সমগ্র বিশ্ববাসীর দুঃখের প্রকৃত কারণ

20240822_222737

প্রকৃতির ব্যবস্থাপনায় জীবনের ক্রমবিকাশে নিম্নশ্রেণির জীব প্রয়োজনের অতিরিক্ত গ্রহণ বা সংগ্রহ করে না, তাই পশুসমাজে সাধারণত অর্থনৈতিক সমস্যা বা প্রয়োজনীয় জিনিসের অভাব নেই। যেমন, এক বস্তা চাল প্রকাশ্য স্থানে পড়ে থাকলে পাখিরা আসবে। তারা কয়েকটি করে দানা খেয়ে চলে যাবে। কিন্তু একজন মানুষ তা করবে না। সে আসবে এবং বস্তাভর্তি সমস্ত চাল নিয়ে যাবে। সেই লোকটি যথাসাধ্য উদরপূর্তি করবে আর বাকি চাল মজুত রেখে দেবে। শাস্ত্রানুসারে এইভাবে অতিরিক্ত সংগ্রহ করা নিষিদ্ধ। এটাই সমগ্র বিশ্ববাসীর দুঃখের কারণ।

শ্রীঈশোপনিষদে বর্ণিত হয়েছে,

ঈশাবাস্যমিদং সর্বং যৎকিঞ্চ জগত্যাং জগৎ।

তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথা মা গৃধঃ কস্য স্বিদ্‌ ধনম্ ॥ 

এই বিশ্বচরাচরে যা কিছু আছে তার মালিক পরমেশ্বর ভগবান এবং তাঁর নিয়ন্ত্রণাধীন। তাই জীবন ধারণের জন্য তিনি যেটুকু বরাদ্দ করে দিয়েছেন, সেটুকুই গ্রহণ করা উচিত এবং সব কিছুই যে ভগবানের সম্পত্তি তা ভালভাবে জেনে, কখনই অন্যের জিনিস গ্রহণ করা উচিত নয়।

তাই যথেষ্ট বুদ্ধিমত্তা সহকারে আমাদের জানতে হবে যে, ভগবান ছাড়া অন্য কেউই কোন কিছুর মালিক নন। ভগবান আমাদের জন্য যেটুকু বরাদ্দ নির্ধারণ করে দিয়েছেন, সেইটুকু কেবল আমাদের গ্রহণ করা উচিত। যেমন, গরু দুধ দেয়, কিন্তু সেই দুধটি সে খায় না; সে ঘাস আর দানা খায় এবং তার দুধ হচ্ছে মানুষের খাদ্য। এমনই সুন্দরভাবে ভগবান সব কিছুর ব্যবস্থা করেছেন এবং তিনি কৃপা পরবশ হয়ে আমাদের জন্য যা আলাদা করে রেখেছেন, তা নিয়েই আমাদের সন্তুষ্ট থাকা উচিত, এবং আমাদের সব সময় বিবেচনা করা উচিত, যে সমস্ত জিনিস আমরা গ্রহণ করছি, প্রকৃতপক্ষে সেগুলি কার।

 

দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, একটি বাড়ি তৈরি হয় মাটি, কাঠ, পাথর,

 

লোহা, সিমেন্ট এবং এই ধরনের সমস্ত জড় পদার্থ দিয়ে, এখন আমরা যদি ঈশোপনিষদের পরিপ্রেক্ষিতে চিন্তা করি, তা হলে আমরা জানতে পারব যে, এর কোনওটিই আমরা তৈরি করতে পারি না। আমরা কেবল আমাদের শ্রম দিয়ে সেগুলি জড়ো করে সেগুলিকে বিভিন্ন রূপ দান করতে পারি। কোনও শ্রমিক তার কঠোর শ্রম দিয়ে কোন কিছু তৈরি করার জন্য তার মালিকানা দাবি করতে পারে না।

 

আধুনিক সমাজে শ্রমিক এবং মালিকদের মধ্যে সর্বদাই ভীষণ সংঘর্ষ হচ্ছে। এই সংঘর্ষ একটি আন্তর্জাতিক রূপ ধারণ করেছে এবং তার ফলে সমস্ত পৃথিবী বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। মানুষে মানুষে শত্রুতা হচ্ছে এবং তারা কুকুর- বেড়ালের মতো ঝগড়া করছে। শ্রীঈশোপনিষদের জ্ঞান কুকুর-বেড়ালকে উপদেশ দান করার জন্য নয়, তা সদ্গুরুর মাধ্যমে মানুষের প্রতি পরমেশ্বর ভগবানের বাণী প্রদান করছে। মানব-সমাজের কর্তব্য হচ্ছে ঈশোপনিষদের এই বৈদিক জ্ঞান গ্রহণ করা এবং জড় বস্তুর মালিকানা নিয়ে ঝগড়া-বিবাদ না করা। পরমেশ্বর ভগবান কৃপা করে আমাদের যতটুকু সুযোগ-সুবিধা দান করেছেন, তা নিয়েই আমাদের সন্তুষ্ট থাকা উচিত। কমিউনিস্ট, ক্যাপিট্যালিস্ট অথবা অন্য সমস্ত দলগুলি যদি প্রকৃতির সম্পদের উপর মালিকানা দাবি করে, তা হলে মানব-সমাজে অশান্তির সৃষ্টি হয়, কেননা প্রকৃতির প্রতিটি বস্তুই হচ্ছে ভগবানের সম্পত্তি। ক্যাপিট্যালিস্টরা যেমন রাজনৈতিক কৌশলের দ্বারা কমিউনিস্টদের দমন করতে পারবে না, তেমনই কমিউনিস্টরা তাদের রুটির জন্য লড়াই করে ক্যাপিট্যালিস্টদের পরাস্ত করতে পারবে না। যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা পরমেশ্বর ভগবানের মালিকানা স্বীকার করছে, ততক্ষণ যে সম্পত্তি তারা তাদের নিজেদের বলে দাবি করছে, তা সবই হচ্ছে চুরি করা সম্পদ। সেই অপরাধের জন্য তাদের প্রকৃতির নিয়মে দণ্ডভোগ করতে হবে। পারমাণবিক বোমাগুলি কমিউনিস্ট আর ক্যাপিট্যালিস্ট উভয়ের হাতেই রয়েছে এবং তারা যদি পরমেশ্বর ভগবানের প্রভুত্ব স্বীকার না করে, তা হলে অন্তিমে সেই বোমাগুলি এই উভয় গোষ্ঠীকেই ধ্বংস করবে। তাই তাদের রক্ষা করার জন্য এবং জগতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করার জন্য উভয় দলেরই কর্তব্য ঈশোপনিষদের উপদেশ অনুসরণ করা।

 

কুকুর-বেড়ালের মতো ঝগড়া করা মানুষের উদ্দেশ্য নয়। যথেষ্ট বুদ্ধি সহকারে তাদের মানব-জীবনের গুরুত্ব এবং উদ্দেশ্য সম্বন্ধে অবগত হওয়া কর্তব্য। বৈদিক শাস্ত্র রচিত হয়েছে মানুষদের জন্য, কুকুর-বেড়ালদের জন্য নয়। কুকুর-বেড়ালেরা অন্য প্রাণী হত্যা করে আহার করতে পারে এবং তার ফলে তাদের কোনও পাপ হয় না, কিন্তু কোনও মানুষ যখন তার অদম্য রসনা তৃপ্তির জন্য কোন পশুকে

 

হত্যা করে, তখন প্রকৃতির নিয়ম ভঙ্গ করার জন্য তাকে সেই পাপের ভাগী হতে হয়। পরিণামে তাকে সেই জন্য দণ্ডভোগ করতে হয়। মানব-জীবনের বিধি-নিয়ম পশুদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। একটি বাঘ চাল, গম খায় না অথবা গরুর দুধ পান করে না, কারণ তার আহার হচ্ছে পশুর মাংস। বহু পশু-পক্ষী রয়েছে যারা হয় মাংসাশী, নয় নিরামিষাশী, কিন্তু তারা কেউই ভগবানের ইচ্ছার অধীন প্রকৃতির নিয়ম লঙ্ঘন করে না। পশু, পক্ষী, সরীসৃপ এবং অন্যান্য সমস্ত নিম্ন স্তরের প্রাণীরা অবিচলিতভাবে প্রকৃতির নিয়ম মেনে চলে; তাই তাদের ক্ষেত্রে কোন রকম পাপের প্রশ্ন ওঠে না, আবার বৈদিক নির্দেশগুলিও তাদের জন্য নয়। কেবল মনুষ্য-জীবনই হচ্ছে দায়িত্ব-সম্পন্ন জীবন।

