আজকাল কিছু শাস্ত্রজ্ঞানহীন ব্যাক্তি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপপ্রচার করছে যে ব্রহ্মসংহিতা নাকি কোন প্রামাণিক শাস্ত্র নয়।প্রকৃত অর্থে তাদের এ ধরনের মন্তব্য সনাতনী শাস্ত্র সমন্ধে তাদের মুর্খতার পরিচায়ক।আসুন আমরা শ্রীল ব্যাসদেবকৃত অষ্টাদশ পুরানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ব্রহ্মবৈবর্ত পুরান শাস্ত্র থেকে ব্রহ্মসংহিতার প্রামানিকতা জানার চেষ্ঠা করি।
“এবং পুরানসংখ্যানাং চতুর্লক্ষমুদাহৃতম।
অষ্টাদশ পুরানানাং নাম চৈতদ্বিদুবুর্ধাঃ।।২১।।
এবঞ্চোপপুরাণামাষ্টাদশ প্রকীর্ত্তিতা।
ইতিহাসো ভারতনঞ্চ বাল্মীকিকাব্যমেব চ।।২২।।
পঞ্চকং পঞ্চরাত্রাণাং কৃষ্ণমাহাত্ম্যপূর্ব্বকম্।
বশিষ্টং নারদীয়ঞ্চ কপিলং গৌতমীয়কম্।।২৩।।
পরং সনৎকুমারীয়ৎ পঞ্চরাত্রঞ্চ পঞ্চকম্।
পঞ্চমী সংহিতান্যঞ্চ কৃষ্ণভক্তিসমন্বিতা।।২৪।।
ব্রহ্মণশ্চ শিবস্যাপি প্রহ্লাদস্য তথৈব চ।
গৌতমস্য কুমারস্য সংহিতাঃ পরিকীত্তির্তা।।” ২৫।।
অনুবাদঃ পূর্বোক্ত ক্রমে অষ্টাদশ পুরানের নাম পন্ডিতগন বলেছেন।পুরানের ন্যায় অষ্টাদশ উপপুরান,ভারত,বাল্মিকী প্রণীত কাব্য ইতিহাস প্রকীর্তিত হয়েছে।শ্রীকৃষ্ণ মাহাত্ম্যপূ্র্ণ পাঁচটি পঞ্চরাত্র হল-বশিষ্ট,নারদ,কপিল,গৌতম এবং সনৎকুমার বিরচিত।ব্রহ্ম, শিব, প্রহ্লাদ, গৌতম এবং সনৎকুমার কর্তৃক কৃষ্ণভক্তি সমন্বিত পাঁচটি সংহিতা পরিকীর্তিত হয়েছে।
– ব্রহ্মবৈবর্ত পুরানঃ শ্রীকৃষ্ণ জন্মখন্ড, ১৩০/২১-২৫
উপরোক্ত ব্রহ্মবৈবর্ত পুরানের শ্রীকৃষ্ণ জন্মখন্ডের,১৩০ তম অধ্যায়ের ২১-২৪ নং শ্লোকে শ্রীল সূত গোস্বামী শৌনক ঋষিকে অষ্টাদশ পুরান, অষ্টাদশ উপপুরান, ইতিহাস শাস্ত্র -মহাভারত, রামায়ন, বশিষ্ট,নারদ,কপিল,গৌতম এবং সনৎকুমারকৃত শ্রীকৃষ্ণ মাহাত্ম্যপূ্র্ণ পঞ্চরাত্র শাস্ত্রের কথা বর্ণনা করেন।
এবং পরিশেষে ব্রহ্মবৈবর্ত পুরান শাস্ত্রের শ্রীকৃষ্ণ জন্মখন্ডের ১৩০ তম অধ্যায়ের ২৫ নং শ্লোকে স্পষ্টভাবে ব্রহ্ম,শিব,প্রহ্লাদ,গৌতম এবং সনৎকুমারকৃত কৃষ্ণভক্তি সমন্বিত সংহিতা শাস্ত্রের কথা বর্ণনা করেন।সুতারাং শ্রীল সূত গৌস্বামী ব্রহ্মবৈবর্ত পুরান শাস্ত্রের সংহিতা শাস্ত্রের মধ্যে কৃষ্ণভক্তি বিষয়ক শিবসংহিতা,প্রহ্রাদ সংহিতা,গৌতম সংহিতা,সনৎকুমার সংহিতার সাথে ব্রহ্মসংহিতা শাস্ত্রের নাম উল্লেখ করেছেন।
সিদ্ধান্তশাস্ত্র নাহি ব্রহ্মাসংহিতার সম |
গোবিন্দমহিমা জ্ঞানের পরম কারণ ॥ ২৩৯ ।।
অল্পাক্ষরে কহে সিদ্ধান্ত অপার সকল।
বৈষ্ণবশাস্ত্রমধ্যে অতি সার ॥ ২৪০ ।।
দক্ষিণ ভারত পরিক্রমাকালে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু ত্রিবাঙ্কুর জেলায় তিরুবত্তর গ্রামে অবস্থিত আদিকেশব মন্দির দর্শনে এসে সেখানে ভক্তদের সাথে ইষ্টগোষ্ঠী করছিলেন। তখন সেখানকার ভক্তরা তাকে জানায় ঠিক এই(গৌড়ীয়) সিদ্ধান্তই একটি গ্রন্থে লেখা আছে। এই বলে তারা ব্রহ্মসংহিতা গ্রন্থ দেখান। ব্রহ্মসংহিতার প্রতিটি শ্লোকে অল্প অক্ষরে অনেক সিদ্ধান্ত বর্ণনা রয়েছে দেখে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু এই গ্রন্থটি লিখিয়ে নেন।
সেই দিন চলি’ আইলা পয়স্বিনীতীরে।
স্নান করি’ গেল আদিকেশব মন্দিরে ॥ ২৩৪
মহাভক্তগণসহ তাহা গোষ্ঠী কৈল।
ব্রহ্মসংহিতাধ্যায়পুথি তাহা পাইল ॥ ২৩৭
পুঁথি পাঞা প্রভুর হৈল আনন্দ অপার ।
কম্পাশ্রু স্বেদ স্তম্ভ পুলক বিকার ॥ ২৩৮
(মধ্যলীলা ৯/২৩৪-২৩৮)
এই ব্রহ্মসংহিতা গ্রন্থকে অনেকে কাল্পনিক গ্রন্থ বলে থাকেন। কিন্তু শ্রীমধবাচার্য্য তার ভাগবৎ তাৎপর্ধ্য নির্ণয় ও ব্রহ্মসূত্রভাষ্যে ব্রহ্মসংহিতা থেকে উদ্ধৃত করেছেন। তাই ব্রহ্মসংহিতা নামে একটি গ্রন্থ ছিল তা প্রমাণিত হয়। যা থেকে শ্রীচৈতন্যমহাপ্রভু ৫ম অধ্যায়টি লিখে আনেন।
ভাঃ১১/১১/৫ শ্লোকের টীকায় শ্রীআনন্দতীর্থ মধ্বাচার্য্যপাদ শ্রীব্রহ্মসংহিতা থেকে উদ্ধৃত করেছেন। বদ্ধজীব সম্পর্কে ব্ৰহ্ম সংহিতায় বলা হয়েছে
বদ্ধা জীবা ইমে সর্বে পূর্ববন্ধসমন্বয়াৎ।
নিত্যমুক্তত্বতো বিষ্ণুমুক্তনামা সদোদিতঃ।
অবদ্ধত্বাদমোক্ষোঽপি দীপ্যতেঽসৌ রবিথা।।
ইতি ব্রহ্মসংহিতায়াম্।।
(ভাগবত তাৎপৰ্য্য নির্ণয় গোবিন্দাচার্য্য সংস্করণ পৃঃ ৬৬৯)
যত্রানবসরোঽন্যত্র পদং তত্র প্রতিষ্ঠিতম্।
বাক্যঞ্চেতি সতাং নীতিঃ সাবকাশে ন তদ্ভবেৎ।।
ইতি ব্রহ্মসংহিতায়াম।।
অনুবাদ: যেখানে যে পদ এর অর্থ বাক্যের অভীষ্ট লক্ষ্য যে তাৎপর্য্যে সেই তাৎপর্য্যেই মানতে হবে। যদি তা সম্ভব না হয় তবে অন্য অর্থ কল্পনা করতে হবে। ব্রহ্মসংহিতায় বলা হয়েছে।
(ব্রহ্মসূত্রভাষ্য ১.১.১, গোবিন্দাচার্য্য সংস্করণ পৃঃ৫)
বৈশেষ্যা তদ্বাদস্তদ্বাদঃ ভাষ্য পার্থিবানাং শরীরাণামর্দ্ধেন পৃথিবী স্মৃতা।
ইতরেঽর্দ্ধত্রিভাগিন্য আপস্তেজস্তু ভাগতঃ।
ইতি সামান্যতো জ্ঞেয়ো ভেদশ্চ প্রতিপুরুষম্।
স্বর্গাস্থানাং শরীরাণামর্দ্ধং তেজ উদাহৃতমিতি।।
ইতি চ ব্রহ্মসংহিতায়াম।।
অনুবাদ: পার্থিব শরীরে পৃথিবীর অর্দ্ধাংশ, অবশিষ্ট অর্দ্ধাংশের তিনভাগ জল, এবং এক ভাগ তেজ। এভাবে প্রতিপুরুষেই সামান্যতঃ ভুতবিভাগ জানতে হবে। স্বর্গস্থ শরীরে তেজ এর অর্দ্ধভাগ কথিত হয়।
(ব্রহ্মসূত্রভাষ্য ২/৪/২২, গোবিন্দাচার্য্য সংস্করণ পৃঃ১১৬)
সুতরাং, উপরোক্ত আলোচনায় ব্রহ্মসংহিতা একটি প্রামানিক সনাতনী বৈদিক শাস্ত্র। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরানের উক্ত শ্লোকে ব্রহ্মসংহিতাকে কৃষ্ণভক্তি বিষয়ক শাস্ত্র বলা হয়েছে। আমরা যখন ব্রহ্মসংহিতা পড়ি তখন আমরা দেখতে পায়,ব্রহ্মসংহিতার প্রতিটি শ্লোক ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সাথে গভীর ভাবে সম্পর্কযুক্ত।
ईश्वर: परम: कृष्ण: सच्चिदानन्दविग्रह:
अनादिरादिर्गोविन्द: सर्वकारणकारणम्।
“ঈশ্বরঃ পরমঃ কৃষ্ণঃ সচ্চিদানন্দবিগ্রহঃ।
অনাদিরাদির্গোবিন্দঃ সর্বকারণকারণম্।”
– ব্রহ্মসংহিতা ৫/১ঃ ব্রহ্মা
বিঃদ্রঃ – বৃহৎব্রহ্মসংহিতা বলে একটি গ্রন্থ পাওয়া যায় সেটি নারদপঞ্চরাত্রের অংশ। তাতে দশটি অধ্যায় আছে। এই গ্রন্থটি শ্রীচৈতন্যমহাপ্রভূ সংগৃহীত ব্ৰহ্মসংহিতা নয়। মধ্বাচার্য্য উদ্ধৃত শ্লোকগুলি সেই গ্রন্থে পাওয়া যায়না। মধ্ব সম্প্রদায়ের প্রখ্যাত পন্ডিত গোবিন্দাচাৰ্য্য এই শ্লোকগুলিকে untraceable reference বলেছেন তাই শ্রীমধ্বাচার্য্য উদ্ধৃত শ্লোক গুলি সেই লুপ্ত গ্রন্থের ই অংশ যা থেকে শ্রীচৈতন্যমহাপ্রভু ৫ম অধ্যায়টি লিখে আনেন।
।।হরে কৃষ্ণ।।
।।প্রনাম।।
– অর্জুন সখা দাস
– সদ্গুন মাধব দাস