যদি সবকিছুরই স্রষ্টা থাকে, তাহলে সৃষ্টিকর্তার স্রষ্টা কে?

20250605_232649

অভিমত: প্রকৃতপক্ষে এখানে কোনো সৃষ্টিকর্তা নেই! তাই সৃষ্টিকর্তার স্রষ্টা কে? এই প্রশ্নটিই অবান্তর।

সাধারণত আমরা কোনোকিছু সম্পূর্ণরূপে নতুনভাবে তৈরি করাকেই সৃষ্টি বলি, আর যে সৃষ্টি করলো তাকে সৃষ্টিকর্তা বলি। একটু গভীরভাবে চিন্তা করলেই বুঝতে পারা যায়, আসলে কোনোকিছুই সৃষ্টি হচ্ছে না, সমস্ত উপাদান ইতিমধ্যেই এখানে রয়েছে। শুধুমাত্র রূপ পরিবর্তন হওয়ার দরুন আমরা ভাবছি সৃষ্টি হয়েছে। সাধারণ দৃষ্টিতে দেখলে বোঝা যায় প্রত্যেক কিছুরই সৃষ্টিকর্তা রয়েছে। এই যুক্তিতে গেলে প্রশ্নের পর প্রশ্নই উত্থাপিত হবে। কখনও কোনোরূপ সমাধানে পৌছানো যাবে না। যেমন- সৃষ্টিকর্তার স্রষ্টা কে, যদি অন্য স্রষ্টা থাকে, তাহলে আবার তার স্রষ্টা কে? এভাবে প্রশ্ন চলমান থেকেই যাবে। এই পর্বে আমরা ব্যাখ্যা করবো কেন সৃষ্টিকর্তার কোনো স্রষ্টা নেই এবং কেনইবা সৃষ্টিকর্তার কোনো স্রষ্টার প্রয়োজনীয়তা নেই। কারণ- বৈদিক শাস্ত্রে বলা হয়েছে-

❝सर्वं खल्विदं ब्रह्म__”সর্বং খ্বলিদং ব্রহ্ম__সমস্ত জগৎ ব্রহ্ম ছাড়া কিছুই নয়।❞ (Everything indeed is Brahman.) [ছান্দোগ্য উপনিষদ- ৩/১৪/১]

এই ব্রহ্মকে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে বলা হয়-

❝यतो वा इमानि भूतानि जायन्ते, येन जातानि जीवन्ति, यत् प्रयन्त्यभिसंविशन्ति, तद् विजिज्ञासस्व, तद् ब्रह्मेति। __যতো বা ইমানি ভূতানি জায়ন্তে যেন জাতানি জীবন্তি যৎ প্রয়ন্ত্যভিসংবিশন্তি। তদ্বিজিজ্ঞাসস্ব তদ ব্রহ্মেতি।__যাঁহা হইতে এই সকল প্রাণী উৎপন্ন হয়, উৎপন্ন হইয়া যদ্দারা জীবিত থাকে, প্রলয়ে যাতে প্রবেশ করে, তাকে জানো, তিনিই ব্রহ্ম।❞ [তৈত্তীরিয় উপনিষদ: ৩/১/১]

এই ব্রহ্ম সর্বব্যাপী একক সত্তা, অবিদ্যা পরবশত দেহাত্মবুদ্ধির স্তরে থেকে জীব নিজেকে ও জগতকে এঁর থেকে কেবল স্বতন্ত্র বলে মনে করে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে,

❝एकमेवाद्वितीयम्__একমেবাদ্বিতীয়ম্❞__ তিঁনি এক এবং অদ্বিতীয়। [ছান্দোগ্য উপনিষদ– ৬/২/১]এ

এই মহাবাক্য সেই পরব্রহ্মকে নির্দেশ করে এবং এটি এও বোঝায় যে তিঁনি ভিন্ন কিছুই অবশিষ্ট নেই। সবকিছুই তাঁর অংশসদৃশ, সেই অর্থেই তিঁনি এক এবং অদ্বিতীয়। এখানে, ঐখানে, সবখানেই, তিঁনি ব্যতীত আর কিছুই নেই। অর্থাৎ, তিঁনি এক এবং তিঁনি ভিন্ন দ্বিতীয় কিছুই নেই। এজন্যই তাঁর এই উপযুক্ত উপাধি “এক এবং অদ্বিতীয়”।

সেই এক, অদ্বিতীয় পরম পুরুষ হচ্ছেন বাসুদেব।

❝वासुदेवः सर्वमिति__বাসুদেবঃ সর্বম্ ইতি❞ [ভ:গী- ৭/১৯] বাসুদেব (কৃষ্ণ) তিঁনিই সবকিছু।

আমরা যারা অবিদ্যায় আচ্ছন্ন হয়ে এই পরম সত্যকে উপলব্ধি করছি না কিংবা বিদ্যার অনুশীলনে যারা রত, উভয়ই তাঁর অংশ।

❝ममैवांशो__মামৈবাংশ__আমার অংশ❞ [ভ:গী- ১৫/৭]

প্রসঙ্গ ব্যাখ্যা: পরমেশ্বর ভগবান অচিন্ত্য শক্তির অধিকারী, তাই এখানে উদাহরণস্বরূপ বলা যায় একটি শরীরে বিভিন্ন প্রকারের শক্তি পরিলক্ষিত হয়, যেমন- দৃষ্টিশক্তি, শ্রবণশক্তি, ঘ্রাণশক্তি, বাকশক্তি ইত্যাদি। এই সমস্ত শক্তিই একটি শরীরের সাথে সংযুক্ত। শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। বিচ্ছিন্ন হওয়া মানে অস্তিত্ব হারিয়ে যাওয়া। আবার এই সমস্ত শক্তি সমূহ ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তিও নয় কিন্তু এই ভিন্ন ভিন্ন শক্তির ভিন্ন ভিন্ন কার্য বা বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এক শক্তি অন্য শক্তির কাজ করে না। যেমন আপনি দৃষ্টিশক্তি দিয়ে শ্রবণ করতে পারবেন না, শ্রবণ শক্তি দিয়ে ঘ্রাণ নিতে পারবেন না। সেই শক্তি সমূহের ভিন্ন ভিন্ন পরিচয় থাকলেও তারা একক কেন্দ্রীয় সত্তা শরীরের সাথে যুক্ত থেকেই শরীরের তুষ্টিতে নিয়োজিত। শক্তিমান থেকে শক্তিকে আলাদা করা যায় না আবার শক্তি কখনো শক্তিমান হয়ে যায় না। ঠিক তেমনিভাবেই পরমেশ্বর ভগবান পরম সত্ত্বা যাঁকে পরব্রহ্ম বলা হচ্ছে তাঁর অচিন্ত্য শক্তি রয়েছে- হ্লাদিনী শক্তি, বহিরঙ্গা মায়া শক্তি, অন্তরঙ্গা যোগমায়া শক্তি, তটস্থা শক্তি ইত্যাদি। সেইসব শক্তি সমূহের ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য ও কার্য রয়েছে। সেই শক্তি সমূহ ভিন্ন ভিন্ন পরিচয় বহন করলেও প্রকৃত অর্থে কেন্দ্রীয় সত্ত্বা পরম ব্রহ্মের অংশসদৃশ, আলাদা নয়। তাই সেই শক্তি সমূহ কখনোই নিজে পরম সত্ত্বাও নয়। পরম সত্ত্বা পরম ব্রহ্মের থেকে নির্গত শক্তি মাত্র। তার থেকেই সবকিছু প্রবাহিত হয়ে বহমান রয়েছে। তাই তিঁনি বলেন-

❝अहं सर्वस्य प्रभवो__অহং সর্বস্য প্রভবো__আমিই জড় ও চেতন সমস্ত কিছুর উৎস❞ [ভ:গী: ১০/৮]

এক কথায় আমি, আপনি, জগৎ, কাল সবকিছুই তাঁর অচিন্ত্য শক্তির স্বপ্রকাশ। অতএব তাই শাস্ত্রে বর্ণিত হয়েছে-

❝सः अहम्__সোহং❞__পরমেশ্বরের সাথে আমি সম্বন্ধযুক্ত।  [ঈশোপনিষদ: ১৬]

❝अहम् ब्रह्मास्मि__অহম্ ব্রহ্মাস্মি__আমি ব্রহ্মবস্তু হই❞ [বৃহদারণ্যক উপনিষদ: ১/৪/১০ ]

❝तत्त्वमसि__তত্ত্বমসি❞__তুমিও সেই। [ছান্দোগ্য উপনিষদ: ৬/৮/৭]

শ্রীল প্রভুপাদ উদাহরণ দিচ্ছেন-
❝যেমন, একটি বৃক্ষ হচ্ছে একটি পূর্ণ সত্তা, কিন্তু তার শাখা-প্রশাখা এবং পাতাগুলি হচ্ছে সেই বৃক্ষের বিভিন্ন অংশ। বৃক্ষের পাতা এবং শাখা-প্রশাখাগুলিও বৃক্ষ; কিন্তু পূর্ণ বৃক্ষটি পাতা নয় অথবা শাখা-প্রশাখা নয়; বেদে বলা হয়েছে, ‘সর্বং খ্বলিদং ব্রহ্ম’- অর্থাৎ, সমস্ত জগৎ ব্রহ্ম ছাড়া আর কিছুই নয়। এই উক্তিটির অর্থ হচ্ছে যেহেতু সব কিছুই পরম ব্রহ্ম থেকে প্রকাশিত হয়েছে, তাই সবই ব্রহ্ম। তেমনই, দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হাত-পাগুলিকে দেহ বলা হয়, কিন্তু পূর্ণ দেহটি হাত অথবা পা নয়।❞ [ভা: ১/৫/২০ ভক্তিবেদান্ত তাৎপর্য]

প্রসঙ্গ ব্যাখ্যা: আসলে সেই পরম সত্তার ক্ষেত্রে সম্বোধিত শব্দ “সৃষ্টিকর্তা” শব্দটিই বেমানান। আপনারা যাঁকে সৃষ্টিকর্তা বলে জানেন, তাঁকে বেদে বলা হয়েছে কৃষ্ণ অর্থাৎ সর্বাকর্ষক, তিনি সমস্ত আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। তিঁন বিষ্ণু অর্থাৎ তিঁনি সর্বব্যাপী, সবকিছুই তাঁর অংশ। প্রকৃতপক্ষে তিঁনি ব্যতীত ভিন্ন কিছুই এজগতে নেই। যেহেতু বদ্ধজীবের চেতনা জড়জগতের ত্রিগুণের (সত্ত্ব রজ তম) বিভিন্ন মাত্রার জড় কলুষের দ্বারা আবৃত থাকার কারণে তাদের নিকট এজগতে দৃশ্যমান বস্তু মানুষ, পশুপাখি, গাছপালা, ঘরবাড়ি, নদীনালা, পাহাড়-পর্বত, ইট-পাথর ইত্যাদি হিসেবে প্রতীয়মান হচ্ছে। বস্তুতপক্ষে সবই পরম-সত্তার স্বরূপ। তিঁনিই সর্বত্র বিস্তৃত; সবকিছু তাঁরই অংশসদৃশ। অজ্ঞানতার কারণে সেসবকিছুকে আমরা পরমেশ্বর থেকে আলাদা ভাবছি বা দেখছি আসলে সবই সেই পরম তত্ত্বের সাথে সংযুক্ত, পরম ঈশ্বর থেকে কখনোই তা বিচ্ছিন্ন নয়। এজগতে বা চিন্ময় জগতে, দৃশ্যমান কিংবা অদৃশ্য কোনোকিছুই প্রকৃতপক্ষে কৃষ্ণ থেকে স্বতন্ত্র নয়। স্বতন্ত্রতা আমাদের ভাবনায়, চেতনায়। আর এজন্য আমরা ভাবছি তিনি সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা হলে তার সৃষ্টিকর্তা কে?

অতএব, যেহেতু দৃশ্যমান ও অদৃশ্য সবকিছুই পরমেশ্বর পরব্রহ্মের সাথে সম্বন্ধযুক্ত ও সংযুক্ত সেহেতু উপরিউক্ত দর্শন অনুযায়ী এখানে সৃষ্টিকর্তার স্রষ্টার প্রয়োজনীয়তাও নেই এবং রয়েছেন কিনা এই প্রশ্নটাই এক অজ্ঞানতার পরিচয় বহন করে।

আশা করছি পরবর্তী পোস্টে সেই পরম সত্ত্বার স্বরূপ ও তাঁর বিস্তৃতি আলোচিত হলে বিষয়টি আরো পরিস্কার হবে।

✍️ প্রবীর চৈতন্য চন্দ্র দাস

Pravira Caitanya Candra Das

Writer & Admin

4 3 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
2 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Mitun Debnath
Mitun Debnath
1 month ago

ভ্রান্ত প্রশ্নে প্রাসঙ্গিক ব্যাখ্যা