শঙ্করাচার্য্যের একদন্ডী সন্ন্যাস

65761176_2401646736821034_5156774499944759296_n

(A reply to a smārta Brahmin who objected to Prabhupada’s commentary)

শঙ্করাচার্য্যের আবির্ভাবের পূর্বে সমস্ত ভারতবর্ষে বৌদ্ধ ও জৈন মতের বিস্তার এতো ব্যাপক হয়েছিলো বৈদিকধর্ম লুপ্ত হয়ে গিয়েছিলো। প্রকৃত বর্ণাশ্রম ধর্ম বিলুপ্ত হয়ে কপট আশ্রমধর্ম প্রচলিত হয়েছিলো। যেহেতু বৌদ্ধ-জৈনগণ বেদকে অস্বীকার করেন, তাই তাদের সন্ন্যাস বৈদিকি সন্ন্যাস নয়, তা ছল-সন্ন্যাস। এমনকি তারা বেদোক্ত ত্রিদন্ড কিংবা একদন্ড-ও ধারণ করেন না।
এমন সময়ে ভারতভূমিতে শ্রীপাদ শঙ্করাচার্য্যের আবির্ভাব ঘটে, যিনি একদন্ডী সন্ন্যাস পুনঃপ্রবর্তন করেন।
শঙ্করাচার্য্যের পরম্পরা হলো: নারায়ণ > বশিষ্ট >পরাশর> বেদব্যাস > ছায়া শুকদেব > গৌড়পাদ > গোবিন্দপাদ> শঙ্করাচার্য্য।
এ পরম্পরাটি সন্ন্যাস পরম্পরা নয়। শঙ্করাচার্য্য গোবিন্দপাদের নিকট হতে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন নি। এমনকি শঙ্করাচার্য্যের পূর্বে এ পরম্পরাতে কোন অবিচ্ছিন্ন সন্ন্যাস পরম্পরাই ছিলো না। বশিষ্ট, পরাশর,বেদব্যাস, ছায়া শুকদেবাদি কেউই সন্ন্যাসী ছিলেন না। বশিষ্ট, পরাশর, বেদব্যাস সকলেই গৃহস্থ ছিলেন। গৌড়পাদের গুরু ছায়াশুকও গৃহস্থ । গৌড়পাদের শিষ্য গোবিন্দপাদের চার বর্ণের চারটি পত্নী ছিলো, তার বড় ছেলের নাম শবর, শবরের বড় পুত্র ‘কুমার ভট্ট’ বিখ্যাত স্মার্ত পন্ডিত। গৌড়পাদ ও গোবিন্দপাদ উভয়ই প্রচ্ছন্ন বুদ্ধমতের প্রচারক। অনেকে ভেবে থাকেন, শঙ্করাচার্য্য গোবিন্দপাদের নিকট সন্ন্যাস নিয়েছিলেন, কিন্তু তা ভুল ধারণা। সায়ানাচার্য্য রচিত শঙ্করাচার্য্যের প্রামাণিক জীবনীগ্রন্থ ‘শঙ্কর দিগ্বিজয়’ গ্রন্থে উল্লেখ আছে, শঙ্করাচার্য্য মাতৃ বাক্যদন্ডে (গুরু হতে সন্ন্যাস গ্রহণ ব্যতীত-ই) নিজে নিজে সন্ন্যাস গ্রহণ করেছিলেন।
প্রমাণ:
শঙ্কর তার মাতাকে বললেন-
” এক্ষণে আপানার করিয়া অনুমতি হইলেই তদণ্ডে আমি সমস্ত ত্যাগ চতুর্থাশ্রম গ্রহণ করিতে প্রস্তুত আছি। এইরূপে বালক শঙ্কর স্পষ্ট করিয়া মনের ভাব প্রকাশ করিবার পর, তদীয় জননী পুত্রের সন্ন্যাস গ্রহণে সত্বর অনুমোদন প্রকাশ করিলেন। শীঘ্র অনুমোদন করিবার কারণ এই যে, যদি পুত্র জীবিত থাকে, তবেই তাহার দর্শন পাইতে পারিব। কিন্তু পুত্রের মৃত্যু হইলে আর এই দুরদৃষ্টে পুত্র দর্শন খড়িয়। উঠিবে না।মাতার অনুমতি হইবার পর শঙ্কর তৎক্ষণাৎ মনে মনে সংন্ন্যাস ধৰ্ম্ম গ্রহণ করিলেন।”
– (শঙ্কর দিগ্বিজয়, ৫।৬৫-৬৭)
গোবিন্দপাদের সাথে সাক্ষাৎ এর পূর্বেই তিনি একদন্ড গ্রহণ করেছিলেন। অর্থাৎ, গোবিন্দ পাদ থেকে তিনি সন্ন্যাস নেন নি, সুতরাং, স্পষ্টত, তার কোন সন্ন্যাস গুরু নেই।
প্রমাণ:
“যাহাদিগের আচরণ অত্যন্ত কুৎসিত, সেই সমস্ত অসৎপথাব্লম্বী লোকদিগকে দণ্ডিত করিবার জন্য জগদগুরু শঙ্কর, বাদীগণের উৎপীড়নে একান্ত কৃশাঙ্গী, প্রাচীন বেদবাণীকে অদ্বৈতপথে স্থাপন করিয়া এক দণ্ড গ্রহণ করিলেন। বস্তুতঃ অধার্ম্মিক, বেদবিদ্বেষ্টা, উন্মার্গ গামী লোক দিগকে শাসন করিবার নিমিত্তই তাঁহার দণ্ড গ্রহণ হইয়াছিল।”
– (শঙ্কর দিগ্বিজয়, ৫।৮৮)
“নবীন, রঞ্জিতবস্ত্র পরিধান করিয়া দন্ডধর শঙ্কর চন্দ্রহহিতা নর্ম্মদা নদীর তটনিকটস্থ গোবিন্দনাথের কাননে প্রবেশ করিলেন।”
– (শঙ্কর দিগ্বিজয়, ৫।৯০)
পরবর্তীকালে শঙ্করাচার্য্য দশনামী একদন্ডী সন্ন্যাস পরম্পরা প্রবর্তন করেছিলেন এবং ভারতের ৪ স্থানে ৪টি মঠ স্থাপন করেছিলেন। পদ্মপুরাণ, গরুড়পুরাণ, বরাহপুরাণে উল্লেখ আছে, শ্রীহরির অনুপ্রেরণায় শঙ্করাচার্য্য ‘মায়াবাদ’ প্রচার করেছিলেন, ‘মায়াবাদং অসৎ শাস্ত্রং…'(পদ্মপুরাণ,উত্তরখন্ড,১৩৬।৭-১২) ইত্যাদি ব্যাস বাক্য তার প্রমাণ। তাই এ সম্প্রদায়ের সন্ন্যাস ‘মায়াবাদী সন্ন্যাস’ বলে খ্যাত
মায়াবাদমসচ্ছাস্ত্রং প্রচ্ছন্নং বৌদ্ধমুচ্যতে।।
ময়ৈব কথিতং দেবী কলৌ ব্রাহ্মণরূপিণা।
অপার্থং শ্রুতিবাক্যানাং দর্শয়ল্লোকগর্হিতম্।।
কর্মস্বরূপত্যাজ্যত্বমত্র বৈ প্রতিপাদ্যতে।
সর্বকর্মপরিভ্রষ্টং বৈধর্ম্যত্বং তদুচ্যতে।।
পরেশজীবয়োরৈক্যং ময়া তু প্রতিপাদ্যতে।
ব্রহ্মণোঽস্যস্বয়ং রূপং নির্গুণং বক্ষ্যতে ময়া।।‌
সর্বস্য জগতোঽপ্যত্র মোহনার্থং কলৌ যুগে।
বেদার্থবন্মহাশাস্ত্রং মায়য়া যদবৈদিকম্।।
ময়ৈব রক্ষ্যতে দেবী জগতাং নাশকারণাৎ।
তচ্চাসুরাণাং মোহনার্থং ভগবত এবাজ্ঞয়েতি।।
[পদ্মপুরাণ: উত্তরখন্ড/১৩৬।৭-১২ ]
অনুবাদ: মহাদেব বলেছেন, “হে দেবী! প্রচ্ছন্ন বুদ্ধমতাবলম্বী মায়াবাদ নামে যে অসৎ শাস্ত্র রয়েছে তা কলিকালে আমিই ব্রাহ্মণমূর্ত্তিতে বলি। আমি শ্রুতিবাক্যের অন্য অর্থ করি ও কর্মকান্ড ত্যাগ করার কথা বলি, তাই একে বিধর্ম্ম বলা হয়। পরমেশ্বর ও জীবের ঐক্য প্রতিপাদন করি ও ব্রহ্ম এর রূপ কে আমি নির্গুণ বলে প্রচার করি, এই সব ই এই জগতকে মোহনের জন্য। হে দেবী মহাশাস্ত্র বেদান্তেও যে অবৈদিক মায়া কল্পনা করেছি তা জগতের নাশের নিমিত্ত। আমি অসুর দের মোহিত করার জন্য ভগবানের আজ্ঞায় এই রূপ অসৎ শাস্ত্র রচনা করি।
[ উল্লেখ্য, অধিকাংশ বৈষ্ণব সন্ন্যাসীগণ ত্রিদন্ড ধারণ করেন বিধায় ত্রিদন্ডী সন্ন্যাসকে ‘বৈষ্ণব সন্ন্যাস’ বলা হয়।]
সিদ্ধান্ত:
শাস্ত্রে প্রাচীনকালে একদন্ডী সন্ন্যাসের কথা থাকলেও তা দ্বাপরান্তে লুপ্তি পায়। কলির প্রারম্ভে বিষ্ণুর মাহামোহাবতার বুদ্ধ ও জিন কর্তৃক ভারতে বৈদিকধর্ম লুপ্ত হয়ে কপট আশ্রম ধর্ম ছড়িয়ে পড়ায় বৈদিক আশ্রম ধর্ম বিলুপ্ত হয়েছিলো। শঙ্করাচার্য্য তখন পুনরায় একদন্ডী সন্ন্যাস প্রবর্তন করেন। কলিকালে শঙ্করাচার্য্য কর্তৃক প্রবর্তিত দশনামী একদন্ডী সন্ন্যাসকে ‘মায়াবাদী সন্ন্যাস’ বলা হয়। কারণ, তা শঙ্করাচার্য্যের মায়াবাদ সিদ্ধান্ত দ্বারা দুষ্ট হয়। শঙ্কর পরবর্তী এ সম্প্রদায়ের সন্ন্যাসীগণ শঙ্কর অনুকরণে মায়াবাদ প্রচার করেছেন।
অর্থাৎ, কলিকালে শঙ্করাচার্য্য প্রবর্তিত যে একদন্ডী মায়াবাদী সন্ন্যাস (দশনামী সন্ন্যাস) তা প্রাচীন বৈদিক গুরুপরম্পরা ধারায় প্রাপ্ত সন্ন্যাস নয়। তা শঙ্করাচার্য্যের স্বয়ং প্রবর্তিত।
প্রাচীনকাল হতে ভারতভূমিতে বৈষ্ণব পরমহংসগণের ত্রিদন্ড সন্ন্যাস ব্যবস্থা চালু ছিলো। দ্বাপরের অন্তকালে শ্রীমদ্ভাগবতমেও একাদশ স্কন্দে উদ্ধবকে শ্রীকৃষ্ণ ত্রিদন্ড সন্ন্যাস সম্পর্কে জ্ঞান দিয়েছিলেন, যার থেকে স্পষ্ট সেকালে ত্রিদন্ড সন্ন্যাসের প্রচলিত ছিলো। অনেক মায়াবাদী স্মার্ত দাবী করেন, ত্রিদণ্ডী সন্ন্যাসের উল্লেখ কেবল পুরাণেই পাওয়া যায়, বেদে-স্মৃতিতে এর উল্লেখ নেই। তাদের ধারণা ভ্রান্ত!
বেদ-স্মৃতি-পুরাণের বহুস্থানে ত্রিদন্ডী সন্ন্যাসের উল্লেখ আছে। শুক্লযজুর্বেদীয় জাবালোপনিষদ ১৮ নং মন্ত্র, শাঠ্যায়নীয়োপনিষদের ৭-১১ নং মন্ত্রসমূহে, হারীতস্মৃতি ৬/৬,২৩ শ্লোকসমূহে, লিখিতস্মৃতি ২২ নং শ্লোকে, দক্ষসংহিতা ১।১৩,৩০ নং শ্লোকসমূহে এবং শ্রীমদ্ভাগবতমাদি ব্যাস রচিত মহাপুরাণসমূহে ত্রিদন্ডী বৈষ্ণব সন্ন্যাসের উল্লেখ আছে।
শ্রীল প্রভুপাদও তাঁর শ্রীমদ্ভাগবতমের ৪র্থ স্কন্দের ভাষ্যে সেটিই ব্যক্ত করেছেন-
“Since time immemorial, the sannyāsa order has carried the tridaṇḍa. Later Śaṅkarācārya introduced the ekadaṇḍi-sannyāsa. A tridaṇḍi-sannyāsī is a Vaiṣṇava sannyāsī, and an ekadaṇḍi-sannyāsī is a Māyāvādī sannyāsī. There are many other types of sannyāsīs, who are not approved by Vedic retuals.”
Points to be noted:
  • ১) এখানে ভাগবতম ভাষ্য শ্রীল প্রভুপাদ বলছেন, অনাদিকাল হতে সন্ন্যাস আশ্রমীরা ‘ত্রিদণ্ড’ ধারণ করে আসছেন। (যা শ্রীমদ্ভাগবতমের ১১ স্কন্দেও শ্রীকৃষ্ণ উদ্ধবকে ত্রিদণ্ড সন্ন্যাস উপদেশ করেছিলেন তাতেও প্রমাণিত)৷ প্রভুপাদ এখানে বলেন নি যে পূর্বে একদন্ডী বৈদিক সন্ন্যাস ছিলো না।
  • ২) অত:পর ‘Later’ শব্দ দ্বারা প্রভুপাদ কলিকালকে নির্দেশ করে বলেছেন, কলিকালে শঙ্করাচার্য্য একদণ্ডী সন্ন্যাস প্রবর্তন করেছেন। এ বাক্য ‘একদণ্ড’ দ্বারা শ্রীল প্রভুপাদ ইঙ্গিত করেছেন শঙ্করাচার্য্যের নিজের প্রবর্তিত ‘একদণ্ডী মায়াবাদী সন্ন্যাস’কে, যেটি দশনামী সন্ন্যাস নামে পরিচিত। শ্রীল প্রভুপাদ পরের বাক্যেই ‘ekadaṇḍi-sannyāsī is a Māyāvādī sannyāsī’ -দ্বারা তা স্পষ্ট করেছেন। শঙ্করাচার্য্য প্রবর্তিত এ একদণ্ডী সন্ন্যাসীরা যারা শঙ্করাচার্য্যের মায়াবাদকে আশ্রয় করে তা প্রচার করেছেন, তারাই মায়াবাদী সন্ন্যাসী নামে পরিচিত হয়।
Avatar of Prakash Chandra Deb

Prakash Chandra Deb

Writer & Admin

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments