ভজ-গোবিন্দম্ (~শ্রীপাদ আদি শঙ্করাচার্য )

20241002_212156

ভজ-গোবিন্দম্ ( সম্পূর্ণ )

ভজ গোবিন্দং ভজ গোবিন্দং গোবিন্দং ভজ মূঢমতে ।

সম্প্রাপ্তে সন্নিহিতে কালে নহি নহি রক্ষতি ডুকৃঙ্করণে ॥ ১॥

অর্থ- গোবিন্দের ভজনা করো , গোবিন্দের ভজনা করো, হে মূঢ়মতি ! গোবিন্দের ভজনা করো । মৃত্যুর সমীপ সন্নিকটে ‘ডুকৃঙ্ করণে’ আবৃত্তি তোমায় রক্ষা করতে পারবে না ।

( জগৎ গুরু ভগবান আদি শঙ্করাচার্য যখন দেখলেন, অতীব বৃদ্ধ এক ব্রাহ্মণ মৃত্যু কালীন অবস্থায় বসেও, ব্যাকরণের জন্য ‘ডুকৃঙ্ করণে’ নামক একটি ধাতু বারবার আবৃত্তি করে যাচ্ছেন তখন এর অসারতা উপদেশ করে আচার্য তাকে গোবিন্দের ভজনা করতে বলেন । )

মূঢ় জহীহি ধনাগমতৃষ্ণাং কুরু সদ্বুদ্ধিং মনসি বিতৃষ্ণাম্।

যল্লভসে নিজকর্মোপাত্তং বিত্তং তেন বিনোদয় চিত্তম্॥ ২॥

ভজ গোবিন্দং…………….

অর্থ- হে মূঢ়জন! কেবলমাত্র অর্থ উপার্জনের তৃষ্ণা পরিত্যাগ করো । এই ধরনের চিন্তা তোমার মনকে কেবলমাত্র জাগতিক করে দেবে, সুতারং মনে এর জন্য বিতৃষ্ণা সৃষ্টি করো । তোমার উত্তম কর্ম্মের দ্বারা উপার্জিত যে অর্থ, তোমাকে স্বচ্ছল রাখে তার দ্বারাই তোমার মনকে খুশী রাখো।
ওহে মূর্খ! নিরন্তর, এই জাগতিক মৃত্যু-গ্রাস থেকে রক্ষাকারী গোবিন্দের ভজনা করো ।

নারীস্তনভরনাভিদেশং দৃষ্ট্বা মা গা মোহাবেশম্ ।

এতন্মাংসবসাদিবিকারং মনসি বিচিন্তয় বারং বারম্ ॥ ৩॥

ভজ গোবিন্দং…………….

অর্থ- নারীদের স্তনমন্ডল ও নাভিদেশ মোহের আবেশে দেখে অভিভূত হয়ো না, এসব নিছক মাংস আর মেদ এর বিকার মাত্র। বারবার মনে এই বিচার করো। হে মূঢ়জন! গোবিন্দের ভজনা করো, গোবিন্দের ভজনা করো, সকল মোহ মুক্তির মূল গোবিন্দের ভজনা করো।

নলিনীদলগতজলমতিতরলং তদ্বজ্জীবিতমতিশয় চপলম্ ।

বিদ্ধি ব্যাধ্যভিমানগ্রস্তং লোকং শোকহতং চ সমস্তম্ ॥ ৪॥

ভজ গোবিন্দং…………….

অর্থ – জলবিন্দু যেমন পদ্মপত্রের উপর ক্ষণিক সময়ও স্থীর থাকে না, ক্ষণস্থায়ী হয়, তেমনি এই জীবনও অতিশয় চঞ্চল এবং ক্ষণস্থায়ী , অনিশ্চিত । সবসময় জানবে, এই ব্যাধি ও অহংকারগ্রস্থ সমস্ত জগৎ সংসার কেবল এক শোকালয় মাত্র।
সুতরাং হে মূঢ়মতি গোবিন্দের ভজনা করো ।

যাবদ্বিত্তোপার্জনসক্ত-স্তাবন্নিজপরিবারো রক্তঃ ।

পশ্চাজ্জীবতি জর্জরদেহে বার্তাং কোঽপি ন পৃচ্ছতি গেহে ॥ ৫॥

ভজ গোবিন্দং…………….

অর্থ- ওহে, যতদিন তুমি অর্থ উপার্জন করে যাবে , ততদিন তোমার পরিবার পরিজন তোমার সাথে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখবে ।  (ভালোবাসবে, মিথ্যা প্রশংসা করবে )। পরে যখন জর্জর দেহ নিয়ে বৃদ্ধ হবে তখন গৃহে তোমার সঙ্গে কেউ ভালো করে দুটো কথা অব্দি বলবে না।

অতএব, হে মূঢ়মতি (মূৰ্খ), সকল মোহ বিনাশকারী গোবিন্দের ভজনা করো ।

যাবৎপবনো নিবসতি দেহে তাবৎপৃচ্ছতি কুশলং গেহে ।

গতবতি বায়ৌ দেহাপায়ে ভার্যা বিভ্যতি তস্মিন্কায়ে ॥ ৬॥

ভজ গোবিন্দং…………….

অর্থ-  যতক্ষণ দেহে প্রাণ বায়ুর নিবাস থাকে, ততক্ষণ-ই সবাই তার কুশলাদি জিজ্ঞাসা করে থাকে । প্রাণ বায়ু ত্যাগ হলে, শরীর ত্যাগ করলে ,  লোক তো দূর নিজের স্ত্রীও শবকে ভয় করে দূরে সরে থাকে । (মৃতে ভৌতিক ভয় – [ অথচ একসময় কতই না প্রিয় ছিল ])
সুতরাং, হে মূঢ়মতি (মূর্খ), সকল মোহ বিনাশকারী গোবিন্দের ভজনা করো। কারণ মৃত্যুর সন্নিকটে তোমায় আর কেউ ই রক্ষা করতে সক্ষম নয়।

(যারা উপর উপর তোমার শরীরের কুশল জিজ্ঞাসা করেছিল তাদের সাথে ঐ শরীর অব্দি ই সম্পর্ক , অথচ তাদের মোহের জন্য তুমি ঈশ্বরের সাধন ভজনের সময় পাচ্ছো না, কী ভয়ানক মোহ তোমায় গিলে রেখেছে ) ।

বালস্তাবৎ ক্রীড়াসক্তঃ তরুণস্তাবত্তরুণীসক্তঃ ।

বৃদ্ধস্তাবচ্চিন্তাসক্তঃ পরমে ব্রহ্মণি কোঽপি ন সক্তঃ ॥ ৭॥

ভজ গোবিন্দং…………….

অর্থ – বাল্যকাল যায় বালকদের খেলাধুলায় মত্ত থেকে, তারুণ্য যায় তরুণ-তরুণীর প্রতি আকর্ষণ, আসক্তিতে। বার্ধক্যে বৃদ্ধ মগ্ন থাকে নানারকম চিন্তা ভাবনায় । কিন্তু হায়! পরব্রহ্মে কারোর কোনো মন নেই ।
অতএব, হে মূঢ়মতি (মূৰ্খ), সকল মোহ বিনাশকারী গোবিন্দের ভজনা করো । মৃত্যুর সন্নিকটে আর কিছুই তোমায় রক্ষা করতে পারবেনা ।

কা তে কান্তা কস্তে পুত্রঃ সংসারোঽয়মতীব বিচিত্রঃ ।

কস্য ত্বং কঃ কুত আয়াত-স্তত্ত্বং চিন্তয় তদিহ ভ্রাতঃ ॥ ৮॥

ভজ গোবিন্দং…………….

অর্থ – কে তোমার স্ত্রী? কে-ই বা তোমার পুত্র? ওহে! এই সংসার অত্যন্ত বিচিত্র । তুমি-ই বা কে, কার ? কোথা থেকে এসেছ ? হে ভ্রাতা, এই তত্ত্ব বারবার চিন্তন ও বিচার করে দেখো।
হে মূঢ়মতি (মূৰ্খ), সকল মোহ বিনাশকারী গোবিন্দের ভজনা করো, মৃত্যুর সন্নিকটে আর কিছুই তোমায় রক্ষা করতে পারবে না ।

সৎসঙ্গত্বে নিস্সঙ্গত্বং নিস্সঙ্গত্বে নির্মোহত্বম্ ।

নির্মোহত্বে নিশ্চলতত্ত্বং নিশ্চলতত্ত্বে জীবন্মুক্তিঃ ॥ ৯॥

ভজ গোবিন্দং…………….

অর্থ – সৎসঙ্গ হতে নিঃসঙ্গত্ব প্রাপ্ত হয়, নিঃসঙ্গ হলে নির্মোহত্ত (মোহ বিহীন অবস্থা ) প্রাপ্ত হয়। নির্মোহ হলে নিশ্চলতত্ব (নিশ্চল অবস্থা ) প্রাপ্ত হয় । নিশ্চল হলে জীবন মুক্তি হয় ( জীবিত অবস্থায় মুক্ত ) ।
অতএব, হে মূঢ়মতি (মূৰ্খ), সকল মোহ বিনাশকারী গোবিন্দের ভজনা করো, মৃত্যুর সন্নিকটে আর কিছুই তোমায় রক্ষা করতে পারবে না ।

বয়সি গতে কঃ কামবিকারঃ শুষ্কে নীরে কঃ কাসারঃ ।

ক্ষীণে বিত্তে কঃ পরিবারঃ জ্ঞাতে তত্ত্বে কঃ সংসারঃ ॥ ১০॥

ভজ গোবিন্দং…………….

অর্থ – যৌবন কাল গত হয়ে বার্ধক্য প্রাপ্ত হলে আর কিসের কামানুরাগ? জল শুকিয়ে গেলে সরোবর আর সরোবর কোথায় ? ধনাভাব হলে স্বজন, পরিজন, পরিবার কোথায় যায়? ওহে, তেমনি তত্ত্ব জ্ঞান যখন হয় তখন কোথায় এই সংসার? কিছুই আর থাকে না ।
সুতরাং, হে মূঢ়মতি (মূৰ্খ), সকল মোহ বিনাশকারী গোবিন্দের ভজনা করো, মৃত্যুর সন্নিকটে আর কিছুই তোমায় রক্ষা করতে পারবে না।

মা কুরু ধনজযৌবনগর্বং হরতি নিমেষাৎকালঃ সর্বম্ ।

মায়াময়মিদমখিলং বুধ্বা ব্রহ্মপদং ত্বং প্রবিশ বিদিত্বা ॥ ১১॥

ভজ গোবিন্দং…………….

অর্থ – ধন – জন – যৌবনের গর্ব কখনো করো না, সর্বগ্রাসী কাল এসকল কিছুই এক নিমিশে হরণ করে নেয়। এই অখিল ব্ৰহ্মাণ্ড বিশ্ব চরাচর সমস্তই মায়াময়, সুতরাং এই অনিত্য সংসারের প্রতি মায়া পরিত্যাগ করে শীঘ্রই জ্ঞানার্জন করে সত্য স্বরূপ ব্রহ্মপদে প্রবেশ করো।
হে মূঢ়মতি (মূৰ্খ), সকল মোহ বিনাশকারী গোবিন্দের ভজনা করো, মৃত্যুর সন্নিকটে আর কিছুই তোমায় রক্ষা করতে পারবে না।

দিনয়ামিন্যৌ সায়ং প্রাতঃ শিশিরবসন্তৌ পুনরায়াতঃ ।

কালঃ ক্রীডতি গচ্ছত্যায়ু-স্তদপি ন মুঞ্চত্যাশাবায়ুঃ ॥ ১২॥

ভজ গোবিন্দং…………….

অর্থ – দিন-রাত্রি, সায়ং সন্ধ্যা ও প্রভাত, শীত-বসন্ত,  পুনঃ পুনঃ নিরন্তর আসাযাওয়া করে। (এইরূপে ) কাল এর গতি ক্রিয়া করে চলতে থাকে । আর ক্রমে (জীবের) আয়ু ক্ষয় হয়। কিন্তু তারপরও অভাগা জীব আশাবায়ুর পরিত্যাগ করতে পারে না ।
অতএব, হে মূঢ়মতি (মূৰ্খ), সকল মোহ বিনাশকারী গোবিন্দের ভজনা করো । মৃত্যুর সন্নিকটে আর কিছুই তোমায় রক্ষা করতে পারবে না।

কা তে কান্তা ধনগতচিন্তা বাতুল কিং তব নাস্তি নিয়ন্তা ।

ত্রিজগতি সজ্জনসঙ্গতিরেকা ভবতি ভবার্ণবতরণে নৌকা ॥ ১৩॥

ভজ গোবিন্দং…………….

অর্থ – ওহে পাগল! কেনো ধন সম্পত্তির চিন্তায় শোকাকুল হচ্ছো? তোমার কী কোনো পথপ্রদর্শক বা নিয়ন্তা নেই? তোমাকে এই ত্রি-জাগতিক সংসার শোক সাগর হতে কেবলমাত্র একটি জিনিস ই রক্ষা করতে পারে তা হলো যত শীঘ্র সম্ভব সৎসঙ্গের (সজ্জন, জ্ঞানী গুণী সাধুদের সঙ্গ ) নৌকায় চড়ে বসা ।
সুতরাং, হে মূঢ়মতি (মূৰ্খ), সকল মোহ বিনাশকারী গোবিন্দের ভজনা করো । মৃত্যুর সন্নিকটে আর কিছুই তোমায় রক্ষা করতে পারবে না ।

জটিলো মুণ্ডী লুঞ্ছিতকেশঃ কাষায়াম্বরবহুকৃতবেষঃ ।

পশ্যন্নপি চ ন পশ্যতি মূঢো হ্যুদরনিমিত্তং বহুকৃতবেষঃ ॥ ১৪॥

ভজ গোবিন্দং…………….

অর্থ – কেউ বা জটাজুটধারী, কারোর ই বা মুন্ডিত মুন্ড, কারোর বা কিছু বিশেষ উৎপাটিত কেশ শিখা, কেউ আবার কাশার বস্ত্র পরিধিত নানান বেশ ভুসা ধরে আছে । এই সকল মূর্খেরা যেন দেখেও দেখছে না যে এরাও মোহবশত – উদরপূর্তির জন্যই এই নানান রকম বেশ ভূসা ধরেছে মাত্র । অতএব, হে মূঢ়মতি (মূৰ্খ), সকল মোহ বিনাশকারী গোবিন্দের ভজনা করো । মৃত্যুর সন্নিকটে আর কিছুই তোমায় রক্ষা করতে পারবে না।

(বি.দ্রঃ- আদি গুরু শঙ্করাচার্য যখন অবতীর্ণ হন, তখন বৈদিক সনাতন ধর্ম এক মৃতপ্রায় অবস্থা লাভ করেছিল । ধর্মের নামে ভন্ডামীর রাজত্ব চলছিল, বিশেষত বৌদ্ধ ধর্মে দেশ ছেয়ে গিয়ে, ন্যাড়া ন্যাড়ির দল দেখা যাচ্ছিল । যারা কাশার বস্ত্র (সন্ন্যাসীর পোশাক ) পরিধান করে , মাথা মুন্ডন করে মাত্র আরামে বসে খাবার মোহে সন্ন্যাসী সেজে ঘুরতো। আচার্য তাদের তীব্র কটাক্ষ করলেন। আর তখন সনাতন হিন্দু ধর্মে নানা শাখা, নানা বিতি বিচ্ছিরি অবস্থা ছিল, তাদের ও একই দশা, কেউ যাগ যজ্ঞের নাম করে শিখা রেখে উদর পূর্তি করছে, কেউ জটা দেখিয়ে উদর পূর্তি করছে। এই সমগ্র ভন্ডামীর সময়কালে, ধর্মের নিগূঢ় তত্ত্ব নিয়ে, মোহ মায়া হতে রক্ষা করতেই জগৎ গুরু ভগবান শঙ্করাচার্য রূপে আবির্ভূত হলেন এবং এসকল ভন্ডামি কে তীব্র কটাক্ষ করলেন। যে, , ধর্ম জগতে ঢুকে, সাধু সন্ন্যাসীর বেশ নিয়েও কিছু মূর্খের মোহ গেলো না, এখানেও তারা শুধু উদরপূর্তির নিমিত্তেই এই বহুরূপী বেশ ধরেছে।)

অঙ্গং গলিতং পলিতং মুণ্ডং দশনবিহীনং জাতং তুণ্ডম্ ।

বৃদ্ধো যাতি গৃহীত্বা দণ্ডং তদপি ন মুঞ্চত্যাশাপিণ্ডম্ ॥ ১৫॥

ভজ গোবিন্দং…………….

অর্থ- অঙ্গ সকল কুঁচকে গিয়ে এমন হয় যেন গলে গলে পড়ছে, মাথা থেকে সব চুল উঠে যায়, দাঁত পড়ে গিয়ে মুখ বিবর চুপসে যায়, ঠুকরে ঠুকরে হাঁটে, বৃদ্ধ হয়ে গিয়েছে, লাঠি হাতে চলতে হয় তবুও এই দেহ হতে আশাপিন্ড ত্যাগ হয় না।
অতএব, হে মূঢ়মতি (মূর্খ), সকল মোহ বিনাশকারী গোবিন্দের ভজনা করো। মৃত্যুর সন্নিকটে আর কিছুই তোমায় রক্ষা করতে পারবে না।

অগ্রে বহ্নিঃ পৃষ্ঠে ভানুঃ রাত্রৌ চুবুকসমর্পিতজানুঃ ।

করতলভিক্ষস্তরুতলবাস- স্তদপি ন মুঞ্চত্যাশাপাশঃ ॥ ১৬॥ভজ গোবিন্দং…………….

(যে নিজেকে ত্যাগী মনে করে ভাবে সে মায়া মুক্ত সেক্ষেত্রে মোহ কিরূপে তাকে জড়িয়ে থাকে এখানে আচার্যদেব তাই উপদেশ করছেন )

অর্থ – (শীত বস্ত্রের অভাবে ) তুমি দিনের শুরুতে সামনে অগ্নি কুন্ড নিয়ে এবং দিনে পিঠে সূর্য তাপ এর আকাঙ্খা নিয়ে ঘুরছো । রাত্রে উষ্ণতার আকাঙ্ক্ষায় হাঁটু ভাঁজ করে থুতনির সঙ্গে মিশিয়ে রাত্রিযাপন করো । ( কোনো ভিক্ষা পাত্র নেই, তবু) করতলে (হাতের তালুতে ) করে ভিক্ষা যাচনা করে থাকো। (বাস গৃহের অভাব ) তরুতলে বাস করে যাচ্ছ। তথাপি তোমার আশা-পাশ তোমাকে পরিত্যাগ করছে না।
অতএব, হে মূঢ়মতি (মূৰ্খ), সকল মোহ বিনাশকারী গোবিন্দের ভজনা করো । মৃত্যুর সন্নিকটে আর কিছুই তোমায় রক্ষা করতে পারবে না।

কুরুতে গঙ্গাসাগরগমনং ব্রতপরিপালনমথবা দানম্ ।

জ্ঞানবিহীনঃ সর্বমতেন ভজতি ন মুক্তিং জন্মশতেন ॥ ১৭॥

ভজ গোবিন্দং…………….

অর্থ – গঙ্গা সাগরে পূণ্য স্নানেই গমন করো কী ব্রত – উপবাস ই পরিপালন করো অথবা দান ই করো, তবুও জ্ঞান না হলে শত জন্মেও এসব করে মুক্তি লাভ হবে না ।
অতএব, হে মূঢ়মতি (মূৰ্খ), সকল মোহ বিনাশকারী গোবিন্দের ভজনা করো, মৃত্যুর সন্নিকটে আর কিছুই তোমায় রক্ষা করতে পারবে না।

সুরমন্দিরতরুমূলনিবাসঃ শয়্যা ভূতলমজিনং বাসঃ ।

সর্বপরিগ্রহভোগত্যাগঃ কস্য সুখং ন করোতি বিরাগঃ ॥ ১৮॥

ভজ গোবিন্দং…………….

অর্থ – দেবগৃহ মন্দিরে বা বৃক্ষমূলে বসবাস করলে , ধরিত্রী মায়ের কোলেই শয্যা গ্রহণ করলে, মৃগ চর্মের বস্ত্র পরিধান করলে এবং সর্বপ্রকার পরিগ্রহ ও ভোগের প্রতি  ত্যাগ করার সামর্থ্য থাকলে, এরূপ বৈরাগ্য দ্বারা কে না সুখী হবে?
অতএব, হে মূঢ়মতি (মূর্খ), গোবিন্দের ভজনা করো, মৃত্যুর সন্নিকটে আর কিছুই তোমায় রক্ষা করতে পারবে না।

যোগরতো বা ভোগরতো বা সঙ্গরতো বা সঙ্গবিহীনঃ ।

যস্য ব্রহ্মণি রমতে চিত্তং নন্দতি নন্দতি নন্দত্যেব ॥ ১৯॥

ভজ গোবিন্দং…………….

