প্রভু কহে, বেদান্তসূত্র – ঈশ্বর বচন।
ব্যাসরূপে কৈল তাহা শ্রীনারায়ণ।।
ভ্রম, প্রমাদ, বিপ্রলিপ্সা, করণাপাটব।
ঈশ্বরের বাক্যে নাহি দোষ এই সব।।
(চৈ: চ: আদি)
**************************
পূর্ববর্তী পর্বে আমরা বেদ সম্বন্ধে কিছু আলোচনা করার চেষ্টা করেছি। সেখানে বেদান্ত সূত্র সম্বন্ধেও কিছু আলোচনা হয়েছিল, আজকের পর্বে আমরা বেদান্ত সূত্রের প্রসঙ্গ ধরেই চার সুবৃহৎ বৈষ্ণব মহাসম্প্রদায়ের বেদান্ত ভাষ্য এবং অদ্বৈত মায়াবাদী ভাষ্য সম্বন্ধে আলোচনা করার চেষ্টা করব।
বেদান্ত সূত্রে অর্থবাদ আরোপিত হতে পারে ভেবে শ্রীল কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস নিজ গুরুদেবের নির্দেশে সমাধিস্থ অবস্থায় ব্রহ্মসূত্রের অকৃত্রিম এবং যথাযথ ভাষ্য শ্রীমদ্ভাগবত রচনা করেন। শ্রীমন্মহাপ্রভু এবং তদনুগত গোস্বামীগণও শ্রীমদ্ভাগবতকেই বেদান্তের যথার্থ ভাষ্য বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন।
দুর্ভাগ্যবশত, বর্তমানে বেদান্ত সূত্র বা বেদান্ত সূত্রের ভাষ্য বলতে অনেকেই উপযুক্ত জ্ঞানের অভাবে শ্রীল শঙ্করাচার্য অদ্বৈতবাদী “শারীরক ভাষ্যকেই” বোঝেন। তাঁরা এটা জানেন না যে আচার্য শঙ্করের বহু আগেই রুদ্র সম্প্রদায়ের আচার্য শ্রীল বিষ্ণুস্বামী বেদান্ত ভাষ্য রচনা করেন। শঙ্করোত্তর সময়ে যথাক্রমে শ্রী, মাধ্ব এবং গৌড়ীয় সম্প্রদায়ের বৈষ্ণবাচার্যগণ পৃথক পৃথক দ্বৈতবাদী দর্শন দ্বারা ব্রহ্ম সূত্রের ভাষ্য রচনা করেছেন এবং শঙ্করের অদ্বৈতবাদ পুনঃ পুনঃ খন্ডন করেছেন।
• পদ্মপুরাণে উল্লিখিত বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের দ্বৈতবাদী “বেদান্ত দর্শন”:
• বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ (শ্রী সম্প্রদায়):
শ্রী সম্প্রদায় আচার্য শেষাবতার শ্রীল রামানুজাচার্য বেদান্ত সূত্রের যে ভাষ্য রচনা করেন সেটি “শ্রীভাষ্য” নামে খ্যাত। তাঁর দর্শন বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ নামে পরিচিত।
এই মতানুসারে পরম ব্রহ্মের অদ্বয়ত্ব স্বীকার করা হয়েছে- পরব্রহ্ম এক। “চিদচিদবিশিষ্টাদ্বৈতং তত্ত্বম্” অর্থাৎ চিৎ ও অচিৎ ব্রহ্মের একত্বই বিশিষ্ট অদ্বৈত তত্ত্বের প্রতিপাদ্য।
তাঁর মতে এই অদ্বয় ব্রহ্ম বিশেষ বিশেষণযুক্ত বা বিশিষ্ট। চিৎ, অচিৎ এবং ঈশ্বর এই তিনটি তত্ত্ব বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ দর্শনে উল্ল্যেখ করা হয়েছে। “চিৎ” শব্দে জীবাত্মাকে বোঝানো হয়েছে, অচিৎ শব্দে “জড়” এবং “ঈশ্বর” শব্দে চিৎ ও অচিৎ তত্ত্বের পরম নিয়ন্ত্রক পরম পুরুষোত্তম শ্রীমন্নারায়ণ। চিৎ ও অচিৎ সগুণ ব্রহ্মের বিশেষণ এবং ঈশ্বর হলেন বিশেষ বা বিশিষ্ট। চিৎ-অচিৎ বিশেষণযুক্ত একাত্ম অদ্বৈত ব্রহ্ম বা ঈশ্বরকে বিশ্লেষণ করার জন্য এই দর্শনকে বিশিষ্ট অদ্বৈতবাদ বলা হয়। পরমব্রহ্ম, পরমাত্মা বা ঈশ্বর পূর্ণতম, সর্বব্যাপী এবং অখন্ড চেতন কিন্তু জীবাত্মা পরমাত্মার নিত্য অংশ হলেও সেটি খন্ড চেতন। আত্মা এবং পরমাত্মা তত্ত্ব তত্ত্বগতভাবে সমান হলেও আত্মা অণুসদৃশ তাই পরমাত্মার সাথে সেটি কখনোই একত্ব নয়। এই জায়গাতেই শ্রীল রামানুজাচার্যের এই মতবাদের সাথে গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের অচিন্ত্য ভেদ অভেদ তত্ত্বের মিল পাওয়া যায়।
(চলবে…)
পর্ব : ১ এর লিঙ্ক