শ্রীমতি রাধারাণী:
সনাতন শাস্ত্র অনুসারে শ্রীমতি রাধারাণী হলেন পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং। পরমাত্মা ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এবং শ্রীমতি রাধারাণী মূলত একজনই, তাদের মধ্যে কোন ভেদ বা পার্থক্য নেই। কিন্তু চিন্ময় জগতের সর্বোচ্চ লোক গোলক বৃন্দাবন ধামে শ্রীকৃষ্ণ যখন তার অপ্রাকৃত লীলাকে লোকশিক্ষার নিমিত্তে বিস্তার করতে ইচ্ছে করেন, তখন শ্রীকৃষ্ণ থেকে শ্রীমতি রাধারাণী আবির্ভূত হন।
পদ্মপুরাণ শাস্ত্রে শ্রীমতি রাধা ঠাকুরাণী দেবর্ষি নারদকে বলছেন-
অহঞ্চ ললিতা দেবী পুংরূপা কৃষ্ণবিগ্রহা।
আবয়োরন্তরং নাস্তি সত্যং সত্যং হি নারদ।।
[ পদ্মপুরাণ, পাতালখণ্ড, ৪৪।৪৬ ]
অনুবাদ:
শ্রীমতি রাধিকা বললেন, আমিই ললিতা দেবী, আমিই পুংরূপে কৃষ্ণবিগ্রহ। হে নারদ, সত্য বলছি, সত্য বলছি, আমাদের মধ্যে কোনও ভেদ নেই।
শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত গ্রন্থেও গ্রন্থকার খুব সুন্দরভাবে শ্রীমতি রাধারাণীর সমন্ধে আমাদের শিক্ষা প্রদান করছেন।
রাধাকৃষ্ণ ঐছে সদা একই স্বরুপ।
লীলারস আস্বাদিতে ধরে দুইরুপ।।
[ শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত, আদিলীলা, ৪।৯৮]
অনুবাদ:
শ্রীমতি রাধারাণী এবং পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সর্বদাই একজন,তবুও লীলারস আস্বাদন করার জন্য তাঁরা ভিন্নরুপ ধারণ করেছেন।
চিন্ময় জগতের গোলক বৃন্দাবনে শ্রীমতি রাধারাণী আবির্ভাব-
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ,প্রকৃতিখন্ড ৪৮/২৬-৩২,৩৭ নং শ্লোকে
মহাদেব শিব মাতা দুর্গা দেবীকে চিন্ময় জগতের গোলক বৃন্দাবনে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ থেকে কিভাবে শ্রীমতি রাধারাণী আবির্ভূত হন, এ বিষয়ে বর্ণনা করেন,নিম্নে তা আলোচনা করা হল।
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে বলা হয়েছে –
পুরা বৃন্দাবনে রম্যে গোলকে রাসমন্ডলে।
শতশৃঙ্গৈক দেশে চ মালতী মল্লিকাবনে।।২৬।।
রত্মসিংহাসনে রম্যে তস্থৌ তত্র জগৎপতিঃ।
স্বেচ্ছাময়শ্চ ভগবান বভূব রমনোৎসুক।।২৭।।
রমনং কত্তুর্মিচ্ছংশ্চ তদ্বভূব সুরেশ্বরী।
ইচ্ছয়া চ ভবেৎ সর্ব্বং তস্য স্বেচ্ছাময়স্য চ।।২৮।।
এতস্মিন্নন্তরে দুর্গে দ্বিধারুপৌ বভূব সঃ।
দক্ষিণাঙ্গঞ্চ শ্রীকৃষ্ণঃ বামাঙ্গং সা চ রাধিকা।।২৯।।
বভূব রমনী রম্যা রামেসা রমণোৎসুকা।
অমূল্য রত্নাভরণা রত্মসিংহাসনস্থিতা।।৩০।।
বহ্নিশুদ্ধাং সুকাধানা কোটিপূর্ণশশী প্রভা।
তপ্তাকাঞ্চনবর্ণাভা রাজিতা চ স্বতেজসা।।৩১।।
সস্মিতা সুদতী শুদ্ধা শরৎপদ্মা নিভাননা।
বিভ্রতী কবরী রম্যাং মালতীমাল্য মন্ডিতাং।।৩২।।
দৃষ্ট্বাচৈবং সুকান্তঞ্চ সা দধার হরেঃ পুরঃ।
তেন রাধা সমাখ্যাতা পুরা বিদ্ভিম্মহেশ্বরী।।৩৭।।
[ ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ,প্রকৃতিখন্ড ৪৮।২৬-৩২,৩৭ ]
অনুবাদ:
মহাদেব শিব, মাতা দুর্গা দেবীকে বললেন, “পূর্বে গোলক বৃন্দাবনের মনোরম রাসমন্ডলের শতশৃঙ্গ পর্বতের একপ্রান্তে মালতী এবং মল্লিকাবন বেষ্ঠিত মনোরম রত্নসিংহাসনে স্বেচ্ছাময় পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অবস্থিত ছিলেন। সে সময় পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণের পরমানন্দ লাভের প্রয়াস জাগে। পরাৎপর পরমাত্মা শ্রীকৃষ্ণ স্বেচ্ছাময়,তাই তার ইচ্ছা মাত্রই তা কার্যে পরিণত হয়। তাই তিনি যখন পরমানন্দ লাভে প্রয়াসী হলেন, তখন সুরেশ্বরী ( সমস্ত দেবগণের ঈশ্বরী) রাধারাণী আবির্ভূত হন। হে দুর্গে,সেই সময়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সেখানে দুইরুপে অবস্থান করতে লাগলেন। তাঁর দক্ষিণ অঙ্গ শ্রীকৃষ্ণরুপে এবং তার বাম অঙ্গ শ্রীমতি রাধারাণীরুপে প্রকাশমান হয়েছিলেন। এইরুপে শ্রীমতি রাধারাণী রাসমন্ডলের মধ্যে অমূল্য রত্নাভরণে বিভূষিতা পরমানন্দ লাভে উৎসুক হয়ে রত্নসিংহাসনে অবস্থান করতে লাগলেন। তার গায়ের বর্ণ তপ্তকাঞ্চনের ন্যায় এবং তাঁর প্রভা কোটি চন্দ্রের ন্যায় উজ্জ্বল্যমান।তিনি অগ্নিশুদ্ধ বস্ত্র পরিধান করে স্বীয় তেজে পরিপূর্ণ হয়ে জগৎ আলোকিত করেন।সেই পরিশুদ্ধ নারীর শরৎকালীন পদ্মের ন্যায় মুখমন্ডলে সুন্দর দর্শন জ্যোতি এবং মধুর হাস্য বিকশিত হল। এবং তাঁর মস্তকে মনোহর কবরী সংবদ্ধ ও তাতে মালতীমালা শোভিত হতে লাগল। হে মহেশ্বরী (দুর্গা), এরপর শ্রীমতি রাধারাণী পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণকে দর্শন করে হৃদয়ে তাঁকে ধারণ করেন। তাই পুরাবিদপন্ডিতগণ তাঁকে রাধা নামে কীর্তন করেছেন।
মৎস্যপুরাণ ৬৯/৬-৮, স্কন্দপুরাণ– প্রভাসখণ্ড ১৯/৭১-৭৮, চৈ. চঃ আদি.৩/৫-১০ নং শ্লোকের বর্ণনা অনুযায়ী, “শ্রীকৃষ্ণ যদিও তার স্বীয়ধাম চিন্ময় জগতের গোলক বৃন্দাবনে নিত্য বিরাজমান, কিন্তু জড় জগতের বদ্ধ জীবকে শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে তার স্বীয় ধামে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার অভিলাষে প্রতিটি জড় ব্রহ্মান্ডে ব্রহ্মার প্রতিদিনে অথাৎ মনুষ্যজীবের ১ হাজার চতুর্যুগের (সত্য,ত্রেতা,দ্বাপর ও কলি= ১ চতুর্যুগ) মধ্যে অষ্টাবিংশ চতুর্যুগের দ্বাপর যুগের শেষভাগে একবার মাত্র এ পৃথিবীতে আবির্ভুত হন। ব্রহ্মার এই এক দিনকে ১ কল্প বলা হয়।
ব্রহ্মার প্রতি কল্পে চিন্ময় জগতের গোলক বৃন্দাবন থেকে শ্রীমতি রাধারাণী পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাবের পূর্বে এই পৃথিবীতে আবির্ভূত হন।তখন প্রতি কল্পে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মতো শ্রীমতি রাধারাণীর অন্যান্য লীলার মতো তার আবির্ভাবলীলাও প্রায় একই থাকে অথবা কিছুটা ব্যতীক্রম দেখা যায়।পুরাণাদি শাস্ত্রে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এবং শ্রীমতি রাধারাণীর এরুপ বিবিধ অপ্রাকৃত লীলার কিছুটা ব্যতীক্রম পরিলক্ষণ করে পুরাণাদি শাস্ত্রে অনভিজ্ঞ বা মূর্খেরা পুরাণাদি শাস্ত্রের নামে সাধারণ সনাতনীদের বিভ্রান্ত করছে। আসুন আমরা এখন পদ্মপুরাণ,ব্রহ্মখন্ড ৭/৩৪-৪২ নং শ্লোক অনুযায়ী বর্তমান বরাহ কল্পে সংঘটিত মর্ত্যলোক বা পৃথিবীতে দ্বাপর যুগের শেষভাগে শ্রীমতি রাধারাণীর আবির্ভাব সম্পর্কে জানার চেষ্টা করি।
পৃথিবীতে শ্রীমতি রাধা রানীর আবির্ভাব:
পদ্মপুরাণ,ব্রহ্মখন্ড ৭/৩৪-৪২ নং শ্লোক অনুযায়ী, ব্রহ্মা নারদ মুনিকে শ্রীমতি রাধারাণীর কিভাবে এই পৃথিবীতে আবির্ভূত হন তা বর্ণনা করেন।
ব্রহ্মাজী বললেন-
একদা পৃথিবী বৎস দুষ্টসঙ্গশ্চ তাড়িতা।
গৌভূর্ত্বা চ ভূশং দীনা চ যত্রৌ সা মমান্তিকম।।৩৪।।
নিবেদয়ামাস দুঃখং রুদন্তী চ পুনঃপুনঃ।
তদ্বাক্যঞ্চ সমাকণ্য গতোহহং বিষ্ণুসন্নিধিম।।৩৫।।
কৃষ্ণে নিবেদিতশ্চাশু পৃথিব্যা দুঃখসঞ্চয়ঃ।
তেনোক্তং গচ্ছ ভো ব্রহ্মণ দেবৈ সার্দ্ধঞ্চ ভূতলে।।৩৬।।
অহং তত্রাপি গচ্ছামি পশ্চাত্মম গণৈ সহ।।৩৭।।
তচ্ছ্রত্বা সহিতো দেবৈরাগতঃ পৃথিবীতলম।
ততঃ কৃষ্ণ সমাহূয় রাধাং প্রাণগরীয়সীম।।৩৮।।
উবাচ বচনং দেবি গচ্ছেহহং পৃথিবীতলম।
পৃথিবীভারনাশায় গচ্ছ ত্বং মর্ত্ত্যমন্ডলম।।৩৯।।
ইতি শ্রুত্বাপি সা রাধাপ্যাগতা পৃথিবীং ততঃ।
ভাদ্রে মাসি সিতেপক্ষে অষ্টমীসংজ্ঞিকে তিথৌ।।৪০।।
বৃষভানোযজ্ঞভূমৌ জাতা সা রাধিকা দিবা।
যজ্ঞাথং শোধিতায়াঞ্চ দৃষ্টা সা দিব্যরুপিনী।।৪১।।
রাজানন্দমনা ভূত্বা তাং প্রাপ্য নিজমন্দিরম।
দত্তবান মহিষীং বীত্বা সা চ ত্বাং পয্যপালয়ৎ।।”৪২।।
[ পদ্মপুরাণ, ব্রহ্মখণ্ড ৭।৩৪-৪২ ]
অনুবাদ:
বৎস (নারদ), একদা পৃথিবী দুঃজনের দ্বারা পীড়িত হওয়ায় গোরুপ ধারণপূর্বক অত্যন্ত দীন অবস্থায় পুনঃপুনঃ ক্রন্দন করতে করতে আমার নিকট এসে স্বীয় দুঃখ নিবেদন করেছিলেন। পৃথিবীর (পৃথিবীর অধিষ্ঠাত্রী দেবীকে ভূমিদেবী বা পৃথিবী মাতা বলা হয় ) বাক্য শ্রবণ করে আমি বিষ্ণুর সন্নিকটে গমন পূর্বক তার নিকট পৃথিবীর দুঃখরাশি নিবেদন করলাম। তিনি বললেন, হে ব্রাহ্মণ,তুমি দেবগণসহ ভূতলে গমন কর।আমি পরে আমার নিজজন সহ সেখানে গমন করব। আমি সেই কথা শ্রবণ করে দেবগণসহ ভূতলে আগমন করলাম। এরপর শ্রীকৃষ্ণ প্রাণপ্রিয়া শ্রীরাধিকাকে আহবান করে বললেন,দেবী, আমি পৃথিবীতে গমন করব। পৃথিবীর ভার নাশের নিমিত্তে তুমিও মর্ত্যমন্ডলে (পৃথিবী) গমন কর।শ্রীরাধিকা এই কথা শ্রবণ করে পৃথিবীতলে আগমন করেন।ভাদ্রমাসের শুক্লপক্ষের অষ্টমী তিথিতে শ্রীরাধিকা দেবী বৃষভানুর যজ্ঞস্থলে আবির্ভূত হন। যজ্ঞার্থ শোধিত ভূতলে সেই দিব্যরুপিনী শ্রীরাধা পরিদৃষ্ট হলেন। রাজা তাঁকে পেয়ে আনন্দিত মনে নিজ গৃহে গেলেন এবং মহিষীর নিকট অর্পন করলেন। রাজমহিষী তাঁকে পালন করতে লাগলেন।
সংকলনে: শ্রীপাদ সদগুণ মাধব দাস
[ বি:দ্র: স্বধর্মম্-এর অনুমোদন ব্যাতীত এই গবেষণামূলক লেখার কোনো অংশ পুনরুৎপাদন, ব্যবহার, কপি পেস্ট নিষিদ্ধ। স্বধর্মম্-এর সৌজন্যে শেয়ার করার জন্য উন্মুক্ত। ]
নিবেদক-
° স্বধর্মম্: প্রশ্ন করুন | উত্তর পাবেন °