মনসার পূজায় কি পশুবলি বৈধ !? “অপযুক্তি খন্ডন – ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ ও দেবীভাগবতম সমীক্ষা।”

20240814_210004

মনসা দেবী সম্পর্কে সনাতন ধর্মের তিনটি প্রধান শাস্ত্র, যথা- মহাভারতের আদিপর্ব, শ্রীব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের প্রকৃতিখন্ড ও দেবীভাগবত উপপুরাণের ৯ম স্কন্ধে আলোকপাত করা হলেও এই তিন শাস্ত্রের কোথাও মনসা পূজায় পশুবলি ন্যূনতম উল্লেখ পাওয়া যায় না। কিন্তু বর্তমানে দেখা যাচ্ছে কিছু অপপ্রচারক নিজেদের অন্ধবুদ্ধিতার পরিচয় দিয়ে হঠকারিতা করার নিমিত্তে এই সমস্ত শাস্ত্র হতে দাবি করেন মনসা পূজা নাকি পশুবলির বিধান আছে!!

আসুন এ সমস্ত অপপ্রচারকগণের অপযুক্তিসমূহের খন্ডন দেখে নিই!!

অপপ্রচারকগণের দাবিঃ

শাস্ত্রের পূর্বাপর বাক্য গোপণ করে অপপ্রচারকগণ মূল শাস্ত্রের মাঝখান থেকে হুট করে যে সমস্ত শ্লোক তুলে এনে দাবী করে মনসা পূজায় পশুবলি প্রযোজ্য সে সমস্ত শ্লোক হলো-

নত্বা ষোড়শোপচারং বলিঞ্চ তৎপ্রিয়ং তদা।

প্রদদৌ পরিতুষ্টশ্চ ব্রহ্মাবিষ্ণুশিবাজ্ঞয়া।।

[ শ্রীব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ,প্রকৃতিখন্ড, ৪৬।১১৭; দেবীভাগবত ৯।৪৮।১১৪ ]

অনুবাদঃ
ব্রহ্মা বিষ্ণু ও শিবের আজ্ঞায় দেবেন্দ্র কর্তৃক মনসাদেবী ষোড়শোপচারে পূজিতা হইলে দেবরাজ তাহার প্রিয় বলি প্রদান করিলেন।

পঞ্চম্যাং মনসাখ্যায়াং দেব্যৈ দদ্যাচ্চ যো বলিম্।

ধনবান্ পুত্রবাংশ্চৈব কীর্তিমান্ স ভবেদ্ ধ্রুবম্।।

[ শ্রীব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ,প্রকৃতি খণ্ড,৪৬।৯ ; দেবীভাগবত ৯।৪৮।৯ ]

অনুবাদঃ
পঞ্চমী তিথিতে দেবী মনসাকে যে ব্যক্তি বলি প্রদান করে, সে ধনবান, কীর্তিমান এবং পুত্রবান হয়।

অপযুক্তির খন্ডনঃ

প্রথমত অপপ্রচারকগণের দাবীকৃত শ্লোক দুটিতে কেবল ‘বলি’ শব্দের উল্লেখ আছে, কিন্তু কোথাও ‘পশুবলি’ শব্দের উল্লেখ নেই। এ সমস্ত অন্ধবুদ্ধি সম্পন্ন অপপ্রচারকগণ ‘বলি’ শব্দটি দেখলেই ভেবে বসেন সেখানে ‘পশুবলি’-র কথা বলা হচ্ছে! কি হাস্যকর!!

দাবীকৃত শ্লোক দুটিতে ‘বলি’ শব্দ দ্বারা আসলে পশুবলিকে নির্দেশ করা হয়েছে নাকি সাত্ত্বিকী বলি তথা বিষ্ণুপ্রসাদ নিবেদন করার কথা বলা হয়েছে তা নিয়ে নিম্নে ক্রমান্বয়ে আলোচনা করা হলো-

বিশ্লেষণের সুবিধার্থে শ্রীব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ ও দেবীভাগবত থেকে মনসা দেবী কি পরিচয় তা দেখে নেওয়া যাক-

আত্মারামাচ সা দেবী বৈষ্ণবী সিদ্ধ যোগিনী।

ত্রিযুগঞ্চ তপস্তপ্ত্বা কৃষ্ণস্য পরমাত্মনঃ ॥

[শ্রীব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ,প্রকৃতি খণ্ড, ৪৫/৪ ও দেবীভাগবত ৯/৪৭/৪]

অনুবাদঃ
মনসা দেবী আত্মারামা ও ‘বৈষ্ণবী’ নামে বিখ্যাত আছেন। তিনি যুগত্রয় পরমাত্মা কৃষ্ণের প্রীতিকামনায় তপস্যা করিয়া সিদ্ধযোগিনী হন।

IMG 20240818 WA0013 Svadharmam

শুদ্ধসত্ত্বস্বরূপা ত্বং কোপহিংসাবিবর্জিতা।

ন চ শপ্তো মুনিস্তেন ত্যক্তয়া চ ত্বয়া যতঃ ।।

ত্বং ময়া পূজিতা সাধ্বি জননী চ যথাদিতিঃ ।

[ শ্রীব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ,প্রকৃতি খণ্ড,৪৬।৩০ এবং দেবীভাগবত ৯।৪৮।৩০ ]

অনুবাদঃ
দেবরাজ ইন্দ্র স্তুতি করলেন, ” মনসা! তুমি শুদ্ধসত্ত্ব স্বরূপা ও হিংসা ক্রোধ বিবর্জিতা। যখন তুমি স্বীয় পতি জরৎকারু কর্তৃক পরিত্যক্ত হইয়াও সেই মুনিবকে শাপ প্রদান কর নাই, তখন তোমার ন্যায় শমগুণ সম্পন্না সাধ্বী আর কে আছে? হে দেবি ! আমার জননী অদিতির ন্যায় তুমি যে আমার পূজ্য হইয়াছ তাহার কিছুমাত্র সন্দেহ নাই।”

IMG 20240818 WA0010 Svadharmam

এখানে স্পষ্টত মনসা দেবী একজন বৈষ্ণবী দেবী এবং তিনি শুদ্ধসত্ত্বস্বভাব এবং হিংসাবর্জিতা দেবী। একইভাবে শ্রীব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের প্রকৃতিখন্ডের ১।৬৯, ৪৫।৯, ৪৫।১৫ ইত্যাদি শ্লোকে এবং দেবীভাগবতমের ৯।১।৭৪, ৯।৪৭।৯, ৯।৪৭।১৫ আদি শ্লোকেও মনসাদেবীকে বারংবার বৈষ্ণবীদেবী, বিষ্ণুভক্তা, বিষ্ণুপূজাপরায়না ইত্যাদি নামে স্তুতি করা হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই একজন শুদ্ধসত্ত্বস্বভাব হিংসাবর্জিতা বৈষ্ণবীদেবীর পূজায় রক্তরঞ্জিত পশুবলির কোন প্রকরণই থাকতে পারেনা।

তাই আলোচিত শাস্ত্রে অর্থাৎ শ্রীব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে স্পষ্টভাবে বৈষ্ণবীদেবীর পূজা যে পশুবলি ব্যতীত হবে তা বলা আছে –

উৎসর্গকৰ্ত্তা দাতা চ ছেত্তা পোষ্টা চ রক্ষকঃ।

অগ্রপশ্চান্নিবদ্ধা চ সপ্তৈ তে বধভাগিনঃ ॥

যো যং হন্তি সতং হন্তি চেতি বেদোক্ত মেবচ।

কুৰ্ব্বস্তি বৈষ্ণবী পূজাং বৈষ্ণবাস্তেন হেতুনা ॥

[ শ্রীব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ, প্রকৃতিখন্ড, ৬৫।১১,১২ ]

অনুবাদঃ
উৎসর্গকর্তা, দাতা, ছেত্তা, পোষক, রক্ষক ও অগ্রপশ্চাৎ নিবন্ধা এই সপ্তজন পশুবলির বধভাগী বলিয়া নির্দিষ্ট আছে। বেদে নির্দিষ্ট আছে, যে যাহাকে বিনাশ করে সে তাহার হন্তা(হত্যাকারী) হয়। এইজন্য বৈষ্ণব মহাত্মারা বৈষ্ণবী দেবীর সাত্ত্বিকী পূজা করিয়া থাকেন।”

IMG 20240818 WA0017 Svadharmam

এখন কেউ যদি এ শাস্ত্রবিধি পরিত্যাগ করে বৈষ্ণবীদেবীর পূজায় পশু বলি দেয় তবে অবশ্যই ভীষণ পাপের ভাগী হতে হবে -একথাও উক্ত শাস্ত্রে স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে –

“বলিদানেন.. হিংসাজন্যঞ্চ পাপঞ্চ লভতে নাত্রসংশয়ঃ॥”

[ শ্রীব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ, প্রকৃতিখন্ড, ৬৫।১০ ]

অনুবাদঃ
পশুবলিতে হিংসার জন্য মানবগণের যে পাপসঞ্চার হয় তাহাতে আর সন্দেহ নাই ॥

IMG 20240818 WA0016 Svadharmam

উক্ত শাস্ত্রে তাই বৈষ্ণবীদেবীগণকে শুদ্ধসাত্ত্বিক রীতিতে পূজা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে-

“জীবহত্যা বিহীনায়া বরা পূজাচ বৈষ্ণবী ॥”

[ শ্রীব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ, প্রকৃতিখন্ড, ৬৪।৪৭]

অনুবাদঃ
বৈষ্ণবীদেবীর পূজায় জীবহত্যা হয় না– তাই এটি শ্রেষ্ঠ পূজা।

IMG 20240818 WA0015 Svadharmam

কিন্তু অপপ্রচারকগণ এ সমস্ত শ্লোক গোপন রাখে নিজেদের হীন স্বার্থসিদ্ধি তথা পশুবলির মৌসুমী ব্যবসা ও জিহ্বা লালসা মিটানোর লোভে মন্দিরের পবিত্র স্থানকে কসাইখানাতে পরিনত করেন।

তাহলে এখন প্রশ্ন দাঁড়ায়, মনসা পূজায় ইন্দ্র কর্তৃক পূজা উপাচার সমেত যে ‘বলি’ দেওয়ার কথা শাস্ত্রে বলা হচ্ছে তা যদি ‘পশুবলি’ না হয়, তবে এখানে ‘বলি’ দ্বারা কি বুঝাচ্ছে?

নারায়ণাবতার শ্রীকৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস প্রণীত পদ্মপুরাণ এর উত্তরখণ্ডের ২৫৩ নং অধ্যায়ে মনসা দেবীর গুরু ভগবান শ্রীশিব দেবতাদের উদ্দেশ্যে বিষ্ণুপ্রসাদ বা কৃষ্ণপ্রসাদকেই বলিরূপে নিবেদনের বিধান দিয়েছেন স্পষ্টভাবে এবং এও বলেছেন যারা উক্ত স্থানে পশুহিংসা করেন তারা নিশ্চিতরূপে নরকভাগী হয়-

শ্রী শিব উবাচঃ

হরের্ভুক্তাবশেষেণ বলিস্তেভ্যো বিনিক্ষিপেৎ।

হোমঞ্চৈব প্ৰকুব্বীত তচ্ছেষেণৈব বৈষ্ণবঃ ।

হরের্নিবেদিতং সম্যগদেবেভ্যো জুহুয়াদ্ধবিঃ॥

পিতৃভ্যশ্চাপি তদ্দদ্যাৎ সর্ব্বমান্নত্যমাপ্নুয়াৎ।

প্রাণিনাং পীড়নং যত্তদ্বিদুষাং নিরয়ায় বৈ ॥

অদত্তঞ্চৈব যৎকিঞ্চিৎ পরস্বং গৃহ্যতে নরৈঃ ।

স্তেয়ং তদ্বিদ্ধি গিরিজে নরকসৈব কারণম্ ॥

[ পদ্মপুরাণ, উত্তরখন্ড, ২৫৩। ১০৭-১০৯ ]

অনুবাদঃ
ভগবান শিব বললেন, “হরির ভুক্তাবশেষ (কৃষ্ণপ্রসাদ) দ্বারা দেবতাদের বলিপ্রদান করবে,  হরির ভুক্তাবশিষ্ট(কৃষ্ণপ্রসাদ) হবি দ্বারা দেবতাদের হোম করবে হরিকে সম্যক্‌রূপে নিবেদন করে পরে দেবগণকে হবি হোম করবে। পিতৃগণকেও তা-ই প্রদান করবে। এইরূপে কৃতকাৰ্য্য সমস্তই অনন্ত ফলপ্রদ হয়ে থাকে। প্রাণিগণের পীড়নকে বিজ্ঞগণ নরকভোগের কারণ হিসেবে ব্যাখা করে থাকেন। মনুষ্য নিজের জীবনে অন্যজীব কর্তৃক যে নিষ্ঠুর ব্যবহার আশা করে না, সে নিষ্ঠুর আচরণ যদি সে অন্য জীবের উপর করে,তবে হে গিরিজে! সে মনুষ্য অবশ্যই নরকভোগী হবে।”

IMG 20240818 WA0018 Svadharmam

শুধু মনসাদেবীর গুরু ভগবান শিবই নয়, মনসাদেবীর আরাধ্য পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণও যজ্ঞে পশুবলির নিন্দা করেছেন-

শ্রীকৃষ্ণ উবাচ-

তে মে মতমবিজ্ঞায় পরোক্ষং বিষয়াত্মকাঃ।

হিংসায়াং যদি রাগঃ স্যাদ্‌যজ্ঞ এব ন চোদনা।

হিংসাবিহারা হ্যালব্ধৈঃ পশুভিঃ স্বসুখেচ্ছয়া।

যজন্তে দেবতা যজ্ঞৈঃ পিতৃভূতপতীন্‌খলাঃ৷৷

[শ্রীমদ্ভাগবতম, স্কন্ধ-১১ অধ্যায়-২১, শ্লোক ২৯-৩০ (গীতপ্রেস )]

অনুবাদঃ
“পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ বললেন- যদি পশু হিংসা এবং মাংসভক্ষণ কার্যে অনুরাগ হেতু তার ত্যাগ সম্ভব না হয় তাহলে যজ্ঞ সম্পাদনের মাধ্যমে সেটি গ্রহণ করো—এই বিধান কখনই উত্তম বলে স্বীকৃত হতে পারে না; তাকে কেবল স্বাভাবিক প্রবৃত্তির ভিন্ন রূপে স্বীকৃতি মাত্র বলা চলে। সন্ধ্যা বন্দনাদিসম অপূর্ব সুন্দর বিধি ওই সকল বিধির তুলনায় বহুলাংশে প্রকৃষ্ট। এইভাবে আমার অভিপ্রায় না জেনে বিষয়লোলুপ ব্যক্তিগণ পশুহিংসায় মত্ত হয়ে পড়ে। তারা কপটতা হেতু ইন্দ্রিয়তৃপ্তির অভিলাষে পশুহিংসা দ্বারা প্রাপ্ত মাংস দ্বারা যজ্ঞ সম্পাদন করে দেবতা, পিতৃপুরুষ ও ভূতপতি আদি যজনের অভিনয়-ক্রিয়া করে থাকে৷৷”

IMG 20240818 WA0014 Svadharmam

এমনকি বেদও যজ্ঞে ছাগবলি,পশুবলিকে প্রশ্রয় দেয় না, বেদে বীজ দ্বারা যজ্ঞ করার নির্দেশ। মহাভারতের আদিপর্বে মনসাদেবীর উপাখ্যান পাওয়া যায়। সে মহাভারতের শান্তিমহাপর্বে যজ্ঞে ছাগবলি,পশুবলি যে বেদবিরুদ্ধ তার স্পষ্টত উল্লেখ আছে-

ঋষয় উচুঃ

বীজৈর্যজ্ঞেষু ষষ্টব্যমিতি বৈ বৈদিকী শ্ৰুতিঃ।

অজসংজ্ঞানি বীজানি ছাগং নো হন্তমর্হথ।।

নৈষ ধৰ্ম্মঃ সতাং দেবা যত্ৰ বধ্যেত বৈ পশুঃ ।

ইদং কৃতযুগং শ্রেষ্ঠং কথং বধ্যেত বৈ পশুঃ ॥

[ মহাভারত, শান্তিপর্ব, ৩২৩।৭-৮ ]

অনুবাদঃ
ঋষিগণ বলিলেন—‘বীজ দ্বারা যজ্ঞ করিবে’ ইহাই বেদে শুনা যায়। অতএব ‘অজ’ শব্দের অর্থ বীজ; সুতরাং আপনারা ছাগবধ করিতে পারেন না।। হে দেব! যজ্ঞে পশুবধ সজ্জনের ধর্ম্ম নহে। এটা শ্রেষ্ঠ কৃতযুগ। কি প্রকারে পশুবধ করা হইবে? (অতএব যজ্ঞে পশুবলি হতে পারে না)

IMG 20240818 WA0019 Svadharmam

এখানে পুনরায় স্পষ্টত প্রতীয়মান হয়, মনসাদেবীর আরাধ্য পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ এবং গুরু ভগবান শিব যজ্ঞে পশুবলির নিন্দা করেছেন এবং ভগবান শিব কৃষ্ণপ্রসাদকেই দেবতাদের উদ্দেশ্যে বলিরূপে নিবেদনের নির্দেশ দিয়েছেন। তাই অপপ্রচারকগণের দাবীকৃত শ্লোকে বিষ্ণু-শিবাদি দেবতা কর্তৃক নির্দেশপ্রাপ্ত দেবরাজ ইন্দ্রের মনসাপূজায় যে বলি তা পশুবলি নয়। উক্ত দাবীকৃত শ্লোকে ‘বলিঞ্চ তৎপ্রিয়ং’ শব্দ দ্বারা মনসাদেবীর প্রিয় ভোজ্য কৃষ্ণপ্রসাদকেই বুঝানো হয়েছে

উপযুক্ত শাস্ত্রযুক্তির আলোকে অপপ্রচারকারীগণের দাবীকৃত শ্লোক দুটির ব্যাখাপূর্ণ সঠিক ভাবানুবাদ দাঁড়ায়-

নত্বা ষোড়শোপচারং বলিঞ্চ তৎপ্রিয়ং তদা।

প্রদদৌ পরিতুষ্টশ্চ ব্রহ্মাবিষ্ণুশিবাজ্ঞয়া।।

[শ্রীব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ,প্রকৃতিখন্ড, ৪৬।১১৭ এবং দেবীভাগবত ৯।৪৮।১১৪]

অনুবাদঃ
ব্রহ্মা বিষ্ণু ও শিবের আজ্ঞায় দেবেন্দ্র কর্তৃক মনসাদেবী ষোড়শোপচারে পূজিতা হইলে দেবরাজ মনসাদেবীকে তাহার প্রিয় বস্তু তথা কৃষ্ণপ্রসাদ বলিরূপে প্রদান করিলেন।

পঞ্চম্যাং মনসাখ্যায়াং দেব্যৈ দদ্যাচ্চ যো বলিম্।

ধনবান্ পুত্রবাংশ্চৈব কীর্তিমান্ স ভবেদ্ ধ্রুবম্।।

[শ্রীব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ,প্রকৃতি খণ্ড,৪৬/৯ এবং দেবীভাগবত ৯।৪৮।৯ ]

অনুবাদঃ
পঞ্চমী তিথিতে দেবী মনসাকে যে ব্যক্তি ‘কৃষ্ণপ্রসাদ’ বলিরূপে প্রদান করে, সে ধনবান, কীর্তিমান এবং পুত্রবান হয়।

আমাদের সমাজে ধর্মান্ধ কিছু মানুষ লোকজ সাহিত্য ‘মনসা মঙ্গল’ নামক মঙ্গল কাব্যকে শাস্ত্র ভেবে সেখান থেকে চাঁদ সদাগরের মনসা পূজায় পশুবলির উল্লেখ করেন। কিন্তু তাদের জেনে রাখা প্রয়োজন ‘মনসা মঙ্গল কাব্য’ ভগবান কিংবা কোন মুনি ঋষি প্রদত্ত শাস্ত্র নয়। এটি  চট্টগ্রামের ২২ জন রসিয়াল কবি রচিত পঙ্কিল সাহিত্য মাত্র, যার সাথে প্রামাণিক শাস্ত্র সমূহের কোন মিল নেই। উলটো গ্রামীন মানুষদের মনরঞ্জন করতে সেখানে দেবাদিদেব শিবকে লম্পট, ভাঙখোর, হস্তমৈথুনকারী হিসেবে দেখানো হয়েছে, যা কখনোই প্রামাণিক শাস্ত্রানুকূল নয়। আবার দূর্গাদেবী ও মনসা দেবীর মধ্যে দা-কুমড়া সম্পর্ক যা দেখানো হয়েছে তা অত্যন্ত হাস্যকর।  এই ‘মনসা মঙ্গল’ কাব্যের নাম চেঞ্জ করে নাম দেওয়া হয়েছে পদ্মাপুরাণ। যখন মানুষ এটা আর কিনছে না, তখন এটার নাম ‘পদ্মপুরাণ’ দিয়ে ছাপানো হচ্ছে। এটা কোন শাস্ত্র নয়। মূর্খ কতিপয় বাঙ্গালী এসব পঙ্কিল সাহিত্যকে শাস্ত্র ভাবে।
মনসাদেবীর প্রকৃত পরিচয় জানতে হলে মহাভারতের আদিপর্ব ও ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে যেভাবে উল্লেখ আছে, সেভাবে জানতে হবে। চাঁদসদাগরের পুরো কাহিনীটাই অবান্তর, হাস্যপ্রদ ও কাল্পনিক। যেমন: মনসামঙ্গল নামক কাব্যে বলেছে, চাঁদ সদাগর ডান হাতে দূর্গা দেবীর পূজা করতো। তাই তিনি মনসা পূজার সমস্ত কার্য বাঁ-হাতে করতো। তিনি ৯ দিনে বাম হাতে ৯ লক্ষ পশুবলি দিয়েছিলেন!  কিন্তু গাণিতিক হিসেবে সেটা অসম্ভব। ১ দিন= ৮৬৪০০ সেকেন্ড। অর্থাৎ, ১ দিনে ১ লক্ষ সেকেন্ডও হয় না। ফলে প্রতি সেকেন্ড নিজ হাতে ১টা করে বলি দিলেও ৯ দিনে ৯ লক্ষ বলি দেওয়া কারো পক্ষে সম্ভব নয়। ব্যাপারটা হাস্যকর ও অযৌক্তিক।

ভক্ত গনকে সর্প দংশন হতে সর্বদা রক্ষা করেন মাতা মনসা। তিনি জগন্মাতা। মাতা কখনো তার কোন সন্তানের রক্ত চান না। সমস্ত ভারতবর্ষজুড়ে মাতা মনসার শুদ্ধসাত্ত্বিকী পূজা হয়ে থাকে। কিন্তু যবন সান্নিধ্যে পীর সমাজ কর্তৃক প্রভাবিত হয়ে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও সিলেট সহ বেশ কয়েক অঞ্চলে ধর্মকে পুঁজি করে অহেতুক পশুবলি নামক কুপ্রথা চলে আসছে, যা কোন মতেই শাস্ত্রীয় নয়। এরূপ ধর্মের নামে রক্তরঞ্জিত অসাত্ত্বিকী পূজা ইহলৌকিক ও পরলৌকিক অমঙ্গল-ই ডেকে আনে।

তাই পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ শ্রীমদ্ভগবদগীতায় স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছেন –

ঊর্ধ্বং গচ্ছন্তি সত্ত্বস্থা মধ্যে তিষ্ঠন্তি রাজসাঃ।

জঘন্যগুণবৃত্তিস্থা অধো গচ্ছন্তি তামসাঃ।।

[ শ্রীমদ্ভগবদগীতা ১৪/১৮ ]

অনুবাদঃ
সত্ত্বগুণ-সম্পন্ন ব্যক্তিগণ ঊর্ধ্বলোকে গমন করে, রজোগুণ-সম্পন্ন ব্যক্তিগণ মধ্যে নরলোকে অবস্থান করে এবং জঘন্য গুণসম্পন্ন তামসিক ব্যক্তিগণ অধঃগতি প্রাপ্ত হন।

IMG 20240818 WA0009 Svadharmam

“জয় জয় কৃষ্ণভক্তা, শিবশিষ্যা, সর্পভীতি নাশিনী বৈষ্ণবী মাতা মনসা”

– ব্রজ সখা
গৌরধাম নন্দনকানন
( ২০শে শ্রাবণ, ১৪২৮ বঙ্গাব্দ )

Avatar of Brajasakha Das

Brajasakha Das

Writer & Admin

5 2 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments