গৌড়ীয় দর্শনে বেদ~পর্ব-৩

95419149_122432089439915_4732820528719462400_n
  1. গত পর্বে সংক্ষেপে রামানুজ বেদান্ত আলোচনার পর এই পর্বে মধ্বাচার্যের বেদান্ত মত সংক্ষেপে আলোচনা করা হবে।
শ্রীরামানুজের পূর্বেই বৌধায়ন, দ্রমিড়, টঙ্কাচার্য প্রমুখ বিশিষ্টাদ্বৈতবাদী আচার্য এই বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ প্রচার করেছিলেন। সুতরাং এই দর্শন শ্রীল রামানুজাচার্যের পূর্বেও প্রচলিত ছিল। আচার্য রামানুজ ভক্তিকে দার্শনিক ভাবে ব্যাখ্যা করেন। এরপর আসেন শ্রীল মধ্বাচার্য। যিনি আনন্দতীর্থ পূর্ণপ্রজ্ঞ নামে ও পরিচিতি পান।
• শুদ্ধদ্বৈত বাদ (ব্রহ্ম-মাধ্ব সম্প্রদায়):
শ্রীব্রহ্মা হতে এই সম্প্রদায়ের সৃষ্টি এবং শ্রীল মধ্বাচার্য তাঁর শুদ্ধ দ্বৈত দর্শনের দ্বারা এই সম্প্রদায়ের ঐতিহ্য বর্ধন করেছেন। তাই এই সম্প্রদায়কে ব্রহ্ম-মাধ্ব সম্প্রদায় বলা হয়। আচার্য মধ্বের দর্শন হলো শুদ্ধ-দ্বৈতবাদ অর্থাৎ ঈশ্বরে জীবে, জড়ে নিত্য ভেদ বর্তমান।
এই সিদ্ধান্ত মতে
• পরব্রহ্ম ভগবান শ্রী বিষ্ণুই সর্বোত্তম।
• জগৎ সত্য,
• ঈশ্বর, জীব এবং জড়ে পঞ্চভেদ নিত্য বর্তমান (ঈশ্বরে ও জীবে ভেদ, জীবে ও জড়ে ভেদ, জীবে ও জীবে ভেদ, ঈশ্বরে ও জড়ে ভেদ এবং জড়ে ও জড়ে ভেদ বর্তমান ),
• জীবসমূহ শ্রীহরির অনুচর, যোগ্যতানুসারে জীবগণের মধ্যে নিত্য তারতম্য বর্তমান।
• শুদ্ধা ভক্তিই জীবের স্বরূপানুগত ধর্মের অভিব্যক্তির সাধন অর্থাৎ জীব মাত্রেই বিষ্ণুদাস। এই যুক্তির সাথে গৌড়ীয়নাথ শ্রীমন্মহাপ্রভুর উক্তি (জীবের স্বরূপ হয় কৃষ্ণের নিত্য দাস) মিল পাওয়া যায়।
• আচার্য মধ্ব শাংকরভাষ্য খণ্ডন করেন:
শঙ্করের অদ্বৈতবাদ খন্ডন করে শ্রী মধ্ব বলেন:
১) বিষ্ণু/কৃষ্ণই পরম বস্তু,
২) বিষ্ণু/কৃষ্ণ – অখিল বেদবেদ্য,
৩) জগৎ সত্য,
৪) জীব ও জড় “বিষ্ণু বা কৃষ্ণ” হতে ভিন্ন,
৫) জীব মাত্রই ভগবান বিষ্ণুর দাস,
৬) বদ্ধ ও মুক্তভেদে জীবের মধ্যে তারতম্য আছে,
৭) বিষ্ণুপাদপদ্ম লাভই জীবের লক্ষ্য,
৮) জীবের মুক্তির কারণ -বিষ্ণুর শুদ্ধ ভক্তি এবং
৯) প্রত্যক্ষ, অনুমান ও বেদই প্রমাণত্রয়।
শ্রী মধ্বের এই নয়টি প্রমেয়ই শ্রীমন্মহাপ্রভু উপদেশ করেছেন।
• মহাভারত তাৎপর্য নির্ণয়ে ১/১১ শ্লোকের শ্রী মধ্ব বললেন –
“নির্দ্দোষপূর্ণগুণবিগ্রহ-আত্মতন্ত্র
নিশ্চেতনাত্মকশরীর-গুণৈশ্চ হীনাঃ।
আনন্দমাত্রকরপাদমুখোদরাদি:
সর্ব্বত্র চ স্বগতভেদ বিবর্জ্জিতাত্মা।।
অর্থাৎ, ভগবান বিষ্ণু সর্ব প্রকার দোষরোহিত, তিনি পরিপূর্ণ চিদগুণাত্মক দেহবান (সচ্চিদানন্দ), সম্পূর্ণ স্বাধীন, তাঁর দেহ বা গুণাবলী সম্পূর্ণ চিন্ময়, তাঁর অবচেতনার লেশমাত্র নেই, তিনি হস্ত-পদ-মুখ-উদরাদি যুক্ত শ্রীবিগ্রহ, সেইসকল আনন্দমাত্রস্বরূপ। তিনি সর্বত্র স্বগতভেদ রোহিত বাস্তব বস্তু।
• পবনাবতার শ্রী মধ্ব, শঙ্করের “জগৎ মিথ্যা” যুক্তিকে খন্ডন করে জগতের সত্যতা প্রমান করেন এবং বলেন :
ভগবান শ্রীহরি কল্পের আদিতে অনাদি-নিত্যা জড়া প্রকৃতির তিনটি গুণ (সত্ত, রজ, তম), মহৎ, অহংকার, পঞ্চভূত-ক্রমে ব্রহ্মান্ড, ব্রহ্মান্ড মধ্যে চতুর্দশ লোক, সমুদ্র, মেরুমন্দরাদি পর্বত, গঙ্গা যমুনাদি নদী, শিলা, বনস্পতি, ঔষধি, ধান্য, পুষ্প, ফল, পুষ্প, নবরত্ন, সুবর্ণ, লৌহাদি ধাতু প্রভৃতি সমস্ত বস্তু সৃষ্টি করেন। এই সবই কার্যরূপে অনিত্য কিন্তু কারণরূপে নিত্য। বিষ্ণুর বুদ্ধিবলে সৃষ্ট জগৎ কখনই তাঁর অধ্যক্ষতা ছাড়া মায়ার উপাদানে তৈরী হতে পারে না। অর্থাৎ ঈশ্বর সৃষ্ট জগৎ সত্য কিন্তু নশ্বর।
• উপসংহারে বলা যায়,
আচার্য মধ্ব কখনোই জগৎকে মিথ্যা বলেননি। ঘটের উপাদান কারণ মৃত্তিকা, নিমিত্তকারণ কুমোর- তিনটিই সত্য। তেমনি জগৎ সৃষ্টির উপাদান গুলি শ্রীহরি হতেই উৎপন্ন, আবার শ্রীহরিই নিমিত্তকারণ। তাই সত্যবস্তু শ্রীহরি থেকে উৎপন্ন জগৎ কি প্রকারে মিথ্যা হতে পারে। শ্রীহরি এই জগৎসৃষ্টি করেও অবিকারী তত্ত্ব।
গীতাতে এ কথা বলা হয়েছে :
মৎস্থানি সর্বভূতানি ন চাহং তেষ্ববস্থিতা।।” (৯|৪)
– ভূতসকল আমাতে অবস্থিত, কিন্তু আমি তাতে অবস্থিত নহি।
শংকর জগৎকে রজ্জুতে সর্পভ্রম বা শুক্তিতে রজতভ্রম বলেছেন। মধ্বমতে রজ্জুতে তখনই সর্পভ্রম হবে, যখন প্রকৃত সর্পের বিষয়ে জ্ঞান থাকবে; শুক্তিতে তখনই রজতভ্রম হবে, যখন প্রকৃত রজতের স্মৃতি থাকবে। এইভাবে নিশ্চয়ই একটি শুদ্ধ চিন্ময় জগৎ আছে, যার ফলে জগতে তার ভ্রম হয়। অর্থাৎ, শ্রীভগবানের অবশ্যই চিদ্বৈচিত্র্য আছে।
শ্রীল মধ্ব সম্পর্কে আলাদা দুটি পোস্ট পূর্বে করা হয়েছে এবং ভবিষ্যতে পঞ্চভেদ এবং মধ্বাচার্যের লক্ষ্মী ঠাকুরাণী বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে আলাদা ভাবে বিস্তৃত বর্ণনা করে পোস্ট দেওয়া হবে।
গৌড়ীয় দর্শনে বেদ, প্রথম পর্ব লিঙ্ক 👇
দ্বিতীয় পর্ব লিঙ্ক 👇
Avatar of Navanila

Navanila

Writer & Admin

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments