ইদানীং কিছু আর্য নামধারী পাষণ্ডী অমল পুরাণ শ্রীমদ্ভাগবতসহ অষ্টাদশ পুরাণের অমল ভাষ্য হৃদয়ঙ্গম করতে না পেরে জনসমাজে এর নিন্দা ও মিথ্যাচার করছে। এ পর্বে আমরা এই পাষণ্ডীদের মিথ্যাচারের জবাব দেব।
প্রতিপক্ষের দাবিঃ শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণের ১/৪/২৫ শ্লোকে বলা হয়েছে —
স্ত্রী, শূদ্র এবং দ্বিজোচিত গুণাবলীবিহীন ব্রাহ্মণ কুলোদ্ভূত মানুষদের বেদের তাৎপর্য হৃদয়ঙ্গম( বুঝার) করার ক্ষমতা নেই, তাই তাদের প্রতি কৃপাপরাবশ হয়ে মহর্ষি বেদব্যাস মহাভারত নামক ইতিহাস রচনা করলেন, যাতে তারা তাদের জীবনের পরম উদ্দেশ্য লাভে সমর্থ হতে পারে।
তাই, এখানে নারী ও শুদ্রের প্রতি বিদ্বেষভাবাপন্ন হয়ে শ্রীমদ্ভাগবত তাদের বেদাধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে।
খণ্ডণঃ উক্ত দাবি খণ্ডণে আমরা এই লেখণীকে দুইভাগে বিভক্ত করবো। প্রথম ভাগে নারীদের বেদাধিকার প্রসঙ্গে এবং দ্বিতীয়ভাগে শুদ্রের বেদাধিকার প্রসঙ্গে আলোচনা করা হবে।
স্ত্রীজাতির বেদাধিকারঃ
♦ জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী।।
– (রামায়ণ- ৬/১২৪/১৭)
মমতাময়ী মাতৃমণ্ডলী কোমলতায়, ভালোবাসায়, স্নেহে, যত্নে, ধৈর্যে, আত্মত্যাগে বরাবরই অতুলনীয়। আমাদের সকলেরই প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় মায়ের কাছ থেকে। তাই তাঁদের চরণে প্রণাম রেখেই এই আলোচনা শুরু করছি।
প্রথমেই উক্ত শ্লোকের শব্দের অন্বয় ও শব্দার্থ দেখে নিব।
♦ “স্ত্রীশূদ্রদ্বিজবন্ধূনাং ত্রয়ী ন শ্রুতিগোচরা।
কর্মশ্রেয়সি মূঢ়ানাং শ্রেয় এবং ভবেদিহ।
ইতি ভারতমাখ্যানং কৃপয়া মুনিনা কৃতম্।।”
শব্দার্থ: স্ত্রী– স্ত্রী জাতি, শূদ্র– শ্রমিক শ্রেণী, দ্বিজ বন্ধূনাম– দ্বিজোচিত গুণাবলীবিহীন দ্বিজকুলোদ্ভূত মানুষ, ত্রয়ী– তিন, ন– না, শ্রুতিগোচরা– বোধগম্য, কর্ম– কার্যকলাপে, শ্রেয়সি-কল্যান সাধনে, মূঢ়ানাম-মূর্খদের, শ্রেয়ঃ-পরম কল্যাণ, এবম-এইভাবে, ভবেৎ– প্রাপ্ত হয়, ইহ– এটির দ্বারা, ইতি– এইভাবে বিবেচনা করে, ভারতম– মহাভারত, আখ্যানম– ঐতিহাসিক তথ্য, কৃপয়াঃ– কৃপাপূর্বক, মুনিনা– মুনির দ্বারা, কৃতম– রচিত হয়েছিল।
অনুবাদ: স্ত্রী, শূদ্র এবং দ্বিজোচিত গুণাবলীবিহীন ব্রাহ্মণ কুলোদ্ভূত মানুষদের বেদের তাৎপর্য হৃদয়ঙ্গম( বুঝার) করার ক্ষমতা নেই,তাই তাদের প্রতি কৃপাপরাবশ হয়ে মহর্ষি বেদব্যাস মহাভারত নামক ইতিহাস রচনা করলেন,যাতে তারা তাদের জীবনের পরম উদ্দেশ্য লাভে সমর্থ হতে পারে।
শ্রীমদ্ভাগবতের এই শ্লোকে ‘স্ত্রী’ অর্থে একজন সাধারণ স্ত্রী ‘র বৈশিষ্ঠ্যই গ্রহণ করতে হবে। কেননা শ্রীমদ্ভাগবতাদি অষ্টাদশ পুরাণে, মহাভারতে এমন অনেক উত্তমা স্ত্রীদের কথা উল্লেখ পাওয়া যায় যারা বেদাদি শাস্ত্র অধ্যয়ন এবং অধ্যাপনা করতেন।
অষ্টাদশ পুরাণ ও ইতিহাস গ্রন্থে নারীদের বেদাদি শাস্ত্র অধ্যয়নের প্রমাণঃ
শ্রীমদ্ভাগতে ৪/১/৬৪ শ্লোকে ব্রহ্মবাদিনী কন্যা’র উল্লেখ করা হয়েছে
♦ “তেভ্যো দধার কন্যে দ্বে বয়ুনাং ধারিনীং স্বধা।
উভে তে ব্রহ্মবাদিন্যৌ জ্ঞানবিজ্ঞানপারগে।।”
– [শ্রীমদ্ভাগবত ৪/১/৬৪]
অনুবাদ: স্বধা, তারঁ বয়ুনা এবং ধারিনী নামক দুটি কন্যা হয়।তারাঁ উভয়েই ছিলেন ব্রহ্মবাদিনী এবং জ্ঞান ও বিজ্ঞানে পারদর্শী।
♦ “তেভ্যঃস্বধা সুতে জজ্ঞে মেনাং বৈ ধারিনীং তথা।
তে উভে ব্রহ্মবাদিনৌ যোগিন্যাবপ্যুভে দ্বিজ।।”
– বিষ্ণুপুরান ১/১০/১৯
অনুবাদ: তাদের দ্বারা মেনা এবং ধারিনী নামক দুই কন্যা উৎপন্ন করেন। তাঁরা দুই জনেই উত্তম জ্ঞান এবং সর্বগুণসম্পন্না,ব্রহ্মবাদিনী ও যোগিনী ছিলেন।
বিষ্ণপুরানের এ শ্লোকে ব্রহ্মবাদিনী শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে,যার অর্থ হল বেদ সম্পর্কে যারা আলোচনা করেন।ব্রহ্মা থেকে জাত প্রজাপতি দক্ষের কন্যা হল স্বধা। এই স্বধার কন্যা হল মেনা বা বয়ুনা এবং ধারিণী।তারা উভয়ই বেদ জ্ঞানে অভিজ্ঞ ছিল, যার কারনে তারা বেদ নিয়ে আলোচনা করতেন।
♦ ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে এক নারীর কথা বলা হয়েছে, যিনি ছিলেন কুশধ্বজ এবং মালাবতীর কন্যা। তিনি অনর্গল বেদমন্ত্র পাঠ করতে পারতেন।
♦ “সততং মীর্তিমন্তশ্চ বেদাশ্চত্বার এব চ।
সন্তি যস্যাশ্চ জিহ্বাগ্রে সা চ বেদবতী স্মৃতা।।”
– [ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, প্রকৃতিখন্ড, ১৪/৬৫]
অনুবাদ: এই পূণ্য পাপনাশক পবিত্র আখ্যান তোমাকে বলিলাম।মূর্ত্তিমান বেদচতুষ্টয় তাঁহার জিহ্বাগ্রে সতত স্ফুরিত হওয়ায়, তিনি বেদবতী বলিয়া উক্ত হইয়াছে।
♦ মহাভারতের উদ্যোগ পর্বে ১২৪তম অধ্যায়ে (হরিসিদ্ধান্তবাগীশকৃত) ‘বিদুলা’ নামে এক নারীর উল্লেখ পাওয়া যায় যিনি বেদাদি বহু শাস্ত্রে পারঙ্গত ছিলেন।
গৌড়ীয় বৈষ্ণব ইতিহাসে নারীদের অবদানঃ অধ্যাপিকা ঊমা বন্দোপাধ্যার রচিত “গোড়ীয় বৈষ্ণব নারী” নাম্নী একটি বই রয়েছে যেখানে তিনি ১০০ জনেরও বেশি নারীদের উল্লেখ করেছেন যারা গৌড়ীয় ইতিহাসে অসামান্য অবদান রেখেছেন। এখানে উল্লেখযোগ্য কয়েকজনের নাম দেওয়া হলো-
- জাহ্নবা দেবী(শ্রীনিত্যানন্দ প্রভুর পত্নী)
- সীতাদেবী(শ্রীঅদ্বৈত আচার্যের পত্নী )
চৈতন্য মহাপ্রভুর বরিষ্ঠ পার্ষদরা অপ্রকটের পর এই দুজন বৈষ্ণবী গৌড়ীয় ধারার প্রচার ও প্রসারে নেতৃত্ব প্রদান করেন।
- গৌরাঙ্গপ্রিয়া দেবী(শ্রীনিবাস আচার্য্যের পত্নী)
- হেমলতা /কৃষ্ণপ্রিয়া ঠাকুরাণী(শ্রীনিবাস আচার্য্যের কন্যা)
তিনি একজন সহজিয়া ভাগবত পাঠক “রূপ কবিরাজ”-কে শাস্ত্রার্থ করে পরাজিত করে তার সহজিয়া সিদ্ধান্ত প্রচার বন্ধ করেন। এছাড়াও হেমলতা ঠাকুরাণী একজন আচার্যানীর ভূমিকা পালন করেন ও বহু শিষ্য গ্রহণ করেন।
- জাহ্ণবাদেবীর পুত্রবধু সুভদ্রা দেবী (অনঙ্গকদম্বাবলী নামে শতক কাব্য রচনা করেন)
ইসকনে নারীদের গায়ত্রী দীক্ষা ও আচার্যানীর ভূমিকাঃ
*আপনারা নিশ্চয় সকলে অবগত আছেন যে, ইসকনে নারীদের গায়ত্রী দীক্ষা দেওয়া হয়। এ ব্যাপারে ১৯৬৮ সালের ১১ই অগাস্ট মন্ট্রিলে দেওয়া দীক্ষানুষ্ঠানে শ্রীল প্রভুপাদের দেওয়া প্রবচন থেকে প্রাসঙ্গিক অংশটুকু আপনাদের সামনে তুলে ধরছি–
So then this is the beginning of initiation, and those who have chanted at least for one year, then the next initiation is to offer him Gāyatrī mantra. Some of the students, boys and girls, will be offered this Gāyatrī mantra. And when the Gāyatrī mantra is offered men, they are offered also sacred thread, and girls, they are not offered sacred thread. If their husband is a brāhmaṇa, she automatically becomes brāhmaṇa, because wife is considered to be the half, better half. She is the better portion. So she automatically becomes better brāhmaṇa. [laughter] So better brāhmaṇa does not require any thread.
Reference: Initiations and Gāyatrī of Devotees
এছাড়া কিছুদিন আগে একজন নারী আচার্যপদে অভিষিক্ত হয়েছেন এবং শিষ্য গ্রহণ করা শুরু করেছেন।
২০২২সালের ১৯শে অগাস্ট জন্মাষ্ঠমী তিথিতে শ্রীমত্যা নারায়ণী দেবী দাসী দীক্ষাগুরুরুপে প্রথম শিষ্যা গ্রহণ করেন।
এবার প্রশ্ন হতে পারে, তাহলে শ্রীল প্রভুপাদ কেন শ্রীমদ্ভাগবতের উক্ত শ্লোকের তাৎপর্যে নারীদের বেদপাঠ নিষেধ বা তাদের অল্পবুদ্ধিসম্পন্ন বললেন?!
মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যাঃ
শুনতে অপ্রিয় হলেও সত্য যে, সাধারণত স্ত্রীজাতি শৃঙ্গার, কৌতুক, সাংসারিক গল্প ইত্যাদিতেই মেতে থাকতে পছন্দ করেন। এবং এটা যে নতুন কোন তথ্য নয় তা আপনারা সবাই জানেন। আধ্যাত্মিকথার কথা নাই বা বললাম, এমনকি সোশ্যাল মিডিয়াতেও নারীদের নিয়ে বিভিন্ন জনপ্রিয় কৌতুক ভিডিও রয়েছে। যেমন বর্তমানে জনপ্রিয় ট্রেন্ডিং ফানি ভিডিও “Women” দেখেন নাই এমন নেটিজেন কমই খুঁজে পাওয়া যাবে।
তাই এই বিষয়টি একটি “Open Secret” ও বলা যেতে পারে।
আজকে নারীরা একাডেমিক পড়াশুনা, চাকরী এমনকি কোন কোন দেশ পরিচালনা করছেন। এক্ষেত্রে তাদের সম্বন্ধে এমন মন্তব্য করা যদিও বেমানান মনে হতে পারে কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নারীরা কোন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে বুদ্ধির চেয়ে আবেগের দ্বারা তাড়িত হবার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
শ্রীল প্রভুপাদ তাই শ্রীমদ্ভাগবতের উক্ত শ্লোকের তাৎপর্যে এমন সাধারণ বৈশিষ্ঠ্য সম্পন্ন ‘স্ত্রী’জাতির কথাই বলেছেন, উত্তমা স্ত্রীদের কথা নয়। এবং স্বাভাবিকভাবেই এরা উন্নততর দর্শন আলোচনার চাইতে গল্প/উপাখ্যান শ্রবণ/অধ্যয়ন করতে বেশি উৎসাহী। এখানে আলোচ্য শ্লোকে “ন শ্রুতিগোচরা” মানে এই নয় যে, তাদের কানে বেদের বাণী প্রবেশ করে না। বরং তারা শুনলেও তা হৃদয়ঙ্গম করতে পারবে না এমনটাই বুঝিয়েছে। আর তাই শ্রীল ব্যাসদেবও তাদের সেই স্বাভাবিক আচরণের কথা মাথায় রেখেই রামায়ণ, মহাভারত আদি ইতিহাস গ্রন্থ রচনা করেছেন, যাতে তারা তা শ্রবণে এবং অধ্যয়নে আগ্রহী হয়। এবং পরবর্তীতে কোন তত্ত্বদ্রষ্টা ব্যক্তির তত্ত্বাবধানে থেকে বেদাদি উচ্চতর জ্ঞান প্রাপ্ত হবেন।
এখন প্রশ্ন হতে পারে, তবে কি স্ত্রীজাতিরা সারাজীবনই ইতিহাস গ্রন্থ অধ্যয়ন করবে? বেদাদি শাস্ত্র অধ্যয়নের অধিকার কি তারা পাবে না?!?
হ্যাঁ, অবশ্যই পাবে। এ প্রসঙ্গে অধিকার শব্দটি পর্যালোচনা করা দরকার।
বাংলায় ‘অধিকার’ শব্দের দুটি প্রয়োগ ক্ষেত্র রয়েছে রয়েছে। প্রথমটি হলো ‘Right’ অর্থে এবং দ্বিতীয়টি ‘Eligibility’ অর্থাৎ ‘ক্ষমতা/যোগ্যতা’ অর্থে।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ‘শিক্ষা’ সকল নাগরিকের মৌলিক ‘অধিকার’(Right) হলেও প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষার্থীরা উচ্চতর গণিত(Higher Mathematics) পড়ার ‘অধিকার/যোগ্যতা’(Eligibility) রাখে না।
অতএব বলা যায়, প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষার্থীদের এখনই ‘উচ্চতর গণিত’ বিষয়ে পড়ার অধিকার(যোগ্যতা) না থাকলেও পর্যায়ক্রমে তারা সেই বিষয়ে জ্ঞানার্জনের ‘অধিকার(যোগ্যতা)’ লাভ করবে।
তদ্রুপ বেদাদি শাস্ত্র অধ্যনের ব্যাপারেও একই বিষয়ের অবতারণা করেছে শ্রীমদ্ভাগবত।
আমাদের বুঝতে হবে যে, শ্রীমদ্ভাগবত এস্থলে অধিকার শব্দে যোগ্যতা(Eligibility) অর্থ গ্রহণ করেছেন। এ সম্পর্কে এই শ্রীমদ্ভাগবত ১/৪/২৫ নং শ্লোকের গৌড়িয় মঠের প্রতিষ্ঠাতা শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুর তার ভাগবতের অনুবাদের “ন শ্রুতিগোচরা” শব্দের অন্বয়( শব্দার্থ) করেছেন “নৈব শ্রবণযোগ্য” অথাৎ শ্রবণ করার যার যোগ্যতা / ক্ষমতা নাই।
ব্রহ্মমাধ্ব গৌড়িয় সম্প্রদায়ের আর এক মহান আচার্য শ্রীমৎ বিজয়ধ্বজ তীর্থ বা জয়ধর্ম মুনি তিনি শ্রীমদ্ভাগবতের উপর পদরত্নাবলী নামক একটি গ্রন্থ রচনা করেন।এই গ্রন্থের অত্র শ্রীমদ্ভাগবত ১/৪/২৫ নং শ্লোকের টীকাতে “ন শ্রুতিগোচরা” শব্দের অর্থ করেন, “শ্রোতুং ন যোগ্যা” অথাৎ শ্রবণ করার যার যোগ্যতা / ক্ষমতা নাই। টীকাটি নিম্নরুপ..
♦ “শ্রোতুং ন যোগ্যা ইতি যস্মাদত এবং ময়া করিষ্যামানভারতাদিশাস্ত্রোক্তবিধিনা ইহ জনে শ্রেয়া ভবেদিতি কৃপয়া মুনিনা।সর্বজ্ঞেন ব্যাসেন ভারতমাখ্যানং কৃতমিত্যন্বয়ঃ।”
যদি শ্রীমদ্ভাগবত স্ত্রীজাতিদের বেদাধিকার(Right) নাই দিতো তবে শ্রীমদ্ভাবগবতের ৪/১/৬৪ এই শ্লোকের ভাবার্থ স্ববিরোধী হতো।
ব্রহ্ম-মধ্ব-গৌড়ীয় পূর্বাচার্যরা স্ত্রীদের বেদাধিকার দিয়েছিলেন কি?
(অনা) আর্যদের দাবি যে আমরা নাকি এখন তাদের অনুকরণে এখন পুরাণের প্রক্ষিপ্ত শ্লোক ও শ্রীল প্রভুপাদের তাৎপর্য দেখিয়ে জোর করে নারীদের ও শুদ্রের বেদাধিকার দেখানোর চেষ্টা করছি। আমাদের পুর্বতন আচার্যরা নাকি এ বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করেছেন। আসুন দেখে নেওয়া যাক, শ্রীল প্রভুপাদ ছাড়া ব্রহ্ম-মধ্ব-গৌড়ীয় আর কোন আচার্য নারীদের বেদাধিকার দিয়েছেন।
♦ স্বয়ং মধ্বাচার্য তাঁর ব্রহ্মসূত্রের ১/১/১ ভাষ্যে স্ত্রীদের বেদাধিকার দিয়েছেন।
মধ্বাচার্য এখানে ব্যাসসংহিতা থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বলছেন, “অন্ত্যজা অপি যে ভক্তা নামজ্ঞানাধিকারিণঃ। স্ত্রীশূদ্রদ্বিজবন্ধূনাং তত্ত্বজ্ঞানেহধিকারিতা।”
অর্থাৎ, স্ত্রী, শুদ্র, দ্বিজবন্ধু এমনকি অন্ত্যজ(শুদ্রের থেকেও অধম যে) সকলেই তত্ত্বজ্ঞান লাভের অধিকারী।
“আহুরপ্যুত্তমস্ত্রীণামধিকারস্তবৈদিকে”
অর্থাৎ, বৈদিক ক্রিয়াকর্মে উত্তম স্ত্রীদের অধিকার আছে।
অতএব, প্রমাণীত হলো যে শ্রীল প্রভুপাদ ছাড়াও পূর্বাচার্য এমনকি স্বয়ং মধ্বাচার্য উত্তম স্ত্রী-শুদ্রের বেদাধিকার নিশ্চিত করেছেন।
♦ মধ্বাচার্যের “মহাভারত তাৎপর্য নির্ণয়” গ্রন্থে তিনি দ্রুপদীর পরিচয় দিয়েছেন এভাবে–
এতদ্দশাত্মকো বায়ুস্তস্মাদ্ ভীমস্তদাত্মকঃ।
সর্ববিদ্যা দ্রৌপদী তু যস্মাৎ সৈব সরস্বতী।।
Translation:
Vaayu Deva represents these ten qualities. Bheema who is incarnation of Vaayu also has these qualities. Similarly Draupadi is incarnation of Bharati who will be Saraswati in future kalpa. She represents all learning.
Special Notes:
2) Draupadi will be Saraswati in future. Therefore she is embodiment of all learning. In aadhyatma, she represents speech.
আলোচ্য অংশে আমরা দেখলাম যে শাস্ত্র যেমন সাধারণ স্বভাব সুলভা নারীদের সর্বোচ্চ জ্ঞান বৈদিক শিক্ষার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা দিলেও উত্তমা নারীদের ঠিকই সেইসব শাস্ত্রে অধিকার দিয়েছে। এবং তা ব্রহ্ম-মধ্ব-গৌড়ীয় আচার্যদের দ্বারাই স্বীকৃত হয়েছে।
এবার আসি শুদ্রের বেদাধিকার প্রসঙ্গে—
শুদ্রের বেদাধিকারঃ এ প্রসঙ্গে প্রথমেই বর্ণব্যবস্থা নিয়ে স্পষ্ট ধারণা থাকা চাই। সর্বাগ্রে জেনে নিতে হবে বৈদিক শাস্ত্রে ‘শুদ্র’ কারা?! ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শুদ্র এই চারিবর্ণ কিভাবে নির্ধারিত হয়?! বর্ণব্যবস্থা জন্মের দ্বারা নাকি গুণ ও কর্মের দ্বারা সিদ্ধ?!
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার (৪/১৩) জনপ্রিয় শ্লোক “(चातुर्वर्ण्यं मया सृष्टं गुणकर्मविभागशः।) চাতুর্বর্ণ্যং ময়া সৃষ্টং গুণকর্মবিভাগশঃ”~প্রকৃতির তিনটি গুণ(সত্ত্ব,রজ,তম) ও কর্ম অনুসারে আমি মানব সমাজে চারটি বর্ণবিভাগ সৃষ্টি করেছি।
এবং ১৮/৪১ নং শ্লোকেও সেই একই কথা “(कर्माणि प्रविभक्तानि स्वभावप्रभवैर्गुणै:॥) কর্মাণি প্রবিভক্তানি স্বভাবপ্রভবৈর্গুণৈঃ”।
শ্রীমদ্ভাগবতও সেই একই সিদ্ধান্ত সমর্থন করেছে —
♦ যস্য যল্লক্ষণং প্রোক্তং পুংসো বর্ণাভিব্যঞ্জকম।
যদন্যত্রাপি দৃশ্যেত তৎ তেনৈব বিনিদিশেৎ।।
– [শ্রীমদ্ভাগবত ৭/১১/৩৫]
অনুবাদ: যদি কেউ উপরোক্ত বর্ণনা অনুসারে ব্রাহ্মন,ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শুদ্রের লক্ষণগুলি প্রদর্শন করেন, তাহলেও তাঁকে ভিন্ন বর্ণের বলে মনে হলেও এই লক্ষণ অনুসারে তারঁ বর্ণ নিদিষ্ট হবে।
♦ এ প্রসঙ্গে বেদান্ত সূত্রের ‘গোবিন্দ ভাষ্যে’ শ্রীমৎ বলদেব বিদ্যাভূষণ তার ১/৩/৩৪ সূত্রের টীকায় উল্লেখ করেছেন
যে, “শুদ্রের বেদাধিকার নেই”। কিন্তু ঠিক তার পরের দুটি সূত্রের(১/৩/৩৫-৩৬) টীকায় তিনি বিভিন্ন প্রামাণিক শাস্ত্র (ছান্দোগ্য উপনিষদ, শ্রীমদ্ভাগবত, মহাভারত, চৈতন্য চরিতামৃত হতে উদ্ধৃতি দিয়ে দেখিয়েছেন প্রকৃত শুদ্র কারা?
♦ এ প্রসঙ্গে ছান্দোগ্য উপবিষদের সত্যকাম জাবালের উদাহরণ, শ্রীমদ্ভাগবতের “যস্য লক্ষণং প্রোক্তং” ইত্যাদি প্রমাণ দেখিয়ে তিনি এটাই দাবি করেছেন যে, জন্ম দ্বারা নয় বরং কুটিলতা, অজ্ঞানতা ইত্যাদি গুণ দর্শনেই কাউকে শুদ্র বলে বিচার করতে হবে। অপরপক্ষে সরলতা, শমাদি গুণ দ্বারাই কে ব্রাহ্মণ তা বিচার করতে হবে।
♦ শ্রীল বলদেব বিদ্যাভূষণ বেদান্ত সূত্রের ১/৩/৩৫ এও দেখিয়েছেন যে, বেদপাঠে সংস্কার আবশ্যক। যেহেতু স্বাভাবিকভাবে শুদ্রের গর্ভাধানাদি সংস্কার হয়না সেহেতু সে এই অধিকার থেকে বঞ্চিত থাকে। অর্থাৎ, জন্ম নয় সংস্কার অভাবেই কেউ শুদ্র সংজ্ঞায়িত হয়।
শ্রীমদ্ভাগবত গুণ ও লক্ষণ অনুসারে চারটি বর্ণ ভাগ করেছে। এবং প্রত্যেককেই সুযোগ দিচ্ছে ব্রাহ্মণ হওয়ার। এখন কেউ যদি বলে যে, “আমি ব্রাহ্মণ হবো না, আমি তমাসাচ্ছন্ন অন্ধাকারেই জীবন অতিবাহিত করবো, সারাজীবন শুদ্র(গুণগত) হিসেবেই থাকতে চাই”। তবে তার দায়ভার সম্পূর্ণ তার নিজের। শ্রীমদ্ভাগবতাদি বৈদিক শাস্ত্র তাকে পূর্ণ অধিকার দিয়েছে গুণগতভাবে ব্রাহ্মণ হওয়ার। কিন্তু সেই সুযোগ সে গ্রহণ করেনি।
এমতাবস্থায়, এমন কোন শুদ্র(গুণগত) যদি দাবি করে যে, সে বেদ অধ্যয়ন করবে, তবে তাকে কি বলা উচিৎ বলে আপনি মনে করেন?!
বর্তমান প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে যেখা যায় সে (শুদ্রগুণসম্পন্ন) যদি পিডিএফ ডাউনলোড করে অথবা দোকান থেকে বেদ কিনে নিয়ে এসে পড়া শুরুও করে, তাতে কি তার আদৌ কোন লাভ হবে?!
হয়তো সে মুখস্থ পড়ে যাবে বা তার চেতনা অনুসারে শাস্ত্রার্থ করবে কিন্তু এতে বেদের জ্ঞান কি হৃদয়ঙ্গম করতে পারবে?! নিশ্চয়ই মুখস্থ পড়া আর তত্ত্বদ্রষ্টা সদ্গুরুর তত্ত্বাবধানে থেকে অধ্যয়ন করার ফল এক নয়।
আবার কোন ছাত্র যদি মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় ফেল করে কিন্তু পরবর্তীতে লাইব্রেরি থেকে মেডিক্যাল এর বই কিনে এনে, শিখে চর্চা (Practice) করা শুরু করে, তবে মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় কি তার সেই পড়াশুনার বা পরিশ্রমের মূল্যায়ন করবে?! তাকে চিকিৎসা করতে দিবে?!
এস্থলে শ্রীমদ্ভাগবত সেই গুণগত শুদ্রকে প্রথমে রামায়ণ, মহাভারতাদি ইতিহাস শাস্ত্র শ্রবণ ও অধ্যয়নের মাধ্যমে ধীরে ধীরে তার গুণ ও স্বভাব পরিবর্তন করে তাকে অন্যান্য বৈদিক শাস্ত্র অধ্যয়নের পরামর্শ দিচ্ছে।
শেষাংশঃ যদি কেউ সারাদিন আপনার গুণগান করে তবে সে আপনার সুহৃদ নাও হতে পারে। হতে পারে সে কোন স্বার্থের জন্য আপনার দোষ-ত্রুটি আড়াল করে শুধু প্রসংশাই করছে। কিন্তু আপনার প্রকৃত সুহৃদ সে ই, যে আপনার দোষেরও সমালোচনা করবে।
বৈদিক শাস্ত্র আমাদের মঙ্গলের জন্য, আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য প্রিয়-অপ্রিয় সকল সিদ্ধান্তকেই সরলভাবে তুলে ধরে। মেনে নেওয়া বা নেওয়ার দ্বায়িত্ব আমাদের নিজেদের।
তাই যারা শাস্ত্রের নিগূঢ় ব্যখ্যা আড়াল করে শুধু স্তুতি বা তোষামোদ করে সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জন করতে চায় তাদের থেকে সাবধান!!!
তথ্যসূত্রঃ শ্রীমান অর্জুনসখা দাস
উপস্থাপনেঃ নবনীল ঘনশ্যাম দাস