***নিত্যানন্দ প্রভুর সেবিত ‘বাঁকারায়’ বিগ্রহ***
শ্রীশ্রী বাঁকারায়ের শ্রীমন্দির একচক্রাধাম বীরচন্দ্রপুর তথা পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম সুপ্রাচীন মন্দির। এই মন্দিরে অধিষ্ঠিত শ্রীশ্রী বঙ্কিমবিহারী তথা প্রভু বাঁকারায়।
বাঁকারায় শব্দটিকে ভাঙলে পাওয়া যায় ‘বাঁকা’ ও ‘রাই’। ‘বাঁকা’ শ্রীকৃষ্ণ-গোবিন্দের অপর নাম এবং ‘রাই” অর্থে শ্রীমতি রাধিকা । অর্থাৎ প্রভু বাঁকারায় হল শ্রীরাধা-গোবিন্দের মিলিত বিগ্রহ।
ভগবান চৈতন্য মহাপ্রভু জগন্নাথ পুরীতে যাওয়ার পর, তিনি ভগবান নিত্যানন্দকে বাংলায় ফিরে গিয়ে ধর্মপ্রচার করার নির্দেশ দেন। এই সময়ে নিত্যানন্দ প্রভু একচক্রে ফিরে আসেন। ততক্ষণে তার বাবা-মা এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। এরপর তিনি কদম্ব খান্ডিতে যমুনায় বাঁকে রায় দেবতার সন্ধান পান। তিনি এই দেবতাকে একটি মন্দিরে স্থাপন করেছিলেন। পরে, শ্রীমতি রাধারাণীর এক বিগ্রহ আবিষ্কৃত হয় ভদ্রাপুরে, বীরচন্দ্রপুরা এলাকায়, একটি নিম গাছের শিকড়ের নীচে, প্রায় ½ মাইল পশ্চিমে। শ্রীমতির সে বিগ্রহ বাঁকে রায়ের ডানদিকে স্থাপন করা হয়েছিল। এই কারণে, বাঁকে রায়ের রাধারাণী ভদ্রাপুরের ঠাকুরানি নামে পরিচিত।
***কিভাবে নিত্যানন্দ প্রভু ‘বাঁকারায়’কে প্রাপ্ত হলেন?***
পূর্বে ব্রজ পরিক্রমা করতে বৃন্দাবন যাত্রাপথে নিত্যানন্দ প্রভু কদম্বখাণ্ডিতে যমুনার ভেজা মাটিতে কৃষ্ণের বাঁকারায় বিগ্রহটি আবিষ্কার করেন। সে সময়, তিনি ভাবলেন যে তিনি বৃন্দাবন যাচ্ছেন কিন্তু এখন বৃন্দাবনই তাঁর কাছে এসেছে। তিনি হাসতে লাগলেন। মনে মনে তিনি স্থির করলেন যে তিনি এখন ব্রজেই যাবেন এবং ফিরে আসার পর তিনি একটি মহোৎসব করে শ্রীবিগ্রহকে স্থাপন করবেন।
তারপর তিনি বাঁকারায়ের শ্রীবিগ্রহকে রেশমের কাপড়ে জড়িয়ে নিম গাছের একটি গর্তে লুকিয়ে রাখলেন এই ভেবে যে, ফেরার পথে তাঁকে তুলে নেবেন। যাই হোক, শ্রীকৃ্ষ্ণচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশে ৩০ বছর পর নিত্যানন্দ প্রভু একচক্রাতে ফিরে আসেন। ফিরবার সময় একটি ভিন্ন পথ দিয়ে আসেন বলে বাঁকা রায়কে তুলে নিতে পারেননি৷ একচক্রায় ফিরে আসলে প্রথম রাতেই বাঁকারায় নিত্যানন্দ প্রভুর স্বপ্নে আবির্ভূত হয়ে তাঁকে বলেন যে,তিনি ক্ষুধার্ত এবং তিনি নিম গাছের গর্তে লুকিয়ে থাকতে থাকতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন৷ তিনি নিত্যানন্দকে বৃন্দাবন থেকে ফিরে আসার পর তাকে নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতিটি স্মরণ করিয়ে দেন। স্বপ্নে তখন নিতাই বাঁকারায়কে বলেন, যে তিনি এসে তাঁকে উদ্ধার করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তিনি অন্য পথ দিয়ে ফিরে আসায় তা সম্ভব হয়নি। কিন্তু বাঁকারায় তাঁকে জানালেন যে তিনি এখনও ঐ প্রতিশ্রুতি অনুসারে উত্তম নৈবেদ্য এবং জমকালো প্রতিষ্ঠা অনুষ্ঠান চান।
নিত্যানন্দ প্রভু তখন বাঁকারায়কে বলেছিলেন যে তিনি ক্লান্ত এবং ঠিক তখনই আসতে পারছেন না। তারপর তিনি বাঁকারায়কে কি কি চান তা স্থির করতে বলেন এবং তিনি তা পালন করতে প্রতিশুতি দেন।
বাঁকারায় তখন নিত্যানন্দ প্রভুকে বললেন, “ঠিক আছে, আপনি যদি আমার কাছে আসতে না পারেন, তবে আমি আপনার কাছে আসব। আপনি আমাকে যে নিমগাছের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছিলেন, সকালে সেই একই নিম গাছের মধ্যেই আমি যমুনার নিচে ভেসে যাব। কদম্বখাণ্ডিতে যেখানে আপনি আমাকে প্রথমবার পেয়েছিলেন সেখানে গিয়ে আমাকে গাছের গর্ত থেকে বের করবেন এবং খুব আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানের মধ্যে আমাকে যথাযথভাবে প্রতিষ্ঠা করুন।”
পরদিন সকালে, নিত্যানন্দ প্রভু স্নান করার পরে, ঐ নিম গাছটি নদীর তীরে ভাসতে দেখেন। তিনি শ্রীবিগ্রহকে বের করে তাঁর শ্রীপাটে নিয়ে আসেন এবং তিনি নিজেই প্রতিদিন পূর্ণ ঐশ্বর্য সহকারে বাঁকারায়ের পূজা করতে থাকেন। শ্রীবিগ্রহের নিরেট স্বর্ণনির্মিত সেবা উপকরণ যথা সিংহাসন, ছত্র, বাঁশি, মুকুট, পাদুকা, পাদমূল, শিঙ্গা, থালা, গ্লাস, অলংকার এবং আরতি সামগ্রী। নিত্যানন্দ প্রভুর প্রকটলীলার শেষ অবধি তিনি বাঁকারায়ের সেবার্চনা করেছিলেন।
*** নিত্যানন্দ প্রভুর অন্তর্ধান লীলা ***
মহাপ্রভু তাঁর প্রকট লীলা শেষ করে টোটা গোপীনাথের শ্রীবিগ্রহে মধ্যে অন্তর্হিত হওয়ার পরপরই, নিত্যানন্দ প্রভু তাঁর প্রকটলীলা শেষ করেন।
শ্রীবিগ্রহটি প্রতিষ্ঠা করে এই বিগ্রহের সেবা-পূজা করতে করতে একদা ঐ বিগ্রহে গৌরাঙ্গরূপী ষড়্ভুজ দর্শন করেছিলেন এবং ভক্তি আবেগ বিভোর হয়ে বাঁকারায়ের শ্রীমূর্তি আলিঙ্গন করে লীন হয়ে গেছেন।
নিত্যানন্দ প্রভুর একচক্রা আগমন প্রসঙ্গে শ্রী বৃন্দাবন দাস ঠাকুর ‘শ্রীশ্রী নিত্যানন্দ বংশবিস্তার” গ্রন্থে বলেছেন-
গৌরপ্রেমে গরগর না জানে দিবারাতি।
শ্যামসুন্দরেহ কভু দেখে গৌর দ্যুতি।।
কে বুঝিতে পারে নিত্যানন্দের প্রভাব।
মন্দিরে প্রবেশ করি কৈলা তিরোভাব।।
পরবর্তী সময়ে নিত্যানন্দ প্রভুর পুত্র বীরভদ্রপ্রভু বা বীরচন্দ্রপ্রভু একচক্রায় আসেন এবং তিনি বাঁকারায় শ্রীমূর্তির পাশে নিত্যানন্দ প্রভুর স্ত্রী জাহ্নবী মাতার মূর্তি স্থাপন করেন। তিনিও এই মন্দিরে সেবা- পূজাকালে অন্তর্দ্ধান হন। এ প্রসঙ্গে শ্রী বৃন্দাবন দাস ঠাকুর ‘শ্রীশ্রী নিত্যানন্দ বংশবিস্তার” গ্রন্থে বলেছেন-
এই শ্রীমন্দিরে প্রভু বাঁকারায়, শ্রীমতি রাধিকা, জাহ্নবা মাতার শ্রীমূর্তি ছাড়াও নিত্যানন্দের পিতা হাড়াই পণ্ডিত সেবিত মুরলীধর বিগ্রহ ( যে বিগ্রহটি নিত্যানন্দ প্রভু তাঁর মাতা পদ্মাবতীকে দিয়েছিলেন), যোগমায়া, এবং আরও দুটি শ্রীমূর্তি বর্তমান রয়েছে। নিত্যানন্দ পরিবারের ১৩ তম প্রজন্ম ধরে এ বিগ্রহের উপাসনা চলছে। এ বিগ্রহ অর্ধ সহস্র বর্ষের প্রাচীন।
– বিজয় দাস
Views Today : 213
Total views : 118880
Who's Online : 0
Your IP Address : 216.73.216.136
hare krishna
haribol