শিব অন্য কোন পশুর রূপ ধারণ না করে কেন বানর রূপেই আবির্ভূত হয়েছেন?!
==========================
এর অন্যতম কারণ হলো বানরেরা শাকাহারী। পশুদের মধ্যে বানর প্রজাতি মনুষ্য জাতির সাথে প্রায় সদৃশ এবং ফল,মূল,কন্দ ভক্ষণ করে থাকে, যা শ্রীরামচন্দ্রের অতি প্রিয়।
বাল্মিকী রামায়ণে রাম-লক্ষ্মণকে ‘ফলমূলাশনৌ দান্তৌ’ হিসেবে সম্বোধন করা হয়েছে, যার অর্থ ‘কেবল ফল-মূল ভক্ষণকারী দন্তধারী ব্যক্তি’
ফলমূলাশনৌ দান্তৌ তাপসৌ ব্রহ্মচারিণৌ৷
পুত্রৌ দশরথস্যাস্তাং ভ্রাতরৌ রামলক্ষ্মণৌ।।
[ বাল্মিকী রামায়ণ, অরণ্যকাণ্ড, ১৯। ১৫]
অনুবাদ: দশরথের পুত্রদ্বয় রাম ও লক্ষ্মণ পরস্পর ভ্রাতা, তারা ‘ফলমূলাশনৌ দান্তৌ’ অর্থাৎ তারা ফল-ফল আহারী তপস্বী ব্রহ্মচারী।
শুধু বাল্মীকি রামায়ণই নয়, তুলসীদাসকৃত রাম-রক্ষা-স্তোত্রমের ১৮ নং শ্লোকেও রাম-লক্ষণকে ‘ফলমূলাশনৌ দন্তৌ’ শব্দে বর্ণন করা হয়েছে।
শ্রীরামচন্দ্রের এক নাম ‘শাকপার্থিবঃ’। ‘পতঞ্জলী মহাভাষ্য’তে ‘শাকপার্থিব’ নামের অর্থ করা হয়েছে ‘শাকভোজী পার্থিবঃ’ অর্থাৎ ‘যে রাজার স্বভাবই হলো শাকসবজী ভোজন করা’। এছাড়াও ভট্টোজী দীক্ষিত প্রণীত ‘ব্যাকরণ-সিদ্ধান্ত-কৌমুদী’ এবং ‘পাণিনী অষ্টাধ্যায়ী’ ২।১।৬৯ নং সূত্রের বর্টীকায় কাত্যায়ন এ নামটি ব্যাখা করেছেন- ‘শাকপ্রিয় পার্থিব’- অর্থাৎ ‘যে রাজা শাকাহার প্রিয়।’
সংস্কৃতে ‘মাংস’ শব্দের অর্থ যেমন পশুমাংস হয়, তেমনি ফলের পুষ্ট অংশ তথা শাঁসকেও ‘মাংস’ বলা হয়।
বাল্মীকি রামায়ণের (৫।৩৬।৪১) নং শ্লোকে ‘ন মাংসং রাঘবো ভুঙতে’ দ্বারা স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, ‘শ্রীরামচন্দ্র কখনো মাংসাহার করেন না’।
ফলে রামায়ণের যে সকল শ্লোকে রাম মাংস সম্পর্কে বলেছেন (যেমন: ২।৫৬।২২ রাম লক্ষ্মণকে বলছেন ‘আনয়ম মাংসম’) সে সমস্ত শ্লোকে ‘মাংস’ শব্দ দ্বারা মুখ্য অর্থ গ্রহণ না করে গৌণ অর্থ গ্রহণ করতে হবে অর্থাৎ এ সমস্ত শ্লোক দ্বারা পশুমাংস না বুঝিয়ে ‘ফলের শাঁস’ বুঝতে হবে। তা না হলে রামচন্দ্রের অন্যান্য কথার সাথে সামঞ্জস্য রক্ষিত হয় না। বাল্মীকি রামায়ণের অজস্র স্থানে উল্লেখ আছে, রাম অযোধ্যাতে যেমন মাংসাহার করেন নি, বনেও মাংসাহার করতেন না। এমনকি রামায়ণে রামচন্দ্র নিজ মুখেই তিন বার বলেছেন, তিনি ফল-মূল-কন্দ ভক্ষণ করেই বনবাস করবেন। উল্লেখ্য, রাম কখনো নিজ বচন মিথ্যা হতে দেন না। যেমন-
চতুর্দশ হি বর্ষাণি বৎস্যামি বিজনে বনে।
কন্দমূলফলৈর্জীবন্ হিত্বা মুনিবদামিষম্ ।।
[ বাল্মিকী রামায়ণ, অযোধ্যাকাণ্ড, ২০।২৯ ]
অনুবাদ: রাম মাতা কৌশল্যাকে বললে, “মুনিগণ যেমন আমিষ আহার গ্রহণ না করে কন্দমূল ও ফলাহার করে, ঠিক সেরূপে আমি কন্দ-মূল-ফল দ্বারা জীবনধারণপূর্বক চৌদ্দ বৎসর জনহীন অরণ্যে বাস করব।”
ফলানি মূলানি চ ভক্ষয়ন্ বনে গিরীংশ্চ পশ্যন্ সরিতঃ সরাংসি চ।
বনং প্রবিশ্যৈব বিচিত্রপাদপং সুখী ভবিষয়ামি তবাস্তু নিবৃতিঃ ।। ৫৯
[ বাল্মিকী রামায়ণ, অযোধ্যাকাণ্ড, ৩৪।৫৯ ]
অনুবাদ: রাম দশরথকে বললেন, ‘বনে প্রবেশ করে ফলমূল ভক্ষণ করব; বনের পর্বত, নদী, সরোবর এবং বিচিত্র সব বৃক্ষ দেখে সুখে থাকব। আপনার মনে শান্তি বিরাজ করুক।’
পিত্রা নিযুক্তা ভগবন্ প্রবেক্ষ্যামস্তপোবনম্।
ধর্মমেবাচরিষ্যামস্তত্র মূলফলাশনাঃ।।
[ বাল্মিকী রামায়ণ, অযোধ্যাকাণ্ড, ৫৪।১৬ ]
অনুবাদ: রাম ভরদ্বাজ ঋষিকে বললেন, ‘ভগবন্ ! পিতা কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে আমরা তপোবনে প্রবেশ করব এবং সেখানে ফলমূলাহারী হয়ে ধর্মাচরণ করব।’
পুত্রৌ দশরথস্যাবাং ভ্রাতরৌ রামলক্ষ্মণৌ।
প্রবিষ্টৌ সীতয়া সার্থং দুশ্চরং দণ্ডকাবনম্।।
ফলমূলাশনৌ দান্তৌ তাপসৌ ব্রহ্মচারিণৌ।
বসন্তৌ দণ্ডকারণ্যে কিমর্থমুপহিংসথ।।
[ বাল্মিকী রামায়ণ, অরণ্যকাণ্ড, ২০।৭-৮]
অনুবাদ: রামচন্দ্র খর কর্তৃক প্রেরিত রাক্ষসদের বললেন, ‘’সীতার সঙ্গে দুর্গম দণ্ডকবনে প্রবিষ্ট আমরা দুই ভাই- রাম-লক্ষ্মণ, রাজা দশরথের দুই পুত্র। দণ্ডকে বনবাসী ফলমূলাহারী সংযমী ব্রহ্মচারী তাপসদ্বয় আমাদের কেন তোমরা হিংসা করছ?’
এমনকি স্বয়ং হনুমানও ঘোষণা করেছেন, রাঘব রামচন্দ্র মাংসাহার করেন না।
ন মাংসং রাঘবো ভুঙক্তে ন চৈব মধু সেবতে।
বন্যং সুবিহিতং নিত্যং ভক্তমশ্নাতি পঞ্চমম্।।
[ বাল্মীকি রামায়ণ, সুন্দরকান্ড ৩৬/৪১ ]
অনুবাদ: ‘রাঘব মাংস ভক্ষণ করেন না ; মধু পানও করেন না। শ্রীরামচন্দ্র নিত্য চার প্রহর উপবাসে থেকে পঞ্চম প্রহরে শাস্ত্র বিহিত বন্য ফল-মূল ও নীবার অন্নাদি ভােজন করেন।’
অনেকে প্রশ্ন করেন, রামচন্দ্র যদি মাংস না খাবেন, তবে তিনি কেন মৃগয়া করতেন?!
এর উত্তর হলো, রামচন্দ্র বালীর মতো অত্যাচারী পশুদের বধের জন্য মৃগয়া করতেন। আবার বাল্মীকি রামায়ণের অরণ্যকান্ডের ১০ম সর্গেও রামচন্দ্রের নিকট মুনি-ঋষিরা এসে অভিযোগ করেন, রাক্ষস অসুরেরা নানা পশুর আকার ধারণ করে মুনি ঋষীদের হত্যা করছে। তখন রামচন্দ্র সমস্ত দন্ডকারণ্যকে অসুরশূণ্য করার প্রতিজ্ঞা করেন এবং পশুরূপী অসুরদের বধ করেন। মারীচের মরো স্বর্ণহরিণ বধও তদ্রূপ দৃষ্টান্ত।
ক্ষত্রিয়রা মৃগয়া করে মাংসাহার করেন না, তা রামচন্দ্র নিজ মুখেই বলেছেন-
“রাজ্ঞাঞ্চ মৃগয়া ধর্ম্মে বিনা আমিষভোজনম্ ॥”
[ পদ্মপুরাণ, পাতালখন্ড, অধ্যায় ৭০, শ্লোক ১৯৬, রাম উক্তি ]
বঙ্গানুবাদ: শ্রীরাম বললেন, ‘ধর্মার্থে রাজা কর্তৃক মৃগয়ার বিধান থাকলেও আমিষভক্ষণের জন্য মৃগয়ার বিধান নেই।’
Raghava said, “Hunting without eating the flesh (of the animal killed) is the rule in the hunting done by a king.”
তাই, অনুরাগী ভক্ত যারা হনুমানের উপাসক তারা কখনই মাংস, মাছ বা নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবন করেন না। হনুমানের কোন উপাসক যদি মাংস খান, তবে তিনি নিশ্চিতভাবে হনুমানের ক্রোধের সম্মুখীন হন।