উপনিষদের সংখ্যা বিন্যাস ও মান্যতা নিয়ে অল্পবিদ্যা ভয়ংকরীরা প্রতিনিয়তই প্রপাগাণ্ডা ছড়াতে ব্যস্ত। তারা তাদের নিজস্ব মতাদর্শ প্রচারের স্বার্থে যেসমস্ত উপনিষদাদির তথ্য অনুকূল সেটাকে স্বীকার করে এবং অন্যগুলোকে অপ্রামাণিক ঘোষণা করতে উঠেপড়ে লেগে যায়। এই ধরনের ধৃষ্টতা তারা কেবল উপনিষদের বেলায় দেখায় তা নয়, বৈদিক শাস্ত্র সমূহের মধ্যে যেসমস্ত তথ্য তাদের নির্দিষ্ট আদর্শের সাথে অমিল মনে করে সেই সবগুলোকেই অস্বীকার করে। এমনসব নিন্দিত কার্যের মধ্যে একটি হচ্ছে অষ্টাদশ পুরাণসমুহকে তথা ধর্মশাস্ত্রকে অস্বীকার করা। তাই বেদ’ জ্ঞানের তত্ত্বদর্শী মহাপুরুষ মহর্ষি মনু পূর্ব হতেই এসব বিষয়ে সতর্ক করে দিয়েছেন। মনুসংহিতায় (২/১০,১১) উল্লেখ রয়েছে-
“বেদকে শ্রুতি ও ধর্মশাস্ত্রকে স্মৃতি বলা হয়, ঐ শ্রুতি ও স্মৃতি বিরুদ্ধ তর্কের দ্বারা মীমাংসা করিবে না। যেহেতু, শ্রুতি ও স্মৃতি হইতেই ধর্ম স্বয়ং প্রকাশ প্রাপ্ত হইয়াছে।।১০।।যে ব্যক্তি প্রতিকূল তর্ক দ্বারা মূলস্বরূপ শ্রুতি ও স্মৃতিশাস্ত্রকে অবমাননা করে, সাধু লোকেরা সেই বেদনিন্দক নাস্তিককে দ্বিজের কর্তব্য কর্ম্ম অধ্যয়নাদি সকল অনুষ্ঠান হইতে বহিস্কৃত করিবেন।। ১১।।”
এখানে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, যারা সমস্ত ১০৮ উপনিষদ সমূহকে, ১৮ পুরাণকে অস্বীকার করে তারা বেদনিন্দক আর বেদনিন্দক ব্যক্তি মাত্রই নাস্তিক। তাই বিদ্বান ব্যক্তি মাত্রের উচিত এইরকম নাস্তিকদের বিভ্রান্তিকর তথ্য দ্বারা প্রতারিত না হয়ে সত্যানুসন্ধান করা।
অতএব, উপনিষদ সমূহের সংখ্যা, নাম ও বিন্যাস নিয়ে শুক্লযজুর্বেদীয় মুক্তিকোপনিষদেই (১/২৬-৫৫) সুস্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে। “মুক্তিক উপনিষদ” অনুযায়ী আমরা ১০৮টি উপনিষদের সুনির্দিষ্ট বর্ণনা দেখতে পাই।
এই ১০৮ উপনিষদের মধ্যে মুক্তিকোপনিষদ বলেন যে-
- ঋগ্বেদীয় উপনিষদ : ১০ (দশ) টি
- শুক্ল যজুর্ব্বেদীয় : ১৯ (উনিশ) টি
- কৃষ্ণযজুর্ব্বেদীয় : ৩২ (বত্রিশ) টি
- সামবেদীয় :১৬ (ষোল) টি
- অথর্ব্ববেদীয় : ৩১ (একত্রিশ) টি
ঋগবেদ অন্তর্গত ১০টি উপনিষদ:
১) ঐতরেয়,
২) কৌষীতকী,
৩) নাদবিন্দু,
৪) আত্মপ্রবোধ,
৫) নির্ব্বাণ,
৬) মুদগলা,
৭) অক্ষমালিকা,
৮) ত্রিপুরা,
৯) সৌভাগ্য ও
১০) বহ্বৃচ
শুক্ল যজুর্ব্বেদান্তর্গত ১৯টি উপনিষদ :
১) ঈশ,
২) বৃহদারণ্যক,
৩) জাবাল,
৪) হংস,
৫) পরমহংস,
৬) সুবাল,
৭) মন্ত্রিকা,
৮) নিরালম্ব,
৯) ত্রিশিখী,
১০) ব্রাহ্মণমণ্ডল,
১১) ব্রাহ্মণদ্বয়তারক,
১২) পৈঙ্গল,
১৩) ভিক্ষু,
১৪) তুরীয়,
১৫) অতীতাধ্যাত্ম,
১৬) তারসার,
১৭) যাজ্ঞবল্ক্য,
১৮) শাট্যায়নী ও
১৯) মুক্তিকা
কৃষ্ণ যজুর্ব্বেদ এর অন্তর্গত ৩২টি উপনিষদ :
১) কঠবল্লী,
২) তৈত্তিরীয়,
৩) ব্রহ্ম,
৪)কৈবল্য,
৫) শ্বেতাশ্বতর,
৬) গর্ভ,
৭) নারায়ণ,
৮) অমৃতবিন্দু,
৯) অমৃতনাদ,
১০) কালাগ্নিরুদ্র,
১১) ক্ষুরিকা,
১২) সর্ব্বসার,
১৩) শুকরহস্য,
১৪) তেজোবিন্দু,
১৫) ধ্যানবিন্দু,
১৬) ব্রহ্মবিদ্যা,
১৭) যোগতত্ত্ব,
১৮) দক্ষিণামূর্তি,
১৯) স্কন্দ,
২০) শারীরক,
২১) যোগশিখা,
২২) একাক্ষর,
২৩) অক্ষি,
২৪) অবধূত,
২৫) কঠরুদ্র,
২৬) হৃদয়,
২৭) যোগকুগুলিনী,
২৮) পঞ্চব্রহ্ম,
২৯) প্রাণাগ্নিহোত্র,
৩০) বরাহ,
৩১) কলিসন্তরণ ও
৩২) সরস্বতীরহস্য
সামবেদ এর অন্তর্গত ১৬টি উপনিষদ :
০১) কেন,
০২) ছান্দোগ্য,
০৩) আরুণি,
০৪) মৈত্রায়ণী,
০৫) মৈত্রেয়ী,
০৬) বজ্রসূচিক,
০৭) যোগচুড়ামণি,
০৮) বাসুদেব,
০৯) মহৎ,
১০) সংন্যাস,
১১) অব্যক্ত,
১২) কুণ্ডিকা,
১৩) সাবিত্রী,
১৪) রুদ্রাক্ষ,
১৫) জাবালদর্শন ও
১৬) জাবালী
অথর্ব্ববেদ এর অন্তর্গত ৩১টি উপনিষদ :
০১) প্রশ্ন,
০২) মুণ্ডক,
০৩) মাণ্ডুক্য,
০৪) অথর্ব্বশিরঃ,
০৫) অথর্ব্বশিখা,
০৬) বৃহজ্জাবাল,
০৭) নৃসিংহ তাপনী,
০৮) নারদ পরিব্রাজক,
০৯) সীতা,
১০) সরভ,
১১) মহানারারণ,
১২) রামরহস্য,
১৩) রামতাপনী,
১৪) শাণ্ডিল্য,
১৫) পরমহংস পরিব্রাজক,
১৬) অন্নপূর্ণা,
১৭) সূর্য্যাত্ম,
১৮) পাশুপত,
১৯) পরব্রহ্ম,
২০) ত্রিপুরাতপন,
২১) দেবী,
২২) ভাবনা,
২৩) ভস্ম,
২৪) জাবাল,
২৫) গণপতি,
২৬) মহাবাক্য,
২৭) গোপালতাপন,
২৮) কৃষ্ণ,
২৯) হয়গ্রীব,
৩০) দত্তাত্রেয় ও
৩১) গারুড়
আরও দুটি কথা এখানে না বললেই নয় যে, কালান্তরের মানুষের চর্চার অভাবে এসব শাস্ত্র আজ বিলুপ্তির পথে। আবার এখনও যেগুলো পাওয়া যায় তার অনেক মন্ত্র/শ্লোক আজ হারিয়ে গিয়েছে। যেমন- কলিসন্তরণ উপনিষদ, বজ্রসূচিকোপনিষদে বর্তমানে কয়েকটি মন্ত্রসংখ্যা পাওয়া যায়। কিন্তু তার মানেই এই নয় যে এগুলো মানবসৃষ্ট বা অগ্রহণযোগ্য। আমাদের শাস্ত্রবিমুখতার কারণেই চর্চার অভাবে দিন দিন এগুলো আমাদের কাছ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। তাই পাঠক মহলের কাছে অনুরোধ থাকবে যেন আমরা আমাদের বৈদিক শাস্ত্রসমূহ অধ্যয়ন করি এবং নিজ দায়িত্বে তা সংরক্ষণ করি আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য।
– প্রবীর চৈতন্যচন্দ্র দাস