পরম তত্ত্ব পরমেশ্বর ভগবানের অত্যন্ত মনোহর বিশেষ রূপ (দ্বিভুজ শ্যাম সুন্দর মুরলীধর) রয়েছে। কিন্তু তা সত্বেও তিঁনি সমস্ত জগতে বিস্তৃত হতে পারেন। প্রকৃতপক্ষে সমস্ত কিছুই পরমেশ্বর ভগবানের অনন্ত শক্তির বিভিন্ন প্রকাশ মাত্র। তবুও তিঁনি সবকিছু থেকেই স্বতন্ত্র থাকতে পারেন। অল্পবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরা পরমেশ্বর ভগবানের সেই সমস্ত শক্তিসমূহের ভিন্ন ভিন্ন বহিঃপ্রকাশকে বুঝতে না পারার কারনে কেউ তাঁকে শুধু নিরাকার মনে করেন কেউবা শুধু সাকার। এই দ্বন্দ্ব নিরসনের জন্য
ভগবদগীতা: ০৭/০৭ নং শ্লোকের ভক্তিবেদান্ত তাৎপর্যটি একটি সহজ সমাধান। নিম্নে প্রদত্ত হলো-
“পরমতত্ত্ব সবিশেষ না নির্বিশেষ এই সম্বন্ধে বহু আলোচিত মতবিভেদ আছে। ভগবদ্গীতাতে বলা হয়েছে যে, পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণই হচ্ছেন পরমতত্ত্ব এবং প্রতি পদক্ষেপেই আমরা সেই সত্যের প্রমাণ পাই। বিশেষ করে এই শ্লোকটিতে পরমতত্ত্ব যে সবিশেষ পুরুষ, তা জোর দিয়ে বলা হয়েছে। পরমেশ্বর ভগবানের সবিশেষত্ব সম্বন্ধে ব্রহ্মসংহিতাতে (৫/১) ও বলা হয়েছে-
ঈশ্বরঃ পরমঃ কৃষ্ণঃ সচ্চিদানন্দবিগ্রহঃ।
অর্থাৎ, পরমতত্ত্ব পরম পুরুষ ভগবান হচ্ছেন শ্রীকৃষ্ণ, তিনিই হচ্ছেন সমস্ত আনন্দের উৎস, তিনিই হচ্ছেন আদিপুরুষ গোবিন্দ এবং তাঁর শ্রীবিগ্রহ হচ্ছেন সৎ, চিৎ ও আনন্দময়।
ব্রহ্মার মতো মহাজনদের কাছ থেকে যখন আমরা নিঃসন্দেহে জানতে পারি যে, পরমতত্ত্ব হচ্ছেন পরম পুরুষ এবং তিনি হচ্ছেন সর্ব কারণের পরম কারণ, তখন আর তাঁর সম্বন্ধে কোন সন্দেহ থাকে না। নির্বিশেষবাদীরা অবশ্য বৈদিক ভাষ্য মতে শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের (৩/১০) এই শ্লোকটির উল্লেখ করে তর্ক করে-
ততো যদুত্তরতরং তদরূপমনাময়ম্ ।
য এতদ্বিদুরমৃতান্তে ভবন্ত্যথেতরে দুঃখমেবাপিযন্তি।“এই জড় জগতে ব্রহ্মা হচ্ছেন প্রথম জীব। সুর, অসুর ও মানুষের মধ্যে তিনিই হচ্ছেন শ্রেষ্ঠ। কিন্তু ব্রহ্মারও ঊর্ধ্বে এক অপ্রাকৃত তত্ত্ব বর্তমান, যাঁর কোন জড় আকৃতি নেই এবং যিনি সব রকমের জড় কলুষ থেকে মুক্ত। তাঁকে যে জানতে পারেন, তিনি এই জড় বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে অপ্রাকৃত জগতে প্রবেশ করতে পারেন। আর যারা তাঁকে জানতে পারে না, তারা এই জড় জগতে নানা রকম দুঃখকষ্ট ভোগ করে।”
নির্বিশেষবাদীরা এই শ্লোকের অরূপম্ শব্দটির উপরে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে। কিন্তু এই অরূপম্ শব্দটির অর্থ নির্বিশেষ নয়। এর দ্বারা ভগবানের সচ্চিদানন্দময় অপ্রাকৃত রূপকে নির্দেশ করা হয়েছে, যা ব্রহ্মসংহিতার উপরে উদ্ধৃত অংশে ব্যক্ত হয়েছে। শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের অন্যান্য শ্লোকেও (৩/৮-৯) সেই কথার সত্যতা প্রমাণ করে বলা হয়েছে-
বেদাহমেতং পুরুষং মহান্তমাদিত্যবর্ণং তমসঃ পরস্তাৎ।
তমেব বিদিত্বাহতি মৃত্যুমেতি নান্যঃ পন্থা বিদ্যতেহয়নায়।যস্মাৎ পরং নাপরমন্তি কিঞ্চিদ যস্মান্নাণীয়ো ন জ্যায়োহস্তি কিঞ্চিৎ।
বৃক্ষ ইব স্তব্ধো দিবি তিষ্ঠত্যেকঃ তেনেদং পূর্ণং পুরুষেণ সর্বম্ ॥“আমি সেই পরমেশ্বরকে জানি, যিনি সর্বতোভাবে সংসারের সকল অজ্ঞানতার অন্ধকারের অতীত। যিনি তাঁকে জানেন, তিনিই কেবল জন্ম-মৃত্যুর বন্ধন থেকে চিরতরে মুক্তি পেতে পারেন। এই পরম পুরুষের জ্ঞান ব্যতীত আর কোন উপায়েই মুক্তি লাভ করা যায় না।
“এই পরম পুরুষের অতীত আর কোন সত্য নেই, কেন না তিনি হচ্ছেন সর্বশ্রেষ্ঠ। তিনি ক্ষুদ্রতম থেকে ক্ষুদ্রতর এবং তিনি মহত্তম থেকেও মহত্তর। একটি গাছের মতো মৌনভাবে অধিষ্ঠিত রয়েছেন এবং তিনি সমস্ত পরব্যোমকে আলোকে উদ্ভাসিত করে রেখেছেন। একটি গাছ যেমন তার শিকড় বিস্তার করে, তিনিও তেমনই তাঁর বিভিন্ন শক্তিকে বিস্তৃত করেছেন।”
এই সমস্ত শ্লোক থেকে আমরা অনায়াসে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, পরমেশ্বর ভগবানই হচ্ছেন পরমতত্ত্ব, যিনি তাঁর জড় ও চিন্ময় অনন্ত শক্তির প্রভাবে সর্বব্যাপ্ত।”
।। হরে কৃষ্ণ ।।
[ বি:দ্র: স্বধর্মম্-এর অনুমোদন ব্যাতীত এই গবেষণামূলক লেখার কোনো অংশ পুনরুৎপাদন, ব্যবহার, কপি পেস্ট নিষিদ্ধ। স্বধর্মম্-এর সৌজন্যে শেয়ার করার জন্য উন্মুক্ত ]
নিবেদক-
° স্বধর্মম্: প্রশ্ন করুন | উত্তর পাবেন °
www.svadharmam.com