প্রাচীন গুরুকূল শিক্ষাব্যবস্থা ও সরস্বতী পূজা

417557005_415743264356099_7888627462177271529_n

█▒▒▒ প্রাচীন গুরুকূল শিক্ষাব্যবস্থা ও সরস্বতী পূজা ▒▒▒█

‘ন হি জ্ঞানেন সদৃশং পবিত্রমিহ বিদ্যতে’ (न हि ज्ञानेन सदृशं पवित्रमिह विद्यते।) (গীতা ৪।৩৮) অর্থাৎ, ‘জ্ঞানের মতো পবিত্র বস্তু আর নেই।’ কে জ্ঞান লাভের অধিকারী?! গীতায় ভগবান বলছেন, ‘শ্রদ্ধাবান্ লভতে জ্ঞানং তৎপরঃ সংযতেন্দ্রিয়ঃ’ (श्रद्धावाँल्ल‍भते ज्ञानं तत्परः संयतेन्द्रियः।) (গীতা ৪।৩৯) অর্থাৎ ‘যার ইন্দ্রিয় সংযত ও যিনি জ্ঞান অর্জনের প্রতি শ্রদ্ধাবান, তিনিই জ্ঞান লাভ করেন।’ বস্তুতই অসংযত ইন্দ্রিয় ব্যক্তির নিকট জ্ঞান জীবজগতের ক্ষতির কারণ। তাই প্রাচীন ভারতের শিক্ষাব্যবস্থা ‘গুণ-বিচারিক’ মানদন্ডের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিলো।
এ পুণ্যভূমির প্রাচীন শিক্ষাব্যবস্থা ছিলো ‘গুরুকূল’ কেন্দ্রিক। গুরুকূলগুলোতে বিদ্যা অর্জনের জন্য কে ধনীর ছেলে আর কে দরিদ্রের ছেলে তা নিয়ে বৈষম্য যাতে না হয়, তাই গুরুকূলে প্রবেশের দিন হতেই বিদ্যার্থীদের সকলের পারিবার প্রদত্ত বস্ত্র অলঙ্কার খুলে নিয়ে দেওয়া হতো ব্রহ্মচারী বস্ত্র, সকলে এক আশ্রমে থাকতো, একই খাবার ভক্ষণ করতো, একই কায়দায় বিদ্যার্জন করতো। এভাবে গুরুকূলে সকল বিদ্যার্থীর মধ্যে সমতা আনায়ন হতো। দরিদ্রের ছেলে নিজেকে হীন ভাবতো না, ধনীর ছেলেরও আরাম আয়েশ ভোগ করে অহংকার প্রদর্শনের সুযোগ থাকতো না।
গুরুকূলে বিদ্যাগ্রহণের অধিকার সমাজের সকলেরই ছিলো, কিন্তু কে কতটুকু বিদ্যা লাভ করতে পারবে তা ছিলো যোগ্যতা অর্জন সাপেক্ষে। অসংযত ইন্দ্রিয় ও অশ্রদ্ধাবান ব্যক্তি বিদ্যালাভের অযোগ্য। তাই গুরুকূলগুলোতে বিদ্যালাভের পূর্বে বিদ্যার্থীদের গুণবিচার করা হতো। মহাভারতের শান্তিপর্বে এর বর্ণনা আছে। গুরু বিদ্যাভিলাষী ব্যক্তির গুণবিচার করে দেখতেন- এ বালক আদৌ বিদ্যালাভের জন্য যথেষ্ট উপযোগী নাকি বিদ্যালম্ভের পূর্বে এর আরো কিছু আচরণগত সুসংস্কার লাভের প্রয়োজন। যদি বিদ্যার্থী অভিলাষীর আচরণগত পারিবারিক সুসংস্কার গ্রহণযোগ্য হতো, তবে তাকে গুরুকূলে ‘আশ্রিত’ করা হতো। আর যাদের আচরণগত-ব্যবহারিক-পারিবারিক সুসংস্কার থাকতো না, তাদের ‘আকাঙ্ক্ষী’ হিসেবে গণ্য করে পরিবারের কাছে পারিবারিক শিক্ষার জন্য পাঠানো হতো এবং এরা নিয়মিত গুরুকূলের সাধু সন্ন্যাসীদের সান্নিগ্ধ্যে যাতায়াত করে আচার-আচরণ শিখতো। যারা ‘আশ্রিত’ শ্রেণীর বিদ্যাভিলাষী তারা ১ বছর যাবত গুরুকূলে স্থায়ীভাবে থেকে গুরুকে পর্যবেক্ষণ করতো, গুরুও তাদের পর্যবেক্ষণ করতো। এভাবে গুরু শিষ্যকে এবং শিষ্য গুরুকে ১ বছর যাবত পর্যবেক্ষণ করে যদি নিশ্চিত হতো এ গুরু সদগুরু এবং এ শিষ্য সদশিষ্য, তবেই গুরু তাকে উপনয়ন সংস্কার প্রদান করে গুরুকূলের স্থায়ী শিষ্য করতেন এবং তখন থেকে শিষ্যরা ‘ব্রহ্মচারী’ হিসেবে স্বীকৃতি পেতেন।
গুরুকূলে সকল শিক্ষার্থীকে ৬৪ কলা (বিদ্যা) প্রাথমিক জ্ঞান দেওয়া হতো। গুরুকূলে কেবল বেদবিদ্যা কিংবা অস্ত্রবিদ্যার শিক্ষা হতো তা নয়, এখানে সংগীত, নৃত্য, রন্ধন, কৃষি প্রভৃতি সমস্ত প্রকার বিদ্যারই শিক্ষা দেওয়া হতো। কারণ জীবনের কখন যে কোন বিদ্যার প্রয়োজন হয়, তা তো বিধাতা বৈ কেউ জানে না। তাই অজ্ঞাতবাসে ভীমের পক্ষে রন্ধনশালার প্রধান রাধুনি, অর্জুনের পক্ষে নৃত্যশিল্পী, নকুল-সহদেবের পক্ষে অশ্বশালা-হস্তিশালা সামলানোর দায়িত্ব পালন কিংবা কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে ব্রাহ্মণ দ্রোণাচার্য্য-কৃপাচার্যের দেশরক্ষায় অস্ত্রধারণ, কর্ণের রথের সারথিত মৃত্যু হলে শল্যরাজের পক্ষে কর্ণের সারথির দায়িত্ব পালনও কঠিন কিছু ছিলো না।
যখন প্রাথমিক শিক্ষা সম্পূর্ণ হতো, তখন স্বভাব ও গুণানুসারে চয়ন করা হতো কোন বিদ্যার্থীকে কোন বিদ্যায় উচ্চ (স্নাতক ও স্নাতকোত্তর) পর্যায়ের জ্ঞান দেওয়া হবে। মহাভারত পাঠে আমরা জানতে পারি, দ্রোণাচার্য্য শিক্ষার্থীদের পক্ষীর চক্ষু বিদীর্ণের পরীক্ষা নিয়ে চয়ন করেছিলেন অর্জুনাদি শিষ্যদের তিনি ধনুর্বিদ্যায় পারদর্শী করবেন, ভীম-দুর্যোধনাদি শিষ্যদের গদা চালন বিদ্যা, যুধিষ্ঠীরাদিকে নীতিবিদ্যায় পারদর্শী করবেন।
মোদ্দা কথা, গুণ বিচার না করে কোন বিদ্যাই প্রদান করা হতো না। কিছু উদাহরণ দেখা যাক। বেদব্যাসী মহাভারতের শান্তিপর্বের প্রথম দুই অধ্যায়ে উল্লেখ আছে, সুতপুত্র কর্ণ পান্ডব-কৌরবদের সাথেই গুরু দ্রোণের গুরুকূলে অস্ত্রশিক্ষা করতেন। কিন্তু অর্জুনের সাথে পারদর্শীতায় পেরে উঠছিলেন না তিনি। অস্ত্র চালনার পারদর্শিতা হেতু অর্জুন বহু দুর্লভ অস্ত্র দ্রোণাচার্য্যের নিকট হতে আগে আগে লাভ করে ফেলতো । কিন্তু কর্ণ তা লাভ করতে পারায় ঈর্ষাণ্বিত হতো এবং একদিন তিনি দ্রোণাচার্য্যের নিকট গিয়ে ব্রহ্মাস্ত্র লাভের বাসনা করেন। অর্জুনের প্রতি কর্ণের ঈর্ষাপরায়ণতা বুঝতে পেরে দ্রোণাচার্য্য তাকে ব্রহ্মাস্ত্রের জ্ঞান দান করতে অস্বীকৃতি জানান। ফলে কর্ণ গুরুকূল ত্যাগ করে এবং মিথ্যা পরিচয় দিয়ে পরশুরামের নিকট ব্রহ্মাস্ত্রাদি লাভ করে। কিন্তু ঈর্ষাপরায়ণতার জন্য তিনি অধর্মের সঙ্গ করে জগত বিধ্বংসে দুর্যোধনকে সাহায্য করতে থাকে। মিথ্যাচারে প্রাপ্ত অস্ত্রবিদ্যা জীবনের শেষ সময়ে সে বিস্মৃত হয় এবং করুণ মৃত্যু লাভ করেন। এ ঘটনা থেকে আমরা বুঝতে পারি, গুরুকূলে গুণবিচারে শিক্ষাব্যবস্থার যথার্থতা।
আরেকটি উপাখ্যান বলি। মহাভারতের শান্তিপর্বেই বর্ণিত আছে তা। নিষাদকুলের একলব্য অস্ত্রবিদ্যা লাভ করতে আসলেও একলব্যের মধ্যে আচরণগত ত্রুটি থাকায় গুণবিচারপূর্বক দ্রোণাচার্য্য তাকে অস্ত্রশিক্ষা দেন নি । কিন্তু একলব্য লুকিয়ে লুকিয়ে অস্ত্রশিক্ষা করতো এবং একদিন অর্জুনের নিকট ধরা পড়ে যায় একলব্য। যেহেতু একলব্য শত্রুরাষ্ট্র মগধের বাসিন্দা ছিলো তাই রাজকুমারদের সাময়িক শিক্ষার উপর গোপণ নজরদারীর অপরাধে একলব্যকে হস্তিনাপুরের শাসনতন্ত্র ‘মৃত্যুদন্ড’ দিতো। কিন্তু গুরু তো উদার হন, আকাশ হতেও মহান। যেহেতু একলব্য পূর্বেই দ্রোণাচার্য্যকে মনে মনে আপন গুরু করে নিয়েছেন তাই তাকে রক্ষার জন্য দ্রোণাচার্য্য এক সুন্দর কর্ম করলেন। চাতুরী করে বললেন, তার দক্ষিণ হস্তের বৃদ্ধাঙ্গুলি কেটে গুরুদক্ষিণা দিতে। এতে একলব্য পান্ডব-কৌরবদের গুরুভাই হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করে এবং মৃত্যুদন্ড হতে রক্ষা পায়। দ্রোণাচার্য্য গুরুদক্ষিণা চাওয়া মাত্র একলব্য তার বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদান করেন গুরুর চরণে। গুরু দ্রোণাচার্য্য এভাবে একলব্যের শ্রদ্ধা ও ইন্দ্রিয় সংযমত্বের পরীক্ষা নেন এবং একলব্য উত্তীর্ণ হন। তাই দ্রোণাচার্য্য একলব্যকে অস্ত্রবিদ্যা দানের জন্য মনস্থিত করলেন এবং রৈবত পর্বতে গিয়ে তিনি একলব্যকে অস্ত্রবিদ্যার জ্ঞান দিতেন। একলব্য দক্ষিণ হস্তের মধ্যমা-তর্জনী দ্বারা অদ্ভুদ কায়দায় অস্ত্রচালনা কৌশল রপ্ত করেছিলেন এবং পরবর্তীতে মগদ রাজ জরাসন্ধের প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এ উপাখ্যান ব্যাসদেবের শিষ্য শ্রীমধ্বাচার্য্যেকৃত ‘মহাভারত তাৎপর্য নির্ণয়’ ভাষ্যে বর্ণিত আছে।
এভাবে গুরুকূলে শিক্ষা লাভ করে যোগ্যতা অনুসারে শিষ্যের কর্ম নির্ধারিত হতো। স্নাতক পাস করা এসব শিষ্যদের গুণ-কর্মে বর্ণ নির্ধারিত হতো। ফলে সমাজের কারো সুযোগ থাকতো না জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্রের ভিত্তিতে কারো নিন্দা করার। কয়েকটি উদাহরণ দেখা যাক। রামায়ণে দেখা যায়, মন্ত্রী সুমন্ত্র ছিলেন সুতবংশের, তথাপি তিনি দশরথের গুরুকূলের মিত্র, উপদেষ্টা এবং অযোধ্যার প্রধান মন্ত্রী ছিলেন। বিদূরের জন্ম ছিলো দাসীর গর্ভে কিন্তু ভীষ্মদেবের নিকট শিক্ষা অর্জন করে তিনি হস্তিনাপুরের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন, আজও বিদূরনীতি সমাজে সুপ্রসিদ্ধ। দ্রোণাচার্য্যের ছেলে অশ্বত্থমা ব্রাহ্মণকূলে জন্মেও ক্ষত্রিয় রাজা হয়েছিলেন। এমন উদাহরণ বহু দেওয়া যায়।
এবার নারীশিক্ষার ব্যাপারে কিছু বলা যাক। অনেকেই ভেবে থাকেন, প্রাচীন ভারতে নারীশিক্ষা বুঝি উপেক্ষিত ছিলো। কিন্তু এ ধারণা অমূলক। বৃহদারণ্যক উপনিষদে নারী পন্ডিত ‘গার্গি’র কথা জানা যায় যিনি যাজ্ঞবল্ক্যের সাথে শাস্ত্রার্থ করেছিলেন। শুধুমাত্র ঋকবেদেই প্রায় ৩০ জন বিদূষী নারীর উল্লেখ পাওয়া যায়। ঘোশা, অপালা, লোপামুদ্রা, বিশ্ববারা, নিবাবরী, জুহু, কদ্রু, পৌলমী প্রভৃতি বৈদিক যুগের নারীদের কথা জানা যায়। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে বেদবতীর কথা জানা যায়, যার জিহ্বা হতে বেদ মন্ত্র অনবরত উচ্চারিত হতো। বাল্মীকি রামায়ণেও কৌশল্যাকে এবং শ্রীমদ্ভাগবতমে কশ্যপ মুনির পত্নী দিতিকে মন্ত্র উচ্চারণপূর্বক অগ্নিযজ্ঞ করতে দেখা যায়। জ্ঞানের পীঠস্থলী মিথিলায় ছিলো নারী শিক্ষার জন্য বিখ্যাত ছিলো। পাঞ্চালের রাজা দ্রুপদ কর্তৃক তার কণ্যা শিখন্ডীকে অস্ত্রশিক্ষার ব্যবস্থার কথা মহাভারতে জানা যায়।
মহাভারতের যুদ্ধের পরবর্তী সময়ে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর সময়ে ভারতে নারীশিক্ষার ব্যাপক বিস্তার ঘটে। অদ্বৈত আচার্য্যের পত্নী সীতাঠাকুরাণী, নিত্যানন্দ প্রভুর পত্নী জাহ্নবা ঠাকুরাণী, শ্রীনিবাস আচার্যের দ্বিতীয় স্ত্রী গৌরাঙ্গপ্রিয়া দেবী এবং বড় মেয়ে হেমলতা ঠাকুরানি, কৃষ্ণদাস কবিরাজের শিষ্যা গঙ্গামাতা গোস্বামী, কানাই খুঁটিয়ার বোন মাধবী দেবী – ইনারা সকলে দীক্ষাগুরুর ভূমিকা পালন করেছিলেন গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ে। শ্রী বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের নারীগুরু হিসেবে ‘গোদা দেবী’র নাম জানা যায়।
সমাজে নিম্ন হতে উচ্চ সর্ব পর্যায়ে নারীদের ছিলো দৃঢ় অবস্থান। সমাজ তাদের কর্মক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক ছিলো না। শ্রীমদ্ভাগবতমে দেখা যায়, গোপীগণ সুস্বাদু মাখন প্রস্তুত করে হাটে নিয়ে যেতেন বিক্রি করতে। ফল বিক্রেতা এক নারী ব্যবসায়ীর কৃষ্ণকৃপা প্রাপ্তি নারীর ব্যবসায়িক অবস্থান স্পষ্ট করে। অজ্ঞাতবাসকালে দৌপদী ছিলেন মৎস্যরাজের স্ত্রীর অঙ্গসজ্জক (Makeup Artist)। সত্যবতী পূর্বে ছিলেন মৎস্যজীবি। পরবর্তীতে হস্তিনাপুরের রাজমাতা হয়েছিলেন। রাজাশূণ্য হস্তিনাপুরের নেতৃত্ব দিয়ে তার সুরক্ষা অক্ষুণ্ন রেখেছিলেন তিনি। রণাঙ্গনেও নারীদের জয়জয়কার! দশরথের স্ত্রী কৌকেয়ী ছিলেন সম্মুখ সারীর যোদ্ধা যিনি দেবাসুর সংগ্রামে দশরথের প্রাণ উদ্ধার করেছিলেন। পাঞ্চালদের যোদ্ধা শিখন্ডীরও অস্ত্রনৈপুণ্যের কথা মহাভারতে জানা যায়।
ব্রহ্মসংহিতায় (৫.২৪-৫.২৫ ) বলা হয়েছে, ‘যখন ব্রহ্মা ভগবান বিষ্ণুর নাভিকমন থেকে সৃষ্ট হলেন, তখন তিনি তাঁর চারপাশে গাঢ় অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেলেন না। বহু চেষ্টা করেও তিনি তার উৎপত্তির কারণ জানতে পারলেন না। তখন বৈকুণ্ঠনিবাসিনী দিব্যা সরস্বতী তাঁকে দৈববাণী করেন তপস্যা করার এবং তাঁকে পরমপবিত্র অষ্টদশাক্ষর কৃষ্ণমন্ত্র দান করেন।’ (এ থেকে জানা যায়, জড় জগতে প্রথম দীক্ষাগুরু ছিলেন একজন নারী, যা নির্দেশ করে সনাতন ধর্মে নারীর সর্বোত্তম মর্যাদা)।
সমস্ত শাস্ত্র অধ্যয়নের পূর্বে মাতা সরস্বতীর জয়ধ্বনি দেওয়া হয়। যিনি এ অখিল জগতে বাক্য,বুদ্ধি ও জ্ঞানের অধিষ্ঠাত্রী দেবী, তিনি সর্ববিদ্যা স্বরূপিনী দেবী সরস্বতী। তিনি বিদ্যার্থী গণের নিকট সুবুদ্ধি, মেধা, প্রতিভা ও স্মৃতি দায়িনী। তিনি সাহিত্যপ্রিয়গণের নিকট কবিতা স্বরূপিনী। মীমাংসকগনের নিকট তিনি সন্দেহভঞ্জনকারিণী। সঙ্গীত প্রিয়জনের নিকট তিনি সংগীতের সন্ধান ও তাল প্রভৃতির কারণ স্বরূপিণী। বসন্ত পঞ্চমী তিথিতে সমস্ত বিদ্যার্থী মাতা সরস্বতীর বিশেষ আরাধনা করেন।
দেবী মহাসরস্বতী বিষ্ণুপত্নী। তিনি মহাবৈকুন্ঠে সদা বিরাজিতা থাকলেও তার দুইটি অংশ জড়গতে অবস্থান করবে। এ দুই অংশের প্রথম অংশটি ব্রহ্মার পত্নী সাবিত্রী রূপে জগতে বৈদিক শাস্ত্রসমূহের রক্ষা ও সৃষ্টিকারী সাহায্য করেন এবং অপর অংশটি নদী রূপে ধরণীতে নিখিল জীবদের পবিত্র করবে। ঋকবেদের অজস্র স্থানে দেবী সরস্বতীর এ দেবী ও নদীরূপের মুহুর্মুহু স্তুতি রয়েছে। ঋকবেদের ১।৩।১০, ১।১৪২।৯, ৬।৬১।১-১৪, ৭।৩৬।৬, ৮।২১।১৭, ৯।৬৫।২৩, ১০।৬৪।৯, ১০।৭৫।৫ প্রভৃতি মন্ত্রসমূহে কখনো মাতা সরস্বতীর নিকট বিদ্যা-বুদ্ধি-বন্ধুত্ব, কখনো বা ধন-মান-বিজয়, কখনো বা ঐশ্বর্য, কীর্তি ও প্রেরণা প্রদানের জন্য প্রার্থনা করা হয়েছে।
দেবী সরস্বতীর কিছু মহিমা-
১) মহর্ষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পুষ্কর তীর্থে দেবী সরস্বতীর তপস্যা করে ‘কবিকূল তিলক’ হয়েছেন এবং সরস্বতীর কবচ প্রভাবে তিনি সমগ্র বেদকে চারটি সংহিতাভাগে বিভক্ত করেন এবং বেদকে পরিপূর্ণভাবে ব্যাখার জন্য পঞ্চমবেদরূপী অষ্টাদশ পুরাণ রচনা করেন।
২) বাল্মীকি মুনি সরস্বতীদেবীর কৃপা প্রাপ্ত হয়ে বেদব্যাসকে পুরাণসূত্রের শিক্ষা দান করেন।
৩) রামায়ণে উল্লেখ আছে, রাবণের ভাই কুম্ভকর্ণ ব্রহ্মার আরাধনা করে ইন্দ্রাসন বররূপে চাইতে গেলে দেবতাদের অনুরোধে দেবী সরস্বতী কুম্ভকর্ণের জিহ্বাগ্রে বসে ‘ইন্দ্রাসন’ এর পরিবর্তে ‘নিদ্রাসন’ উচ্চারণ করিয়েছিলেন। ফলে ইন্দ্রের আসন পাওয়ার পরিবর্তে সে অসুর বছরের ছয় মাস নিদ্রায় মগ্ন থাকতো, ১ দিন জাগতো, আবার ছয় মাস নিদ্রামগ্ন থাকতো। এভাবে দেবী সরস্বতী দেবরাজের সিংহাসন রক্ষা করে সৃষ্টিকে অসুরের কর্তৃত্ব থেকে রক্ষা করেছিলেন।
৪) ব্রহ্মা ও শিব ‘সরস্বতী কবচ’ দ্বারা শক্তিপ্রাপ্ত হয়ে যথাক্রমে সৃষ্টি ও প্রলয়কার্য করেন।
৫) বাল্মীকি মুনি সরস্বতীর কৃপায় ব্রহ্মা হতে শোনা ১ লক্ষ শ্লোকের রামায়ণকে সংক্ষেপে ২৪ হাজার শ্লোকে মনুষ্যকূলের বোধগম্য রামায়ণ আকারে লিপিবদ্ধ করেন।
৬) তন্ত্র মহাসরস্বতী হতে কিভাবে বিশ্বব্রহ্মান্ড সৃষ্টি ও ধ্বংস হয় তার বর্ণনা আছে। ভারতের বাইরেও বিভিন্ন দেশে যেমন: নেপাল, ভূটান, ইন্দোনেশিয়া, জাপান নানা নামে বীণাপাণী সরস্বতীর তান্ত্রিক পূজা হয়। এমনকি বৌদ্ধ দেবী রূপেও বিভিন্ন পেগোডা ও বৌদ্ধমন্দিরে দেবী বীণাপানির বিগ্রহ দেখা যায়।
দেবী সরস্বতীর শুভ্র বসন শুদ্ধসত্ত্ব, নিষ্পাপ চিত্ত, নিষ্কপটতা, শান্তি ও স্বচ্ছতার প্রতীক। তাঁর হস্তের বীণা প্রেমের প্রতীক, সুরের প্রতীক। তাঁর বাহন রাজহংস। রাজহংসের একটি গুণ হলো তাকে জলমিশ্রিত দুগ্ধ প্রদান করা হলে, সে জল ব্যতীত দুগ্ধটুকুই গ্রহণ করে। মাতা সরস্বতী তার বাহন দ্বারা আমাদের শিক্ষা প্রদান করেন, জগতে জ্ঞান-অজ্ঞান, উচিত-অনুচিত, সত্য-মিথ্যা একত্রে অবস্থান করে। আমরা যেন জ্ঞানচক্ষুর দ্বারা এ সমস্ত দ্বৈতভাবের মধ্য হতে সঠিক পন্থা অনুসন্ধান করে তাতে স্থিত হই। যখন জ্ঞানচক্ষু উন্মেলিত হয়, তখন রাজার হাতি কিংবা রাস্তার কুকুরের মধ্যে ভেদ থাকে না, তখন কে ব্রাহ্মণ আর কে চন্ডাল তাতে ভেদভাব থাকে না। আমরা সকলে জগতপিতার সন্তান, একেক অপরের ভাই। এ পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ববোধ জাগ্রত হলে তবেই সমাজে স্থাপিত হবে প্রকৃত সাম্য, দূর হবে জাতিতে জাতিতে অন্তঃ ও আন্তঃ কলহ, জগতে বিরাজ করবে অনন্ত শান্তি, মাতা সরস্বতীর নিকট আমাদের এই প্রার্থনা।
विद्याविनयसम्पन्ने ब्राह्मणे गवि हस्तिनि।
श‍ुनि चैव श्वपाके च पण्डिता: समदर्शिन:॥
বিদ্যাবিনয়সম্পন্নে ব্রাহ্মণে গবি হস্তিনি।
শুনি চৈব শ্বপাকে চ পন্ডিতাঃ সমদর্শিনঃ।।
[শ্রীমদ্ভগবদগীতা ৫।১৮]
বঙ্গানুবাদ: জ্ঞানবান পন্ডিতেরা বিদ্যা-বিনয়সম্পন্ন ব্রাহ্মণ, গাভী, হস্তী, কুকুর ও চন্ডাল সকলের প্রতি সমদর্শী হন।
জ্ঞানচক্ষুর উন্মীলনে আমরা অনুভব করতে পারি, আমরা সকলে অমৃতের সন্তান, একে অপরের ভ্রাতা। যখন আমাদের সকলের মাঝে এ পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ববোধ জাগ্রত হবে, তখন সমাজে স্থাপিত হবে প্রকৃত সাম্য, দূর হবে জাতিতে জাতিতে অন্তঃ ও আন্তঃ কলহ, জগতে বিরাজ করবে অনন্ত শান্তি। তাই মাতা সরস্বতীর নিকট আমাদের এই জ্ঞানচক্ষুর প্রার্থনা।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়-
মধুর মধুর ধ্বনি বাজে হৃদয়কমলবনমাঝে॥
নিভৃতবাসিনী বীণাপাণি অমৃতমুরতিমতী বাণী
হিরণকিরণ ছবিখানি– পরানের কোথা সে বিরাজে॥
এসো দেবী, এসো এ আলোকে, একবার তোরে হেরি চোখে–
গোপনে থেকো না মনোলোকে ছায়াময় মায়াময় সাজে॥
(রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
ব্রজ সখা দাস
তথ্য-সহায়িকা-
  1. মহর্ষি বেদব্যাস প্রণীত ‘মহাভারতম’- হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ অনুদৃত (বিশ্ববাণী প্রকাশনি)
  2. বেদব্যাস মহাভারত – কালীপ্রসন্ন সিংহ অনুবাদিত
  3. মধ্বাচার্য্যকৃত ‘মহাভারত তাৎপর্য্য নির্ণয়ম’
  4. ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণম- শ্রীযুক্ত মথুরানাথ তর্করত্ন সম্পাদিত
  5. ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণম- শ্রীযুক্ত পঞ্চানন তর্করত্ন সম্পাদিত (নবভারত প্রকাশনি)
  6. শ্রীশ্রীব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ- শ্রীযুক্ত বেণীমাধবশীল সম্পাদিত (অক্ষয় লাইব্রেরী প্রকাশনি)
  7. শ্রীমৎ বাল্মীকি রামায়ণ – গীতাপ্রেস গোরক্ষপুর
Avatar of Navanila

Navanila

Writer & Admin

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments