শুনতে হয়তো অদ্ভূত লাগতে পারে, আমাদের ধর্মের কোন শাস্ত্রেই ‘হিন্দু’ শব্দের কোন উল্লেখ নেই। বেদেও নেই, স্মৃতিতেও নেই, পুরাণ কিংবা ভারতের আদি ইতিহাস- মহাভারতেও নেই। আরো অদ্ভুত তথ্য হলো- সতের শতকের আগে পর্যন্ত ‘হিন্দু’ শব্দটির কোন অস্তিত্বই ছিলো না। উনিশ শতকের আগে অভিধানে হিন্দু বলে কোন শব্দই ছিলো না। ‘হিন্দু’ শব্দটি অতি আধুনিক শব্দ, অথচ ভারতভূমিতে বসবাসকারী জনগনের বৈদিক সংস্কৃতি এতোই সুপ্রাচীন যে কালের হিসেবে গণনা করা যায় না। আমাদের ধর্মের নাম সনাতন, আরো বিশেষভাবে বললে- সনাতন বৈষ্ণব ধর্ম। আমাদের ধর্ম শাস্ত্রগুলোতে সরাসরিভাবেই এর নামকরণ করা হয়েছে। হিন্দু শব্দটি কেবল জাতি বিশেষকে বুঝায়, ধর্মকে নয়। ধর্ম হিসেবে ব্যবহারের জন্য ‘হিন্দু’ শব্দের ব্যুৎপত্তিই হয় নি, এ শব্দের উৎপত্তি হয়েছিলো বিশেষ জাতিকে বুঝাতে। দীর্ঘ কয়েক শতাব্দী ধরে বিদেশী শাসকদের অধীনে দাস্যত্ব করতে করতে আমরা নিজেদের প্রকৃত পরিচয় ভুলে নিজেদেরকে বিদেশীদের দেওয়া নামে পরিচয় দিতে অধিক গর্ববোধ করি। বিষয়টি খুবই দুঃখজনক।[ পোস্টের শেষাংশে আমাদের ধর্ম কেন ‘হিন্দু’ নয় তা বিস্তারিতভাবে ব্যাখা করা হয়েছে ]
ভগবন্! বৈষ্ণবাধর্ম্মাঃ কিংফলাঃ কিংপরাষণাঃ।কিংধর্ম্মসধিকৃত্যাথ ভবতোৎপাদিতাঃ পুবা ॥৩॥পবিত্রাঃ কিল তে ধর্ম্মাঃ সর্বপাপপ্রণাশনাঃ।সর্বধর্ম্মোত্তমাঃ পুণ্যা ভগবংস্ত্বন্মুখোদ্গতাঃ ॥৫॥[মহাভারত: আশ্বমেধিক পর্ব/১১৭/৩,৫ ]
অনুবাদ: যুধিষ্ঠির বললেন, ” হে ভগবান কৃষ্ণ! বৈষ্ণবধর্মের ফল কি? তাহার আশ্রয় কি? এবং তুমি কোন আচার অবলম্বন করে এই ধর্ম উৎপাদন করেছো? ভগবান! তোমার মুখনির্গত এই বৈষ্ণবধর্ম পবিত্র, সর্বপাপনাশক ও দানধর্ম, অহিংসাধর্ম, পিতৃধর্ম, পতিধর্ম, বর্ণাশ্রম ধর্ম ইত্যাদি যত প্রকার পুন্যধর্ম আছে তা সে ধর্মেরই জাত, তাই এ বৈষ্ণবধর্ম সর্বশ্রেষ্ঠ।”
অনুবাদ: বৈশম্পায়ন বলিলেন—সভায় যুধিষ্ঠির কৃষ্ণকে এইরূপ বলিলে, তপস্বী ও তত্ত্বদর্শী বসিষ্ঠপ্রভৃতি মুনিগণ এবং ভগবদ্ভক্ত সাধুগণ পরম গোপনীয় উত্তম বৈষ্ণবধর্ম্ম শুনিবার ইচ্ছা করিয়া আসিয়া কৃষ্ণকে পরিবেষ্টন করিলেন ॥ যুধিষ্ঠির বলিলেন—‘ভক্তবৎসল ! যথার্থই আমি তোমার প্রতি ভক্তিবশতঃ তোমার পাদমূলে আসিয়াছি, তুমি যদি আমাকে ভক্ত ও স্নেহযুক্ত বলিয়া জান এবং আমি যদি তোমার অনুগ্রহভাগী হই, তাহা হইলে আমার নিকট বৈষ্ণবধৰ্ম্ম বল। আমি যথার্থভাবে গুপ্ত সমস্ত বৈষ্ণবধৰ্ম্ম জানিতে ইচ্ছা করি’ ॥ বৈশম্পায়ন বলিলেন—যুধিষ্ঠির এইরূপ প্রশ্ন করিলে, ধর্ম্মত কৃষ্ণ আনন্দিত হইয়া তাঁহার নিকটে এ সূক্ষ্ম ধৰ্ম্ম বলিতে আরম্ভ করিলেন॥
ভগবানুবাচ।শৃণু পার্থিব ! তৎ সৰ্ব্বং ধৰ্ম্মসূক্ষ্মং সনাতনম্ ।দুর্বিজ্ঞেয়তমং নিত্যং যজ্ঞ যত্র মহাজনাঃ ॥[ মহাভারত আশ্বমেধিক পর্ব, ১২০।২ ]
-ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বললেন, “রাজা! অভিজ্ঞ লোকেরাও যে বিষয়ে সর্বদা মুগ্ধ হয়ে থাকেন, অত্যন্ত দুর্জ্ঞেয় সেই সূক্ষ্ম সনাতনধর্ম আপনি শ্রবণ করুন।”
বৈশম্পায়ন উবাচ।এবং শ্ৰুত্বা বচঃ পুণ্যং সত্যং কেশবভাষিতম ।এহৃষ্টমনসো ভূত্বা চিন্তযস্ন্তোহদ্ভূতং পরম্ ॥৫॥দেবব্রহ্মর্ষণঃ সর্বে গন্ধৰ্বপ্পবসস্তথা।ভূতা যক্ষগ্রহাশ্চৈব গুহ্যকা ভুজগাস্তথা ॥৬॥বালখিল্যা মহাত্মানো যোগিনস্তত্ত্বদৰ্শিনঃ।তথা ভাগবতাশ্চাপি পঞ্চকলিমুপসিকাঃ ॥৭॥কৌতূহলসমাবিষ্টাঃ প্রহৃষ্টেদ্ৰিয্যানসাঃ।শ্রোতুকানাঃ পরং ধর্ম্মং বৈষ্ণবংধর্মশাসনস্।হৃদি কর্তৃক তদ্বাক্যং প্রণেমুঃ শিরসা নতাঃ।।[মহাভারত: আশ্বমেধিক পর্ব/১১৮/৫-৮ ]
অনুবাদঃ বৈশম্পায়ন বলিলেন—কৃষ্ণোক্ত এইরূপ সত্য ও পুণ্যজনক বাক্য শুনে অত্যন্ত অদ্ভুক্ত হবে এমন ভেবে প্রফুল্ল হয়ে সকল দেবর্ষি, ব্রহ্মর্ষি, গন্ধৰ্ব্ব, অপসরা, ভূত, যক্ষ, গ্রহ, গুহক, নাগ, মহাত্মা যোগী ও তত্ত্বদর্শী বালখিল্য ও দিনের মধ্যে পাঁচটী সময়ে ভগবানের উপাসক সাধুগণ কৌতুকযুক্ত হয়ে উত্তম বৈষ্ণবধৰ্ম্ম শুনার ইচ্ছা করে মস্তক অবনত করে কৃষ্ণকে নমস্কার করলেন॥
ত্বমক্ষরং পরমং বেদিতব্যংত্বমস্য বিশ্বস্য পরং নিধানম্।ত্বমব্যয়ঃ শাশ্বতধর্মগোপ্তাসনাতনস্ত্বং পুরুষো মতো মে।।[ গীতা ১১।১৮ ]অনুবাদ: তুমি পরম ব্রহ্ম এবং একমাত্র জ্ঞাতব্য। তুমি বিশ্বের পরম আশ্রয়। তুমি অব্যয়, সনাতন ধর্মের রক্ষক এবং সনাতন পরম পুরুষ। এই আমার অভিমত।
“আমি দেবগণের আদি, আমি ব্ৰহ্মাদি দেবগণকে সৃষ্টি করিয়াছি এবং আমি নিজের প্রকৃতিকে অবলম্বন করিয়া সমগ্র জগৎ সৃষ্টি করিয়া থাকি। আমি ব্রহ্মচর্য্যপ্রভৃতি চারিটী আশ্রমের ধর্ম্মস্বরূপ, চাতুর্হোত্রযজ্ঞের ফল ভোগ করি, ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর ও প্রজাপতি এই চারিটী আমার মূর্তি এবং ব্রহ্মচর্য্য, গার্হস্থ্য, বানগ্রস্থ ও ভিক্ষু—এই চারিটী আশ্রম আমিই সৃষ্টি করিয়াছি ॥ দেবতা, অসুর, মানুষের সহিত সমগ্র জগৎ এইভাবে আমার থেকে উৎপন্ন হয় এবং আমাতেই লয় পায়।”– [ মহাভারত, আশ্বমেধিক পর্ব, ১১৭।৩৮,৫০,৫৯ ]
বৈষ্ণবমসি বিষ্ণবে ত্বা।– [ শুক্ল যজুর্বেদ ৫।২১ ]-(হে মনুষ্য), তোমার পরিচয় তুমি বৈষ্ণব, বিষ্ণুর প্রীতির জন্য তোমাকে নিযুক্ত করছি।
বিষ্ণোনুকং বীর্যাণি প্র বোচং যঃ পার্থিবানি বিমমে রজাংসি যো অস্কভায়দুত্তরং সধস্থং বিচক্রমাণস্ত্রেধোরগায়ো বিষ্ণবে ত্বা৷৷– [ শুক্ল যজুর্বেদ ৫।১৮]-যিনি পার্থিব পরমাণু জাত নির্মাণ করেছেন, সে বিশ্বব্যাপক ভগবান বিষ্ণুর মহিমা নিত্য কীর্তন করছি। অগ্নি, বায়ু ও সূর্যরূপে যিনি ভূমি, অন্তরিক্ষ ও দ্যুলোকে নিজ মাহাত্ম্য স্থাপন করেছেন, মাহাত্মাগণের দ্বারা যিনি গীত, যিনি উপরিতন অন্তরিক্ষলোক স্তম্ভিত করেছেন, (হে মনুষ্য) সে বিষ্ণুর উদ্দেশ্যে তোমাকে নিযুক্ত করছি।
দিবো বা বিষ্ণ উত বা পৃথিব্যা মহো বা বিষ্ণ উরোরন্তরিক্ষাৎ। উভা হি হস্তা বসুনা পূণস্বা প্র যচ্ছ দক্ষিণাদোত সব্যাদ্বিষ্ণবে ত্বা৷– [ শুক্ল যজুর্বেদ ৫।১৯ ]– হে বিষ্ণু, তুমি দ্যুলোক অথবা ভূলোক হতে, কিম্বা মহান বিস্তৃত অন্তরিক্ষলোক হতে তোমার উভয় হস্ত ধন-সম্পত্তি দ্বারা পূর্ণ কর এবং দক্ষিণ বা বাম হস্তে আমাদের দাও। হে মনুষ্য, সে সর্বব্যাপক ভগবান বিষ্ণুর প্রীতির জন্য তোমাকে নিযুক্ত করছি।
বৈষ্ণবমসি বৈষ্ণবা স্থ।।– [ শুক্লযজুর্বেদ ৫/২৫ ]~তোমরা বৈষ্ণব হও, তােমরা ভগবান বিষ্ণুর প্রীতিসাধক হও।।
মন্মনা ভব মদ্ভক্তো মদযাজী মাং নমস্কুরু।মামেবৈষ্যসি সত্যং তে প্রতিজানে প্রিয়োহসি মে।।৬৫।।সর্বধর্মান্ পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ।অহং ত্বাং সর্বপাপেভ্যো মোক্ষয়িষ্যামি মা শুচঃ।।৬৬।।[ শ্রীমদ্ভগবদগীতা ১৮।৬৫-৬৬ ]অনুবাদ: তুমি আমাতে(শ্রীকৃষ্ণ তথা বিষ্ণু) চিত্ত অর্পণ কর, আমর ভক্ত হও, আমার পূজা কর এবং আমাকে নমস্কার কর। তা হলে তুমি আমার অত্যন্ত প্রিয় হবে৷ সর্ব প্রকার ধর্ম পরিত্যাগ করে কেবল আমার শরণাগত হও। আমি তোমাকে সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত করব। এ নিয়ে তুমি কোনরূপ সন্দেহ রেখো না।
রাজা “ভরত” এর নাম থেকে সেই জায়গার নাম হয় “ভারতবর্ষ”। যখন মুঘলরা এলো তখন সেই জায়গার নাম হল “হিন্দুস্থান” এবং ইংরেজরা আসার পরে নাম দিলো “ইন্ডিয়া”। যখন মুঘলরা এই দেশে রাজত্ব করা শুরু করে তখন তারা আমাদের উপর “জিজিয়া কর” লাগায় । “জিজিয়া কর” সম্পর্কে অনেকেই ইতিহাসে পড়েছেন । অমুসলিমদের কে যদি মুসলিম শাসন করে তাহলে সেই অমুসলিম কে “জিজিয়া কর” দিতে হবে এইটা কুরআনের বাণী ( ৯ সূরা আত তাওবাহ্.. আয়াত ২৯ ) তাই আমাদের কে চিহ্নিত করার জন্য আমাদের নাম দেওয়া হয় “হিন্দু” , অর্থাৎ আমাদেরকে তখন “হিন্দু” বলে ডাকতো । যেহেতু মুসলিমদের দেওয়া নাম এই “হিন্দু” সেহেতু তাদের হিসেব মতোই এই নামের অর্থ তারাই দিয়েছে ।
আপনারা যদি “হিন্দু”-র অর্থ উর্দু , ফারসি , আরবি ভাষার মধ্যে খুঁজতে যাও তাহলে এর অর্থ মিলবে – ‘চোর’ , ‘লুচ্চা’ , ‘ডাকাত’ , ‘মাতাল’ , ‘দাঙ্গাবাজ’ , ‘কালো’ , ‘শয়তান’ , ‘কাফের’ । এর থেকে আর খারাপ কিছু অর্থ নেই । ডিকশনারীর নাম বলে দিচ্ছি – “Gayas-ul-Lughat” ফারসী ডিক্শনারী , “Kareem-ul-Lughat” আরবি ডিকশনারি , “Feroz-ul-Lughat” ঊর্দু ডিকশনারি , এগুলোতে পেয়ে যাবেন “হিন্দু” শব্দের অর্থ কি । যতটা খারাপ বলা যায়, ‘ঘৃণাবাচক’ শব্দ একটা এই “হিন্দু”। মোঘলরা আমাদের নাম “হিন্দু” দিয়েছে আর আমরা সেটা গ্রহন করেছি । কেউ আমাদের বা আমাদের পূর্বপুরুষদেরকে চোর , ডাকাত , মাতাল , দাঙ্গাবাজ প্রভৃতি বলছে আর এটা শুনে কি আমাদের গর্ব হচ্ছে নাকি অসম্মান হচ্ছে একটু ভেবে দেখবেন।
“Perso-Arabic dictionaries define Hindu as a black, thief and slave” https://satish.com.in/20140416/
” চার্বাকাদি অতি পাষণ্ড ব্যক্তিও হিন্দু, কিন্তু বৈষ্ণব নহেন। আমরা বৈষ্ণব হিন্দু, কেবল হিন্দু নই অর্থাৎ আমাদের সমাজ হিন্দু কিন্তু আমাদের ধর্ম -বৈষ্ণব। তদ্রুপ হরিদাস ঠাকুর প্রভৃতি পূজনীয় পুরুষগণ ‘’হিন্দু’ নহেন, কিন্তু সর্বলোক নমস্কৃত ‘বৈষ্ণব’। বেদশাস্ত্রের যথার্থ তাৎপর্য্যানুসারে শ্রীশ্রীমহাপ্রভু সর্ব্বজাতিকে বৈষ্ণবধর্ম্মের অধিকারী বলিয়া উপদেশ করেন। “– (ভক্তিবিনোদ, সঃ তোঃ ২/১০-১১)।
“জীবের স্বরূপ হয় কৃষ্ণের নিত্য দাস।কৃষ্ণের তটস্থা শক্তি ভেদাভেদ প্রকাশ।।”