পূর্ববর্তী ৩ টি পর্বে বেদের সংজ্ঞা, বিভাগ, বেদান্ত, বেদান্ত সূত্র এবং শ্রীল রামানুজাচার্য ও শ্রীল মধ্বাচার্যের বেদান্ত দর্শন সম্বন্ধে আলোচনা হয়েছে। এই পর্বে আমরা শ্রীমদ বিষ্ণুস্বামীপাদের শুদ্ধাদ্বৈতবাদের উপর আলোকপাত করার চেষ্টা করব।
************************************************
“নমঃ শ্রী গান্ধর্বিকা গিরিধরাভ্যাম্
কন্দর্প কোটি রম্যায় স্ফুরদ ইন্দিবর ত্বিষে
জগন্মোহনলীলায় নমো গোপেন্দ্র সূনবে।। “
*************
সদ্য প্রস্ফুটিত নীল পদ্মের মত যার রূপ, মদনের রূপের কোটি গুন সুন্দর , যিনি নানান লীলায় জগতবাসী কে মুগ্ধ করেন , সেই গোপকূলরাজ নন্দের পুত্র কে বন্দনা করি। (মুক্তা চরিত ১)
(সূত্র -গৌড়ীয় স্ক্রিপচার)
************************************************
শুদ্ধাদ্বৈতবাদ (শ্রীবিষ্ণুস্বামী): বৈষ্ণব শিরোমণি দেবাদিদেব মহাদেব হতে উদ্ভূত রুদ্র সম্প্রদায়। এই সম্প্রদায়ের আচার্য শ্রীল বিষ্ণুস্বামীপাদ। তাঁর রচিত ব্রহ্মসূত্রের ভাষ্য “সর্ব্বজ্ঞসূক্তি” এবং এনার বেদান্ত দর্শন শুদ্ধ অদ্বৈতবাদ নামে পরিচিত। কিছু মূর্খ ব্যক্তি নিজ স্বার্থ সিদ্ধির জন্য বৈষ্ণবীয় শুদ্ধাদ্বৈতবাদকে শঙ্করের কেবলাদ্বৈতবাদ মনে করে ভ্রমের শিকার হন। রুদ্র সম্প্রদায়ে পরবর্তী কালে আরও দুই ব্যক্তি বিষ্ণুস্বামী নামে প্রতিষ্ঠিত হন। কিন্তু এক্ষণে আমরা শ্রীদেবেশ্বর পুত্র দেবতনু আদি বিষ্ণুস্বামীর বেদান্ত দর্শন বিষয়েই আলোচনা করবো।
শ্রীল বিষ্ণুস্বামী অদ্বয় জ্ঞান বা শুদ্ধ অদ্বৈত সিদ্ধান্ত দর্শন প্রচার করেন। শ্রীধর স্বামী, শ্রীল বিল্বমঙ্গল ঠাকুর এই সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন। কিন্তু পরবর্তী কালে অদ্বৈতবাদী সিদ্ধান্তের বিদ্ধমতবাদ প্রবর্তন করেন শঙ্করাচার্য। ফলে রুদ্র সম্প্রদায়ের আচার্যগণ তাঁদের অদ্বৈতবাদ কে শুদ্ধাদ্বৈত এবং শঙ্করের মায়াচ্ছন্ন বিদ্ধ অদ্বৈতবাদকে কেবলাদ্বৈতবাদ নামে আখ্যায়িত করেন।
শ্রীল বিষ্ণুস্বামীপাদের মতে ঈশ্বরের, ভগবানের চিদ শরীরের এবং ভজনকারী ভক্তের শুদ্ধত্ব স্বীকৃত হয়েছে। জীব, মায়া এবং জগত ঈশ্বরের আশ্রয়েই পরিচালিত এবং ঈশ্বর হইতে অভেদ ও সত্য সেটিও স্বীকৃত হয়েছে। কিন্তু এখানে জীব, জগৎ ও মায়া পরম বস্তু বা পরম ঈশ্বরের অংশ বিশেষ, কখনোই তারা ঈশ্বর বা পরমব্রহ্ম নয়। অর্থাৎ পরম তত্ত্ব এবং তাঁর অংশ তত্ত্বগতভাবে বা উপাদানগত ভাবে অদ্বয় হলেও পরিমাণগত ভাবে ভিন্ন। জীব, জগৎ এবং মায়া ঈশ্বরের নিত্য অংশ বিশেষ। এখানেও ভগবান চৈতন্যের অচিন্ত্য ভেদ-অভেদ তত্ত্বের মিল পাওয়া গেলো। শঙ্করের জগৎ মিথ্যা এবং ব্রহ্ম মায়ার প্রভাবে জীব হন এই উক্তি গুলিও এখানে খণ্ডিত হলো।
জগৎ: এই বিষয়ে শ্রীল আচার্য বললেন “জগৎ হলো পরম বস্তু বা পরমব্রহ্মের কার্য্য। সোনা যেরকম কণ্ঠহার, কুন্ডল ইত্যাদিতে পরিণত হলেও সোনাই থাকে সেইরকমভাবেই সর্বকারণকারণম্ ঈশ্বর যখন সত্য তখন তদ্দ্বারা নির্মিত কার্যরূপ জগৎ সত্য ও নিত্য। এখানে প্রশ্ন আসতে পারে কালের প্রভাবে জগতে প্রলয় আসে এবং জগৎ বিলুপ্ত হয় তবে জগতের নিত্যত্ব কিরূপে প্রমাণিত হয়? শ্রীল বিষ্ণুস্বামীপাদ এর উত্তরে বলছেন -“কোনো বস্তুর তৎকালীন অদর্শনের দ্বারা বস্তুর নিত্যত্ব বা অনিত্যত্ব বিচার করতে পারিনা। যেমন মেঘ সূর্য্য কে ঢেকে দিলেও সূর্য্য হারিয়ে যায়না, সুতরাং এই অদর্শন তাৎক্ষণিক। অতি ক্ষুদ্র অণু পরমাণু আমাদের দৃষ্টিগোচর নয় বলে তাহা বিদ্যমান নয় সেটি আমরা বলতে পারিনা বা গৃহাভ্যন্তরে স্থিত রাজমহিষীর অদর্শনে আমরা তার অবিদ্যমানতার সিদ্ধান্তে উপনীত হোতে পারিনা বা লবনাক্ত জলে লবণের অদর্শনে আমরা লবণের উপস্থিতি অস্বীকার করতে পারিনা সেরকমই জগৎ তাৎক্ষনিকভাবে অদৃশ্যমান হলেও তাহার নিত্যত্ব বর্তমান থাকে। আবার আমরা ব্যক্তিগত ভাবে এটাও বলতে পারি রক্তে লোহার অদর্শনে আমরা রক্তে হিমোগ্লোবিনের নিত্যত্ব অস্বীকার করতে পারিনা। অন্ধের সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে অবিদ্যমান মনে করা যা জগৎ মিথ্যা মনে করাও তাই।
ঈশ্বর: এই বিষয়ে বর্ণনা করতে গিয়ে আচার্য বিষ্ণুস্বামীপাদ বললেন –
“হ্লাদিন্যা সংবিদাশ্লিষ্ঠ: সচ্চিদানন্দ ঈশ্বর:।
স্বাবিদ্যা-সংবৃতো জীব: সংক্লেশনিকরাকর:।।
তথা__স ঈশো যদ্বশে মায়া স জীব যস্তয়ার্দ্দিত:।
স্বাবির্ভুত: পরানন্দ: স্বাবির্ভূত: সুদু:খভূ:।। “
অর্থাৎ,
হ্লাদিনী ও সম্বিৎ শক্তি আলিঙ্গিত সচ্চিদানন্দ বিগ্রহই ঈশ্বর। অবিদ্যা সংবৃতত্ব ও সংক্লেশ ইত্যাদির মূল স্বরূপতাই বদ্ধ জীবের লক্ষণ। বিভু ঈশ্বরের সহিত অংশস্বরূপ জীবের যে সেব্য ও সেবক বা প্রভু ও ভৃত্যের অবস্থানরূপ একত্বাবস্থা সেই শুদ্ধজ্ঞান থেকে বিচ্যুত এবং উপাধিবশত ঈশ্বর এবং জড়ের ভেদগত সত্তা দর্শনে নিজেকে অবিদ্যার দ্বারা আবৃত ও সংক্লেশের মূল স্বরূপ জ্ঞানই বদ্ধ জীবাভিমান। উল্লেখ্য, বর্তমানে কিছু মূঢ় ব্যক্তি গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের ঈশ্বর এবং তটস্থা জীবের যে প্রভু এবং ভৃত্যের সম্পর্ক সেই বিষয়ে অশাস্ত্রীয় বালক সুলভ মন্তব্য করে থাকেন কিন্তু বহুকাল পূর্বেই বৈষ্ণবাচার্য শ্রীল বিষ্ণুস্বামীর সিদ্ধান্তেও যে উক্ত প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্ক বর্ণিত হয়েছে সেটি তারা মায়াপহৃত জ্ঞানের কারণে বুঝতে সক্ষম হন না।
আচার্যদেব বিষ্ণুস্বামীর মতে ঈশ্বর মায়াধীশ, স্বপ্রকাশ পরমানন্দস্বরূপ, তিনি নিত্য মুক্ত (এক্ষেত্রে শঙ্করের ব্রহ্ম মায়াবদ্ধ তত্ত্ব খণ্ডিত হলো), ঈশ্বর কোনো উপাধির বশ্যতা প্রাপ্ত হননা, তিনি অপ্রাকৃত গুণ বিশিষ্ট, সর্ব্বজ্ঞ, সর্ব শক্তিমান, সর্ব্বেশ্বর (উল্ল্যেখ্য শঙ্কর মতে ব্রহ্ম শক্তিহীন), সর্ব নিয়ন্তা, সর্ব্বোপাস্য, সর্ব্বকর্মফল প্রদাতা এবং সচ্চিদানন্দ পরমবস্তু। আচার্য বিষ্ণুস্বামী প্রবর্তিত মতবাদ যদিও অদ্বৈত কিন্তু এখানে তিনি ঈশ্বরের সচ্চিদানন্দ সাকার ঈশ্বরের কথাই বললেন, তিনি অদ্বৈত মতবাদ প্রচার করলেও ঈশ্বরের নিরাকারত্ব স্বীকার করেননি। তাঁর মতে জীব সেই পরম সচ্চিদানন্দ পরমবস্তুর অংশ বিশেষ কিন্তু কখনোই পরমবস্তুর সাথে এক নয় অর্থাৎ ঈশ্বর এবং জীবের ভেদ নিত্য।
জীব: এই বিষয়ে আচার্য বিষ্ণুস্বামী বলেন জীব পরমবস্তুর অংশ বিশেষ এবং ব্রহ্ম সূত্রের থেকেই তিনি প্রমান দিলেন এইভাবে –
“অংশ নানা ব্যপদেশাৎ” (ব্রহ্ম সূত্র -২/৩/৪২)
ব্যাখ্যা : বেদে কোথাও জীবকে ব্রহ্ম, কোথাও অজ্ঞ, কোথাও চিদরূপ, কোথাও দাস আবার কোথাও অণু বলা হয়েছে। এই ভাবে জীবতত্ত্বকে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন নামে সম্বোধনের ফলে প্রমান হচ্ছে যে জীব ব্রহ্মের অংশ স্বয়ং ব্রহ্ম নয়। এছাড়াও ব্রহ্ম সূত্রের আরও কিছু সূত্রে জীব ব্রহ্মের অংশ বিশেষ এই তত্ত্বই বর্ণিত হয়েছে যেমন “মন্ত্রবর্ণাৎ”-সূত্র ২/৩/৪৩, “অপি স্মর্য্যতে”-সূত্র ২/৩/৪৪, “প্রকাশাদিবত্তু নৈবং পর:”-সূত্র ২/৩/৪৫ ইত্যাদি। যেভাবে অগ্নি হোতে নির্গত অগ্নি স্ফুলিঙ্গও অগ্নি নামেই পরিচিত কিন্তু অগ্নিসম নয় সেইরূপ জীব ও ব্রহ্ম অংশ ও অংশী হলেও দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য বিদ্যমান তাই জীব কখনও পরমব্রহ্ম নয়।
আর এই ভেদ এবং অভেদ তত্ত্বই গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের সিদ্ধান্ত। বাকি সমস্ত আচার্যদের সিদ্ধান্ত পরিপূর্ণতা পায় একমাত্র “অচিন্ত্য ভেদ-অভেদ” তত্ত্ব এসে।
উল্লেখ যোগ্য বিষয় এই যে, কিছু ব্যক্তি বলে থাকেন, অদ্বৈতবাদের প্রবর্তক শ্রীল শঙ্করাচার্য। কিন্তু অজ্ঞানতাবশত তাঁরা জানেননা যে খ্রীষ্টের জন্মের ৩০০ বছর আগে এবং আদি শঙ্করাচার্যের আবির্ভাবের বহু পূর্বেই রুদ্র সম্প্রদায় আচার্য শ্রীল বিষ্ণুস্বামীপাদ অদ্বৈত দর্শনের শুদ্ধ মতবাদ প্রবর্তন করেছিলেন। শঙ্করের বহু পূর্ব থেকেই ছয়টি বৈষ্ণব সম্প্রদায় বর্তমান ছিল।
বহু পরে আচার্য শঙ্কর এসে অদ্বৈত দর্শনের বিদ্ধ মতবাদ প্রচার করেন। অর্থাৎ শুদ্ধ-অদ্বৈতবাদের বিকৃত রূপ হলো প্রচলিত কেবলাদ্বৈতবাদ। সঠিক জ্ঞানের অভাবে মূর্খেরাই অদ্বৈতবাদ বলতে কেবলাদ্বৈতবাদ বা মায়াবাদ বা প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধ মতবাদকেই বোঝেন।
শ্রীল বিষ্ণুস্বামী এবং তাঁর শুদ্ধ-অদ্বৈত দর্শন সংক্রান্ত একটি পৃথক বিশদ প্রবন্ধ শীঘ্রই প্রকাশ করা হবে। “গৌড়ীয় দর্শনে বেদ” সিরিজের পর্ব ৫ -এ নিম্বার্ক সম্প্রদায় এবং তার বেদান্ত দর্শন নিয়ে আলোচনা করা হবে।
প্রতিটি প্রবন্ধ বা পোস্ট মনোযোগ সহকারে পড়ুন এবং শেয়ার করে সৎ দর্শন প্রচারে আমাদের প্রচেষ্টাকে সফল করুন। পাশে থাকুন।
গৌর প্রেমানন্দে হরি হরিবোল।
@RUPANUGA