In Search of Krishna’s Wife Radhika (Part-2): ‘Radharani, Krishna’s aunt or wife?’
গ্রাম্য সাহিত্য শ্রবণে যাদের আগ্রহ, তাদের কেউ কেউ ধারণা করে থাকেন- শ্রীমতি রাধিকা রায়ান(আয়ান) নামক এক গোপের পত্নী। আরেক পক্ষ দেখা যায়, শ্রীমতি রাধিকাকে কৃষ্ণের মামী বলে সম্বোধন করে ভগবান কৃষ্ণচরিতকে উপহাস করতে চান। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হলো- যারা ভগবান প্রণীত শাস্ত্র না পড়ে গ্রাম্য রসালো সাহিত্যকে প্রামাণিক বলে গ্রহণ করেন, তারা যে প্রকৃত সত্য হতে বঞ্চিত তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই শাস্ত্রে এরূপ ব্যক্তিদের ‘মূঢ়’ বলে সম্বোধন করা হয়েছে।
‘মূঢ়া রায়াণপত্নী ত্বাং বক্ষ্যন্তি জগতীতলে’
[ শ্রীব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ, কৃষ্ণজন্মখন্ড, অধ্যায় ৩, শ্লোক ১০৩ ]
বঙ্গানুবাদ: ভূতলে যারা মূঢ় (মূর্খ), তারাই শ্রীমতি রাধিকাকে রায়াণ(আয়ান) এর পত্নী বলে মনে করে।
বাস্তবে রায়াণ বা অন্য কোন গোপের পক্ষে শ্রীমতি রাধিকাকে বিবাহ করা দূরে থাক, তাকে স্পর্শ বা দর্শন করাও সম্ভব নয়। শ্রীমতি রাধিকা নিত্যকৃষ্ণ পত্নী। রায়ান নামক গোপ যাকে বিবাহ করেছিলেন, তিনি হলেন রাধিকার অংশ ‘ছায়া-রাধা’।
শাস্ত্রে উল্লেখ আছে-
অতীতে দ্বাদশাব্দে তু দৃষ্টা তাং নবযৌবনাম ।।
সার্দ্ধং রায়াণ বৈশ্যেন তৎসম্বন্ধং চকার সঃ।
ছায়াৎ সংস্থাপ্য তদ্দেহে সান্তর্দ্ধানং চকার হ।।
বভূব তস্য বৈশ্যস্য বিবাহশ্ছায়য়া সহ ।
[ শ্রীব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ, প্রকৃতিখন্ড, অধ্যায় ৪৯, শ্লোক ৩৭-৩৯ ]
বঙ্গানুবাদ: শ্রীমতি রাধিকার আবির্ভাবের দ্বাদশবর্ষ অতীত হলে বৃষভানু স্বীয় কন্যা রাধিকাকে নবনৌবনা দেখে রায়াণ বৈশ্যের সাথে তাঁর বিবাহ সম্বন্ধ স্থির করলেন। সম্বন্ধ স্থির হলে শ্রীমতী স্বীয় দেহে ছায়া মাত্র সংস্থাপন করে অর্থাৎ তিনি ছায়া-রাধা প্রকট করে স্বয়ং অন্তর্হিতা হলেন । অতঃপর সেই ছায়ারূপিণী রাধিকার সাথে রায়াণের বিবাহ হলো।
বৃষভানু আঙ্গিনায় সংগঠিত এ বিবাহের সবিস্তার বর্ণনা ব্রহ্মান্ড মহাপুরাণের উত্তরখন্ডের (উত্তমাখন্ডে) রাধাহৃদয়াখ্যান ভাগে বর্ণিত হয়েছে, যা সংক্ষেপে নিম্নে বর্ণিত হলো-
৭ম মন্বন্তরের ২৮ তম দ্বাপর যুগে শ্রীমতি রাধারাণীর বয়স যখন ১২ বছর হয়, তখন রাজা বৃষভানু আয়ান নামক এক গোপের সাথে রাধিকার বিবাহ ঠিক করেন। কিন্তু শ্রীমতি রাধারাণীর সে বিবাহে মত ছিলো না, তাই তিনি সহস্র গোপীদের সাথে নিয়ে কূলদেবী কাত্যায়নীর ব্রতের ছল করে শ্রীহরির তপস্যা করতে থাকেন, যেন শ্রীকৃষ্ণকে পতিরূপে লাভ করেন। কখনো দিনে ১ বেলা আহার করে, কখনী বা রাত্রিতে একাহার করে, কখনো বা ফল কিংবা দুগ্ধমাত্র গ্রহণ করে, কখনো বা কেবল জল বা পত্ররস গ্রহণ করে তিনি বহু দিবস কঠোর তপস্যা করতে লাগলেন৷ তাঁর তপস্যায় তুষ্ট হয়ে স্বয়ং শ্রীহরি প্রকট হয়ে রাধিকার সম্মুখে আসলে শ্রীমতি রাধিকা কৃষ্ণকে পতিরূপে বর চান।
কৃষ্ণ তখন তাকে বলেন, ‘আয়ান নামক গোপ প্রকৃতপক্ষে শ্রীকৃষ্ণেরই অংশাবতার যে কিনা পূর্বজন্মে অভিমুন্ন্য নামক যোগীরূপে নারায়ণের তপস্যা করে লক্ষ্মীকে পত্নীরূপে চেয়েছিলেন। তখন ভক্তবৎসল ভগবান তাকে বর দিয়েছিলেন, পরজন্মে লক্ষ্মী ঠিকই তার গৃহে বধূরূপে থাকবে, কিন্তু নপুংসকতা প্রাপ্তি হেতু সে লক্ষ্মীর সাথে কোনরূপ সম্পর্ক স্থাপন করতে পারবে না।’ তাই শ্রীকৃষ্ণ রাধাকে বললেন, তিনি যেন আয়ানকে বিবাহ করেন।
আয়ান যে শ্রীকৃষ্ণের অংশাবতার ছিলো, সে সম্পর্কে শাস্ত্রীয় প্রমাণ হলো-
কৃষ্ণস্তু কলয়া যজ্ঞে জটিলায়াং প্রভাসতঃ ।
তিলকো দুর্ম্মদশ্চাপি আয়ানাবরজৌ সুতৌ ॥
[ ব্রহ্মান্ডপুরাণ, উত্তরভাগ, রাধাহৃদয়াখ্যান, অধ্যায় ০৮, শ্লোক ১১৮ ]
বঙ্গানুবাদ: শ্রীকৃষ্ণ নিজের অংশকলাতে জটিলাগর্ভে জন্মগ্রহণ করেন, তাহার নাম আয়ান। আয়ানের জ্যৈষ্ঠ তিলক ও দুর্ম্ম নামে জটিলা অপর দুই পুত্র প্রসব করেন।
সে যাই হোক, কৃষ্ণের কথা শুণে পূর্ণশক্তি রাধিকা বললেন, আয়ান শ্রীকৃষ্ণের অংশ হতে পারে, কিন্তু পূর্ণশক্তিমান কৃষ্ণ ব্যতীত অনয় কেউ তাকে বিবাহ করার যোগ্যতা রাখে না। তাই তিনি অন্য কাউকে বিবাহ করবেন না, প্রয়োজনে তিনি গলায় দড়ি দিবেন।
তখন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এক উপায় করলেন, যেন শ্রীমতি রাধিকার ইচ্ছাও পূর্ণ হয় এবং অভিমুন্ন্য যোগীকে দেওয়া বরের মান রক্ষিত হয়। তিনি রাধিকাকে বর দিলেন-
শ্রীভগবানুবাচ—
উপায়ন্তে প্রবক্ষ্যামি মানসোত্তাপনাশনং।
তদুদ্বাহোৎসব প্রেক্ষা সিদ্ধার্থং মাতুলগৃহং।।
মাত্রা গমিষ্যেঁ তদনু মাতুলাঙ্ক গতোস্ম্যহং।।৬৪।।
আয়াস্যে ত্বৎ পিতুর্গেহং ক্রোড়গো মাতুলস্যহং।
তং দ্রংশয়িত্বা দায়ানং পুং স্ত্বাৎ কৈতব মাতুলং।।৬৫।।
[ ব্রহ্মান্ডপুরাণ, উত্তরভাগ, রাধাহৃদয়াখ্যান, অধ্যায় ১৩, শ্লোক ৬৪,৬৫ ]