অর্থ – কেউ যোগরত অবস্থায় ই থাকুক বা ভোগেই ডুবে থাকুক বা নানান সঙ্গে যুক্ত থাকুক কিংবা সঙ্গহীন-ই হোক, একমাত্র যাঁর মন ব্রহ্ম চিন্তনে সদা মগ্ন থাকে, সে-ই পরমানন্দ অনুভব করে। এছাড়া অন্য কেউ-ই তা অনুভব করে না।
অতএব, হে মূঢ়মতি (মূৰ্খ), সেই ব্রহ্ম স্থিতি লাভের জন্য সকল মোহ বিনাশকারী গোবিন্দর ভজনা করো, মৃত্যুর সন্নিকটে আর কিছুই তোমায় রক্ষা করতে পারবে না।

ভগবদ্গীতা কিঞ্চিদধীতা গঙ্গাজললবকণিকা পীতা ।

সকৃদপি যেন মুরারিসমর্চা ক্রিয়তে তস্য যমেন ন চর্চা ॥ ২০॥

ভজ গোবিন্দং…………….

অর্থ – ভগবদ্গীতার শিক্ষা জীবনে কিঞ্চিৎ ধারণ করলে , গঙ্গা জলের এক কণা মাত্রও ভক্তির সঙ্গে পান করলে এবং নিত্য ভগবান শ্রীকৃষ্ণ মুরারির পূজা বন্দনা করলে , যম ই বা তার কী করতে পারবে ?
অতএব হে মূঢ়! নিত্য গোবিন্দের ভজনা করো , মৃত্যুর সমীপ সন্নিকটে আর কিছুই তোমায় রক্ষা করতে পারবে না ।

পুনরপি জননং পুনরপি মরণং পুনরপি জননীজঠরে শয়নম্ ।ইহ সংসারে বহুদুস্তারে কৃপয়াঽপারে পাহি মুরারে ॥ ২১॥

ভজ গোবিন্দং…………….

অর্থ – এই জগৎ সংসারে পুনঃ পুনঃ জন্ম হয় , পুনঃ পুনঃ মরণ হয় , বারবার মাতৃ জঠরে জীব জন্ম গ্রহণের জন্য শায়িত থাকে । তাই ” হে কৃপাময় ভগবান মুরারে! কৃপা করে আমায় এই ভব সংসারে সমুদ্র হতে পার করুন । ” এরূপ শরণাগত হয়ে , হে মূঢ়! গোবিন্দের ভজনা করো । কারণ মৃত্যুর সমীপ সন্নিকটে ব্যাকরণের আবৃত্তি তোমায় রক্ষা করতে পারবে না ।

রথ্যাচর্পটবিরচিতকন্থঃ পুণ্যাপুণ্যবিবর্জিতপন্থঃ ।

যোগী যোগনিয়োজিতচিত্তো রমতে বালোন্মত্তবদেব ॥ ২২॥

ভজ গোবিন্দং…………….

অর্থ- পথে পরে থাকা বস্ত্র খণ্ড দিয়েই যে কাঁথা তৈরি করে নেয় , পুণ্যাপুণ্য বিবর্জিত মুক্তির পথে চলে , যোগীর মতন চিত্ত কে যোগ যুক্ত করে ভাগবত চিন্তায় নিয়োজিত থাকে সে ঐশ্বরিক আনন্দে বালকবত উন্মাদনায় আনন্দিত থাকে ।
সুতরাং হে মূঢ়! গোবিন্দের ভজনা করো । কারণ মৃত্যুর সমীপ সন্নিকটে ব্যাকরণের আবৃত্তি তোমায় রক্ষা করতে পারবে না ।

কস্ত্বং কোঽহং কুত আয়াতঃ কা মে জননী কো মে তাতঃ ।

ইতি পরিভাবয় সর্বমসারম্ বিশ্বং ত্যক্ত্বা স্বপ্নবিচারম্ ॥ ২৩॥

ভজ গোবিন্দং…………….

অর্থ – কে তুমি ? কে ই বা আমি ? কোথা হতে এসেছি ? কে আমার মাতা , কে ই বা পিতা ? এই সমস্ত জগৎ প্রপঞ্চ অসার স্বপ্নের মতন , একে সত্য ভাবা পরিত্যাগ করো ।
হে মূঢ়! পরম সত্য গোবিন্দের ভজনা করো কারণ মৃত্যুর সমীপ সন্নিকটে ব্যাকরণের আবৃত্তি তোমায় রক্ষা করতে পারবে না ।

ত্বয়ি ময়ি চান্যত্রৈকো বিষ্ণু-র্ব্যর্থং কুপ্যসি ময়্যসহিষ্ণুঃ ।

ভব সমচিত্তঃ সর্বত্র ত্বং বাঞ্ছস্যচিরাদ্যদি বিষ্ণুত্বম্ ॥ ২৪॥

ভজ গোবিন্দং…………….

অর্থ – তোমার মধ্যে আমার মধ্যে এবং সর্বত্র সর্ব কিছুতেই সেই সর্বব্যাপী ভগবান বিষ্ণু অবস্থান করছেন । তাই কারোর উপর ব্যর্থ ক্রোধ করো না , সবার প্রতি সহিষ্ণু হও । যদি বিষ্ণুত্ব লাভ করতে চাও সর্বদা সমভাব সম্পন্ন সমদর্শী হও ।
তাই হে মূঢ়! সর্বব্যাপী সর্বেশ্বর গোবিন্দের ভজনা করো ।  মৃত্যুর সমীপ সন্নিকটে ব্যাকরণের আবৃত্তি তোমায় রক্ষা করতে পারবে না ।

শত্রৌ মিত্রে পুত্রে বন্ধৌ মা কুরু যত্নং বিগ্রহসন্ধৌ ।

সর্বস্মিন্নপি পশ্যাত্মানং সর্বত্রোৎসৃজ ভেদাজ্ঞানম্ ॥ ২৫॥

ভজ গোবিন্দং…………….

অর্থ – তোমার সমস্ত প্রচেষ্টা শক্তির ক্ষয়,  শত্রুর সঙ্গে লড়তে কিংবা মিত্র, পুত্র , বন্ধু পরিজনের থেকে প্রশংসা লাভের জন্য করো না । সর্বত্র নিজ আত্মাকে দর্শন করো এবং অজ্ঞান হতে জাত ভেদ দর্শন ত্যাগ করো ।
হে মূঢ়! সর্বব্যাপী সর্বেশ্বর গোবিন্দের ভজনা করো ।  মৃত্যুর সমীপ সন্নিকটে ব্যাকরণের আবৃত্তি তোমায় রক্ষা করতে পারবে না ।

কামং ক্রোধং লোভং মোহং ত্যক্ত্বাঽঽত্মানং  পশ্যতিসোঽহম্।

আত্মজ্ঞানবিহীনা মূঢা-স্তে পচ্যন্তে নরকনিগূঢাঃ ॥ ২৬॥

ভজ গোবিন্দং…………….

অর্থ – কাম , ক্রোধ , লোভ , মোহ পরিত্যাগ করো এবং আত্মস্বরূপ নিজেকে দর্শন করো । যে মূঢ়! আত্মজ্ঞানহীন হয়েই থেকে যায় সে নিগূঢ় নরকে পচতে থাকে ।
অতএব হে মূঢ়! নিত্য গোবিন্দের ভজনা করো , মৃত্যুর সমীপ সন্নিকটে আর কিছুই তোমায় রক্ষা করতে পারবে না ।

গেয়ং গীতানামসহস্রং ধ্যেয়ং শ্রীপতিরূপমজস্রম্ ।

নেয়ং সজ্জনসঙ্গে চিত্তং দেয়ং দীনজনায় চ বিত্তম্ ॥ ২৭॥

ভজ গোবিন্দং…………….

অর্থ – নিত্য গীতা ( পাঠ করবে) এবং বিষ্ণু সহস্রনাম গান করবে  । শ্রী পতি ভগবান বিষ্ণুর অজস্র রূপ রয়েছে নিরন্তর তাঁর ধ্যান করবে।চিত্ত কে সবসময় সাধু সজ্জনদের প্রতি নিবিষ্ট করে রাখবে । দীনন দরিদ্র জনকে যথা সাধ্য বিত্ত, ধনসম্পদ দান করবে ।
আর হে মূঢ়! নিরন্তর গোবিন্দের ভজনা করবে । মৃত্যুর সমীপ সন্নিকটে আর কিছুই তোমায় রক্ষা করতে পারবে না ।

সুখতঃ ক্রিয়তে রামাভোগঃ পশ্চাদ্ধন্ত শরীরে রোগঃ ।

যদ্যপি লোকে মরণং শরণং তদপি ন মুঞ্চতি পাপাচরণম্ ॥ ২৮॥

ভজ গোবিন্দং…………….

অর্থ – যারা সুখের সঙ্গে স্ত্রী সম্ভোগ , ভোগ বিলাসে মজে থাকে কিছুকাল পরেই তাদের শরীর নানারকম রোগে জর্জরিত হয়ে যায় । যদিও জগতে মৃত্যুই অবশ্যম্ভাবী তারপরেও এই মূর্খের দল পাপাচারণ ( পাপীর আচরণ ) ছাড়তে পারে না ।
তাই ওহে মূঢ়! সকল পাপ বিনষ্টকারী গোবিন্দের ভজনা করো। মৃত্যুর সমীপ সন্নিকটে আর কিছুই তোমায় রক্ষা করতে পারবে না ।

অর্থমনর্থং ভাবয় নিত্যং নাস্তিততঃ সুখলেশঃ সত্যম্।
পুত্রাদপি ধনভাজাং ভীতিঃ সর্বত্রৈষা বিহিতা রীতিঃ ॥ ২৯॥
ভজ গোবিন্দং…………….

অর্থ – ধন সম্পদ , অর্থ কে সবসময় অনর্থের কারণ বলেই জানবে , সত্যি সত্যিই এতে লেশমাত্র সুখও নেই । সর্বত্র তো এইরকম ই রীতি দেখা যায় যে ধনবান পিতা  নিজের পুত্রকেও বিশ্বাস করতে না পেরে ভয়ে ভয়ে থাকে ।
অতএব হে মূঢ়! পরম ধন গোবিন্দ নামের ভজনা করো । মৃত্যুর সমীপ সন্নিকটে আর কিছুই তোমায় রক্ষা করতে পারবে না ।

প্রাণায়ামং প্রত্যাহারং নিত্যানিত্য বিবেকবিচারম্ ।

জাপ্যসমেতসমাধিবিধানং কুর্ববধানং মহদবধানম্ ॥ ৩০॥

ভজ গোবিন্দং…………….

অর্থ- নিয়মিত প্রাণায়াম , প্রত্যাহার এবং নিত্য-অনিত্য বস্তু বিবেক বিচারের অভ্যাস করবে । খুব সাবধানে যত্নের সঙ্গে বিধিসম্মতভাবে ভগবানের নাম জপ , ধ্যান , সমাধি করতে সংকল্পবদ্ধ হও – কারণ এটিই মহান সিদ্ধান্ত ।
সুতরাং হে মূঢ়! গোবিন্দের ভজনা করো । কারণ মৃত্যুর সমীপ সন্নিকটে ব্যাকরণের আবৃত্তি তোমায় রক্ষা করতে পারবে না ।

গুরুচরণাম্বুজনির্ভরভক্তঃ সংসারাদচিরাদ্ভব মুক্তঃ ।

সেন্দ্রিয়মানসনিয়মাদেবং দ্রক্ষ্যসি নিজহৃদয়স্থং দেবম্ ॥ ৩১॥

ভজ গোবিন্দং…………….

অর্থ – যে ভক্ত গুরুর চরণ বন্দনা করে, গুরু চরণের  আশ্রয়েই নির্ভরশীল সে অচিরেই সংসার বন্ধন হতে মুক্ত হয়ে যায় । যে নিয়মিত ইন্দ্রিয় ও মনের সংযম করে চলে সে অতি সহজেই নিজের হৃদয়ে অবস্থিত ভগবান কে দর্শন করতে পারবে ।
সুতরাং,  গোবিন্দের ভজনা করো , গোবিন্দের ভজনা করো, হে মূঢ়মতি ! গোবিন্দের ভজনা করো । মৃত্যুর সমীপ সন্নিকটে ‘ডুকৃঙ্ করণে’ আবৃত্তি তোমায় রক্ষা করতে পারবে না ।

ইতি জগৎ গুরু শিবাবতার ভগবান আদি শঙ্করাচার্য বিরচিত চর্পটপঞ্জরিকা-স্তোত্র ও দ্বাদশপঞ্জরিকা-স্তোত্র এর শ্লোক গুলোর একত্র ভাবানুবাদ ” ভজ গোবিন্দম্ ” সমাপ্ত ।

ভাবানুবাদ -শ্রী মুকুল চক্রবর্তী

° স্বধর্মম্: প্রশ্ন করুন | উত্তর পাবেন °

 

Avatar of Brajasakha Das

Brajasakha Das

Writer & Admin

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments