দেবী পার্ব্বতীকে বলেছেন- হে প্রিয়ে! কলিকলুষ বিনাশের নিমিত্ত গঙ্গা দক্ষিণ তীরবর্ত্তী অতি মনোরম নবদ্বীপ গ্রামে ফাল্গুনী পূর্ণিমা নিশিতে মিশ্র পুরন্দর গৃহে শচীদেবীর গর্ভে স্বয়ং ভগবান গৌররূপে অবতীর্ণ হবেন।
.
(প্রমাণ-১১)
সতত পরম দেবো, শ্রী শচীদেবী নন্দন,দ্বিনেত্র দ্বিভুজ গৌর, তপ্ত জাম্বুনদ প্রভা।।
[ সতাভাতাতন্ত্র, ৫।৪১ ]
অনুবাদ:
তখন সেই পরম দেব, যিনি শচীদেবীর পুত্র, যার দুই চক্ষু, দুই হাত, যার প্রভা তপ্ত জাম্বুনদের ন্যায়।
.
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর পিতৃপ্রদত্ত নাম ছিলো ‘বিশ্বম্ভর’। তাঁর মাতার নাম শচীদেবী, তাই তাকে ‘শচীসূত’ নামেও ডাকা হয়। তাঁর গাত্রবর্ণ তপ্ত স্বর্ণের ন্যায় গৌরবর্ণ হওয়ায় তাঁকে ‘গৌর’, ‘হেমাঙ্গ’, ‘গৌরাঙ্গ’ ইত্যাদি নামে ডাকা হয়।
প্রমাণ-(১২)
বিশ্বম্ভর বিশ্বেন মা ভরসা পাহি স্বাহা।
[ অথর্ববেদ, ২য় কাণ্ড, ৩য় অনুবাক, ৬ সূক্ত, ৫ মন্ত্ৰ ]
অনুবাদ:
হে বিশ্বম্ভর,সকল পোষণ শক্তির দ্বারা আমাকে মৃত্যু থেকে রক্ষা কর। স্বাহা মন্ত্রে তোমাকে আহুতি দিচ্ছি।
.
প্রমাণ-(১৩-১৫)
ঋগ্বেদ সংহিতা,(১।১৬।৫), (৮।৪।৩), (৪।৫৮।২)- এই সকল মন্ত্রে স্পষ্ট ভাবে পরমব্রহ্মের “গৌর” নাম রয়েছে।
.
প্রমাণ-(১৬)
চৈতন্যরূপশ্চৈতন্যশ্চেতনাগুণবর্জ্জিতঃ।
অদ্বৈতাচারনিপুণোহদ্বৈতঃ পরমনায়কঃ।।
[ নারদপঞ্চরাত্র,চতুর্থরাত্র, ৮।১৫৪ ]
অনুবাদ:
চৈতন্যরূপ, চৈতন্য, চেতনাগুণবর্জ্জিত, অদ্বৈতাচারনিপুণ, অদ্বৈত, পরমনায়ক।
.
প্রমাণ-(১৭)
মহাপ্রলয়কারী চ শচীসূতজয়প্রদঃ।।
[ নারদপঞ্চরাত্র,চতুর্থরাত্র, ৮।১৫৪ ]
অনুবাদ:
মহাপ্রলয়কারী, শচীসূত, জয়প্রদ।
.
প্রমাণ-(১৮)
শচীসুতঃ জয়প্রদঃ।।
[ গৌতমীয় তন্ত্র,গোপালসহস্রনাম স্ত্রোত্র ]
অনুবাদ:
শচীপুত্র জয় যুক্ত হোন।
.
প্রমাণ-(১৯)
নমো ভুম্যাদিরূপায় নমশ্চৈতন্যরূপিণে।৫৯।
[ বৃহন্নারদীয়পুরাণ ৪।৫৯ ]
অনুবাদ:
পৃথিবী প্রভৃতি সমস্ত তোমার রূপ, তুমি চৈতন্য স্বরূপ, তোমাকে নমস্কার।
.
পদ্মপুরাণের উত্তরখন্ডে শ্রীহরিকে ‘চৈতন্য’, ‘বিশ্বম্ভর’ ইত্যাদি নামে সম্বোধন করা হয়েছে যা চৈতন্য মহাপ্রভুকেই নির্দেশ করে। যথা-
প্রমাণ-(২০)
পুরাণপুরুষঃ প্রত্যকচৈতন্যঃ পুরুষোত্তমঃ।।
[ পদ্মপুরাণ,উত্তরখণ্ড ৭১।১৩১]
অনুবাদ:
পুরাণপুরুষ, প্রত্যকচৈতন্য, পুরুষোত্তম।
.
প্রমাণ-(২১)
বিশ্বম্ভরস্তীর্থপাদঃ পুণ্যশ্রবণকীৰ্ত্তনঃ।
[ পদ্মপুরাণ,উত্তরখণ্ড ৭১।১৫৬ ]
অনুবাদ:
বিশ্বম্ভর, তীর্থপাদ, পুণ্যশ্রবণকীৰ্ত্তন।
.
প্রমাণ-(২২)
মহাভারত-উক্ত প্রমাণ- (ইতিহাস) আনুশাসনিক-পৰ্বনি (৬নং)দানধর্মে-ভীষ্ম-যুধিষ্ঠির সংবাদে বিষ্ণুসহস্রনাম প্রসঙ্গে-
সুবর্ণবর্ণো হেমাঙ্গো বরাঙ্গশ্চন্দনাঙ্গদী। ৯২।।
সন্ন্যাসকৃচ্ছমঃ শান্তো নিষ্ঠাশান্তি-পরায়ণঃ।।৭৫।।
[ মহাভারত, অনুশাসন পর্ব, দানধর্ম, অধ্যায় ১৪৯।৯২,৭৫ ]
অনুবাদ :
হরিনাম প্রচার উপলক্ষে “কৃষ্ণ” এই উত্তম বর্ণদ্বয় সর্বদা বর্ণন করেন বলিয়া তাঁহার একটি নাম সুবর্ণবর্ণ; তাঁহার অঙ্গ স্বর্ণের ন্যায় উজ্জ্বল বলিয়া তাঁহার একটি নাম হেমাঙ্গ; সাধারণ লোক অপেক্ষা তাঁহার অঙ্গ শ্রেষ্ঠ বলিয়া তাঁহার একটি নাম বরাঙ্গ; চন্দনের অঙ্গদ (কেয়ূর) পরিধান করেন বলিয়া তাঁহার নাম চন্দনাঙ্গদী; সন্ন্যাসগ্রহণ করেন বলিয়া তাঁহার নাম সন্ন্যাসকৃৎ; ভগবন্নিষ্ঠ-বুদ্ধি বলিয়া তাঁহার নাম শম; অচঞ্চল-চিত্ত বলিয়া তাঁহার নাম শান্ত; কৃষ্ণভক্তিতে নিষ্ঠা ও নিবৃত্তিপরায়ণ বলিয়া তাঁহার নাম নিষ্ঠাশান্তি-পরায়ণ। এই সকল নামে অভিহিত হওয়ায় কলিতে গৌরাঙ্গাবতার সূচিত হইয়াছে।
.
প্রমাণ-(২৩)
স হোবাচ । রহস্যং তে বদিষ্যামি – জাহ্নবীতীরে নবদ্বীপে গোলোকাথ্যে ধাম্নি গোবিন্দো দ্বিভুজো গৌরঃ সর্বাত্মা মহাপুরুষো মহাত্মা মহাযোগী ত্রিগুণাতীতঃ সত্বরূপো ভক্তিং লোকে কাশ্যতীত । তদেতে শ্লোকা ভবন্তি ॥ ৫॥
[ অথর্ব্বেদ, পিপ্পলাদ শাখা, চৈতন্যোপনিষদ, মন্ত্র-৫ ]
অনুবাদ:
ব্রহ্মা বললেন আমি তোমাকে সেই রহস্য বলব গোলোক নামে খ্যাত নবদ্বীপ ধামে জাহ্নবীতীরে ভগবান শ্রী গোবিন্দ ত্রিগুনাতীত সর্বাত্মা মহাযোগী মহাপুরুষ মহাত্মা দ্বিভূজ গৌর রূপে অবতীর্ণ হবেন। নিত্য শ্বাশ্বতস্বরূপে সেই ভগবান পৃথিবীতে ভক্তিরহস্য প্রকাশ করবেন। এবিষয়ে আরো বহু শ্লোক আছে।
.
প্রমাণ-(২৪)
শ্রীমদভাগবতম এ গর্গমুনি নন্দ মহারাজকে বলছেন-
আসন বর্ণাস্ত্রয়োহ্যস্য গৃহ্নতোহনুযুগং তনুঃ।
শুক্লোরক্তস্তথাপীত ইদানীং কৃষ্ণতাং গতঃ।।
[ শ্রীমদ্ভাগবতম ১০।৮।১৩]
অনুবাদ:
তোমার পুত্র কৃষ্ণ প্রতি যুগে তার শ্রীমূর্তি প্রকাশ করেন। পূর্বে ইনি শুক্ল, রক্ত, পীতবর্ণ ধারণ করে প্রকাশিত হয়েছিলেন, সম্প্রতি কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করে প্রকট হয়েছেন।
সত্য যুগে ভগবান শুক্ল বর্ণ, ত্রেতাযুগে রক্তবর্ণ যজ্ঞ অবতার ধারণ করে যুগধর্ম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, এই দ্বাপর যুগে কৃষ্ণ বর্ণ শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং অবতীর্ণ হয়ে যুগধর্ম স্থাপন করেন। অতএব কলিযুগে ভগবান পীত বর্ণ তথা শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু।
.
প্রমাণ-(২৫)
কলি যুগে ভগবানের অবতার যে প্রচ্ছন্ন তা প্রহ্লাদ মহারাজের উক্তিতে বলা হয়েছে-
ইত্থং নৃতির্য্যগৃষিদেবঝষাবতারৈর্লোকান বিভাবয়সি হংসি জগৎপ্রতীপান। ধর্ম্মং মহাপুরুষ পাসি যুগানুবৃত্তং ছন্নঃ কলৌ যদভবস্ত্রিযুগোহথ স ত্বম।।
[ শ্রীমদ্ভাগবতম ৭।৯।৩৭ ]
অনুবাদ:
হে ভগবান, আপনি বিভিন্ন অবতারকালে মানুষ, পশু, মহর্ষি, দেবতা, মীন, কিংবা কূর্ম, রূপে আবির্ভূত হন, যাতে বিভিন্ন লোকের মধ্যে সমগ্র সৃষ্টির পালন হয় এবং আসুরিক নীতি গুলি দমন করেন। যুগ অনুসারে হে ভগবান আপনি ধর্মনীতি রক্ষা করে থাকেন। অবশ্য কলিযুগে আপনি পরমেশ্বর ভগবান রূপে আবির্ভূত হননা (ভক্তরূপে আবির্ভূত হন)।
এই প্রচ্ছন্ন অবতারের কারণ ভগবান ভক্ত রূপে অবতীর্ণ হন। তাই আপনাকে ত্রিযুগী বলা হয়।
.
প্রমাণ-(২৬)
শান্তাত্মা লম্বকন্ঠশ্চ গৌরাঙ্গশ্চ সুরাবৃতঃ।
[ অগ্নিপুরাণ অধ্যায় ৪৯ শ্লোক ৮ ]
অনুবাদ:
প্রশান্তাত্মা, লম্বকন্ঠ, দেবগণপরিবেষ্টিত গৌরাঙ্গরূপে আবির্ভূত হবেন।
.
প্রমাণ-(২৭)
প্রচ্ছন্ন ভক্ত রূপে অবতীর্ণ হবেন গোবিন্দ যিনি আখ্যায়ীত হবেন চৈতন্য নামে। গোবিন্দ নিজের নামের অমৃতের লালসা কিরকম তার স্বাদ নিতে দয়াপরোবশ হয়ে কীর্তন করবেন তখন তিনি ভবিষ্যতে শচীমায়ের সন্তান হিসেবে থাকবেন।।
[ কৃষ্ণযামল তন্ত্র ২৮।৬৩,৬৪]
.
প্রমাণ-(২৮)
একো দেবঃ সর্বরূপী মহাত্মা গৌরো রক্ত-শ্যামল-শ্বেতরূপঃ । চৈতন্যাত্মা স বৈ চৈতন্যশক্তির্ভক্তাকারো ভক্তিদো ভক্তিবেদ্যঃ ॥ ৬॥
[ অথর্ব্বেদ, পিপ্পলাদ শাখা, চৈতন্যোপনিষদ, মন্ত্র-৬]
অনুবাদ:
সেই এক অদ্বয় পরমেশ্বর ভগবান গৌর রূপে অবতীর্ণ হন। পূর্বে তিনি রক্ত, শ্যামল, শ্বেত কান্তি পরিগ্রহ করে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। ভগবান তার এই আদি শ্রীচৈতন্য রূপে তিনি সকলের চেতন শক্তি তিনি ভক্তির মূর্ত বিগ্রহ, তিনি ভক্তিদাতা, তিনিই আবার ভক্তির বেদ্য, এবং সর্বজ্ঞ।
.
প্রমাণ (২৯)
শিব উবাচ
ততঃ স ভগবান্ কৃষ্ণঃ লোক নিস্তার হেতুনা।অনন্তমুক্তবানদেবো জায়স্ব পৃথিবীতলে।। গোকুলে বলরামায় পাতু ত্বাং শৃণু পার্বতী। নিত্যানন্দঃ স হি ভাবি লোকানাং হিতকাম্যয়া।। শচী চ দেবকী দেবী বসুদেবঃ পুরন্দরঃ। তয়োঃ প্রীতে স ভগবান্ চৈতন্যত্বং গতঃ স্বয়ং।। কলৌ প্রবৃত্তে লোকানাং গৌরচন্দ্রঃ শচীসুতঃ। আবিরাসীৎ গৌররূপী হরিনামেতি সংস্মরন্।। কলৌ পূজাদিকং নাস্তি ধ্যান যজ্ঞাদিকী ক্রিয়া। হরিনাম বিনা দেবী নাস্তি সত্যং ব্রবীম্যহম্।।
[ ব্রহ্মযামল ২য় অধ্যায় ]
অনুবাদ:
তখন ভগবান শ্রী কৃষ্ণ লোক নিস্তারের জন্য অনন্তদেব কে প্রেরণ করলেন, হে পার্বতী গোকুলে যিনি বলরাম তিনিই লোক হিতার্থে নিত্যানন্দ প্রভু রূপে প্রকট হলেন, দেবকী দেবী শচীমাতা রূপে ও বসুদেব পুরন্দর মিশ্র রূপে আবির্ভূত হলেন।
কলির প্রারম্ভ হলে হরিনাম দ্বারা ত্রিলোক উদ্ধার করতে গৌরচন্দ্র নিজলোক সহ আবির্ভূত হলেন। হে দেবী আমি সত্য করে বলছি কলিতে কোন পূজাদি, ধ্যান যজ্ঞ ক্রিয়া নেই কেবল হরিনামের দ্বারাই জীব উদ্ধার হয়।
.
প্রমাণ-(৩০)
ভগবান চৈতন্য মহাপ্রভু বিশ্বকে শেখাবেন কীভাবে বিশুদ্ধ কৃষ্ণপ্রেম অর্জন করতে হয়। তিনি ভগবানের পরম করুণাময় অবতার, এবং তিনি সমস্ত জীবকে বস্তুগত অস্তিত্বের বন্ধন থেকে উদ্ধার করবেন।
[ অনন্তসংহিতা ৫।১৫ ]
প্রমাণ-(৩১)
কলি যুগে পরমেশ্বর ভগবান জগন্নাথ মিশ্র এবং শচী দেবীর পুত্র শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু রূপে আবির্ভূত হবেন। তিনি সারা বিশ্বে কৃষ্ণপ্রেম ও কৃষ্ণভক্তির বার্তা প্রচার করবেন।
[ সাত্বতসংহিতা ১।২।১০ ]
.
প্রমাণ-(৩২)
নমস্তে শচীনন্দনানন্দ কারিন্ মহাপাপস্নতাপ দু লাপহারিন্।সুরারীন্নিহত্যাশুলোলোকাধিধারিন স্বভক্ত্যাঘজাতাং গকোটি প্রহারিন্।। ত্বয়া হংসরূপেন সত্যং প্রপাল্যং ত্বয়া যজ্ঞরূপেন বেদঃ প্ররক্ষ্য। সব যজ্ঞ রূপো ভবাঁল্লোকধারীশচীনন্দনঃ শত্রুশর্মপ্রসক্ত।। অনর্পিতচরোচিরাৎ করুণয়াবতীর্ণঃ কলৌ।সমর্পয়িতুমুন্নতোজ্জ্বলরসাং স্বভক্তি শ্রিয়ম্। হরে পুনরসুন্দরদ্যুতিকন্দং বসন্দীপিতঃ সদা। সফুরতু নো হৃদয়কন্দরে শচীনন্দনঃ।। বিসর্জতি নরান্ ভবান্ করুণয়া প্রপাল্য ক্ষিতৌ। নিবেদয়িতুমুদ্ভবঃ পরাৎ পরং স্বকীয় পদম্।কলৌ দিতিজসম্ভবাধিব্যথদ্ধিসুর মগ্নমান্ সমুদ্ধর মহাপ্রভো কৃষ্ণচৈতন্য শচীসুত।। মাধুর্য্যের্মধুভিঃ সুগন্ধবদনঃ স্বার্ণাম্বুজানাং বন। কারুন্যামৃতনির্ঝরৈরুপচিতেঃ সৎ প্রেমহেমাচলঃ। ভক্তাম্ভোধরধারিনী বিজয়িনী নিষ্কম্পসপ্তাবলী। দেবো নঃ কুল দৈবতং বিজয়তে চৈতন্য কৃষ্ণো হরি:।
[ ভবিষ্যপুরাণ, দ্বিতীয়খণ্ড ১৮।২৯,৩০,৩১,৩২,৩৩]
অনুবাদ:
হে শচীনন্দন হে আনন্দ প্রদানকারী আপনি মহান পাপের সন্তাপের দুর্লান হরণকারী সুরশতারু হনন করে শীঘ্র লোকের অধিকারী হন । আপনার প্রতি ভক্তিতে কোটি পাপ দূর হয় । আপনি হংসাবতার ধারণ করে সত্য পালন করেছেন । সেই আপনি যজ্ঞ স্বরূপ লোককে ধারণকারী ইন্দ্রের কল্যাণ করতে প্রসক্ত শচীনন্দন রূপে জন্ম নিয়েছেন । আপনি অনর্পিত চর অনেক সময় এই ঘোর কলি যুগে করুণা করে অবতীর্ণ হয়েছেন ।এবং উন্নত ও উজ্জ্বল ভক্তিশ্রী সমর্পিত করতে এই রূপ ধারণ করেছেন । আমরা প্রার্থনা করছি যে হরির এই সুন্দর দ্যুতি কদম্ব দ্বারা সন্দিপীতা এই রূপ যেন আমাদের হৃদয়ে স্ফুরিত হয় ।
আপনি করুণাপূর্বক নরপারতি পালন করে ভূমিতে বিসর্জন করেন । আপনার উদ্ভব পরাৎপর নিজপদ প্রদান করার জন্যই সৃষ্ট । হে মহাপ্রভো, হে শচীপুত্র কলিযুগে দিতিজ থেকে উৎপন্ন ব্যথা সমুদ্র থেকে হে কৃষ্ণ, চৈতন্য আমাদের উদ্ধার করুন মাধুর্যের দ্বারা সুন্দর বদন যুক্ত স্বর্ণিম অম্বুজ বনস্বরূপ কারুণ্যরুপী আমৃতের নির্ঝরের দ্বারা উপচিত সৎপ্রেমের হেমগিরি ভক্তরূপী অম্ভোধর ধারনকারা বিজয়ী নিষ্পংক সপ্তাবলী আমাদের কুলদেবতা দেব কৃষ্ণচৈতন্য শ্রীহরির বিজয় হোক।
এছাড়াও গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের গ্রন্থাবলিতে বরাহপুরাণ, মৎস্যপুরাণ, কূর্মপুরাণাদি শাস্ত্র সমূহ হতে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর উল্লেখ পূর্বতন আচার্য্যবর্গ করে গেলেও সে সকল পাঠ বর্তমানে কালের অন্তরালে বিলুপ্ত। তাই বর্তমান লব্ধ শাস্ত্র সমূহ হতে প্রাপ্ত প্রমাণগুলোই রেফারেন্স সমেত তুলে ধরা হলো।
হেন কৃপাময় চৈতন্য না ভজে যেই জন।
সর্বোত্তম হইলেও তারে অসুরে গণন ।।
[ শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত, আদিলীলা, ৮।১২ ]
শ্লোকার্থ:
এই রকম কৃপাময় শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুকে যে ভজনা করে না, সে যদি মানব-সমাজে অতি সম্মানিত ব্যক্তিও হয়, তাকে অসুর বলেই গণনা করতে হবে।
এভাবে দক্ষিণ ভারতের রামানুজী শাখার পরে উত্তর ভারতীয় রামানুজী শাখাও ভগবান শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য মহাপ্রভুর ভগবদসত্ত্বা স্বীকার করে নিলেন। ইতিহাস সাক্ষী, মহাপ্রভুর প্রকটলীলাতেও যখন মহাপ্রভু চাতুর্মাস্য ব্রতকালে শ্রীরঙ্গমে যান তখন শ্রীরঙ্গমের প্রধান পূজারী বেঙ্কট ভট্ট শ্রীমন্মহাপ্রভুর পান্ডিত্যের নিকট পরাভূত হয়ে তাঁর চরণাশ্রয় গ্রহণ করেন এবং বেঙ্কট ভট্টের ছেলে শ্রী গোপাল ভট্ট প্রভু রামানুজ সম্প্রদায় ত্যাগ করে গৌড়ীয় সম্প্রদায়ে মহাপ্রভুর চরণাশ্রয়ী হন, তিনি মহাপ্রভুর আদর্শে সনাতন গোস্বামীর নির্দেশে ‘শ্রীহরিভক্তিবিলাস’, ‘সৎক্রিয়াসারদীপিকা’ ইত্যাদি মহান বৈষ্ণবীয় গ্রন্থাবলি রচনা করেন।
আজও পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে স্বয়ং মহাপ্রভু ষড়ভুজরূপে সেবিত হন। সমস্ত প্রামাণিক শাস্ত্র প্রমাণে শ্রীচৈতন্যদেব স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণাবতার। অতএব, যে অজ্ঞ চৈতন্যপ্রভুর ভগবদতত্ত্বের উপর প্রশ্ন তুলে সে অসুর, সে দৈত্য, সে পাষণ্ডী।
পঞ্চরাত্র প্রমাণে রামানুজ হলেন অনন্তশেষনাগ, যিনি চৈতন্যসিংহের বসার আসন। নিম্বার্ক হলেন মহাপ্রভুর হাতের সেই সুদর্শনচক্র। মধ্ব(পবন-হনুমান-ভীমাবতার) ও বিষ্ণুস্বামী সদা চৈতন্যহরির সেবক। তাই শুদ্ধভক্তগণ তাঁর ভগবদ সত্ত্বার উপর প্রশ্ন তুলে না।
রামানুজ শ্রী সম্প্রদায়ের মতোই সাম্প্রতিক সময়গুলোতে রামানন্দী শ্রী সম্প্রদায়ের জগদগুরু রাজেন্দ্র মহারাজ ও নিম্বার্ক সম্প্রদায়ের অন্যতম দীক্ষাগুরু শ্রীদেবকীনন্দন ঠাকুর জীও শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যদেবের ভগবতত্ত্বা স্বীকার করেছেন এবং তারা মহাপ্রভুকে ‘গোলোকবিহারী হরি’ বলে সম্বোধন করতে অধিক পছন্দ করেন। এভাবে সকল বৈষ্ণব সম্প্রদায় শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য মহাপ্রভুর চরণাশ্রয় গ্রহণ করছে। শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুরের ভবিষ্যতবাণী সার্থক রূপ নিচ্ছে- “একদিন সমস্ত সম্প্রদায় ব্রহ্ম সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত হবে।”
।। হরে কৃষ্ণ ।।
[ বি:দ্র: স্বধর্মম্-এর অনুমোদন ব্যাতীত এই গবেষণামূলক লেখার কোনো অংশ পুনরুৎপাদন, ব্যবহার, কপি পেস্ট নিষিদ্ধ। স্বধর্মম্-এর সৌজন্যে শেয়ার করার জন্য উন্মুক্ত ]
নিবেদক-
° স্বধর্মম্: প্রশ্ন করুন | উত্তর পাবেন °