 

কেবল নিরামিষাশী হলেই যে প্রকৃতির নিয়মগুলির লঙ্ঘন পরিহার করা হয়, তা মনে করা ভুল। গাছেরও প্রাণ রয়েছে। প্রকৃতির নিয়ম হচ্ছে, একটি জীব আর একটি জীবের আহার। সুতরাং নিষ্ঠাবান নিরামিষাশী হওয়ার জন্য গর্ব করা উচিত নয়; আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে পরমেশ্বর ভগবানকে জানা। ভগবানকে জানার মতো উন্নত বুদ্ধিমত্তা পশুদের নেই, কিন্তু বৈদিক শাস্ত্রের শিক্ষা গ্রহণ করার মাধ্যমে এবং প্রকৃতির নিয়ম কিভাবে কার্য করে তা জেনে, এই জ্ঞানের যথার্থ সদ্ব্যবহার করার উপযুক্ত বুদ্ধি মানুষের রয়েছে। মানুষ যদি বৈদিক শাস্ত্রের নির্দেশ অবহেলা করে, তা হলে তার জীবন অত্যন্ত বিপদসঙ্কুল হয়ে পড়ে। তাই মানুষের কর্তব্য হচ্ছে পরমেশ্বর ভগবানের প্রভুত্ব হৃদয়ঙ্গম করা। তার কর্তব্য হচ্ছে ভগবানের ভক্ত হওয়া, সব কিছু ভগবানের সেবায় উৎসর্গ করা এবং ভগবানকে নিবেদিত প্রসাদই কেবল গ্রহণ করা। তার ফলে তিনি তার কর্তব্য যথাযথভাবে সম্পাদন করতে পারেন। ভগবদ্গীতায় ভগবান সরাসরিভাবে বলেছেন যে, তিনি কেবল শুদ্ধ-ভক্তের প্রদত্ত নিরামিষ আহারই গ্রহণ করেন (ভগবদ্গীতা ৯/২৬)। তাই মানুষকে কেবল নিষ্ঠাবান নিরামিষাশী হলেই চলবে না, তাকে ভগবানের ভক্ত হতে হবে এবং তার সমস্ত আহার্য ভগবানকে নিবেদন করতে হবে। তারপর কেবল ভগবানের প্রসাদরূপে অথবা ভগবানের করুণারূপে তা গ্রহণ করতে হবে। যে ভক্ত এভাবেই সচেতন হয়ে আচরণ করেন, তিনিই যথাযথভাবে মানব-জীবনের কর্তব্য সম্পাদন করছেন। যে সমস্ত মানুষ ভগবানকে নিবেদন না করে আহার করে, তারা প্রকৃতপক্ষে তাদের পাপ ভক্ষণ করছে এবং পরিণামে এই পাপের ফলস্বরূপ তাদের নানারকম দুঃখকষ্ট ভোগ করতে হবে (ভগবদ্গীতা ৩/১৩)।

 

সমস্ত পাপের মূল উৎস হচ্ছে পরমেশ্বর ভগবানের প্রভুত্ব অস্বীকার করে প্রকৃতির নিয়মের অবাধ্যতা করা। প্রকৃতির নিয়মের অবাধ্যতা অথবা ভগবানের আদেশ অমান্য করার ফলে মানুষের সর্বনাশ হয়। কেউ যদি যথার্থভাবে প্রকৃতিস্থ হন, প্রকৃতির নিয়ম সম্বন্ধে অবগত হন এবং অনর্থক আসক্তি অথবা বিরক্তির দ্বারা প্রভাবিত না হন, তা হলে ভগবান অবশ্যই তাকে কৃপা করেন, এবং তিনি তখন নিঃসন্দেহে তাঁর নিত্য আলয় ভগবানের কাছে ফিরে যাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেন।

 

~ কৃষ্ণকৃপাশ্রীমূর্তি শ্রীল অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ

গ্রন্থসূত্র:

শ্রীউপদেশামৃত (তাৎপর্য, শ্লোক ২)

শ্রীঈশোপনিষদ (তাৎপর্য, মন্ত্র ১)

 

Avatar of Madhura Gaurakiśora Dās

Madhura Gaurakiśora Dās

Writer & Admin

5 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments