মৃগয়ার উদ্দেশ্য কি? মাংসাহার নাকি লোক কল্যাণ?

448993340_494286626501762_9171595380647725788_n
আমাদের মধ্যে অনেকে ভেবে থাকেন, ক্ষত্রিয় রাজারা বুঝি পশুমাংস ভক্ষণের উদ্দেশ্যে মৃগয়া করতেন। এমনকি কিছু অতি উৎসাহী ব্যক্তিও পাওয়া যায় মাঝে মাঝে, যারা রামায়ণ/মহাভারত থেকে শ্রীরামচন্দ্র বা পান্ডবদের মৃগয়ার দৃষ্টান্ত দেখিয়ে দাবী করে বসেন, তারাও নাকি মাংসভোজী ছিলেন! যারা এরূপ ভাবেন, তারা ‘ক্ষত্রিয়’ ও ‘ব্যাধ’ জাতির মধ্যকার পার্থক্য বুঝেন না। পশুশিকার করে পশুমাংস ভক্ষণ ও বিক্রি করা ব্যাধ(কসাই) জাতির কর্ম। এটি গর্হিত কর্ম, এ ধরনের নিন্দিত কর্মকারীদের অস্পৃশ্য গণ্য করা হতো। তাই এ সমস্ত ব্যাধ জাতিদের নগরীর মধ্যেও বসবাস করতে দেওয়া হতো না। নগরীর বাইরে বনের মধ্যে তাদের বাস করতে হতো। অপরদিকে ক্ষত্রিয়ের কর্ম উদ্দেশ্য মহৎ। সমস্ত মনুষ্য এবং জীবকূলের রক্ষা ক্ষত্রিয়ের ধর্ম। ধর্মার্থে মৃগয়া ক্ষত্রিয়ের কর্তব্য, কিন্তু মাংসাহারের জন্য মৃগয়ার বৈধতা নেই ক্ষত্রিয়ের। ভগবান শ্রীরামচন্দ্র স্বয়ং ক্ষত্রিয়ের মৃগয়া ধর্ম বর্ণনাকালে তা উল্লেখ করেছেন-
রাজ্ঞাঞ্চ মৃগয়া ধর্ম্মে বিনা আমিষভোজনম্॥
~ [পদ্মপুরাণ:পাতালখন্ড/৭০।১৯৬ (নবভারত)]
বঙ্গানুবাদঃ শ্রীরাম বললেন, ‘ধর্মার্থে রাজা কর্তৃক মৃগয়ার বিধান থাকলেও আমিষভক্ষণের জন্য মৃগয়ার বিধান নেই।’
Raghava said, “Hunting without eating the flesh (of the animal killed) is the rule in the hunting done by a king.” [Padma Purana, Patal Khand, 116/199, Motilal Banarasidass Press]
প্রশ্ন-১: তাহলে প্রশ্ন উঠে, রাজারা যদি পশুমাংস আহারই না করবেন, তবে কিরূপ ধর্ম পালনের জন্য তারা মৃগয়া করতেন?
উত্তরঃ মূলত লোক কল্যাণার্থে ৪টি কারণে ক্ষত্রিয়রা মৃগয়া করতেন-
  • ১) রাজা কেবল কোন রাজ্যের বসবাসরত মানুষের অধিপতি নয়, সে রাজ্যের অন্যান্য জীব জন্তুদেরও অধিপতি। মানুষের মতো পশুপাখিদের মধ্যেও অন্তঃ ও আন্তঃ বিরোধ প্রায়ই দেখা যায়, যা প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্টের জন্য দায়ী হয়ে পড়ে। তাই রাজা মৃগয়া করে জীবজন্তদের মধ্যকার এরূপ দ্বন্দ্বের নিরশন করেন।
দৃষ্টান্ত: বাল্মীকি রামায়ণের কিষ্কিন্ধাকান্ডের ১৮ নং সর্গে বর্ণিত আছে, বানর সাম্রাজ্য নিয়ে বালী ও সুগ্রীব নামক দুই বানরের মধ্যে যুদ্ধ হলে রামচন্দ্র মৃগয়া দ্বারা বালীকে বধ করে বানরকূলের অন্তঃদ্বন্দ্বের নিরশন করেন।
  • ২) পূর্ব যুগসমূহে অসুরেরা বিভিন্ন জন্তুর (যেমন: মৃগ,অজ,খরগোশ ইত্যাদি) রূপ ধারণ করে বনে বিচরণ করতো এবং সুযোগ পেলে মুনি ঋষিদের বধ করতো। ক্ষত্রিয় রাজারা এ সমস্ত পশুরূপী অসুরদের বধ করে মুনি ঋষিদের সুরক্ষা দান করতেন।
দৃষ্টান্ত: বাল্মীকি রামায়ণের অরণ্যকাণ্ডের ১০ম সর্গে আমরা দেখতে পাই, দন্ডকারণ্যে মুনি ঋষিরা রামচন্দ্রের নিকট প্রার্থনা করেন, মৃগরূপী অসুরদের নাশ করে তাদের রক্ষা করতে। রামচন্দ্র তাদের অভয়দান করেন এবং সমস্ত দন্ডকারণ্য অসুরমুক্ত করেন। এছাড়াও মারীচাদি অসুরদের মৃগরূপ ধারণ করে রাম-লক্ষ্মণের উপর আক্রমণের একাধিক উপাখ্যান বর্ণিত আছে। রামচন্দ্র এসব অসুরদের বধ করতেন।
  • ৩) ‘কস্তুরী মৃগ’ নামক এক বিশেষ প্রকারের মৃগ আছে, যার নাভীতে এক বিশেষ প্রকার গ্রন্থী থাকে। পরিণত বয়সে এ গ্রন্থ থেকে অতীব সুগন্ধ ছড়ায়। এ সুগন্ধ এতোই মনোহর যে তা সমস্ত জীব জন্তুদের আকৃষ্ট করে। কিন্তু কস্তুরী মৃগ নিজে বুঝে না যে এ গন্ধ তার নাভী থেকে আসছে। সে পাগলের মতো খানা-পিনা ছেড়ে ছাটাছুটি করতে থাকে। এভাবে দুর্বল হয়ে এক সময় মারা যায়। মারা গেলে মহামূল্যবান কস্তুরী নষ্ট হয়ে যায়। এ কস্তুরী ওষুধ ও পারফিউম তৈরিতে ব্যবহৃত হতো। বনের মধ্যে পাগলা কস্তুরী মৃগের সামনে কোন মনুষ্য পড়লে এর আক্রমণে অকালমৃত্যু বরণ করতে হতো। তাই তাদের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ অতীব জরুরি হয়ে পড়ে। সেজন্য নির্দিষ্ট মৌসুমে রাজাদের মৃগয়ায় গিয়ে এ কস্তুরী মৃগদের বধ করতে হতো।
  • ৪) এছাড়া নরমাংসভোজী বাঘ্র, সিংহ, ভাল্লুকাদি হিংস্র জীবের উৎপাত শুরু হলেও তাদের বধের জন্য ক্ষত্রিয় রাজারা মৃগয়া করতেন।
দৃষ্টান্ত: শ্রীমদ্ভাগবতমের ১০ম স্কন্ধের ৫৬-৫৭ অধ্যায় হতে আমরা জানতে পারি, সত্রাজিৎ এর ভাইকে বনমধ্যে সিংহ বধ করলে শ্রীকৃষ্ণ মৃগয়ায় গিয়ে সিংহকে বধ করে এবং জাম্বুবান নামক ভাল্লুকরাজকে যুদ্ধে পরাজিত করে সত্রাজিতের হারানো সামন্তক মণি উদ্ধার করেন।
প্রশ্ন-২: মৃগয়ায় শিকার করা জন্তুদের কি করা হতো?
উত্তর: ১) মৃগয়ায় বধ হওয়া জন্তুদের চামড়া বিশেষ করে হরিণ ও বাঘের চামড়া মুনি ঋষিদের দান করা হতো। এর উপর বসে তারা যখন তপস্যা করতেন। এছাড়া মৃগচর্ম, ব্যাঘ্রচর্ম মুনি ঋষিরা পরিধান করতেন। এমনকি মহাদেব শিবও ব্যাঘ্র চর্ম পরিধান করে তপস্যা করেন। গীতাতেও মৃগচর্মের উপর বসে তপস্যার বিধান আছে। এভাবে মুনি ঋষি তপস্বীগণ যখন এসমস্ত বধ্য জীবের চর্মের উপর তপস্যা করতো, সে পুণ্য প্রভাবে এ সমস্ত জীবেরা উত্তম গতি প্রাপ্ত হতো।
২) মৃগয়ায় বধ হওয়া পশুর দেহের উপর নানাবিধ গবেষণা করা হতো। প্রাণীর অভ্যন্তরীন গঠন, অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কার্যাবলি ইত্যাদি সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনের জন্য মৃত জন্তু ঋষিকূলে পাঠানো হতো। সেখানে তারা যজ্ঞে বসে এ সমস্ত মৃত পশুদের শুদ্ধি করে নানা প্রকার অঙ্গ প্রত্যঙ্গ পর্যবেক্ষণ করতো এবং নানা গ্রন্থি হতে প্রয়োজনীয় উপকরণ সংগ্রহ করে নানা রোগের ওষুধি প্রস্তুত করা হতো।
৩) মৃগয়ায় যে পশুমাংস পাওয়া যেত তা যজ্ঞের পর রাজ-কুকুর, রাজ-শকুন, রাজ-চিল ইত্যাদি মাংসাশী পশুপাখিদের খাওয়ানো হতো। একে শাস্ত্রের ভাষায় ‘ভূতযজ্ঞ’ বলা হয়।
এভাবে বিধিবৎ মৃগয়া দ্বারা প্রভূত লোক-কল্যাণ সাধিত হতো।
প্রশ্ন-৩ মৃগয়ায় যে পশুবধ হচ্ছে তাতে কি সত্যিই পাপ হয় না? মৃগয়াকালে তো নির্দোষ জীবেরও বধ হতে পারে।
উত্তর: লোক কল্যাণার্থে মৃগয়া উদ্দেশ্য হলেও মৃগয়াকালে অনেক সময় নির্দোষ জীবেরও বধ হয়ে যায়। রামায়ণে দেখা যায় রাজা দশরথ কিংবা মহাভারতে দেখতে পাই রাজা পান্ডুর দ্বারাও মৃগয়াকালে ভুলে ঋষিহত্যা পর্যন্ত হয়ে গিয়েছিলো। তাই মৃগয়াকালে কম বেশি পাপ হয়েই থাকে। এ পাপ হতে বাঁচতে ক্ষত্রিয়কে শেষ বয়সে সংসার ত্যাগ করে ভগবানের সন্তুষ্টি বিধানের জন্য তপস্যায় নিজেকে নিয়োজিত করতে হয়।
শ্রীকৃষ্ণ উবাচ-
ক্ষাত্রধর্মস্থিতাে জন্তুন্যবধীরমগয়াদিভিঃ।
সমাহিতস্তত্তপসা জহঘং মদুপাশিতঃ ॥
~ [শ্রীমদ্ভাগবতম ১০/৫১/৬২]
অনুবাদঃ পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ রাজা মুচুকুন্দকে বললেন, “যেহেতু তুমি ক্ষত্রিয়ের নীতি অনুসরণ করেছিলে, তাই মৃগয়া ও অন্যান্য কর্তব্য সম্পাদনের সময় তুমি প্রাণী হত্যা করেছ। আমাতে শরণাগত হয়ে থেকে যত্ন সহকারে তপস্যা পালনের দ্বারা তোমার সঞ্চিত পাপরাশি পরাভূত করা উচিত।”
প্রশ্ন-৪: কোন ক্ষত্রিয় যদি লোককল্যাণার্থ মৃগয়া না করে ইন্দ্রিয় তৃপ্তির কোন মৃগয়া করে তবে তার পরিণতি কি হবে?
উত্তরঃ এর উত্তরে মনুস্মৃতিতে বর্ণিত আছে,
“যে লোক নিজের সুখের জন্য হিংসারহিত হরিণ প্রভৃতি নিরীহ পশুদের হত্যা করেন, সে লোক জীবিত কিংবা মৃত্যুর পর কোন অবস্থাতেই সুখী হতে পারেন না।”
~ [ মনুসংহিতা, অধ্যায় ৫, শ্লোক ৪৫ ]
মনুসংহিতায় ক্ষত্রিয়দের পক্ষে পাপের সম্ভাবনা আছে এরূপ দশটি পাপের কথা বলা হয়েছে, যেখানে বলা হচ্ছে মৃগয়া যেহেতু বধকার্য্য, এর মাধ্যমে ক্ষত্রিয় খুব সহজেই দূষিত হয়ে যেতে পারে এবং পাপভাগী হতে পারে-
পানমক্ষাঃ স্ত্রিয়শ্চৈব মৃগয়া চ যথাক্ৰমম্।
এতৎ কষ্টতমং বিদ্যাচ্চতুষ্কং কামজে গণে৷৷
~ [মনুস্মৃতি ৭।৫০]
অনুবাদ: ক্ষত্রিয়ের দশটি কামজ দোষের মধ্যে মদ্যপান, পাশাখেলা, স্ত্রীসম্ভোগ (ব্যভিচার অর্থে) এবং মৃগয়া—এই চারটিকে যথাক্রমে অত্যন্ত দূষ্য এবং কষ্টতম বলে বুঝতে হবে।।
তাই, মহাভারতে ক্ষত্রিয় রাজের প্রতি মহামন্ত্রী বিদূরের উপদেশ তারা যেন লোকরক্ষা ব্যতীত আসক্তি বশত মৃগয়া না করেন।
সপ্ত দোষাঃ সদা রাজ্ঞা হাতব্যা ব্যসনোদয়াঃ।
প্রায়ণো যৈবিনশ্যন্তি কৃতমূলা অপীশ্বরাঃ ॥
স্ত্রিয়োহ’ক্ষা মৃগয়া পানং বাকপারুষ্যাঞ্চ পঞ্চমম্।
মহচ্ছ দণ্ডপারুষ্যমর্থদূষণমেব চ ॥
~ [মহাভারত, উদযোগপর্ব, ৩৩।৯৭-৯৮]
অনুবাদ: সপ্তবিধ দোষ যথা- স্ত্রীসঙ্গ, দ্যূতক্রীড়া, মৃগয়া, মদ্যপান, কটু কথা বলা, নিষ্ঠুরভাবে গুরুতর দণ্ড করা এবং ঘুষ প্রভৃতি গ্রহণ করা ॥ সুপ্রতিষ্ঠিত প্রভুরাও যেগুলি দ্বারা প্রায়ই বিনষ্ট হইয়া থাকেন, আসক্তিমূলক সেই সপ্তবিধ দোষ রাজা সর্ব্বদাই ত্যাগ করিবেন ॥
ঐতিহাসিক বিবরণ: মাত্র ২৫০ বছর আগেও এ ভারত ভূমিতে ক্ষত্রিয়রা আমিষাহার করতেন না। মোগল আমলে এসে ক্ষত্রিয়রা ম্লেচ্ছ যবন শাসকদের সাথে মিশে অখাদ্য-কুখাদ্য খাওয়া শুরু করলো তো ক্ষত্রিয়ত্বই বিসর্জন দিলো। ইতিহাস সাক্ষী, সম্রাট ছত্রশাল যবন (গো-খাদক) শত্রুদের সাথে যুদ্ধে তাদের পরাজিত করে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। যুদ্ধভূমিতে তাদের খাওয়ার মতো কিছু ছিলো না। তখন সৈনিকেরা বললো, পলাতক যবন শত্রুদের ঘাটিতে কিছু খাবার আছে, ওগুলো খেয়ে নিক তারা। কিন্তু সম্রাট ছত্রশাল সে আজ্ঞা দেন নি। তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘’আমরা প্রয়োজনে না খেয়ে জীবন বিসর্জন দিবো, কিন্তু কভু মাংসাহার করবো না’। শেষে ঘোড়াশালে ঘোড়ার জন্য রাখা শস্যদানা খেয়ে তারা জীবন রক্ষা করেছিলেন। আরো উদাহরণ লাগবে? ক্ষত্রিয়কূল তিলক মহারাণা প্রতাপের নাম কে না জানে? সেই মহারানা প্রতাপের জীবনে এমন বিকট পরিস্থিতি এসেছিলো তাকে স্ত্রী পুত্র নিয়ে বনে আত্মগোপণে থাকতে হচ্ছিলো। সে সময় তিনি তার পুত্রের জন্য ঘাসের রুটি তৈরি করতেন। কখনো ভেবে দেখেছেন, মহারানা প্রতাপের কেন ঘাসের রুটি সংগ্রহ করতে হচ্ছে? তিনি কি বন্য পশু মেরে জলসে খেতে পারতেন না? কারণ তারা সকলেই শাকাহারী ছিলেন।
তাই, অহেতুক না জেনে ক্ষত্রিয়দের ব্যাধ-কসাইয়ের সাথে এক কাতারে ফেলবেন না। ক্ষত্রিয় সর্ববর্ণের ও সর্বজীবের কল্যাণার্থে অস্ত্রধারণ করেন, তুচ্ছ ইন্দ্রিয় তৃপ্তির জন্য নয়।

Pravira Caitanya Candra Das

Writer & Admin

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments