শিবলিঙ্গ কি?!

285540302_119688030752572_1683188882838570884_n

শিবলিঙ্গ বিষয়ে বিশদ আলোচনা প্রয়োজন। এ বিষয়ে তত্ত্বত কোনো জ্ঞান না থাকায় কতিপয় ব্যক্তি এর নিন্দা করে থাকে। কিন্তু কেউ তাঁর সম্পর্কে যথার্থ অবগত হলে তখন নিন্দার পরিবর্তে তাঁর স্তুতি করবে
মূল সংস্কৃত लिङ्गं (লিঙ্গ) শব্দের অর্থ হলো “প্রতীক” বা চিহ্ন। বাংলা ব্যাকরণ অনুসারেও লিঙ্গ চার প্রকার, যথা-

১) পুংলিঙ্গ
২) স্ত্রীলিঙ্গ
৩) ক্লীবলিঙ্গ
৪) উভয়লিঙ্গ

অতএব, খুব সহজেই বুঝা যায় ব্যাকরণের যে ব্যাখ্যার দ্বারা কোন মানুষকে তথা প্রাণীকে, পুরুষ বা স্ত্রী প্রজাতি হিসেবে, কিংবা কোন জড়বস্তুকে আলাদা আলাদাভাবে সনাক্ত করা হয় তাই লিঙ্গ। যারা লিঙ্গ বলতে কেবল জননেন্দ্রিয়কে বুঝেন তাদের জ্ঞাতার্থে জানিয়ে রাখি সংস্কৃতে জননেন্দ্রিয়ের প্রতিশব্দ হল- শিশ্নম্। যদি শিবলিঙ্গম্ শব্দে জননেন্দ্রিয়কে বোঝানো হতো তাহলে লিঙ্গ শব্দের ব্যবহার না করে শিশ্নম্ শব্দটি ব্যবহার করা হতো। প্রকৃতপক্ষে “শিবলিঙ্গ” বলতে কোন জননেন্দ্রিয়কে বোঝায় না। “শিব” শব্দের অর্থ মঙ্গলময় এবং “লিঙ্গ” শব্দের অর্থ প্রতীক। এই কারণে শিবলিঙ্গ শব্দটির অর্থ “মঙ্গলময় প্রতীক”, যাঁর দ্বারা জগতের সৃষ্টি কার্য সাধিত হয়েছে। এই প্রতীকরূপেই শিব মনুষ্যগণ, ব্রহ্মাদি দেবগণ, মহর্ষিগণের দ্বারা বহু প্রাচীনকাল থেকেই পূজিত, বন্দিত। কিন্তু অধুনা মানুষের চেতনা কলুষিত হওয়ার ফলে মানুষ এই প্রতীকরূপে শিবের মাহাত্ম্য হৃদয়ঙ্গম করতে পারে না।

পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর বহিরঙ্গা মায়াশক্তির দ্বারা জড়জগত সৃষ্টি করেন। কিন্তু মায়ার সাথে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সাক্ষাৎ অর্থাৎ প্রত্যক্ষ কোনো সম্বন্ধ নেই। তাই শ্রীকৃষ্ণের পুরুষাবতাররূপে কারণোদকশায়ী বিষ্ণু মায়াদেবীর প্রতি ইক্ষণ বা দৃষ্টিপাত করেন। ভগবানের ইক্ষণের ফলে সৃষ্ট দিব্য জ্যোতির্ময় প্রকাশ প্রকৃতিরূপা মায়ার গর্ভে সমস্ত জীব ও ব্রহ্মাণ্ডসমূহের উপাদান সঞ্চার করেন এ জ্যোতির্ময় স্বরূপই শিবলিঙ্গরূপে পরিচিত। আবার, যদি লিঙ্গ শব্দে জননেন্দ্রিয়কে বোঝায়, তবুও তা নিন্দার্হ কি না তা একটি উদাহরণের সাহায্যে বিশ্লেষণ করা যাক-

আমাদের জন্মের কথা ধরা যাক। পিতামাতার আনন্দঘন মূহুর্তের ফলেই আমাদের উৎপত্তি। কিন্তু যে কারণে আমাদের জন্ম হয়েছে, সে বিষয়ে আমরা চর্চা করি না বা তাকে ঘৃণাও করি না। বরং, সেই কারণেই আমরা পিতাকে জন্মদাতা বলে সবচেয়ে মর্যাদা দান করে থাকি। কোনো সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন বুদ্ধিমান ব্যক্তি তার নিন্দা করবে না। ঠিক তেমনি ভগবান শিবরূপী তাঁর লিঙ্গম্ বা জ্যোতির দ্বারা প্রকৃতিস্বরূপা মায়াদেবীর গর্ভে এ ব্রহ্মাণ্ডের গর্ভাধান করেন, যার মাধ্যমে এ ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টিকার্য সম্পন্ন হলো। তাই, আমাদের সৃষ্টির কারণস্বরূপা যে লিঙ্গ, তাঁকে কি আমাদের প্রাকৃত বা জড় দৃষ্টিতে দেখা উচিত, নাকি অপ্রাকৃত দৃষ্টিতে দর্শনপূর্বক এর অর্চন করা উচিত?

তাই লিঙ্গ শব্দের অর্থ বিশ্লেষণ করেই দেখা গেল যে, শিবলিঙ্গ প্রাকৃত কোনো বিষয় নয়; বরং জগৎ সৃষ্টির কারণ। তাই তা পরম শ্রদ্ধাসহকারে গ্রহণ করার বিষয়। কিন্তু আমাদের দৃষ্টি প্রাকৃত বিধায় আমরা সবকিছুকে প্রাকৃত দৃষ্টিতে বিচার করি। অজ্ঞতাবশতও আমাদের এ ধরনের অপরাধ যেন না হয়, সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখা আবশ্যক এবং যেসকল মূঢ় শিবলিঙ্গের যথার্থ মর্ম না জেনে তাঁর নিন্দা করে, তাদের এ তত্ত্ব অবগত করানো উচিত।

“যেসকল মূর্খ শিবলিঙ্গ বলতে জননেন্দ্রিয় মনে করে, তাদের জ্ঞান-বুদ্ধিও সেই ইন্দ্রিয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।”

শিবলিঙ্গকে পুরুষাঙ্গ ভাবার শাস্তি!!!
রাম চন্দ্রের পূর্বপুরুষ রাজা ইক্ষ্বাকু জীবনের শেষভাগে শিবের ভক্ত ছিলেন, কিন্তু পূর্বে তিনি শিবলিঙ্গকে পুরুষের শিশ্ন (পুরুষাঙ্গ) বলে নিন্দা করেছিলেন। ফলে মৃত্যুর পরে পূর্বকৃত পাপের কারণে তার জননাঙ্গের রোগ হয় এবং তিনি জিহ্বা ও নাক হীন হন।

“মহেশ্বর ইক্ষ্বাকুর প্রতি কহিলেন, ” তুমি দিন দিন ক্ষীণ হইয়া অষ্টদিন মাত্র আমার পূজা করিয়াছ, কিন্তু পূর্বে শিবলিঙ্গকে ‘শিশ্নের অগ্রভাগ’ এই বলিয়া আমার নিন্দা করিয়াছ, সেই পাপযোগ দ্বারা তোমার শিশ্নের অগ্রভাগ চক্র ও বিবর হইবে এবং তোমার জিহ্বা ও নাসিকাদি থাকিবে না।”

– (পদ্মপুরাণ: পাতালখন্ড/ ৬৬/১৬৮-১৮৬)

তাই যারা শিবলিঙ্গকে পুরুষাঙ্গ ভাবেন, তারা সাবধান! সংস্কৃতে লিঙ্গ শব্দ দ্বারা পুরুষাঙ্গকে বুঝায় না। ব্যাকরণে পুলিঙ্গ, স্ত্রীলিঙ্গ যে পড়ানো হয়, সেখানে কি জননাঙ্গকে বুঝানো হয়? সংস্কৃতে শিব শব্দের অর্থ ‘মঙ্গল’ এবং লিঙ্গ শব্দের অর্থ ‘প্রতীক’। ভগবান বিষ্ণুর যে মঙ্গলময় রূপ, তা-ই শিবলিঙ্গ।

 

– প্রবীর চৈতন্যচন্দ্র দাস

Pravira Caitanya Candra Das

Writer & Admin

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments