আজকাল অনেকে বলে থাকেন প্রভু মহাদেব নাকি বৈষ্ণব শ্রেষ্ঠ নন। শাস্ত্রে নাকি কোথাও বলা নেই যে প্রভু শিব বৈষ্ণব শ্রেষ্ঠ। বৈষ্ণবেরা নাকি প্রভু শিবকে “পরম বৈষ্ণব” বলে অপপ্রচার করে থাকেন। অথচ সমগ্র শাস্ত্রে প্রভু মহাদেবকে পরম বৈষ্ণব বলা হয়েছে। আসুন আমরা বিভিন্ন শাস্ত্র হতে শাস্ত্র প্রমাণ সহ উক্ত কথা কতটা সত্য তা যাচাই করি।
এ সম্পর্কে শ্রীমদ্ভাগবতে বলা হয়েছে-
নিম্নগানাং যথা গঙ্গা দেবানামচ্যুতো যথা ।
বৈষ্ণবানাং যথা শম্ভুঃ পুরাণানামিদং তথা ।।
[ শ্রীমদ্ভাগবত ১২।১৩।১৬ ]
বঙ্গানুবাদ:
ঠিক যেমন সমস্ত নদীর মধ্যে গঙ্গা শ্রেষ্ঠ, সমস্ত আরাধ্য বিগ্রহদের মধ্যে অচ্যুতই পরম, বৈষ্ণবগণের মধ্যে শম্ভু(শিব) যেরুপ শ্রেষ্ঠ, তেমনি শ্রীমদ্ভাগবত হচ্ছে পুরাণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ।
.
[ অনেকে অপপ্রচার করে থাকেন, শ্রীমদ্ভাগবতে যে শম্ভুর কথা বলা হয়েছে, তিনি প্রভু মহাদেব নন। তারা আরো বলেন মহাদেব নাকি পরম-বৈষ্ণব নন এবং বৈষ্ণবেরাই নাকি অশাস্ত্রীয় ভাবে অপপ্রচার করে যে, মহাদেব পরম-বৈষ্ণব। অথচ স্কন্দ মহাপুরাণে বলা বলা হয়েছে, “বৈষ্ণবানাং যথা রুদ্র, অর্থাৎ বৈষ্ণব গনের মধ্যে রুদ্র (শিব) শ্রেষ্ঠ। শ্রীব্রহ্মবৈবর্ত মহাপুরাণে বলা হয়েছে, “বৈষ্ণবানাং যথা শিব, অর্থাৎ বৈষ্ণব গনের মধ্যে শিব শ্রেষ্ঠ”। এছাড়াও আরো বহু শাস্ত্রে প্রভু শিবকে পরম-বৈষ্ণব বা বৈষ্ণব শ্রেষ্ঠ বলা হয়েছে, তা আমরা নিচে বিস্তারিত দেখবো। ]
প্রভু শিবেরই এক নাম শম্ভু! এ সম্পর্কে স্কন্দ পুরাণে বলা হয়েছে –
নমস্তে পার্ব্বতী-নাথ নীলকণ্ঠ মহেশ্বর।
শিব রুদ্র মহাদেব নমস্তে শম্ভবে বিভো।।
[ স্কন্দ পুরাণ, ব্রহ্মখণ্ড, সেতুমাহাত্ম্যম্ ১৩।২৫ ]
বঙ্গানুবাদ:
হে পার্ব্বতীনাথ, হে নীলকন্ঠ, হে শিব, হে রুদ্র, হে মহাদেব, হে শম্ভু আপনাকে নমস্কার।
অর্থাৎ, পার্ব্বতীনাথ, নীলকন্ঠ, শিব, রুদ্র, মহাদেব, এবং শম্ভু প্রভু-শিবেরই নাম এতে কোনো সন্দেহ নেই।
.
প্রভু শিব যে বৈষ্ণব-শ্রেষ্ঠ, বৈষ্ণব-শিরোমণি সে সম্পর্কে স্কন্দ পুরাণে বলা হয়েছে –
আয়ুধানাং যথা বজ্রং লোহানাং কাঞ্চনং যথা।
বৈষ্ণবানাং যথা রুদ্রো রত্নানাং কৌস্তুভো যথা।।
[ স্কন্দপুরাণ, বিষ্ণুখণ্ড, বেঙ্কটাচলমাহাত্ম্যম ১৭।১৫ ]
বঙ্গানুবাদ:
আয়ুধগণের মধ্যে বজ্র শ্রেষ্ঠ, ধাতুসমূহের মধ্যে স্বর্ণ শ্রেষ্ঠ, বৈষ্ণবগণের মধ্যে রুদ্র (শিব) শ্রেষ্ঠ, এবং রত্ননিচয় মধ্যে কৌস্তভ শ্রেষ্ঠ।
.
এ সম্পর্কে ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে উল্লেখ রয়েছে –
নাস্তি গঙ্গাসমং তীর্থং ন চ কৃষ্ণাৎ পরঃ স্মৃতঃ।
ন শঙ্করাদ্বৈষ্ণবশ্চ ন সহিষ্ণুর্ধরাপরা ॥
[ ব্ৰহ্মবৈবৰ্ত পুরাণ, ব্ৰহ্মখণ্ড, ১১।১৬ ]
বঙ্গানুবাদ:
যেমন গঙ্গার সমান তীর্থ নাই, যেমন বিষ্ণু হইতে উৎকৃষ্ট দেবতা নাই, শঙ্কর (শিব) অপেক্ষা বৈষ্ণব যেমন আর কেহই নাই, ধরণীর তুল্য সহিঞ্চুতাগুণ যেমন কাহারও নাই।
.
এ সম্পর্কে পদ্মপুরাণে উল্লেখ রয়েছে –
বৈষ্ণবানাং পরঃ শ্রেষ্ঠঃ প্রাহ বাড়বসত্তমম্।
কম্মাদিহ সমায়াতো বদ দেবর্ষিসত্তম।।
[ পদ্মপুরাণ, উত্তরখণ্ড ৭১।৫১ ]
বঙ্গানুবাদ:
পরে সেই বৈষ্ণবশ্রেষ্ঠ দেবদেব (শিব) নারদকে কহিলেন,- হে দেবর্ষিবর! কিজন্য হেথায় (এখানে) আগমন করিয়াছেন!
.
এ সম্পর্কে ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে আরো উল্লেখ রয়েছে-
আশ্রমাণাং যথা বিপ্রো বৈষ্ণবানাং যথা শিবঃ ॥
[ ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, কৃষ্ণজন্মখণ্ড ২৬।৫ ]
বঙ্গানুবাদ:
আশ্রমবাসীদিগের মধ্যে যেরূপ বিপ্রো শ্রেষ্ঠ তেমনই বৈষ্ণবদিগের মধ্যে শিব শ্রেষ্ঠ।
.
এসম্পর্কে শ্রীমদ্ভাগবতে আরো উল্লেখ রয়েছে –
যং মামপৃচ্ছস্ত্বমুপেত্য যোগাৎ সমাসহস্রান্ত উপারতং বৈ ।
স এষ সাক্ষাৎ পুরুষ পুরাণো ন যত্র কালে বিশতে ন বেদ ।।
[ শ্রীমদ্ভাগবত ৮।১২।৪৪ ]
বঙ্গানুবাদ:
মহাদেব বললেন, হে দেবী এক হাজার বছর যোগ অনুষ্ঠান করার পর আমি যখন নিবৃত্ত হয়েছিলাম, তখন তুমি আমায় জিজ্ঞাসা করেছিলে, আমি কার ধ্যান করছিলাম। ইনিই সেই পুরাণ পুরুষ (শ্রীরামচন্দ্র), যার মধ্যে কাল প্রবেশ করতে পারে না এবং যাকেঁ বেদ জানাতে পারে না।
.
এ সম্পর্কে পদ্মপুরাণে আরো উল্লেখ রয়েছে –
সদাশিবো যমারাধ্য পরমং স্থানমাগতঃ।
স রামো মন্মনস্ত্যক্ত্বা ন ক্বাপি পরিগচ্ছতি।।
[ পদ্মপুরাণ, পাতালখণ্ড ৪২।১৬১ ]
বঙ্গানুবাদ:
সদাশিব যাঁহাকে আরাধনা করিয়া পরম স্থান প্রাপ্ত হইয়াছেন, সেই রামচন্দ্র, মদীয় (আমার) হৃদয়ক্ষেত্র পরিত্যাগ করিয়া কদাচ কুত্রাপি গমন করেন না।
অর্থাৎ প্রভু সদাশিব প্রভু শ্রীরামচন্দ্রের আরাধনা করে থাকেন।
.
এ সম্পর্কে পদ্মপুরাণে আরো উল্লেখ রয়েছে –
ময়া শ্রুতং পুরা বেদ-ঋষিভির্ব্বহুধোদিতম্।
রঘুনাথপদস্থায়ী নিত্যং রুদ্রঃ পিনাকভৃৎ।।
[ পদ্মপুরাণ, পাতালখণ্ড ২৬।৩ ]
বঙ্গানুবাদ:
আমি পূর্ব্বে বহুবার দেবর্ষিগণকথিত এই কথা শুনিয়াছিলাম যে, পিনাকপাণি রুদ্রদেব (শিব) প্রতিনিয়তই শ্রীরামের পাদযুগল স্মরণ করিয়া থাকেন।
অর্থাৎ প্রভু শিব শ্রীরামচন্দ্রের আরাধনা করে থাকেন।
.
এ সম্পর্কে ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে আরো উল্লেখ রয়েছে –
মোক্ষদানাং যথা কাশী বৈষ্ণবানাং যথা শিবঃ।
ন পার্ব্বতীপরা সাধ্বী ন গণেশাৎ পরো বলী।।
[ ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, গণেশখণ্ড ৪৪।৭৫ ]
বঙ্গানুবাদ:
যেমন কাশী মোক্ষদাতৃগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, তেমনই শিব বৈষ্ণবগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। যেমন পার্ব্বতী অপেক্ষা সতী আর কেহ নেই, গণেশ অপেক্ষা বলবান আর কেহ নেই, তেমনই বিদ্যার সদৃশ বন্ধু আর কেহ নাই।
.
অর্থাৎ প্রভু শিব বৈষ্ণবগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। শাস্ত্রে এ সম্পর্কে বহু আরো উল্লেখ রয়েছে। সমগ্র সনাতন শাস্ত্রে প্রভু শিবকে বৈষ্ণব-শ্রেষ্ঠ, বৈষ্ণব-শিরোমণি বলা হয়েছে। তাই বৈষ্ণবেরা প্রভু শিবকে পরম বৈষ্ণব বলে থাকেন।
পরিশেষে, যারা মহান বৈষ্ণবদের নিয়ে কটুক্তি এবং অপপ্রচার করে থাকেন, বৈষ্ণব শিরোমণি প্রভু শিব তাদের কৃপা করে সঠিক পথ দেখাবেন, এটাই প্রার্থনা।
।। বৈষ্ণব শিরোমণি প্রভু শিবের জয় ।।
।। হরে কৃষ্ণ ।।
[ বি:দ্র: স্বধর্মম্-এর অনুমোদন ব্যাতীত এই গবেষণামূলক লেখার কোনো অংশ পুনরুৎপাদন, ব্যবহার, কপি পেস্ট নিষিদ্ধ। স্বধর্মম্-এর সৌজন্যে শেয়ার করার জন্য উন্মুক্ত ]
নিবেদক-
° স্বধর্মম্: প্রশ্ন করুন | উত্তর পাবেন °