বঙ্গানুবাদ: ভগবান্ শ্রীরাধাকে এই কথা কহিলেন- হে রাধে! পূৰ্ব্ব বাক্য কদাচ মিথ্যা হইবে না। এক্ষণে তোমার মনের উত্তাপনাশনে যে উপায় আমি বলি তাহা তুমি শ্রবণ কর। আমার মাতুল আয়ান, তাহার বিবাহ মহোৎসব দেখিবার নিমিত্ত মাতা যশোদার সহিত আমি মাতুলগৃহে গমন করিব, তখন মাতার ক্রোড় হইতে মাতুলের অদ্ধগত হইব। হে রাধে! আমি বিবাহকালে তোমার পিতা বৃষভানুর ভবনে আগমন করিয়া মাতুল আয়ানের ক্রোড়স্থিত হয়ে আয়ানকে পুরুষত্ব হইতে নিবন্ধ করত নপুংসক করিব (এবং তোমাকে বিবাহ করিব)।
শ্রীকৃষ্ণ হতে বরপ্রাপ্ত হয়ে রাধিকা পিতৃগৃহে ফিরে গেলেন। এরপর শ্রীমতি রাধিকার বয়স যখন ১৪ বছর হলো তখন ব্রজেন্দ্রনন্দন শ্রীকৃষ্ণ নন্দগৃহে আবির্ভূত হন এবং একদা নন্দমহারাজের সাথে বৃন্দাবনে ভান্ডীরবনে গোচারণে গেলে সেখানে ব্রহ্মার পৌরহিত্যে সমস্ত দেবতার উপস্থিতিতে রাধাকৃষ্ণের গান্ধর্ব্ব বিবাহ সম্পন্ন হয় (পূর্ববর্তী লিখনিতে উক্ত গান্ধর্ব্ব বিবাহের বর্ণনা আছে, আগ্রহীগণ তা পড়ে নিবেন)। এরপর কোন এক সময় বৃষভানু মহারাজ বর্ষাণায় নিজ বাড়ির আঙ্গিনায় নিজ কণ্যার বিবাহের আয়োজন করলেন এবং পূর্বপ্রতিশ্রুতি অনুযায়ী শ্রীকৃষ্ণ মাতা যশোদার সাথে আপন মামা আয়ানের বিবাহে উপস্থিত হলেন। সে মনোহর বিবাহ আয়োজনে শ্রীকৃষ্ণ হঠাৎ কন্দন আরম্ভ করে বিবাহে উপবেশনরত মামা আয়ানের ক্রোড়ে উঠে গেলেন৷ ছোট শিশু হওয়ায় কেউ তাকে বাঁধা দেয় নি। এরপর বালক শ্রীকৃষ্ণ নিয়তির বিধান অনুসারে আয়ানকে নপুংসত্ব দান করলেন।
ততস্তাংচারু সৰ্ব্বাঙ্গীং বৃষোদিৎ সুস্তমীক্ষ্য সঃ।
ধাঙক্ষায়ৈব পুরোডাশ মধ্বরে মাধবো রুষা ॥
আয়ানাঙ্কগ কৃষ্ণস্ত পুংস্তাদপনয়ং স্তদা ॥ ৩৩
দ্বিতীয়ং প্রকৃতিং তস্মা দায়ানায়া দদৎ ক্ষণাৎ
যস্যেঙ্গিতৈ লয়ং যান্তি ব্ৰহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বরাঃ ॥
তস্যা ৰিৰিৎসিতং কৰ্ম্ম কোবা বারায়তুং ক্ষমঃ॥৩৪
প্রিয়ায়া লিপ্সিতং যত্তু বিধায়োরুক্রমস্তদা।
প্রসারিত করো বাঢ় মুবাচ তদনন্তরম্ ॥ ৩৫
সত্যস্তে দদত্তামু দক্ষিণা রত্নসঞ্চয়ম্ ।
নাজ্ঞানীত্তস্য তদ্বৃত্তং কিঞ্চিদ্ৰাত্মা তদানে ॥ ৩৬
[ ব্রহ্মান্ডপুরাণ, উত্তরখন্ড, রাধাহৃদয়্যাখানভাগ, ১৫।৩৩-৩৬ ]
বঙ্গানুবাদ: যজ্ঞীয় ঘৃত কাককে প্রদান করার ন্যায় বৃষভানু সর্বাঙ্গসুন্দরী মনোহারিণী কন্যা, আয়ানকে দান করিতে ইচ্ছুক হলেন। যেহেতু আয়ান রাধারাণীর অযোগ্য তাই আয়ান ক্রোড়স্থিত শ্রীকৃষ্ণ তার পুরুষার্থহরণ করলেন অর্থাৎ আয়ানকে নপুংসকত্ব প্রদান করিলেন । কৃষ্ণের স্পর্শ মাত্র আয়ান যে নপুংসত্ব প্রাপ্ত হলো, এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই, কারণ সে কৰ্ম্ম ভগবত সম্বন্ধে বিচিত্র নয়, যেহেতু যে শ্রীকৃষ্ণের ইঙ্গিত মাত্রে সৃষ্টি স্থিতি লয়কর্ত্তা ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরেরও লয় হয়, সে শ্রীকৃষ্ণের অকরণীয় কার্য্য জগতে কি আছে ? সেই অচিন্ত্য অব্যয় পরম পুরুষের বিবেচনা সিদ্ধবিধেয় কর্ম্ম নিবারণ করতে কে সমর্থ হয়? উরুক্রম ভগবান শ্রীকৃষ্ণ স্বপ্রিয়া শ্রীমতী রাধিকার মনোভিলষিত যে প্রার্থনা তাহা সম্পূর্ণ করে আয়ানকে পশ্চাতে রেখে আপনার দক্ষিণহস্ত প্রসারিত করে কন্যারত্নের পাণিগ্রহণ পূর্বক ‘তদনন্তর বাঢ়ং ইতি’ প্রতিগ্রহ সূচক বাক্য বললেন।। হে মুনে! অঙ্গিরা! বৃষভানু রাজা কন্যাদান করে দক্ষিণা স্বরূপ বহু রত্ন সঞ্চর শ্রীকৃষ্ণ হস্তে প্রদান করলেন। শ্রীকৃষ্ণও স্বস্তি বলে তা নিলেন, কিন্তু এতোকিছু হওয়া সত্ত্বেও রাজা বৃষভানু কিঞ্চিৎ মাত্রও উপলব্ধি করিতে পারিলেন না যে আয়ানের পরিবর্তে শ্রীকৃষ্ণের সাথে রাধিকার বিধিবৎ বিবাহ সম্পন্ন হয়েছে।
ব্যাখানঃ
এখানে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, শ্রীকৃষ্ণ আয়ানকে নপুংসকত্ব দান করেন এবং বৃষভানু রাজা রাধিকাকে আয়ানের নিকট সম্প্রদান করতে গেলে শ্রীকৃষ্ণ দক্ষিণ হাত বাড়িয়ে রাধিকার হস্ত গ্রহণ করেন এবং বেদমন্ত্র দ্বারা বিবাহ সম্পন্ন করেন। কিন্তু কৃষ্ণমায়ায় বিমোহিত হওয়ায় বৃষভানু রাজা কিংবা উপস্থিত কেউই (আয়ান ছাড়া) তা উপলব্ধি করতে পারে নি।
বিবাহ কার্য শেষ হলে শ্রীমতি রাধিকা আপন ছায়া বিবাহস্থলে রেখে স্বয়ং অন্তর্হিত হলেন।
‘ছায়াৎ সংস্থাপ্য তদ্দেহে সান্তর্দ্ধানং চকার হ।’
[ শ্রীব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ, প্রকৃতিখন্ড, অধ্যায় ৪৯, শ্লোক ৩৮ ]
বঙ্গানুবাদ: শ্রীমতি স্বীয় দেহে ছায়া মাত্র সংস্থাপন করে অর্থাৎ তিনি ছায়া-রাধা প্রকট করে স্বয়ং অন্তর্হিতা হলেন।
আয়ানের পিতা তখন মহাধূমধামের সাথে এ ছায়া রাধাকে নিয়ে গৃহে ফিরে গেলেন। কিন্তু বিচক্ষণ আয়ান যখন বুঝতে পারলেন বাস্তবে তার বিবাহ সম্পন্ন হয় নি এবং তিনি আর পুরুষ নেই, তখন তিনি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলা ছাড়া আর কিছুই করতে পারলেন না। নাওয়া-খাওয়া-শয়ন-উপবেশন কোন কিছুতেই তার মনোযোগ নেই দেখে তার বন্ধুগণ তাকে এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি তাদের সব খুলে বলেন এবং বন্ধুরা শীঘ্রই তা আয়ানের মাতা-পিতাকে জানান। পুত্রের নপুংসকতা সম্পর্কে জেনে তারাও ব্যথিত হন।
সিদ্ধান্তঃ
এ উপাখ্যান হতে দেখা গেলো, যদিও আয়ান নামক গোপ সম্পর্কে শ্রীকৃষ্ণের মাতুল হয়, তবুও শ্রীমতি রাধিকা শ্রীকৃষ্ণের মামী নন। কারণ, শ্রীমতি রাধিকার সাথে আয়ানের বিবাহ সম্পন্ন হয় নি। প্রকৃত রাধিকা সর্বদা শ্রীকৃষ্ণের বক্ষঃস্থিতা এবং কোন গোপ তাকে দর্শন পর্যন্ত করতে পারে না। আয়ানের গৃহে বধূরূপে যিনি ছিলেন, তিনি বাস্তবে শ্রীমতি রাধিকার কলা মহালক্ষ্মীর অংশাবতা ‘ছায়া-রাধা’। এ ছায়ারাধা পূর্ব জন্মে ছিলেন ‘ছায়াসীতা’, যাকে রাবণ রামপত্নী সীতা ভেবে অপহরণ করে লঙ্কায় নিয়ে গিয়েছিলেন। ভগবানের রাম অবতারের সময় যেমন রাবণ প্রকৃত সীতাকে হরণ করার স্থলে ছায়াসীতাকে হরণ করেছিলেন, ঠিক সেরূপে কৃষ্ণ অবতারের সময় প্রকৃত রাধার স্থলে ছায়ারাধা বধূরূপে আয়ানের ঘরে বাস করেছিলেন। ছায়াসীতা ও ছায়ারাধার বিস্তারিত বিবরণ শ্রীব্রহ্মবৈবর্তপুরাণাদি শাস্ত্রে বর্ণিত আছে।
তাই শাস্ত্রে’রাধাপতি‘,’রাধাকান্ত‘,’রাধাস্বামিন‘,’বৃষভানুসুতাকান্ত‘ প্রভৃতি শব্দে বারংবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছে রাধিকা শ্রীকৃষ্ণের নিত্য পত্নী।
রাধাকৃষ্ণের দাম্পত্য বিষয়ক আরো কিছু শাস্ত্রীয় উদ্ধৃতি-
স্বয়ং রাধা কৃষ্ণপত্নী কৃষ্ণবক্ষঃস্থলস্থিতা ।
প্রাণাধিষ্ঠাতৃদেবী চ তস্যৈব পরমাত্মনঃ।।
[ শ্রীব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ, প্রকৃতিখন্ড, অধ্যায় ৪৮, শ্লোক ৪৭ ]
বঙ্গানুবাদ: শ্রীমতী রাধিকা স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণের পত্নীরূপে অবস্থিতা। নিরন্তর তিনি পরমব্রহ্ম কৃষ্ণের বক্ষঃস্থলে স্থিতি করেন, ফলতঃ সেই রাধা পরাৎপর কৃষ্ণের প্রাণাধিষ্ঠাত্রী দেবীরূপে নির্দিষ্টা আছেন।
গর্গ সংহিতাতে বলা হয়েছে-
বৃষভানুসুতা রাধা যা জাতা কীর্ত্তিমন্দিরে।
তস্যাঃ পতিরয়ং সাক্ষাত্তেন রাধাপতিঃস্মৃত।।
পরিপূর্ণতমঃ সাক্ষাৎ শ্রীকৃষ্ণো ভগবান স্বয়ম।
অসংখ্যব্রহ্মাণ্ডপতির্গোলকে ধাম্নি রাজতে।।
[ গর্গসংহিতা, গোলকখন্ড, অধ্যায় ১৫, শ্লোক-৩৪,৩৫ ]
বঙ্গানুবাদ: বৃষভানুর কণ্যা রাধা যিনি কীর্ত্তিদার গৃহে আবির্ভূত হয়েছিলেন, শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং তাঁহার পতি বলিয়া ‘রাধাপতি’ নামে অভিহিত। অসংখ্য ব্রহ্মান্ডের অধিপতি পরিপূর্ণতম সাক্ষাৎ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গোলকধামের অধিশ্বর।
পদ্মপুরাণে বলা হয়েছে –
বামপার্শ্বে স্থিতাং তস্য রাধিকাঞ্চ স্মরেত্ততঃ।
নীলচোলকসংবীতাং তপ্তহেমসমপ্রভাম্।।
পট্টাঞ্চলেনাবৃতার্দ্ধ-সুস্মেরাননপঙ্কজাম্।
কান্তবক্তে ন্যস্তনেত্রাং চকোরীর চলেক্ষণাম।।
[ পদ্মপুরাণ, পাতালখন্ড, অধ্যায় ৫০, শ্লোক ৪৪,৪৫ ]
বঙ্গানুবাদ: ভক্ত স্মরণ করবে- পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণের বামভাগে রাধিকা বিরাজমান রয়েছেন, তাঁর পরিধান—নীলবসন, উত্তপ্ত স্বর্ণের ন্যায় তাঁর দেহপ্রভা; তাঁর ঈষৎ হাসিযুক্ত মুখপদ্ম আঁচলে অর্ধাবৃত। চকোরী পাখি যেমন চন্দ্রের অমৃত কিরণ পান করেন, তেমনি শ্রীমতি রাধিকা তার চঞ্চল নেত্রযুগল দ্বারা নিজ কান্ত(স্বামী) কৃষ্ণের মুখচন্দ্রের দিকে তাকিয়ে তার রূপমাধুর্য্যসুধা আস্বাদন করছেন।
পদ্মপুরাণে আরও বলা হয়েছে-
ততঃ সারিশুকানাঞ্চ শ্রুত্বা বাগাহবং মিথঃ।
নির্গচ্ছতস্ততঃ স্থানাদগন্তুকামৌ গৃহং প্রতি ॥
কৃষ্ণঃ কান্তামনুজ্ঞাপ্য গবামভিমুখং ব্রজেৎ।
সা তু সূর্যাগৃহৎ গচ্ছেৎ সখীমণ্ডলসংযুতা ॥
[ পদ্মপুরাণ, পাতালখন্ড, অধ্যায় ৫২, শ্লোক ৭৬-৭৭ ]
বঙ্গানুবাদ: রাধার ভ্রূভঙ্গী দর্শন ও কৃষ্ণের প্রতি তিরস্কার বাক্য শ্রবণ করার নিমিত্ত শুক-সারিকা- পক্ষিগণ সেখানে উপস্থিত হয়ে নিজেরাই আবার বাগ্যুদ্ধ বাধিয়ে দিলো। রাধা- কৃষ্ণ তাদের বাগযুদ্ধ শ্রবণ করে গৃহগমনাভিলাষে সেখান হতে বহির্গত হন। কৃষ্ণ তার কান্তা(পত্নী) শ্রীমতি রাধিকার অনুমতি নিয়ে গাভীবৃন্দের অভিমুখে গমন করেন। শ্রীমতি রাধা সখীগণসমভিব্যাহারে সূর্য্য পূজা করার জন্য সূর্য্য-গৃহে গমন করেন।
স্কন্দপুরাণে বলা হয়েছে-
বৃষভানুসুতাকান্তবিহারে কীর্ত্তনশ্রিয়া।
সাক্ষাদিব সমাবৃত্তে সর্ব্বেহনন্যদৃশোহভবন।।
[ স্কন্দপুরাণ, বিষ্ণুখন্ড, শ্রীমদ্ভাগবতমাহাত্ম্যম, অধ্যায় ২, শ্লোক ৩১ ]
বঙ্গানুবাদ: বৃষভানুর কণ্যা শ্রীমতি রাধিকার কান্ত(পতি) সাক্ষাৎ কৃষ্ণের বিহারভূমি কীর্ত্তনসমৃদ্ধিতে পরিপূর্ণ হলো এবং সকলেই যেন অনন্য নয়ন হয়ে সেই উৎসব দর্শন করিতে লাগিলেন।
নারদপঞ্চরাত্র শাস্ত্রে বলা হয়েছে-
শ্রীকৃষ্ণো জগতাং তাত জগন্মাতা চ রাধিকা।
পিতুঃ শতগুণ মাতা বন্দ্যা পূজা গরীয়সী ॥
[ নারদপঞ্চরাত্র ২য় রাত্র, অধ্যায় ৬, শ্লোক ৭ ]
বঙ্গানুবাদ: শ্রীকৃষ্ণ জগতের পিতা, শ্রীরাধা জগতের মাতা। পিতা অপেক্ষা মাতা শতগুণে বন্দনীয়া, পূজনীয়া এবং শ্রেষ্ঠা।
শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতে বলা হয়েছে-
গোবিন্দানন্দিনী, রাধা গোবিন্দমোহিনী।
গোবিন্দসর্বস্ব, সর্বকান্তা-শিরোমণি।।
[ শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত, আদিলীলা, অধ্যায় ৪, শ্লোক ৮২ ]
শ্লোকার্থ: শ্রীমতী রাধারাণী হচ্ছেন শ্রীগোবিন্দের আনন্দদায়িনী এবং তিনি গোবিন্দের মোহিনীও। তিনি শ্রীগোবিন্দের সর্বস্ব এবং সমস্ত কান্তাগণের (স্ত্রীগণের) শিরোমণি।
শিব পুরাণে বলা হয়েছে-
কালবতীসুতা রাধা সাক্ষাদগোলোকবাসিনী।
গুপ্তস্নেহানিবদ্ধা সা কৃষ্ণপত্নী ভবিষ্যতি।।
[ শিব মহাপুরাণ, রুদ্রসংহিতা, পার্বতীখন্ড, অধ্যায় ২ শ্লোক ৪০; সনদকুমার উক্তি]
বঙ্গানুবাদ: সাক্ষাৎ গোলকনিবাসিনী রাধা কলাবতীর কণ্যা হয়ে শ্রীকৃষ্ণের সহিত গোপণে স্নেহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে ভবিষ্যতে কৃষ্ণপত্নী হবেন।
প্রকৃত-পক্ষে এই ছায়া-রাধা কে ছিলেন? এই প্রশ্নের উত্তরে শ্রীব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে বলা হয়েছে-
পশ্চাৎ গোকুলমাগত্য বারাহে চ বরাননে।
বৃষভানুসুতা ত্বঞ্চ রাধাচ্ছায়া ভবিষ্যসি।।
[ শ্রীব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ, কৃষ্ণজন্মখণ্ড, অধ্যায় ৮৬, শ্লোক ১২৯ ]
বঙ্গানুবাদ: হে দেবী তুলসী! তুমি এখন গোলকধাম গমন কর। পশ্চাৎ তুমি এই তপস্যার ফল লাভ করিবে। বরাননে! পরে তুমি বরাহ কল্পে গোলক হইতে গোকুলে আগমনপূর্ব্বক রাধিকার ছায়া রুপে বৃষভানুর কন্যা হইবে এবং আমার কলা-অংশজাত রায়াণ তোমার পাণিগ্রহণ করিবে।
এখানে অল্প কিছু সংখ্যক শাস্ত্রীয় বাক্য উদ্ধৃতি করা হলেও আরো ব্যাপক শাস্ত্রে রাধাকৃষ্ণের নিত্য সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে, সে সমস্ত আরেকটি লিখনিতে প্রকাশ করার ইচ্ছা রেখে এখানে ইতি টানলাম।
তথ্য-সহায়িকা-
১) ব্রহ্মান্ড পুরাণ – নন্দকুমার কবিরত্ন ভট্টাচার্য্য অনুদিত (তারাচাঁদ দাস এণ্ড সন্স প্রকাশনি)
২) পদ্মপুরাণম, পাতালখন্ড- শ্রীযুক্ত পঞ্চানন তর্করত্ন সম্পাদিত (নবভারত পাবলিশার্স)
৩) স্কন্দ-পুরাণম, বিষ্ণুখন্ড- শ্রীযুক্ত পঞ্চানিন তর্করত্ন সম্পাদিত( নবভারত প্রকাশনি)
৪) ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণম- শ্রীযুক্ত মথুরানাথ তর্করত্ন সম্পাদিত
৫) ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণম- শ্রীযুক্ত পঞ্চানন তর্করত্ন সম্পাদিত (নবভারত প্রকাশনি)
৬) শ্রীশ্রীব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ- শ্রীযুক্ত বেণীমাধবশীল সম্পাদিত (অক্ষয় লাইব্রেরী প্রকাশনি)
৭) শ্রীচৈতন্য চরিতামৃত- শ্রীল অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ ভাষ্যকৃত (প্রকাশনি- ভক্তিবেদান্ত বুক ট্রাস্ট, ইস্কন, মায়াপুর, ভারত)
।। বন্দে গুরু পরম্পরা, মধ্ব-গৌড়ীয় পরম্পরা, জয় বৈষ্ণব পরম্পরা ।।
নিবেদক-
ব্রজসখা দাস