আমাদের এই পেজের উদ্দেশ্য বহুবিধ। তন্মধ্যে অন্যতম, অপসিদ্ধান্তের প্রচারকে সদর্থক ভঙ্গিতে খন্ডন করার পাশাপাশি সৎসিদ্ধান্তের প্রচার। তাই দুষ্টাত্মাদের জবাব ইতিমধ্যেই দেওয়া শুরু হয়েছে এবং আচার্যকৃপা সাপেক্ষে ক্রমশ চলতেও থাকবে। এর পাশাপাশি প্রকৃত রূপানুগ ভক্তিসিদ্ধান্তের যথাযথ প্রচারের চেষ্টা করব আমরা।
আমরা ঠিক করেছি কয়েকটি পর্বে “গৌড়ীয় দর্শনে বেদ” এই বিষয়ে একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করা হবে।
আপনারা, অদোষদর্শী বৈষ্ণবগণ, তাই ভুল ত্রুটি হলে ক্ষমা করবেন।
********************************************
।।গৌড়ীয় দর্শনে বেদ।।
(পর্ব ১)
===================================
“তা বাং বাস্তূন্যুশ্মসি গমধ্যে যত্র গাবো ভূরিশৃঙ্গা অয়াসঃ।
অত্রাহ তদুরুগায়স্য বিষ্ণো পরমং পদমবভাতি ভূরি।।” (ঋগ্বেদ, ১ম মণ্ডল, ১৫৪ সূক্ত, মন্ত্র ৬)
– “তোমাদের উভয়ের (রাধাকৃষ্ণ যুগলের) গৃহসমূহে স্থান পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা করি যেসব গৃহে সুন্দর সুন্দর গাভী সর্বপ্রকার সুখ প্রদান করে, সেই ধামে প্রচুর কীর্তিশালী সর্বকামনা বর্ষণশীল শ্রীকৃষ্ণের নিজধাম (নন্দগৃহ) বহুভাবে সর্বদা নিত্য প্রকাশিত।” ( শ্রীমদ্ভাগবতমের ১০|৮৭|১৮ শ্লোকের “বৃহদ্বৈষ্ণব তোষণী” টীকায় শ্রীল সনাতন গোস্বামী কৃত ব্যাখ্যার বঙ্গানুবাদ)
:::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::
বেদের গৌড়ীয় দর্শন বা শ্রীমন্মহাপ্রভুর অচিন্ত্য ভেদাভেদতত্ত্বের বিষয়ে আলোকপাত করার পূর্বে বেদ কি বা বেদের সংজ্ঞা কি সেই বিষয়ে কিছু প্রাথমিক এবং আবশ্যিক জ্ঞানের প্রয়োজন মানি। সেই হেতু প্রথম পর্বে বেদের সংজ্ঞা এবং বিভাগ সম্বন্ধে আমরা আলোচনা করব।
বেদের সংজ্ঞা এবং ইতিবৃত্ত :
“বেদ” শব্দটির উদ্ভব হয়েছে “বিদ্” ধাতু থেকে। সাধারণত “বিদ্” ধাতুর অর্থ “জানা বা অনুভব করা”। “বেদয়তি ধর্ম্মং ব্রহ্ম চ বেদঃ” -অর্থাৎ যে শাস্ত্র হতে ধৰ্ম্ম ও ব্রহ্মতত্ত্বকে জানতে পারি, তাকেই “বেদ” বলে।
শ্রীল জীব গোস্বামীর বর্ণনায় পাই : “যশ্চানাদিত্বাৎ স্বয়মেব সিদ্ধঃ, স এব নিখিলৈতিহ্যমূলরূপো মহাবাক্য সমুদায়ঃ শব্দহত্র গৃহ্যতে, স চ শাস্ত্রমেব, তচ্চ বেদ এব – স বেদসিদ্ধঃ, য এব সর্ব্বকারণস্য ভগর্বতোনাদিসিদ্ধং পুনঃ সৃষ্ঠ্যাদৌ তস্মাদেবাবিভুর্তমপৌরষেয়ং বাক্যম, তদেব ভ্রমাদি-রহিতং সম্ভাবীতং, তচ্চ সর্ব্বজনকস্য তস্য চ সদোপদেশায়াবশ্যকং মন্তব্যং, তদেব চাব্যভিচারিপ্রমাণম। “
অর্থাৎ- যা অনাদি ও স্বয়ংসিদ্ধ, নিখিল ঐতিহ্য, প্রমাণ মূলরূপ সেই মহা বাক্য সমুদায়ই এখানে “শব্দ”রূপে গৃহীত হয়েছে। এই শব্দই শাস্ত্র নামে প্রচারিত এবং একেই “বেদ” বলে।
“বেদ” হল অনাদিসিদ্ধ এবং জগৎ সৃষ্টির সময় পরমেশ্বর ভগবান শ্রী কৃষ্ণ হইতে বারংবার আবির্ভূত অপৌরুষেয় বাক্যসমুদায়। ভগবান শ্রী কৃষ্ণের পুরুষাবতার শ্রীমন্নারায়ণের শ্বাস থেকে বেদ প্রকাশিত হয় তাই এটি অপৌরুষেয়। যেহেতু বেদ প্রত্যক্ষভাবে শ্রীভগবান হতে প্রকাশিত এবং সেই সময়ের অত্যন্ত মেধাবী সাধুগণ এই জ্ঞান বছরের পর বছর তাঁদের হৃদয়ে যথাযথভাবে ধরে রাখতে পারতেন, সেহেতু এই অপৌরুষেয় বেদকে লিপিবদ্ধ করার কোন প্রয়োজন ছিলনা।
কিন্তু দ্বাপরের শেষভাগে মনুষ্যের মেধাশক্তি হ্রাস পেতে থাকে; ফলে এই দিব্য জ্ঞানগঙ্গা যা সৃষ্টির শুরু থেকে তখনও পর্যন্ত সাধুজনের হৃদয়ের মাধ্যমে প্রবাহিত হত- সেই প্রবাহমানতায় ছেদ পড়ে।
এছাড়াও আগতপ্রায় অধর্ম এবং স্বল্প মেধার যুগ কলি তখন শক্তি সংগ্রহ করে তার করাল গ্রাসে সসাগরা মেদিনী আগ্রাসনে মত্ত। এইসমস্ত বিষয় বিবেচনা করে ভগবান কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাস অপৌরুষেয় শাস্ত্রাবতার বেদকে “ঋক, সাম, যজুঃ এবং অথর্ব” এই চারটি ভাগে বিভক্ত করেন এবং ভবিষ্যত স্বল্প মেধাসম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্য তা লিপিবদ্ধ করলেন।
পরমব্রহ্মের শব্দময় শাস্ত্রাবতারই হলো বেদ।
সাধারণত বেদের শ্লোক ছন্দময়। এইরকম ছন্দময় শ্লোককে বেদে “মন্ত্র” বলে আখ্যায়িত করা হয় এবং মন্ত্রের সমষ্টিকে “সূক্ত” বলা হয়।
বেদের বিভাগ : এই অপৌরুষেয় শব্দবতার বেদ চারভাগে বিভক্ত।
১) সংহিতা : সূক্তের সমষ্টি বেদে “সংহিতা” নামে পরিচিত।
২) ব্রাহ্মণ : এই অংশে বিভিন্ন যজ্ঞের মন্ত্র এবং নিয়মাদি উল্লিখিত।
৩) আরণ্যক : চতুরাশ্রমের অন্যতম বানপ্রস্থাশ্রমে ব্রহ্ম চিন্তার বিষয়াদি এখানে বর্ণিত।
৪) উপনিষদ : এটি বেদের শেষ অংশ এবং “বেদান্ত” নামে পরিচিত। বেদের শেষ বা অন্তিম বা অন্ত অংশ এবং সম্পূর্ণ বেদের চরম ও পরম সিদ্ধান্ত এই অংশেই উপলব্ধ হয় তাই উপনিষদকে “বেদান্ত” বলা হয়েছে। “উপনিষদ” শব্দের অর্থ হলো : “ব্রাহ্মণ উপ সমীপে নিষিদতি অনয়া ইত্যুপনিষদ” -অর্থাৎ যে শাস্ত্রের সাহায্যে সাধক মুক্ত হয়ে ভগবানের সমীপে উপস্থিত হোতে সমর্থ হন সেটিই উপনিষদ।
“বেদান্ত সূত্র” : ভগবান ব্যাসদেব উপনিষদ বা বেদান্তের জটিল তাৎপর্য গুলি সূত্রাকারে সুসংবদ্ধভাবে গুম্ফিত করেন। এটিই “বেদান্ত সূত্র” বা “ব্রহ্ম সূত্র” নামে পরিচিত। অর্থাৎ শ্রীল ব্যাসদেব শ্রুতি শাস্ত্রের চরম তাৎপর্য সূত্রাকারে উপস্থাপন করলেন বলে এটি “বেদান্ত সূত্র”। আবার বেদের সমস্ত মীমাংসা এই সূত্রের মধ্যে পাওয়া যায় বলে এটিকে “উত্তরমীমাংসা” বা “মীমাংসাশাস্ত্র” বলেও অভিহিত করা হয়।
বেদান্ত সূত্রের রচনার পর ভগবান ব্যাসদেব অনুধাবন করেন যে, এই “বেদান্ত সূত্র” তত্ত্ব জ্ঞান লাভ করার পক্ষে যথেষ্ট প্রামানিক শাস্ত্র হলেও সূত্রার্থ নির্ণয় বিষম দুরূহ, এছাড়াও পরবর্তীকালে বিভিন্ন ব্যক্তি নিজ নিজ মতে ব্রহ্মসূত্রের মনগড়া ব্যাখ্যা করতে পারে। শ্রীল ব্যাসদেব এই সমস্যার সমাধানার্থে নিজ গুরুদেব শ্রীল নারদ মুনির শরণাপন্ন হন এবং সমাধিস্থ অবস্থায় তত্ত্ব দর্শনপূর্বক বেদান্ত/ব্রহ্ম সূত্রের অকৃত্রিম ভাষ্য “শ্রীমদ্ভাগবতম্” রচনা করেন।
চিত্রে : “বদরিকাশ্রমে ভগবান ব্যাস শ্রীমধ্বকে বেদান্তশিক্ষা দিচ্ছেন”
(চলবে…….)