‘ধাতব রথ’ (পর্ব -১)
পুরীর জগন্নাথদেবের রথ কাষ্ঠ নির্মিত হলেও সমগ্র ভারতভূমিতে বিখ্যাত অগণিত মন্দিরে ধাতু নির্মিত রথ সেই প্রাচীনকাল হতে চলে আসছে, যা অনেকেরই অজানা। এককালে এদেশের বহু স্থানে স্বর্ণের রথে ভগবানের রথযাত্রা হতো। কালক্রমে বিধর্মী শাসকেরা সে সব লুট করে নিয়ে যায়। আজও তিরুপতির ভেঙ্কটেশ্বরের স্বর্ণরথের দেখা মিলে। শুধু স্বর্ণই নয়, রূপা, পিতল, লোহা, কাঁসা, তামার তৈরি রথও ভারতের বিখ্যাত সব মন্দিরগুলোতে দেখা যায়। এককালে গোটা বঙ্গ অঞ্চলে বিখ্যাত ৬৪টি পিতলের রথ দেখা যেত, যা বিভিন্ন রাজবাড়ি কিংবা জমিদার বাড়ির রথযাত্রায় আজও দেখা যায়। বাল্মীকি রামায়ণে দেখা যায়, রামচন্দ্র রাবণবধের পর স্বর্ণনির্মিত পুষ্পরথে আরোহন করে ভ্রমণ করতেন। পদ্মপুরাণে জানা যায়, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের অন্তে দন্তবক্রকে বধ করার পর শ্রীকৃষ্ণ ও বলরামকে স্বর্ণরথে চড়িয়ে বৃন্দাবনে নিয়ে এসেছিলেন ব্রজবাসীগণ।
আজ আমরা আপনাদের সামনে ভারতভূমির প্রাচীন ও প্রসিদ্ধ ১৪টি ‘ধাতব রথ’ এর পরিচয় তুলে ধরছি।
১) শ্রীরামপুরে মাহেশের লোহার রথ :
পুরীর রথের পর ভারতের ২য় প্রাচীনতম ও বৃহৎ কোন রথের নাম করতে হলে সবার আগে আসবে “মাহেশের রথ” এর কথা। এটি বাংলার প্রাচীনতম রথযাত্রা উৎসব। ৭০০ বছরের এই উৎসব ১৩৯৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে পশ্চিমবঙ্গের শ্রীরামপুর শহরের মাহেশে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।
রথযাত্রাকালে কাষ্ঠরথে বারংবার অগ্নিকান্ডের দুর্ঘটনা ঘটার সম্মুখীন হয়। সর্বশেষ ১৮৮৪ সালে রথযাত্রার দিন বল্লভপুরে গুন্ডিচাবাটিতে মাহেশের রথটি ভয়াবহ আগুনে সম্পূর্ণ পুড়ে যায়। তখন শ্রী রামকৃষ্ণের বিখ্যাত শিষ্য বলরাম বসুর পরিবারের কর্তা কৃষ্ণচন্দ্রবাবু বর্তমান লোহার রথটি তৈরি করিয়ে দেন। মার্টিন বার্ন কোম্পানি রথটি তৈরি করে। সেই সময়েই এর দাম পড়েছিল ২০ লক্ষ টাকা। ১৮৮৫ সাল থেকে ওই রথে টান শুরু হয়।
পুরীর রথের সর্বোচ্চ উচ্চতা যেখানে ৩৪ ফুট, সেখানে মাহেশের লোহার রথটি ৫০ ফুট লম্বা। এ রথে ১২ টা লোহার চাকা, গায়ে কাঠের পাটাতন টিন দিয়ে মোড়া। এ রথটি ঐতিহ্যগত বাংলা নবরত্ন শৈলী, এতে ৯ টি চূড়া রয়েছে যদিও কিছু বছর পূর্বে চূড়া ছিল ১৩ টি।
২) তিরুপতি ভেঙ্কটেশ্বরের কনক ধাতুর স্বর্ণরথ :
ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশের তিরুমালাতে ভগবান ভেঙ্কটেশ্বর ৮৪ কেজি কনক ধাতু দিয়ে নির্মিত স্বর্ণরথে আরোহণ করে ভগক্তদের কৃপা করেন।
কনক হলো বিশুদ্ধ সোনা, সবচেয়ে অধিক বিদ্যুৎ সুপরিবাহী পদার্থ হওয়ায় এর উজ্জ্বলতা ও চাকচিক্য চোখ ধাঁধালো। এটি ভারতের সবচেয়ে ব্যয়বহুল রথ। রথটির উচ্চতা ৩২ ফুট। সোনায় নির্মিত এ রথটি সমস্ত বিশ্বের নিকট ভারতের ধনৈশ্বর্য্যের প্রতীক।
৩) দক্ষিণেশ্বরে রানী রাসমনির রূপার রথ :
১৮৩৮ সালে জগন্নাথদেবের স্নান যাত্রার পুণ্য তিথিতে রাণী রাসমণি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন দক্ষিণেশ্বরে মা ভবতারিণীর মন্দির এবং রাণী রাসমণি এক লক্ষেরও বেশি টাকা খরচ করে রুপোর রথ বানিয়েছিলেন। তাঁর গৃহদেবতা রঘুবীরকে নিয়ে কলকাতার রাস্তায় শোভাযাত্রা বের করেছিলেন।
রাণী রাসমণি প্রচলিত সেই রথযাত্রা আজও রথের দিনে দক্ষিণেশ্বরে মহাসমারোহে পালন করা হয়। রথে আরোহণ করার জগন্নাথ পুরো দক্ষিণেশ্বর প্রদক্ষিণ করেন।
৪) বীরভূমে বৈষ্ণবকবি জয়দেবের পিতলের রথ :
স্বর্ণের মতো উজ্জ্বল হওয়ায় ভারতে সুপ্রাচীনকাল থেকে পিতলের রথ ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। গীতগোবিন্দমের রচয়িতা বৈষ্ণব কবি জয়দেবের কেন্দুলীর পিতলের রথা ৭০০ বছরের প্রাচীন। এ রথটি শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য মহাপ্রভুর আবির্ভাবেরও আগের। ১২৯৬-৯৮ এর মাঝামাঝি সময়ে এখানে প্রথম রথ নির্মাণ করা হয়েছিল।
৫) চন্দননগরের লোহার রথ :
চন্দননগর লক্ষ্মীগঞ্জ বাজারের ব্যবসায়ী যদুবেন্দ্র ঘোষ ১৭৭৬ সালে এই রথযাত্রা শুরু করেছিলেন। প্রায় আড়াইশো বছর ধরে সেই রীতি চলছে। চন্দননগরের বর্তমান রথটি ৬০ টন ওজনের লোহা দিয়ে নির্মিত।
৬) গোপীনাথের পিতলের রথ :
পশ্চিম বর্ধমান জেলার উখরার জমিদার বাড়ির ১৭৯ বছরের পুরান ‘গোপীনাথ জিউর’ ২০ ফুট উঁচু পিতলের রথ। এটি উখড়ার পূর্বতন জমিদার লাল সিংহ হান্ডা পরিবারের প্রায় ১৭৭ বছরের প্রাচীন রথ।
৭) মুখার্জি পরিবারের তামা-পিতলের রথ :
বীরনগরে নদিয়ার সিংহ দুয়ার মুখার্জি পরিবারের রথ ৭০০ বছরেরও বেশি প্রাচীন! ধাতুর তৈরি রথে আরোহন করেন আরাধ্য দেবতা জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা (Rath Yatra)। রথটি ৭০০ বছর আগে ঢাকা থেকে নদিয়ার ফুলিয়াতে আনা হয়। সেখানে ২০০ বছর অবস্থান করার পর নিয়ে যাওয়া হয় মুখার্জি পরিবারে। রথটি তৈরি তামা ও পিতল দিয়ে। রথের চাকাও তৈরি মিশ্রিত ধাতু দিয়ে।
৮) সিয়ারশোল রাজবাড়ির পিতলের রথ :
১০০ বছরের পুরাতন ত্রিতলবিশিষ্ট এই পিতলের রথটি নবরত্ন মন্দিরের আদলে তৈরি করানো হয়েছে বলেই জানা যায়। পশ্চিম বর্ধমান জেলায় রথযাত্রার আকর্ষণ এ রথটি সারা বছর রাখা থাকে রাজবাড়ি প্রাঙ্গণে। ৩০ ফুটের এই পিতলের রথের ওজন ৮-১০ টন।
৯) নসিপুর আখড়ার রূপার রথ :
১১৬৮ বঙ্গাব্দে স্বামী রামানুজ আচার্য্যের শিষ্য লক্ষণ দাস ও মনসরাম দাস ধর্ম প্রচারের জন্য মুর্শিদাবাদে এসে নসিপুরে এক আখড়া স্থাপন করেন এবং পরবর্তীতে এখানে রথযাত্রার সূচনা করে। রাজস্থান থেকে কারিগর নিয়ে এসে রুপোর রথ তৈরি করান ভগবানদাস আচার্য্য। হাতির উপরে উপবিষ্ট মাহুত রথটিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। রথের বাহন হাতি ও হাতির উপরে উপবিষ্ট মাহুত সোনার জলে পালিশ রুপো দিয়ে তৈরি। সেই প্রথা মেনে আজও আয়োজিত হচ্ছে প্রায় ২৫৫ বছরের প্রাচীন নসিপুর আখড়ার রথযাত্রা।
১০) সীমলার প্রামাণিক বাড়ির কাঁসা-পিতলের রথ :
উত্তর কলকাতার তারক প্রামাণিক রোডের প্রামাণিক বাড়ির পিতলের রথটি আনুমানিক ২৫০ বছরের পুরোনো৷ তারক প্রামাণিকের বাবা গুরুচরণ প্রামাণিকের আমলে হুগলির ব্যান্ডেলে পারিবারিক কাঁসা-পিতলের কারখানাতে তৈরি হয়েছিল ১৪ ফুট উচ্চতার পিতলের এই রথ, যার ওজন প্রায় ২২ টন৷
১১) হেতমপুর রাজবাড়ির পিতলের রথ :
রাজপরিবারের ইতিহাস বলছে, বাংলা ১২৫০ সালের আশপাশে হেতমপুরের রাজা রামরঞ্জন চক্রবর্তী ইংল্যাণ্ডের স্টুয়ার্ট কোম্পানিকে দিয়ে রথটি বানিয়েছিলেন। ইংল্যান্ডে তৈরি হেতমপুর রাজবাড়ির পিতলের রথ দেখে মনে হয় যেন সোনার তৈরি। রথটি তৈরি হয়েছিল রাজপরিবারের গৌরাঙ্গ মন্দিরের গৌরাঙ্গ-নিত্যানন্দের জন্যই। প্রথা অনুযায়ী গৌরাঙ্গ নিত্যানন্দের বিগ্রহ তোলা হতো রথের দিন। বর্তমানে মন্দিরটির সেবাভার গ্রহণ করেছে গৌড়ীয় মঠ।
১২) বাঁকুরার রানি শিরোমণির পিতলের রথ :
ইতিহাস বলে বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরে প্রাচীন রথ উৎসব প্রায় ৩৫০ বছরের বেশি প্রাচীন। ১৬৬৫ খ্রীঃ বিষ্ণুপুরের মল্লরাজা শহরের মাধবগঞ্জে রানি শিরোমণি দেবীর ইচ্ছা অনুযায়ী পাথরের পাঁচ চূড়া মন্দির নির্মাণ করেন। মন্দিরের বিগ্রহ রাধা মদন গোপাল জিউ। এই মন্দিরের অনুকরণের তৈরি করা হয় পিতলের রথ। মল্লরাজাদের সময় থেকেই এই রথ উৎসবের সূচনা হয়।
১৩) লালগড় রাজবাড়ির লোহার রথ :
১৭১০ সালে লালগড়ের রাজবাড়িতে রথযাত্রার সূচনা হয়। রথযাত্রার দিনে ৮ চাকার লোহার তৈরি ২০ ফুট উঁচু রথে চড়েন লালগড় রাজপরিবারের কুলদেবতারা।
৩১৫ বছরের প্রাচীন এ রথযাত্রায় লালগড়ের বাবুপাড়ার মন্দির থেকে রাধামোহন ও শ্রীমতীর পাশাপাশি গোপীনাথ, গোবিন্দ, আরও দু’টি শ্রীমতী, সাক্ষীগোপাল, কৃষ্ণ-বলরাম, ধাম গৌরাঙ্গ ও জগন্নাথের বিগ্রহ নিয়ে আসা হয় রথতলায়। কেবলমাত্র এ দিনই রাধামোহন ও শ্রীমতীকে সোনার অলঙ্কারে সাজানো হয়। রথযাত্রার দিন বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত মতে, অমৃতযোগে রথের রশি টানা শুরু হয়। স্থানীয় হাটচালায় মাসির বাড়িতে পৌঁছে যাত্রা শেষ হয়।
১৪) বনকাঠির পিতলের রথ :
বনকাঠির পিতলের রথটি মুখোপাধ্যায় পরিবারের গোপালেশ্বর মন্দিরের আদলে তৈরি করা হয় পিতলের রথ। ১৭৫৪ বঙ্গাব্দে গোপালেশ্বর মন্দির তৈরি হয় আর তার দুই – তিন বছরের পরেই পিতলের রথ তৈরি হয়। সময় লাগে ছয় থেকে আট মাস। বনকাটির পিতলের রথটি ১৫ ফুট উচ্চতার এবং এর আটটি চাকা রয়েছে। মাথায় রয়েছে বিষ্ণুচক্র। চাকার উপরে রয়েছে সাত ফুট / সাত ফুট রেলিং। পিতলের দুই ঘোড়া এবং সারথী আছে এই রথে। রথের দেওয়ালে রয়েছে মহাভারত, রামায়নের নানা যুদ্ধকাহীনি। রয়েছে বৈষ্ণব সাহিত্যের নানা সামাজিক কাহীনির ছবি।
এরকম খুঁজলে ভারতের প্রাচীন ও বিখ্যাত বহু বহু মন্দিরে ধাতব রথের দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। ধাতব নির্মিত রথগুলো যেমন কাঠের কেয়ে তুলনামূলক হালকা হয়, তেমনি সাশ্রয়ী এবং কম জায়গাতে ফোল্ড করে রাখা যায়, শত শত বছরেও নষ্ট হয় না। অপরদিকে কাঠের রথ বানানোর ব্যয়বহুলতা, দক্ষ কারিগরের অভাব, কাঠের রথে অগ্নিদুর্ঘটনার পূর্ব ইতিহাস, সহজে নষ্ট হয়ে যাওয়া এবং সর্বপরি কাঠ সংগ্রহে বনকে বন উজার করার যে ভয়াবহতা এসব বিবেচনা করে আধুনিক কালে বেশিরভাগ রথই ধাতু দ্বারা নির্মিত হচ্ছে। তিরুমালা ভেক্টেশ্বরের রথ থেকে শুরু করে দক্ষিণেশ্বর কালীমন্দিরে রানী রাসমনির ধাতব রথগুলো ভারতভূমির সুপ্রাচীন ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং কৃষ্টির ধারক।
নিবেদক-
ব্রজ সখা দাস ও ভক্ত অমিত দে
All rights reserved to স্বধর্মম্ : Connect to the inner self
Connect with us: ° স্বধর্মম্ : প্রশ্ন করুন | উত্তর পাবেন ° group.