গৌড়ীয় সম্প্রদায়ের মন্ত্র পরম্পরা
রূপানুগ গৌড়ীয় বৈষ্ণবের শ্রীগুরুপরম্পরাতে একসাথে রয়েছে মন্ত্রদীক্ষা পরম্পরা এবং ভাগবত শিক্ষাপরম্পরা। সম্পূর্ণ গৌড়ীয় সম্প্রদায়ের প্রধান প্রধান আচার্যগণকে একটি ক্রমবদ্ধ ধারায় প্রকাশ এবং বংশানুক্রমিক গুরুপারম্পর্য খণ্ডন করে এই ভাগবত পরম্পরা অনবদ্যভাবে একটি আদর্শ গুরুপ্রণালী উপস্থাপন করছে। প্রতিটি প্রাচীন পরম্পরাই ভাগবত পরম্পরা। পূর্বে আচার্য শংকর কর্তৃক প্রদর্শিত পরম্পরা, শ্রীসম্প্রদায়ে আলোয়াড় পরম্পরা, ব্যাস-মধ্ব পরম্পরা প্রভৃতির কোনটিই সম্পূর্ণ মন্ত্রপরম্পরা নয়। মন্ত্র গুরু ও শিক্ষাগুরু ভিন্ন হতেই পারেন। গৌড়ীয় সম্প্রদায়ে সখ্যরসভুক্ত শ্রীল হৃদয়চৈতন্য প্রভুর মন্ত্রশিষ্য শ্রীল শ্যামানন্দ প্রভু মাধুর্যরসে শ্রীরূপমঞ্জরীর অনুগত। যাই হোক এই প্রবন্ধে সংক্ষেপে ভাগবত পরম্পরার আচার্যবর্গের মন্ত্রদীক্ষা ও শিক্ষা বর্ণনা করা হল। এই শিক্ষা পরম্পরা আলোচনা করলে খুব স্পষ্টভাবে বোঝা যায়- ভাগবত পরম্পরা সর্বৈব সঠিক ও যুক্তিযুক্ত। শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী প্রভুপাদ যুক্তিগ্রাহ্য ভাবে এই ভাগবত পরম্পরা প্রকাশ করেছিলেন।
গৌড়ীয় পরম্পরা
১) স্বয়ং ভগবান শ্রীগৌরসুন্দর মহাপ্রভু:
• মন্ত্রদীক্ষা ও শিক্ষা অভিনয় : শ্রীল ঈশ্বরপুরী (মাধবেন্দ্রপুরীর শিষ্য)
• মন্ত্র : দশাক্ষরী মন্ত্র
• সন্ন্যাস সংস্কার : শ্রীল কেশব ভারতী
• সন্ন্যাস নাম : শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য
২) শ্রীল স্বরূপ দামোদর গোস্বামী :
• পূর্বনাম : শ্রীপুরুষোত্তম আচার্য
• মন্ত্রদীক্ষা : অজ্ঞাত
• শিক্ষা : শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু।
• বেশ : বারাণসীতে চৈতন্যানন্দের কাছ থেকে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। কিন্তু যোগপট্ট ধারণ করেননি। মহাপণ্ডিত, রসাচার্য এই স্বরূপ দামোদরের তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ ছাড়া কোন রচনা মহাপ্রভুকে নিবেদন করা হত না।
৩) শ্রীল রূপ গোস্বামী এবং শ্রীল সনাতন গোস্বামী :
• দীক্ষা : সনাতন গোস্বামীর গুরু বিদ্যাবাচস্পতি । রূপ গোস্বামী সনাতনের শিষ্য ছিলেন।
• শিক্ষা : শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু
• মহাপ্রভুর প্রদত্ত নাম : “রূপ” ও “সনাতন”
• বেশ : শ্রীরূপ সনাতন প্রমুখ গোস্বামীগণ মহাপ্রভুর অনুমোদনেই শ্বেত বহির্বাস ধারণ করেন। এই বেশ পরবর্তীতে “বাবাজী” বেশ বলে পরিচিত হয়। আসলে এটি প্রচ্ছন্ন সন্ন্যাস বেশ। “গোস্বামী” উপাধিটিও সন্ন্যাস উপাধি। শ্রীরূপ গোস্বামী হলেন সর্বপ্রধান গৌড়ীয় রসাচার্য। জগতে তিনিই প্রচার করে চৈতন্যমনোভিষ্ট পূরণ করেন। শ্রীরূপ স্বরূপের প্রত্যক্ষ কৃপাপ্রাপ্ত।
৪। শ্রীল রঘুনাথ দাস গোস্বামী
• মন্ত্রদীক্ষা : শ্রীঅদ্বৈত প্রভুর শিষ্য শ্রীল যদুনন্দন আচার্য।
• শিক্ষা : শ্রীল স্বরূপ দামোদর গোস্বামী এবং শ্রীরূপ-সনাতন।
৫। শ্রীল কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামী :
• দীক্ষা : জানা যায় না।
• শিক্ষা : শ্রীরূপাদি ষড় গোস্বামী।
• বেশ : জানা যায় না।
• নিত্য ব্রজলীলায় তিনি শ্রীললিতার যূথে শ্রীরূপমঞ্জরীর অনুগতা কস্তুরিকা মঞ্জরী। তিনি অষ্টমঞ্জরীর অন্যতমা। কবিরাজ গোস্বামী শ্রীচৈতন্য চরিতামৃতের প্রায় প্রতিটি পরিচ্ছেদের ভণিতায় “রূপ-রঘুনাথ”-এর শ্রীচরণে কৃপা প্রার্থনা করেছেন। তাঁর ভাই যখন শ্রীল মীনকেতন রামদাসের চরণে অপরাধ করেন, তখন শ্রীনিত্যানন্দ প্রভুর স্বপ্নাদেশ পেয়ে তিনি গৃহত্যাগ করে ব্রজে গমন করেন।
৬৷ শ্রীল নরোত্তম ঠাকুর মহাশয় :
• মন্ত্র দীক্ষা : শ্রীল লোকনাথ গোস্বামী
• মন্ত্রপরম্পরা : শ্রী অদ্বৈত আচার্য প্রভু > শ্রীল লোকনাথ গোস্বামী > শ্রীল নরোত্তম ঠাকুর।
• ভাগবত শিক্ষা : শ্রীল জীব গোস্বামী প্রভু
• বেশ : অজ্ঞাত
• শ্রীল রূপ গোস্বামীই তাঁর গুরুরূপা সখী। এ সম্পর্কে বহু প্রমাণ পাওয়া যায়। তিনি তাঁর পদে বারবার শ্রীরূপের চরণাব্জে সমর্পিত হতে চেয়েছেন।
৭)শ্রীল বিশ্বনাথ চক্রবর্তী ঠাকুর :
• মন্ত্রদীক্ষা : শ্রীল রাধারমণ চক্রবর্তী
• মন্ত্রপরম্পরা : শ্রীল নরোত্তম > শ্রীল গঙ্গানারায়ণ চক্রবর্তী > শ্রীল কৃষ্ণচরণ চক্রবর্তী > শ্রীল রাধারমণ চক্রবর্তী > শ্রীল চক্রবর্তীপাদ।
• শিক্ষা : শ্রীল নরোত্তম ঠাকুরের পরম্পরাসূত্রে শ্রীল কৃষ্ণচরণ চক্রবর্তীর কাছে।
• বেশ : শ্রীহরিবল্লভ দাস নামে ইনি বিরক্তবেশ গ্রহণ করেন।
৮। শ্রীল বলদেব বিদ্যাভূষণ :
• মন্ত্রদীক্ষা : শ্রীল রাধাদামোদর দেব গোস্বামী
• মন্ত্রপরম্পরা : শ্রীল গৌরসুন্দর, নিত্যানন্দ প্রভু > শ্রীল হৃদয়চৈতন্য প্রভু > শ্রীল শ্যামানন্দ প্রভু > শ্রীল রসিকানন্দ প্রভু > শ্রীল রসিকানন্দের প্রশিষ্য শ্রীল রাধাদামোদর দেব > শ্রীল বলদেব বিদ্যাভূষণ।
• ভাগবত শিক্ষা : কিছুকাল রাধাদামোদর দেবের কাছে শিক্ষা করেন। পরবর্তীতে শ্রীল বিশ্বনাথ চক্রবর্তী ঠাকুরের নিকটে ভাগবত শিক্ষা নেন।
• বেশ : বিদ্যাভূষণ প্রভু বেশ নিয়ে “একান্তী গোবিন্দ দাস” নামে পরিচিত হন। তিনি বেদান্তসূত্রের “গোবিন্দ ভাষ্য” রচনা করেন। ইহা গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের বেদান্তভাষ্য।
৯। শ্রীল জগন্নাথ দাস বাবাজি :
• মন্ত্রদীক্ষা : অনেকে বলেন বৃন্দাবনের শৃঙ্গারবটের জগদানন্দ গোস্বামী। জগদানন্দ গোস্বামীর বেশগুরু ছিলেন গোবর্ধনের কৃষ্ণদাস বাবাজি। কিন্তু দৈনিক নদীয়া প্রকাশ, ১৪ ই ফেব্রুয়ারি, ১৯৪২ অনুসারে নিতাইবংশের রাসবিহারী গোস্বামী ছিলেন তাঁর পাঞ্চরাত্রিকী গুরু।
• বেশ : গোবর্ধনের সূর্যকুণ্ড নিবাসী শ্রীল মধুসূদন দাস বাবাজি ছিলেন এনার বেশগুরু।
• বেশ পরম্পরা : শ্রীল বলদেব বিদ্যাভূষণ > শ্রীল উদ্ধবদাস বাবাজি > শ্রীল মধুসূদন দাস বাবাজি > শ্রীল জগন্নাথ দাস বাবাজি
• ভজন : বাবাজি মহারাজ দীর্ঘকাল সূর্যকুণ্ডে নিজ বেশগুরুর শিক্ষায় ভজন করেছেন। পরবর্তীতে কোলদ্বীপ (বর্তমান শহর নবদ্বীপে) এসে অবস্থান করেন। সেখানে তাঁর সমাধি আছে।
১০৷ শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর :
• মন্ত্রদীক্ষা : শ্রীবংশীবদনানন্দের পুত্র রামাই পণ্ডিতের বংশের বিপিনবিহারী গোস্বামী। এনার পাট বাঘনাপাড়ায়।
• মন্ত্রপরম্পরা : ঈশ্বরী জাহ্ণবী > রামচন্দ্র > রাজবল্লভ > কেশবচন্দ্র > রুদ্রেশ্বর > দয়ারাম > মহেশ্বরী গোস্বামিনী > গুণমঞ্জরী গোস্বামিনী > যজ্ঞেশ্বর > বিপিনবিহারী গোস্বামী > ঠাকুর ভক্তিবিনোদ
• ভজনশিক্ষা : শ্রীল জগন্নাথ দাস বাবাজি।
• বেশ : অপ্রকটের কিছু পূর্বে শ্রীল গৌরকিশোর দাস বাবাজির কাছে বেশ প্রার্থনা করেন। বাবাজি মহারাজের নির্দেশে শ্রীল জগন্নাথ দাস বাবাজির প্রসাদী ডোর কৌপীন গ্রহণ করেন।
১১৷ শ্রীল গৌরকিশোর দাস বাবাজি :
• মন্ত্রদীক্ষা : অদ্বৈত বংশীয় নিমাইচাঁদ গোস্বামী।
• মন্ত্রপরম্পরা : মাধবেন্দ্রপুরী > অদ্বৈত প্রভু > শ্রীকৃষ্ণমিশ্র > দোলগোবিন্দ (শ্রীপাট উথলী) > গোপীনাথ > রাধাগোবিন্দ > কেশব > শুকদেব > রাধারমণ > নিমাইচাঁদ গোস্বামী > গৌরকিশোর বাবাজি > প্রভুপাদ ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী।
• বেশ : শ্রীল ভাগবত দাস বাবাজি
• বেশ পরম্পরা : শ্রীল জগন্নাথ দাস বাবাজি> শ্রীল ভাগবত দাস বাবাজি > শ্রীল গৌরকিশোর দাস বাবাজি।
শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর এবং সিদ্ধ গৌরকিশোর বাবা পরস্পর পরস্পরকে অত্যন্ত সম্মান করতেন। ঠাকুর মহাশয় ছিলেন বাবাজি মহারাজের বেশগুরুর সতীর্থ।
১২৷ শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী প্রভুপাদ :
• মন্ত্রদীক্ষা : শ্রীল গৌরকিশোর দাস বাবাজি।
• মন্ত্রপরম্পরা : গৌরকিশোর বাবার পরম্পরা
• বেশ : ত্রিদন্ড বৈষ্ণব সন্ন্যাস
• বেশ পরম্পরা : “ভক্তিসিদ্ধান্ত বৈভব” গ্রন্থ মতে উপযুক্ত সন্ন্যাস গুরুর অভাবে নিজ মন্ত্রগুরুর আলেখ্য সমীপে শ্রীগান্ধর্বিকা গিরিধারীকে সাক্ষী রেখে কাষায় বস্ত্র ধারণ করেন। শ্রীরামানুজাচার্যও বরদবিষ্ণুকে সাক্ষী রেখে ত্রিদন্ড ও যতিবেশ ধারণ করেন।
এই বিষয়ে বিস্তারিত কথা এই পেজে যথাসময়ে প্রকাশিত হবে।