শ্রীল প্রভুপাদ কেন বলেছিলেন “বেদে কুরুক্ষেত্রের মহিমা বর্ণিত আছে”?
শ্রীল অভয়চরণারভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ তাঁর ‘শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা যথাযথ’র ১/১ শ্লোকের ভাষ্যে বলেছেন “বেদে বলা হয়েছে, কুরুক্ষেত্র হচ্ছে অতি পবিত্র স্থান, যা দেবতারাও পূজা করে থাকেন।”
এখন, এই কথাটা তিনি কেন বললেন?! এটা সত্য নাকি মিথ্যা?! এ নিয়ে একদল শেয়াল পণ্ডিত উপহাস করছে যে, এমন কথা নাকি বেদের কোথাও লেখা নাই। প্রতিপক্ষের এমন দাবি আজকে খণ্ডণ করা হবে।
এই আর্টিকেলে যা যা থাকছে —
- প্রভুপাদ ছাড়া এমন কথা আর কেউ কি বলেনি?!
- বেদের কোথায় কুরুক্ষেত্রের মহিমা উল্লেখ আছে?!
- স্মৃতিশাস্ত্র ও ইতিহাস গ্রন্থে কোথায় কুরুক্ষেত্রের মহিমা বর্ণনা করা হয়েছে?!
প্রথমেই দেখবো শ্রীল প্রভুপাদ ছাড়া আর কে কে এই ধরণের কথা বলেছেন:
বাংলাতে অন্যতম জনপ্রিয় শ্রীজগদীশ চন্দ্র ঘোষ ও ঊপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাদের উক্ত শ্লোকের ভাষ্যে একই কথা স্বীকার করেছেন।
নিচে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর ভাষ্যটি হুবুহু তুলে ধরা হলো—
কুরুক্ষেত্র একটি চক্র বা জনপদ। ঐ চক্র এখনকার স্থানেশ্বর বা থানেশ্বর নগরের দক্ষিণবর্তী। আম্বালা নগর হইতে উহা ১৫ ক্রোশ দক্ষিণ। পানিপাট হইতে উহা ২০ ক্রোশ উত্তর। কুরুক্ষেত্র ও পানিপাট ভারতবর্ষের যুদ্ধক্ষেত্র, ভারতের ভাগ্য অনেক বার ঐ ক্ষেত্রে নিষ্পত্তি পাইয়াছে। “ক্ষেত্র” নাম শুনিয়া ভরসা করি, কেহ একখানি মাঠ বুঝিবেন না। কুরুক্ষেত্র প্রাচীন কালেই পঞ্চ যোজন দৈর্ঘ্যে এবং পঞ্চ যোজন প্রন্থে। এই জন্য উহাকে সমন্তপঞ্চক বলা যাইত। চক্রের সীমা এখন আরও বাড়িয়া গিয়াছে।
কুরু নামে এক জন চন্দ্রবংশীয় রাজা ছিলেন। তাঁহা হইতেই এই চক্রের নাম কুরুক্ষেত্র হইয়াছে। তিনি দুর্য্যোধনাদির ও পাণ্ডবদিগের পূর্ব্বপুরুষ; এজন্য দুর্য্যোধনাদিকে কৌরব বলা হয়, এবং কখন কখন পাণ্ডবদিগকেও বলা হয়। তিনি এই স্থানে তপস্যা করিয়া বর লাভ করিয়াছিলেন, এই জন্য ইহার নাম কুরুক্ষেত্র। মহাভারতে কথিত হইয়াছে যে, তাঁহার তপস্যার কারণেই উহা পুণ্যতীর্থ। ফলে চিরকালই কুরুক্ষেত্র পুণ্যক্ষেত্র বা ধর্মক্ষেত্র বলিয়া প্রসিদ্ধ।
শতপথ ব্রাহ্মণে আছে, “দেবাঃ হ বৈ সত্রং নিষেদুরগ্নিরিন্দ্রঃ সোমো মখো বিষ্ণুর্বিশ্বেদেবা অন্যত্রেবাশ্বিভ্যাম্। তেষাং কুরুক্ষেত্রং দেবযজনমাস। তস্মাদাহুঃ কুরুক্ষেত্রং দেবযজনম্।” অর্থাৎ দেবতারা এইখানে যজ্ঞ করিয়াছিলেন, এজন্য ইহাকে ‘দেবতাদিগের যজ্ঞস্থান’ বলে।
মহাভারতের বনপর্ব্বের তীর্থযাত্রা পর্ব্বাধ্যায়ে কথিত হইয়াছে যে, কুরুক্ষেত্র ত্রিলোকীর মধ্যে প্রধান তীর্থ। বনপর্ব্বে কুরুক্ষেত্রের সীমা এইরূপ লেখা আছে-“উত্তরে সরস্বতী, দক্ষিণে দূষদ্বতী; কুরুক্ষেত্র এই উভয় নদীর মধ্যবর্তী।” (৮৩ অধ্যায়) মনুসংহিতায় বিখ্যাত ব্রহ্মাবর্তেরও ঠিক সেই সীমা নিদ্দিষ্ট হইয়াছে।-
সরস্বতীদূষদ্বত্যোর্দেবনদ্যোর্যন্তরং। তং দেবনির্মিতং দেশং ব্রহ্মাবর্তং প্রচক্ষতে || ২। ১৭।
অতএব, কুরুক্ষেত্র এবং ব্রহ্মাবর্ত একই। কালিদাসের নিম্নলিখিত কবিতাতে তাহাই বুঝা যাইতেছে।
ব্রহ্মাবর্তং জনপদমথচ্ছায়য়া গাহমানঃ
ক্ষেত্রং ক্ষত্রপ্রঘনপিশুনং কৌরবং তদ্ভজেথাঃ।
রাজন্যানাং শিতশরশতৈর্যত্র গাণ্ডীবধন্বা ধারাপাতৈত্ত্বমিব কমলান্যভ্যবর্ষন মুখানি ||
[মেঘদূত ৪৯]
বেদের কোথায় কুরুক্ষেত্রের মহিমা উল্লেখ আছে?
উত্তর: শুক্ল যজুর্বেদীয় “জাবাল উপনিষদ” এর প্রথম মন্ত্রে বলা হচ্ছে –
“কুরুক্ষেত্রং দেবানাং দেবযজনং”
– [শুক্লযজুর্বেদীয়ঃ জাবাল উপনিষদ-১]
অর্থাৎ, কুরুক্ষেত্র এতই মহিমান্বিত যে, দেবতারাও এখানে যজ্ঞ করতে আসেন।
এছাড়া শুক্লযজুর্বেদীয় “শতপথ ব্রাহ্মণ” থেকে কুরুক্ষেত্রের মহিমা উপরের অংশে দেখানো হয়েছে।
স্মৃতিশাস্ত্র ও ইতিহাস গ্রন্থে কোথায় কুরুক্ষেত্রের মহিমা বর্ণনা করা হয়েছে?!
পুরাণ ও মহাভারত আদি ইতিহাস গ্রন্থেও কুরুক্ষত্রের মাহাত্ম্য বর্ণিত হয়েছে। প্রসঙ্গক্রমে আমাদের এই পবিত্র কুরুক্ষেত্রের ইতিহাস জানা দরকার। কুরুক্ষেত্র পূর্বে সমন্তপঞ্চক, ব্রহ্মাবর্ত [মনুসংহিতায় (২/১৭)], ব্রহ্মর্ষিদেশ [মনুসংহিতায় (২/১৯)] ইত্যাদি নামে প্রসিদ্ধ ছিল।
পরশুরাম একুশ বার পৃথিবী নিঃক্ষত্রিয় করিয়া এই স্থানে পিতৃ-তর্পণ করিয়াছিলেন । দুর্যোধনাদির পূর্বপুরুষ বিখ্যাত কুরু রাজা এই স্থানে হল-চালনা করিয়া এই বর লাভ করিয়াছিলেন যে, যে-ব্যক্তি এই স্থানে তপস্যা করিবে অথবা যুদ্ধে প্রাণত্যাগ করিবে, সে স্বর্গে গমন করিবে । তদবধিই ইহার নাম কুরুক্ষেত্র । প্রাচীন গ্রন্থাদীতে সর্বত্রই কুরুক্ষেত্রকে ধর্মক্ষেত্র বলিয়া উল্লেখ করা হইয়াছে । বনপর্বের তীর্থযাত্রা পর্বাধ্যায়ে কুরুক্ষেত্রকে তিন লোকের মধ্যে শ্রেষ্ঠ তীর্থস্থান বলিয়া বর্ণনা করা হইয়াছে; সুতরাং ‘ধর্মক্ষেত্র’ এই বিশেষণটি একান্ত সুসঙ্গত ও প্রয়োজনীয় ।
সরস্বতী ও দৃষদ্বতী নদীর মধ্যবর্তী প্রদেশ । স্বায়ম্ভূব-মনুর সময়ে এরই নাম ব্রহ্মাবর্ত । পরে নাম হয় সমন্তপঞ্চক।
এছাড়াও নিম্নোক্ত শাস্ত্রে কুরুক্ষেত্রের মহিমার উল্লেখ পাওয়া যায়:
- বামন পুরাণ/কুরুক্ষেত্রমাহাত্ম্য নামক অধ্যায়
- মহাভারত/শল্যপর্ব/কুরুক্ষেত্রের মাহাত্ম্য কথন
- মহাভারত/আদিপর্ব/২য় অধ্যায় [হরিসিদ্ধান্তবাগীশ]
- মহাভারত/বনপর্ব/যুধিষ্ঠিরের তীর্থভ্রমণ [হরিসিদ্ধান্তবাগীশ]
অতএব, কুরুক্ষেত্র সম্পর্কে কৃষ্ণকৃপাশ্রীমূর্তি শ্রীল অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ যথার্থই বলেছেন। এবং তাঁর বাক্য যে মোটেও শাস্ত্রবিরুদ্ধ নয় ইহাই প্রমাণিত হলো।