দুর্গা দেবী-
দেবী দুর্গা হলেন চিন্ময় জগতের সর্বোচ্চ লোক গোলক বৃন্দাবনে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বুদ্ধি থেকে আবির্ভূত এক মহান দেবী।তিনি পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আজ্ঞা অনুসারে জড় জগৎরুপী দুর্গের দেখাশুনা করেন,তাই এ মহান দেবীর নাম দুর্গা।দুর্গা দেবী জড় জগতে পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণের বহিঃরঙ্গা শক্তিরুপে কার্য সম্পাদন করেন।ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ শাস্ত্রের ব্রহ্মখন্ডের ৩/৭০-৭১ শ্লোকে বলা হয়েছে –
নিন্দ্রাতৃষ্ণাক্ষুৎপিপাাসাদয়াশ্রদ্ধাক্ষমাদিকাঃ।
তাসাঞ্চ সর্ব্বশক্তীনামীশাধিষ্টাতৃদেবতা।।
ভয়ঙ্করী শতভুজা দুর্গা দুর্গার্ত্তিনাশিনী।
আত্মনঃ শক্তিরুপ সা জগতাং জননীপরা।।
অনুবাদঃ দেবী দুর্গা হলেন জড় জগতের মধ্যে নিদ্রা,তৃষ্ণা,ক্ষুধা,দয়া,শ্রদ্ধা আদি যত বিষয় রয়েছে তার শক্তিদেবী হিসেবে তিনি অধিষ্ঠাত্রী দেবতা।তিনি ভয়ঙ্করী, শতভুজা,দুর্গতি বিনাশকারীনি তাই তিনি দেবী দুর্গা।তিনি পরমাত্মার শক্তিরুপা,আবার তিনিই সমস্ত জগতের জননী।
অষ্টাদশ পুরাণ,রামায়ন, মহাভারত ইত্যাদি সনাতনী শাস্ত্রে দুর্গাদেবীর কথা বিস্তৃত অথবা সংক্ষিপ্ত পরিসরে আলোচনা করা হয়েছে। মার্কেন্ডেয় পুরাণে ৮১-৯৩ অধ্যায়, এ তেরটি অধ্যায়কে শ্রীশ্রীচন্ডী বলা হয়।শ্রীশ্রীচন্ডী শাস্ত্রের দ্বিতীয় অধ্যায়ে মহিষাসুর বধকালে দেবী দুর্গা দশভূজারুপ ধারণ করেন। শ্রীশ্রীচন্ডী শাস্ত্রে ৫ম অধ্যায়ের বর্ণনা অনুযায়ী দেবতারা হিমালয় পর্বতে উপনীত হয়ে মাতা দুর্গার বন্দনাকালে জগৎ জননী দুর্গাদেবীকে ৫/ ১৬ শ্লোকে বিষ্ণুমায়া শব্দে সম্বোধন করেছেন।
যা দেবী সর্বভূতেষু বিষ্ণুমায়েতি শব্দিতা।
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ ॥১৬
-(শ্রীশ্রীচন্ডী ৫/১৬)
অনুবাদ– যে দেবী সকল-প্রাণিতে বিষ্ণু মায়া বলিয়া অভিস্মৃত হন, তাঁহাকে নমস্কার, তাঁহাকে নমস্কার, তাঁহাকে বার বার নমস্কার।
এই বিষ্ণুমায়ার কথা ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গীতা ৭/১৪ অধ্যায়ে বর্ণনা করেন।
দৈবী হ্যেষা গুণময়ী মম মায়া দুরত্যয়া।
মামেব যে প্রপদ্যন্তে মায়ামেতাং তরন্তি তে ।।১৪ ।।
-( গীতা ৭/১৪)
অনুবাদঃ আমার এই দৈবী মায়া ত্রিগুণাত্মিকা এবং তা দুরতিক্রমণীয়া। কিন্তু যাঁরা আমাতে প্রপত্তি করেন, তাঁরাই এই মায়া উত্তীর্ণ হতে পারেন।
উপরোক্ত গীতা ৭/১৪ শ্লোকের বর্ণনা অনুযায়ী দৈবী মায়া / বিষ্ণু মায়া ত্রিগুণময়ী অথাৎ সত্ত্ব,রজ এবং তমগুণসম্পন্ন। এবং এ মায়াকে অতিক্রম করা জীবের পক্ষে সম্ভব নয়।গুণ শব্দের আর একটি অর্থ হচ্ছে রজ্জু। এর থেকে বোঝা যায় যে, মায়া সত্ত্ব,রজ এবং তম রজ্জুর দ্বারা বদ্ধ জীবকে দৃঢ়ভাবে বেঁধে রেখেছে। সত্ত্বগুণের দ্বারা জীব ভগবানের সেবাকে পরিত্যাগ করে জড়বিদ্যা লাভ করে নিজেকে সুখি মনে করছে,রজোগুণের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে জীব ভগবানের সেবা পরিত্যাগ করে সকাম কর্মে ব্যস্ত থাকার মাধ্যমে সুখি হওয়ার প্রচেষ্টা করছে।আর তমোগুণের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে জীব আলস্য,নিন্দ্রার মাধ্যমে ভগবানের সেবা পরিত্যাগ করে সুখি হওয়ার বাসনা করছে। জড় জগতে যারা এভাবেই ভগবানের সেবা পরিত্যাগ করছে, তাদেরকে দেবী দুর্গা তাঁর মায়া শক্তি দ্বারা আবদ্ধ করেন এবং আধ্যত্মিক, আধিভৌতিক এবং আদিদৈবিক দুঃখ প্রদান করেন।আধ্যত্মিক দুঃখ বলতে বুঝায় দেহ এবং মন থেকে প্রাপ্ত দুঃখ, আধিভৌতিক দুঃখ বলতে নিকট আত্মীয়,শত্রু এবং হিংস্র পশু, সাপ ইত্যাদি জীব থেকে প্রাপ্ত দুঃখ। যার হাত-পা দড়ি দিয়ে বাঁধা, সে নিজে মুক্ত হতে পারে না। মুক্ত হতে হলে তাকে এমন কারও সাহায্য নিতে হয়, যিনি নিজে মুক্ত। কারণ, যে নিজেই বদ্ধ, সে কাউকে মুক্ত করতে পারে না।
তাই, ভগবান শ্রীকৃষ্ণই কেবল বদ্ধ জীবকে জড় বন্ধন থেকে মুক্ত করতে পারেন। এই ধরনের পরম সাহায্য ব্যতীত জড়া প্রকৃতির বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়া যায় না। ভক্তিযোগ বা কৃষ্ণভাবনা এই মুক্তির পরম সহায়ক হতে পারে। শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন মায়াশক্তির অধীশ্বর। তাই, তিনি যখন এই অলঙ্ঘনীয় মায়াকে আদেশ দেন কাউকে মুক্ত করে দিতে, মায়া তৎক্ষণাৎ তাঁর সেই আদেশ পালন করেন। জীব হচ্ছে ভগবানের সন্তান, তাই জীব যখন ভগবানের শরণাগত হয়, তখন ভগবান তাঁর অহৈতুকী করুণাবশে পিতৃবৎ স্নেহে তাকে মুক্ত করতে মনস্থ করেন এবং তিনি তখন মায়াকে আদেশ দেন তাকে মুক্ত করে দিতে। তাই, ভগবানের চরণ-কমলের শরণাগত হওয়াটাই হচ্ছে কঠোর জড়া প্রকৃতির কবল থেকে মুক্ত হওয়ার একমাত্র উপায়।
এছাড়াও শ্রীশ্রীচন্ডী শাস্ত্রের একাদশ অধ্যায়ে অসুর শুম্ভ নিহত হলে দেবতারা দুর্গা দেবীকে শ্রীশ্রীচন্ডী ১১/১০,১১ শ্লোকে সৃষ্টি, স্থিতি বিনাশ কার্যে পরমেশ্বরের শক্তি অথাৎ নারায়নী এবং ১১/১৬ শ্লোকে বৈষ্ণবী অথাৎ বিষ্ণুভক্ত শব্দে সম্বোধন করেন।
সর্বমঙ্গল মঙ্গল্যে শিবে সর্বার্থসাধিকে।
শরণ্যে ত্র্যম্বকে গৌরি নারায়নি নমোহস্তুতে ।। ১০
সৃষ্টি-স্থিতি-বিনাশানাং শক্তিভূতে সনাতনি।
গুণাশ্রয়ে গুণময়ে নারায়ণি নমোহস্ত তে৷৷ ১১
–( শ্রীশ্রীচন্ডী- ১১।১০,১১)
অনুবাদ–হে গৌরি!হে নারায়নি! তুমি সমস্ত মঙ্গলস্বরুপা!তুমি মঙ্গলময়ী!তুমি সমস্ত অভীষ্টদায়িনী!বিপদে তোমারই শরণ লইতে হয়।হে ত্রিনয়নি,আমরা তোমাকে নমস্কার করতেছি।হে নারায়ণি! তুমি সৃষ্টি, স্থিতি ও. বিনাশের শক্তিরূপিণী। তুমি নিত্যা। তুমি আশ্রয়ের যোগ্য। তুমি গুণময়ী। আমরা তোমাকে নমস্কার করিতেছি।
শঙ্খ-চক্র-গদা-শার্ঙ্গ-গৃহীত-পরম-আয়ুধে।
প্রসীদ বৈষ্ণবী-রূপে নারায়ণি নমঃ অস্তু তে।।
-( শ্রীশ্রী চন্ডী, ১১।১৬ )
অনুবাদঃ হে শঙ্খ চক্র গদা শার্ঙ্গাদি শ্রেষ্ঠ আয়ুধ-ধারিণি, তুমি বৈষ্ণবী রূপে বিখ্যাত, হে নারায়ণী, তোমাকে নমস্কার।
একইকথা ব্রহ্মসংহিতা শাস্ত্রে স্বয়ং ব্রহ্মাজী বর্ননা করেন–
সৃষ্টিস্থিতি-প্রণয়-সাধন-শক্তিরো
ছায়েব যস্য ভুবনানি বিভর্তি দুর্গা।
ইচ্ছানুরূপমপি যস্য চ চেষ্ঠতে সা
গোবিন্দমাদিপুরুষং তমহং ভজামি॥
-(ব্রহ্মসংহিতা-৫/৩৪)
অনুবাদঃ স্বরূপশক্তি বা চিৎশক্তির ছায়া স্বরূপা প্রাপঞ্চিক জগতের সৃষ্টি – স্থিতি – প্রলয়কার্যে শক্তিস্বরুপা ভুবনপূজিতাই ‘দূর্গা’ নামে খ্যাত, তিনি যাঁর ইচ্ছা অনুরূপ চেষ্টা করেন, সেই আদিপুরুষ গোবিন্দকে আমি ভজনা করি।
দেবী দুর্গার আবির্ভাবঃ
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরান শাস্ত্রের ব্রহ্মখন্ডের ৩য় অধ্যায়ে জগৎ পুজিতা দুর্গা দেবীর আবির্ভাবের কথা সবিস্তারে বর্ণিত হয়েছে।কিন্তু এর পূর্বের ব্রহ্মখন্ডের ২য় এবং ৩য় অধ্যায়ের ১-৬৮ নং শ্লোকের বর্ণনা অনুসারে-
“চিন্ময় জগতের সর্বোচ্চ লোক হল গোলক বৃন্দাবন ধাম। তার পরিধি তিনকোটি যোজন।সে গোলক বৃন্দাবনের নিম্নে দক্ষিন দিকে পঞ্চাশ কোটি যোজন দূরে বৈকুন্ঠলোক। সে বৈকুন্ঠের বিস্তার ১ কোটি যোজন। বৈকুন্ঠের নিম্নদিকে বামে শিবলোক অবস্থিত।এ গোলক বৃন্দাবন, বৈকুন্ঠ এবং শিবলোককে একত্রে চিন্ময় জগৎ বলা হয়।যাহোক চিন্ময় জগতের সর্বোচ্চ লোক গোলক বৃন্দাবনের রত্নসিংহাসনে প্রবিষ্ট আছেন পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। তিনি দ্বিভুজ, মুরলীধর এবং শ্যামসুন্দর(গায়ের রং শ্যামবর্ণ)।তার মস্তকে উজ্জ্বল মুকুট, গলায় বনমালা,রত্ন অলংকারে শোভিত।
সেই পরম প্রভু পরমব্রহ্ম,পরমাত্মা, পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দক্ষিণ অঙ্গ থেকে আবির্ভূত হন চতুর্ভুজ নারায়ন।এরপর শ্রীকৃষ্ণের বাম অঙ্গ থেকে আবির্ভূত হন শিব।এরপর শ্রীকৃষ্ণের নাভিপদ্ম থেকে আবির্ভূত হন ব্রহ্মার।এরপর শ্রীকৃষ্ণের বক্ষ থেকে আবির্ভূত হন মুর্তিমান ধর্মের।এরপর শ্রীকৃষ্ণের মুখ থেকে আবির্ভূত হন স্বরস্বতী দেবীর।এরপর শ্রীকৃষ্ণের মন থেকে আবির্ভূত হন লক্ষ্মী দেবীর।”
এরপর ব্রহ্মবৈবর্ত পুরান শাস্ত্রের ব্রহ্মখন্ডের ৩/৬৯-৭৩ নং শ্লোকের বর্ণনা অনুসারে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বুদ্ধি থেকে আবির্ভূত হন জগৎ পূজিতা মাতা ভগবতী দুর্গা।সে দুর্গা মাতা শতভুজা,ভয়ংঙ্করী এবং দুর্গতি নাশিনী।
আর্বিবভূব তৎপশ্চাদবুদ্ধেশ্চ পরমাত্মন।
সর্ব্বাধিষ্ঠাতৃদেবী সা মূলপ্রকৃতিরীশ্বরী।।
নিন্দ্রাতৃষ্ণাক্ষুৎপিপাাসাদয়াশ্রদ্ধাক্ষমাদিকাঃ।
তাসাঞ্চ সর্ব্বশক্তীনামীশাধিষ্টাতৃদেবতা।।
ভয়ঙ্করী শতভুজা দুর্গা দুর্গার্ত্তিনাশিনী।
আত্মনঃ শক্তিরুপ সা জগতাং জননীপরা।।
ত্রিশূলশক্তিশাঙ্গঞ্চ ধনুঃখড়গশরাণি চ।
শঙ্খচক্রগদাপদ্মমক্ষমালাকমন্ডলু।।
বজ্রমঙ্কুশপাশঞ্চ ভূষন্ডীদন্ডতোমরম।
নারায়ণাস্ত্রং ব্রহ্মাস্ত্রং রৌদ্রং পাশুপতং তথা।।
-(ব্রহ্মবৈবর্ত পুরানঃ ব্রহ্মখন্ড ৩/৬৯-৭৩)
অনুবাদঃ পরমাত্মা ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বুদ্ধি থেকে আর্বিভূত হন দেবী দুর্গা।তিনি সর্ব অধিষ্ঠাত্রী দেবী,আবার তিনিই আদি প্রকৃতি ঈশ্বরী।তিনি জড় জগতের মধ্যে নিদ্রা,তৃষ্ণা,ক্ষুধা,দয়া,শ্রদ্ধা আদি যত বিষয় রয়েছে তার শক্তিদেবী হিসেবে তিনি অধিষ্ঠাত্রী দেবতা।তিনি ভয়ঙ্করী, শতভুজা,দুর্গতি বিনাশকারীনি তাই তিনি দেবী দুর্গা।তিনি পরমাত্মার শক্তিরুপা,আবার তিনিই সমস্ত জগতের জননী। তিনি ত্রিশূল,শাঙ্গ,ধনু,খড়গ,শর,শঙ্খ,চক্র,গদা,পদ্ম, অক্ষমালা এবং কমুন্ডলশোভিতা।তিনি বজ্র,অঙ্কুশ,পাশা,দন্ড,নারায়ন অস্ত্র,ব্রহ্মাস্ত্র,এবং রুদ্রের পাশুপত অস্ত্র শোভিত।
হরে কৃষ্ণ।জয় মা দূর্গা। প্রনাম।
Views Today : 154
Total views : 118821
Who's Online : 0
Your IP Address : 216.73.216.136