- হিন্দুরা কেন গরুকে মা বলে?
- গরুর দুধ খেলেও, মাংস কেন খাও না?
- গরুর চামড়ার তৈরি পণ্য কেন ব্যবহার করেন?
- শাস্ত্রে কোথায় গোহত্যা নিষিদ্ধ?
বিধর্মীদের দ্বারা কথিত এমন প্রশ্নের সম্মুখীন হন না এমন কোনো হিন্দু মানুষ খুজে পাওয়া দুষ্কর। কেউ আবার এসব প্রশ্নের যথার্থ উত্তর না জানার ফলে হীনমন্যতায় ভুগেন ও স্বধর্মের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলেন। এভাবে ধীরে ধীরে কারও মানসিকতা ধর্মান্তরের দিকে এগোতে থাকে। কারণ বিধর্মীদের এমন সামান্য কিছু প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারায় বিধর্মীরা এই সুযোগে তাদের ধর্মের গুন গেয়ে বৈদিক ধর্ম সম্পর্কে অপব্যাখ্যা করে মগজ ধোলাই করে ধর্মান্তরিত করতে থাকে। তাই এসব প্রশ্নের উত্তর জানতে, নিজ বিশ্বাসকে শক্তিশালী করতে ও নিন্দুকদের দাঁতভাঙা জবাব দিতে পড়ুন .
- প্রশ্ন- হিন্দুরা কেন গরুকে মা বলে?
গাভীকে কেন মা’’ ডাকা হয়; যেহেতু বিধর্মীরা সম্পূর্ণভাবে তমগুনাচ্ছন্ন হওয়ার ফলে এই দৃষ্টিভঙ্গির যথার্থতা বিশ্লেষণে সক্ষম নয়, তাই আদিযুগ থেকেই তাদের এমন প্রশ্ন ছিলো। চৈতন্য চরিতামৃত আদিলীলা/১৭/১৫৩ নং শ্লোকে মুসলমান চাঁদকাজির সাথে বিতর্কের মধ্যে উক্ত প্রশ্নের খুব সুন্দর যৌক্তিক উত্তর দেখা যায়। মহাপ্রভু তাকে বলেছেন-
প্রভু কহে, গোদুগ্ধ খাও, গাভী তোমার মাতা।
বৃষ অন্ন উপজায়, তাতে তেঁহো পিতা ॥১৫৩৷৷সরলার্থ: মহাপ্রভু বললেন, “আপনি গরুর দুধ খান; সেই সূত্রে গাভী হচ্ছে আপনার মাতা। আর বৃষ (ষাড়) অন্ন উৎপাদন করে, যা খেয়ে আপনি জীবন ধারণ করেন; সেই সূত্রে সে আপনার পিতা।
তাই গরু গাভী কিংবা ষাড়, বৈদিক সভ্যতার গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। বলা বাহুল্য কেবল (গোমাতা) গরুকেই মা ডাকা হয় বিষয়টি এমন নয়। পবিত্র “বেদ’’ আমাদেরকে মনুষ্যত্বের অধিকারী ও বিবেকবান হতে শেখায় তাই বেদ শাস্ত্রে ০৭ (সাত) ধরণের মায়ের উল্লেখ দেখতে পাওয়া যায়। চাণক্য পণ্ডিত বলেন-
“আদৌ-মাতা গুরুঃ পত্নী ব্রাহ্মণী রাজ-পত্নীকা।ধেনর ধাত্রী তথা পৃথ্বী সপ্তেতা মাতর স্মৃতা ॥”
১) জন্মদাত্রী
২) ধাত্রী
৩) ধরিত্রী
৪) গোমাতা
৫) বেদমাতা
৬) ব্রাহ্মণ পত্নী
৭) রাজমাতা
তার মধ্যে গাভী বা গোমাতা অন্যতম। গরুকে মা’’ বলা হয়, বিষয়টি ব্যাখ্যা করলে দেখা যায়- জন্মের পর থেকে আমরা মায়ের দুধ খাই ২-৩ বছর পর্যন্ত অতঃপর, আমাদের পুষ্টি নির্ভর করে গাভীর দুধের উপর। গরুর দুধের চেয়ে উৎকৃষ্ট দুধ আর নেই। বুদ্ধিমান মানুষ মাত্রই তা জানেন। যেহেতু, মায়ের দুধের বিকল্প হিসেবে গরুর দুধই আমাদের পুষ্টি যোগায় সেহেতু, এমন উপকারী গাভীকে মায়ের সম্মান প্রদর্শন করার বিষয়টি বৈদিক শাস্ত্রে দেখতে পাওয়া আশ্চর্যজনক কিছু নয়! বরং বিবেকবান ব্যক্তি মাত্রই গাভীকে মায়ের সম্মান প্রদর্শন করেন।
- প্রশ্ন- গরুর দুধ খেলেও, মাংস কেন খাও না?
যেকেউ’ই মায়ের দুধ পান করে বড় হয়, কিন্তু তাই বলে কি সে মায়ের মাংস ভক্ষন করে?!?
না, কখনই করে না। তো কিভাবে যাঁকে মা’’ বলে সম্মান প্রদর্শন করা হয় তাকে হত্যা করে তার মাংস ভক্ষণ করে কেউ? এটা পাশবিক ও বর্বরতা ছাড়া কিছুই হতে পারে না।
- এখন ভাবতে পারেন তাহলে ষাড় গরু হত্যা/ভক্ষণ করা যেতে পারে?
এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু চাঁদকাজীকে আরও কয়েকটি প্রশ্ন করেছিলেন–
পিতা – মাতা মারি’ খাও এবা কোন্ ধর্ম।
কোন্ বলে কর তুমি এমত বিকর্ম ॥১৫৪॥
সরলার্থ: যেহেতু বৃষ ও গাভী আপনার পিতা ও মাতা, তা হলে তাদের হত্যা করে তাদের মাংস খান কি করে? এটি কোন ধর্ম? কার বলে আপনি এই পাপকর্ম করছেন? (চৈতন্য চরিতামৃত: আদিলীলা/১৭/১৫৪)
পূর্বোক্ত চৈতন্য চরিতামৃত বর্ণনায় আমরা দেখতে পেয়েছি বৃষকে কেন পিতার সাথে তুলনা করা হয়েছে। তো একটু গভীর দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দেখুন বৈদিক সভ্যতায় জমি চাষাবাদের জন্য বৃষ (ষাড়) ব্যবহৃত হয়। গাভী যেমন মায়ের পরিপূরক হিসেবে আমাদের দুধ প্রদান করেন এবং তেমনিভাবে পরিবারে পিতা যেমন কঠোর পরিশ্রম করে খাদ্যের যোগান দেন সেভাবে একটি ষাড় জমি চাষবাসের দ্বারা খাদ্য উৎপাদনে সহযোগিতা করে, তাই বৃষকে পিতা বলা হয়। বেদে গোহত্যা ষাড় হউক বা গাভী অর্থাৎ, গরুকে হত্যা করা কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে।
যদি কোনো সংস্কৃতি এমন উপকারী প্রাণীকে হত্যা করে তার মাংস ভক্ষণ করতে শিখায়, সেটা কোনো সভ্য সংস্কৃতি হতেই পারে না। অতএব, বৈদিক শাস্ত্র আমাদের উপকারীর উপকার শিকার করতে শিখায়। যে গরু/গাভী আমাদের এহেন উপকার করে তাকে আমরা হত্যা করতে পারিনা। এজন্যই বৈদিক সংস্কৃতি, শিক্ষা মহান!
- প্রশ্ন- গরুর চামড়ার তৈরি পণ্য কেন ব্যবহার করেন?
সোজা উত্তর- যারা ধর্ম জানেন, সাধুরা গরুর চামড়ার তৈরি পণ্য ব্যবহার করেন না। কোনো ব্যক্তি যদি করে থাকে তবে সেটা তার ব্যাক্তিগত অজ্ঞতার কারণে, বিশেষ কোনো পরিস্থিতির কারণে কিংবা নিজের ইন্দ্রিয়তৃপ্তির জন্য ব্যবহার করেন।
তবে শাস্ত্রে গো থেকে প্রাপ্ত সমস্ত কিছুকেই পরম পবিত্র ঘোষণা করা হয়েছে। তেমনি গো চর্মকেও পবিত্র বলা হয়েছে। মৃদঙ্গে তা ব্যবহৃত হয়, যে মৃদঙ্গ ভগবদ্কীর্তনে ভগবানের প্রীতি বিধানে বাদিত হয়। এক্ষেত্রে, বোঝার বিষয় হচ্ছে- চামড়া সংগ্রহের উদ্দেশ্যে গোহত্যা করা হয়না, কিংবা কারও ব্যক্তিগত ইন্দ্রিয় উপভোগের জন্য তা করা হয়না। প্রাকৃতিকভাবেই মৃত গরুর চর্ম মৃদঙ্গে ব্যবহৃত হয়। সুক্ষ্ম বিষয়টি হচ্ছে, সেই গরু যাঁর শরীরের চর্ম ভগবানের প্রীতি বিধানার্থে ব্যবহৃত মৃদঙ্গে যুক্ত হয়, সেটা তার জন্য পরম সৌভাগ্যজনক।
- প্রশ্ন- শাস্ত্রে কোথায় গোহত্যা নিষিদ্ধ?
বেদ শাস্ত্রে গোহত্যা বিষয়ে কঠোরভাবে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে এবং গোহত্যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ বটে। পাশাপাশি বৈদিক শাস্ত্রে যেকোনো পশুকে নির্বিচারে হত্যা কিংবা তার মাংস ভক্ষণে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। নিম্নরূপ-
গোমাতাকে কোন কারণে হত্যা করা যাবে না, তাদের জল, সবুজ তৃণ দিয়ে সমৃদ্ধ করতে হবে। (ঋগ্বেদ: ১/১৬৪/৪০)
“যিনি রুদ্রগণের মাতা, বসুগণের দুহিতা, আদিত্যের ভগিনী, অমৃতের আবাস্থল, হে জলগণ! সেই নির্দোষ অদিতি গো’দেবীকে (গাভী) হিংসা (হত্যা) করিও না।” (ঋগ্বেদ: ৮/১০১/১৫)
“হে অঘ্না (বধের অযোগ্য) গাভী! তুমি সর্বদা তৃণ ভক্ষণ পূর্বক বিচরণ করতে থাকো এবং শুদ্ধ জল পান করতে থাকো।” (অথর্ববেদ: ৭/৭৩/১১)
“গাভীর মাংস ভক্ষণ অনুচিত” (অথর্ববেদ: ৯/৮/৯)
“গাভী অবধ্য অর্থাৎ, হত্যার অযোগ্য” (অথর্ববেদ: ৬/৭০/১,২)
“গাভীর অপর নাম অঘ্ন্যা, এরা অবধ্য অর্থাৎ হত্যার অযোগ্য। যে এই সকল গাভী ও বৃষকে হত্যা করে সে মহাপাপ করে।” (মহাভারত: শান্তিপর্ব/২৬২/৪৭)
“যে মানুষ শাস্ত্রীয় নিষেধ অগ্রাহ্য করিয়া মাংস বিক্রয়ের জন্য গো’বধ করে কিংবা গো-মাংস ভক্ষণ করে অথবা যাহারা মাংসার্থী হইয়া গো’বধের জন্য গো’ঘাতককে অনুমতি করে; তাহাদের মধ্যে ঘাতক, খাদক ও অনুমতিদাতা সেই গরুর যতগুলি লোম থাকে, তত বৎসর নরকে নিমগ্ন থাকে॥” (মহাভারত: অনুশাসন পর্ব/৫৯/৬৫,৬৬)
“গাভী ও ষাঁড় কদাপি ভক্ষণযোগ্য নয়।” (শতপথ ব্রাহ্মণ: ৩/১/২/২১)
অথর্ববেদ ২য় কান্ড ২৬ নং সূক্তে গো তথা পশুদিগকে রক্ষার বিষয়ে বর্ণনা রয়েছে এবং অথর্ববেদ: ৭ম কাণ্ড ৭৫ নং সূক্তে গাভীকে যত্ন করে পালন ও যেন কোনোভাবে কারো আক্রমনের শিকার যেন না হয় তার বর্ণনা দেখা যায়। এছাড়াও বৈদিক শাস্ত্রসমূহের অজস্র জায়গায় গোহত্যা নিষিদ্ধ করা হয়েছে ও নিষেধাজ্ঞার যথার্থ কারণও বর্ণিত রয়েছে।
এইতো সেদিন ৫’’শ বছর পূর্বে বেদ শাস্ত্রের অগাধ ও অপ্রতিরোধ্য পাণ্ডিত্যের অধিকারী শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু নবাব চাঁদকাজীর সাথে বিতর্ককালে বলেছেন-
“গো-অঙ্গে যতলোম, তত সহস্র বৎসর।
গোবধী রৌরব মধ্যে পচে নিরন্তর।।”
– (চৈ:চ: আদি: ১৭/১৬৬)
সরলার্থ: “যে ব্যক্তি গো/গরু হত্যা করে, তাদের সকলকেই সেই নিহত গরুর লোম পরিমিত বৎসরকাল রৌরব নরকে নিমগ্ন থাকতে হয়”
।। হরেকৃষ্ণ ।।
– প্রবীর চৈতন্যচন্দ্র দাস
তথ্যসূত্রঃ
১। ঋগ্বেদ- দিলীপ মুখোপাধ্যায়; রমেশচন্দ্র দত্ত,
২। অথর্ববেদ- দিলীপ মুখোপাধ্যায়,
৩। মহাভারত- হরিদাস সিদ্ধান্ত বাগীশ ভট্টাচার্য
৪। চৈতন্য চরিতামৃত- বিবিটি (দি ভক্তিবেদান্ত বুক ট্রাস্ট)