- বেদের প্রতিপাদ্য একমাত্র শ্রীকৃষ্ণ। তাঁর উপাসনাই জীবের পরম ধর্ম। বেদে তিনি বিভিন্ন নামে কীর্তিত হয়েছেন।
ঈশ্বর একজনই আর এতে কোন সন্দেহ নেই। প্রকৃতপক্ষে দ্বন্দ্বসমূহ মনুষ্যসৃষ্ট, ঈশ্বর সৃষ্ট নয়। বলা হয় যে, ‘নানা মুনির নানা মত। কোন মুনির মত যদি অন্য মুনির থেকে স্বতন্ত্র না হয়, তবে তাঁকে যথার্থ মুনি বলা যায় না।
নাসাবৃষির্যস্য মতং ন ভিন্নম্।।
– (মহাভারত, বনপর্ব ৩১৩/১১৭)
কিন্তু ভগবান এখানে বলেছেন, স্থিতধীমুনি সাধারণ মুনিদের থেকে ভিন্ন। স্থিতধীমুনি সর্বদাই কৃষ্ণভাবনায় মগ্ন, কেন না তিনি জল্পনা-কল্পনামূলক সমস্ত কার্যকলাপের পরিসমাপ্তি করেছেন। তাঁকে বলা হয় প্রশান্ত-নিঃশেষ-মনোরথান্তর (স্তোত্ররত্ন, ৪৩), অথবা যিনি জল্পনা-কল্পনার স্তর অতিক্রম করে উপলব্ধি করতে পেরেছেন যে, বসুদেব-তনয় ভগবান বাসুদেব বা শ্রীকৃষ্ণই হচ্ছেন সবকিছু (वासुदेव: सर्वमिति स महात्मा सुदुर्लभ: ॥বাসুদেবঃ সর্বমিতি স মহাত্মা সুদুর্লভঃ)। তাঁকে বলা হয় মুনি, যাঁর মন একনিষ্ঠ। তিনি জানেন যে বেদে সর্বদেবতার উপাস্য ভগবান রূপে শ্রীবিষ্ণুকে স্তুতি করা হয়েছে, যেমন ঋগ্বেদে (১/২২/২০) বলা হয়েছেঃ
तद्विष्णो॑: पर॒मं प॒दं सदा॑ पश्यन्ति सू॒रय॑: । दि॒वी॑व॒ चक्षु॒रात॑तम् ॥
ওঁ তদ্বিষ্ণোঃ পরমং পদং সদা পশ্যন্তি সূরয়……..“পরমেশ্বর বিষ্ণুই হচ্ছেন পরম সত্য, সুরগণ তাঁর পাদপদ্ম দর্শনে সর্বদা উদগ্রীব। সূর্যের মতোই ভগবান তাঁর শক্তিরাজির বিস্তার করে সর্বত্র ব্যাপ্ত আছেন। শ্রীবিষ্ণু শ্রীকৃষ্ণেরই প্রকাশ বা বিস্তার, শাস্ত্রের সিদ্ধান্ত, যেমন সকল বেদ-উপনিষদের সার গীতোপনিষদ (সর্বোপনিষদো গাবো), ভগবদগীতায় শ্রীকৃষ্ণকে বিষ্ণু বলে সম্বোধন করা হয়েছেঃ শমং চ বিষ্ণো (शमं च विष्णो)— ১১/২৪, প্রতপন্তি বিষ্ণো (प्रतपन्ति विष्णो)— ১১/৩০, আদিত্যানাম্ অহং বিষ্ণু (आदित्यानामहं विष्णु)— ১০/২১ ইত্যাদি। শ্রীকৃষ্ণই শ্রীবিষ্ণুরূপে সর্বজীবের অন্তরস্থিত পরমাত্মা— অহমাত্মা গূঢ়াকেশ সর্বভূতাশয়স্থিতঃ (अहमात्मा गुडाकेश सर्वभूताशयस्थित:।)– ১০/২০। বিষ্ণুমূর্তি-সমূহ, রাম-নৃসিংহ ইত্যাদি অবতার ভগবান শ্রীকৃষ্ণেরই প্রকাশ, অংশ, কলা (রামাদিমূর্তিষু কলানিয়মেন তিষ্ঠন্ – ব্রহ্মসংহিতা ৫/৩৯)। শ্রীকৃষ্ণই স্বয়ং ভগবান (এতে চাংশ কলাঃ পুংসঃ কৃষ্ণস্তু ভগবান্ স্বয়ম্/ एते चांशकला: पुंस: कृष्णस्तु भगवान् स्वयम् । – শ্রীমদ্ভাগবত ১/৩/২৮)। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ পূর্ণপরাৎপর পুরুষ, সেজন্য তাঁর থেকে অসংখ্য ভগবৎ-রূপ বিস্তার হলেও তিনি তাঁর পূর্ণস্বরূপে নিত্যবিরাজমান। যেমনটা শ্রীবৃহদারণ্যক উপনিষদে (৫/১/১) উল্লেখ করা হয়েছে,
ॐ । पूर्णमदः पूर्णमिदं पूर्णात्पूर्णमुदच्यते ।
पूर्णस्य पूर्णमादाय पूर्णमेवावशिष्यते ॥
ওঁ পূর্ণমদঃ পূর্ণমিদং পূর্ণাৎ পূর্ণমুদচ্যতে ।
পূর্ণস্য পূর্ণমাদায় পূর্ণমেবাবশিষ্যতে ।।
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় (৭/৭, ১৫/১৫) ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন:
मत्त: परतरं नान्यत्किञ्चिदस्ति धनञ्जय ।
“মত্তঃ পরতরং নান্যৎ কিঞ্চিদস্তি ধনঞ্জয়”।
वेदैश्च सर्वैरहमेव वेद्यो वेदान्तकृद्वेदविदेव चाहम् ॥
“বেদৈশ্চ সর্বৈরহমেব বেদ্যঃ বেদান্তকৃদ্ বেদবিদেব চাহম্”। ইত্যাদি..
( হে ধনঞ্জয় ! আমা অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ আর কেহ নাই। আমিই সমস্ত বেদের জ্ঞাতব্য, আমিই বেদান্তকর্তা ও বেদবিৎ )
শ্রীগোপাল পূর্বতাপনী উপনিষদ ২১ মন্ত্রে বলেন-
“তস্মাৎ কৃষ্ণ এব পরো দেবস্তং ধ্যায়েৎ।
তং রসেৎ তং ভজেৎ তং যজেৎ।।
একা বশী সর্বগঃ কৃষ্ণ ঈড্য
একোপি সন্ বহুধা যো বিভাতি।
তং পীঠস্থং যে তু ভজন্তি ধীরাস্তেষাং সুখং শাশ্বতং নেতরেষাম্।।”
সেইজন্য শ্রীকৃষ্ণই পরমেশ্বর, সেই শ্রীকৃষ্ণকেই ধ্যান করিবে, তাঁর নামই সংকীর্তন করবে (সততং কীর্তয়ন্তো মাং) তাঁকেই ভজন করবে, পূজা করবে। সর্বব্যাপী, সর্ববশকর্তা শ্রীকৃষ্ণই একমাত্র সকলের পূজ্য। তিনি এক হয়েও মৎস-কূর্মাদি, বাসুদেব সঙ্কর্ষণাদি, কারণার্ণব-গর্ভোদকাদি বহুমূর্তিতে প্রকাশমান হন। শুকদেবাদির ন্যায় যে সকল ধীর পুরুষ তাঁর পীঠমধ্যে অবস্থিত শ্রীমূর্তির পূজা করেন, তাঁরাই নিত্য সুখ লাভে সমর্থবান হন।
তত্র কারিকা–
“কৃষ্ণাংশঃ পরমাত্মা বৈ ব্রহ্ম তজ্জ্যোতিরেব চ।
পরব্যোমাধিপস্তস্যৈশ্বর্যমূর্তির্নসংশয়ঃ।।”
শ্রীকৃষ্ণই একমাত্র সর্বেশ্বর। পরমাত্মা তাঁর অংশ, ব্রহ্ম তাঁর জ্যোতি। পরব্যোমনাথ শ্রীনারায়ণ তাঁরই ঐশ্বর্যবিলাসমূর্তিবিশেষ। এই সিদ্ধান্তে কিছু মাত্র সংশয় নাই ; যেহেতু বেদাদি শাস্ত্র ইহাই নির্দেশ করছেন।
যথা তৈত্তিরীয়ে ২/১/২–
“সত্যং জ্ঞানমনস্তং ব্রহ্ম। যো বেদনিহিতং গুহায়াং পরমে ব্যোমন্। সোঽশ্লূতে সর্বান্ কামান সহ। ব্রহ্মণা বিপশ্চিতেতি।।”
( সত্য স্বরূপে, চিন্ময়, অসীমতত্ত্বই “ব্রহ্ম”। চিত্তগুহায় অন্তর্যামীরূপে অবস্থিত তত্ত্বই ” পরমাত্মা”। পরব্যোমে অর্থাৎ বৈকুণ্ঠে অবস্থিত তত্ত্বই “নারায়ণ”। এই তত্ত্ব যিনি অবগত আছেন, তিনি ” বিপশ্চিৎ ব্রহ্ম” অর্থাৎ পরব্রহ্ম কৃষ্ণের সহিত যাবতীয় কল্যাণ গুণ প্রাপ্ত হন।)
- বেদাদি শাস্ত্রে বিভিন্ন নামে শ্রীকৃষ্ণকেই নির্দেশ করেঃ
মহাভারতে শান্তিপর্বে মোক্ষধর্মের ৩২৭ অধ্যায়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলছেন যখন অর্জুন বেদ, পুরাণে ভগবানের যে সকল নাম ( ইন্দ্র, অগ্নি, রুদ্র, বিষ্ণু আদি..), লীলা ঋষিরা উল্লেখ করেছেন তা জানতে চেয়ে।
শ্রীকৃষ্ণ উবাচঃ
“ঋগ্বেদে সযজুর্বেদে তথৈবথর্বসামসু পুরাণে।
সোপনিষদে তথৈব জ্যোতিষে অর্জুন।। ৮।।
সাংখ্যে চ যোগশাস্ত্রে চ আয়ুর্বেদে তথৈব চ।
বহুনি মম নামানি কীর্তিতানি মহার্ষিভিঃ।। ৯।।
গৌণানি তত্র নামানি কর্মজানি চ কানি চিত।
নিরুক্তম কর্মজ্ঞম চ শৃণুস্ব প্রয়াতো অনঘ।।” ১০।।
অর্থাৎ, শ্রীকৃষ্ণ বল্লেন হে অর্জুন! ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, অথর্ববেদ, সামবেদ, পুরাণে, উপনিষদে, জ্যোতিষে, সাংখ্যে শাস্ত্রে, যোগশাস্ত্রে, আয়ুর্বেদে ঋষিরা অসংখ্য যেসব নাম উল্লেখ করেছেন, কিছু নাম আমার স্বরূপ সম্পন্ধিত, কিছু আমার কার্য্য সম্পর্কিত। হে পাপরহিত অর্জুন ! আমি তোমার কাছে সেই সব নাম ও তাদের মাহাত্ম্য বর্ণনা করছি, তুমি তা মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করো।
” নরাণাময়নং খ্যাতমঽমেকঃ সনাতনঃ।
আপো নারা ইতি প্রোক্তা আপো বৈ নরসূনবঃ।
অয়নং মম তৎপূর্বমতো নারায়ণো হ্যহম্।।” ৩৭।।
মুক্তিকালে প্রাণিগণের জীবাত্মার আমিই আশ্রয়স্থান ; এইজন্য এক সনাতন আমিই নারায়ণ। অথবা, নার শব্দের অর্থ জল। যেহেতু জল নরের অর্থাৎ ব্রহ্মের পুত্র। সৃষ্টির পূর্বে সেই নার অর্থাৎ জল আমার আশ্রয় ছিল, এইজন্য আমি নারায়ণ।
“ছাদয়ামি জগদ্বিশ্বং ভূত্বা সূর্য্য ইবাংশুভিঃ।
সর্বভূতাধিবাসশ্চ বাসুদেবস্ততো হ্যহম্।। ৩৮।।
গতিশ্চ সর্বভূতানাং প্রজনশ্চাপি ভারত!।
ব্যাপ্তা মে রোদসী পার্থ ! কান্তিশ্চাভ্যধিকা মম।। ৩৯ ।।
অধিভূতানি চান্তেষু তদিচ্ছংশ্চাস্মি ভারত !।
ক্রমণাচ্চাপ্যহং পার্থ ! বিষ্ণুরিত্যভিসংজ্ঞিতঃ।।” ৪০।।
আমি সূর্যের ন্যায় হয়ে কিরণ দ্বারা সমগ্র জগৎ আচ্ছাদন করি, এই জন্য আমি বাসুদেব। অথবা আমি সর্বভূতের বাসস্থান বলে “বাসুদেব”। ভরতবংশীয় পৃথানন্দন ! আমি সর্বভূতের গতি বলে ” বিষ্ণু” ; কিংবা আমা হতেই সর্বভূত উৎপন্ন হয় বলে আমি “বিষ্ণু” ; অথবা আমি স্বর্গ ও মর্ত্য ব্যাপিয়া রয়েছি বলে “বিষ্ণু” কিংবা প্রলয়কালে আমি নিজদেহে সমস্ত ভূত প্রবেশ করাতে ইচ্ছা করি বলে আমি “বিষ্ণু” ; অথবা আমি বামন রূপে সমগ্র জগৎ আক্রমণ করেছিলাম বলে আমি বিষ্ণু নামে অভিহিত হয়ে থাকি।
স্বর্গ, মর্ত্য ও আকাশবর্তী লোকেরা ইন্দ্রিয়দমননিবন্ধন আমাকে লাভ করবার ইচ্ছা করে, সিদ্ধি কামনা করে সেই জন্য আমি “দামোদর”।। ৪১।।
অন্ন, বেদ, জল ও অমৃতকে ” পৃশ্নি” বলা হয়, সেই অন্ন প্রভৃতি সর্বদাই আমার গর্ভে থাকে ; সেই জন্য আমি “পৃশ্নিগর্ভ”।। ৪২।।
একদা একত ও দ্বিত নামক দুই ভ্রাতা ত্রিত নামক কনিষ্ঠ ভ্রাতাকে কূপমধ্যে নিপাতিত করেছিলেন ; তখন তত্রত্য ঋষিরা আমাকে এইরূপ বলেছিলেন যে, হে পৃশ্নিগর্ভ ! আপনি কূপনিপাতিত ত্রিতকে রক্ষা করুন।। ৪৩।।
তারপর সেই আদিকালে ব্রহ্মার পুত্র ঋষিশ্রেষ্ঠ ত্রিত ” পৃশ্নিগর্ভ” এই নাম কীর্তন করার জন্যই, কূপ হতে উত্থিত হয়েছিলেন।। ৪৪।।
জগতের তাপকারী সূর্য, অগ্নি ও চন্দ্রের যে সকল কিরণ প্রকাশ পায়, সেই গুলিই আমার কেশ। অতএব সর্বজ্ঞ ব্রাহ্মণেরা আমাকে “কেশব” বলেন।।৪৫।।
।।হরে কৃষ্ণ।।
।।প্রণাম।।