‘প্রভুপাদ’ — উপাধির অর্থ ও ব্যবহার ~
৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ভারত সরকার শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুর প্রভুপাদের ১৫০তম আবির্ভাব বর্ষপূর্তি উদযাপন করেছে। তাঁর জন্য সম্মাননা সূচক “প্রভুপাদ” সম্বলিত একটি ডাকটিকিটও উন্মোচন করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন, শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুর প্রভুপাদের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করেন এবং সম্মিলিত বৈষ্ণব দর্শক শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখেন।
যখন আমরা “প্রভুপাদ” উপাধিটি শ্রবণ করি, কিছু স্বাভাবিক প্রশ্নের উদয় হয়:
- প্রভুপাদ শব্দটির অর্থ কী?
- গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ে সর্বপ্রথম কে প্রভুপাদ উপাধি লাভ করেন?
- কে এই উপাধি প্রাপ্ত হতে পারেন?
এই ছোট আলোচনাটি এইসব প্রশ্নের উত্তর প্রদানের জন্য প্রণীত।
গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের বহু গুরু/আচার্যকে “প্রভুপাদ” আখ্যায়িত করা হয়েছে। এই শব্দটি প্রভু + পাদ দুটি শব্দের সমাস। ইংরেজিতে কখনো কখনো একে অনুবাদ করা হয় — “যে গুরুদেবের শ্রীপাদপদ্মে অন্য গুরুবর্গ আশ্রয় লাভ করেন।”
সংস্কৃতে “প্রভু-পাদ” শব্দটি নানাভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। একটি উপায় হলো এই সমাসের মাধ্যমে — প্রভবঃ পাদে যস্য — “যার পদদ্বয়ে বহু প্রভুর আবাস।” এই বিশ্লেষণটি উপর্যুক্ত ইংরেজি অনুবাদের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। ব্যাকরণগতভাবে এটি “ব্যাধিকরণ-বহুব্রীহি-সমাস” হিসেবে পরিচিত।
প্রভুপাদ শব্দের অন্য একটি ব্যাখ্যা হতে পারে — প্রভোঃ (শ্রীকৃষ্ণ) পাদ্ব ইব পাদৌ যস্য — “ যার পদদ্বয় প্রভু (শ্রীকৃষ্ণের) পদদ্বয়ের সমতুল্য।” এটি ব্যাকরণগতভাবে “উত্তরপদলোপি-বহুব্রীহি-সমাস” এবং — “সপ্তম্য উপমান পূর্বপদস্যোত্তরপদ লোপশ্চ বক্তব্যঃ” (অষ্টাধ্যায়ী ২।২।২৪) বার্ত্তিকা অনুসারে রচিত।
এই বিশ্লেষণ অনুসারে শ্রীগুরু-পাদ-পদ্ম শ্রীকৃষ্ণের পাদপদ্মের ন্যায়। শ্রীকৃষ্ণের চরণকে শাস্ত্রে বহু স্থানে পদ্মের সাথে তুলনা করা হয়েছে। তেমনি, শ্রীগুরুদেবের চরণও পদ্মের সাথে তুলনীয়। কেন?!
“শ্রীগুরু-চরণ-পদ্ম” প্রবন্ধে শ্রীশ্রীমৎ গৌর গোবিন্দ স্বামী মহারাজ অত্যন্ত মধুর উপলব্ধি প্রদান করেছেন। এর সারকথা তুলে ধরা হলো— পদ্ম জলে জন্ম নিয়েও জলের স্পর্শ থেকে মুক্ত থাকে। উপরন্তু পদ্ম-মধু হিসেবে পরিচিত পদ্মের মধু অত্যন্ত মিষ্টি। এই মধু প্রাপ্ত হওয়ার জন্য মৌমাছিকে কাঁটার সাথে সংগ্রাম করতে হয় না, যেখানে (গোলাপ প্রভৃতি) বহু অন্য ফুলের মধু সংগ্রহ করতে হয় কাঁটার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনার মধ্যে। পরিশেষে, পদ্মফুল রাতে বন্ধ হয়ে যায় এবং মৌমাছির জন্য এক আরামপ্রদ বিশ্রামস্থলে পরিণত হয়, যেখানে অন্য ফুলগুলো ঐ মৌমাছির জন্য বিশ্রামস্থল নয়।
তেমনি, শ্রীগুরুদেবের চরণপদ্ম এই জড়জগতে প্রকাশিত হয় কিন্তু এর দ্বারা স্পৃষ্ট হয়ে না। চরণদ্বয় ভক্তিরসের মিষ্টতা প্রদান করে এবং তা জগতে আর কোথাও লাভ করা যায় না। জীব এক পরিভ্রমণরত মৌমাছির মতো এবং এই জগতের নানা দুঃখপূর্ণ স্থানে আনন্দ অনুসন্ধানের জন্য সংগ্রামরত। এখন সেই একই জীব শ্রীগুরুদেবের চরণপদ্মে অপরিমেয় আনন্দ আস্বাদন করতে পারে। তদুপরি, এই চরণদ্বয় জীবের জড় অস্তিত্বের অন্ধকারময় সময়ে জীবের স্থায়ী আবাসস্থলে পরিণত হয়, যখন তার আর কোনো আশ্রয় থাকে না। এই জন্য শ্রীগুরুর চরণদ্বয়কে পদ্মের সাথে তুলনা করা হয়েছে।
অতএব, প্রভুপাদ শব্দের দুটি প্রধান বিশ্লেষণ —
- প্রভবঃ পাদে যস্য — “যার পদদ্বয়ে বহু প্রভুর আবাস।”
- প্রভোঃ (শ্রীকৃষ্ণ) পাদ্ব ইব পাদৌ যস্য — “ যার পদদ্বয় প্রভু (শ্রীকৃষ্ণের) পদদ্বয়ের সমতুল্য।”
————–
গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ে এই উপাধি সর্বপ্রথম শ্রীল রূপ গোস্বামী কর্তৃক তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা শ্রীল সনাতন গোস্বামীকে প্রদান করা হয়েছে। লঘু-ভাগবতামৃতে (১।৫) তিনি লিখেছেন,
শ্রীমৎ-প্রভুপদাম্ভোজৈঃ
শ্রীমদ্ভাগবতামৃতম্।
যদ্ ব্যতানি তদ্ এবেদম্
সংক্ষেপণ নিষেব্যতে ॥
অনুবাদ: “শ্রীমৎ প্রভুপাদ কর্তৃক যা কিছু বৃহদ্ভাগবতামৃতে প্রকাশিত হয়েছে, সে সবই এই লঘু-ভাডবতামৃতে আমার কর্তৃক আস্বাদন হয়েছে।”
শ্রীল রূপ গোস্বামী ভক্তিরসামৃতসিন্ধুতে (১।৩।৩৫) শ্রীল সনাতন গোস্বামীর একটি শ্লোক উদ্ধৃতি দিয়েছেন এই বলে— “শ্রীমৎ-প্রভুপাদানাম্”— “এই শ্লোকটি শ্রীমৎ প্রভুপাদের।”
উভয় উদাহরণে তিনি তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা শ্রীল সনাতন গোস্বামীকে নির্দেশ করেছেন। অতএব, এই উপাধির প্রকৃত ধারক হলেন শ্রীল সনাতন গোস্বামী। পরবর্তীতে এই সম্প্রদায়ের বহু আচার্যকে এই একই উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছে।
————–
কে এই উপাধি লাভ করতে পারে এই বিষয়ে, যেকোনো ব্যক্তিত্বের চরিত্রে প্রভুপাদ শব্দের উপর্যুক্ত অর্থের একটি (বা উভয়) লক্ষণ প্রদর্শিত হলেই তাঁর অনুসারী/শিষ্যগণের দ্বারা “প্রভুপাদ” উপাধিতে ভূষিত হতে পারেন। যাইহোক, কিছু সংগঠন এই উপাধির ব্যবহার কেবল কিছু নির্দিষ্ট আচার্যের জন্য সীমাবদ্ধ করে। এটি স্পষ্টভাবে লক্ষ করতে হবে যে এই উপাধি কোনো নির্দিষ্ট সংগঠন দ্বারা উদ্ভাবিত হয়নি, এবং সেজন্য কোনো সংগঠনের এর উপর স্বতন্ত্র স্বত্ব থাকতে পারে না। এটি একটি সংগঠন-মুক্ত উপাধি, যা মূলত শ্রীল সনাতন গোস্বামীর। অন্য সকল আচার্য এই উপাধির এক বা উভয় অর্থ পূর্ণ করে এই উপাধি প্রাপ্ত হতে পারেন। সমস্ত বৈষ্ণব এবং সংগঠনের প্রতি সম্মানই বৈষ্ণবজগতে সম্প্রীতি অর্জনের চাবিকাঠির।
————–
– শ্রীমান হরি পার্ষদ প্রভু কর্তৃক প্রবন্ধ
৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪
অনুবাদ: মধুর গৌরকিশোর দাস