কল্কি অবতার কি আবির্ভূত হয়েছেন?!

whatsapp-image-2024-06-15-at-03-55-51_d96932a2

কল্কি অবতার:

বেশিরভাগ হিন্দুরা নিজ ধর্ম সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ। না নিজে শিখে, না পরিবার থেকে কেউ শিখায় বরং, কেউ নিজে শিখতে চাইলে অথবা কেউ শিখাতে চাইলে অন্যরা নানাভাবে নিরুৎসাহিত করে। আর এতে করে ধর্মীয় বিভিন্ন বিষয়ে প্রাসঙ্গিক, বৈজ্ঞানিক ও যৌক্তিক সুস্পষ্ট ধারণা লাভের সুযোগ থেকে আমরা বঞ্চিত হই। এরই সুযোগে বিভিন্ন প্রসঙ্গে যেমন- কল্কি অবতার নিয়ে বিধর্মীরা সুকৌশলে সহজ সরল হিন্দুদের ভুলিয়ে ভালিয়ে ধর্মান্তরের চেষ্টা চালায়।

দু’চারটা ভবিষ্যদ্বাণীকে জোরপূর্বক গোজামিল দিয়ে মিলিয়ে নিয়ে নিজেদের মত-পথের প্রবর্তনকারীকে কল্কি অবতার হিসেবে বর্ণনা দিয়ে প্রচার করে বলতে থাকে- “আসো এই সত্যের পথে, আর ইনিই সেই সত্য আনয়নকারী যার কথা ‘হিন্দু ধর্মগ্রন্থে’ বলা হয়েছে।” অতঃপর এই ফাঁদে পা দিয়ে সহজ সরল হিন্দুরা লক্ষণীয়ভাবে যুবক/যুবতীরা বৈদিক সত্য সনাতন ধর্মের আলোর পথকে বিস্মৃত হতে থাকে। এখন পর্যন্ত ভগবান কল্কি অবতার সম্পর্কিত সমস্ত ভবিষ্যদ্বাণীর কিয়দংশেরও মিল কারো সাথে পাওয়া যায়নি। আপনি নিজেও একটু মিলিয়ে দেখবেন এই সমস্ত গুটিকয়েক বৈশিষ্ট্যই কি তাদের দাবীকৃত ব্যক্তির সাথে মিলে যায় নাকি?!

অথচ, ভগবান কল্কিদেব’র সমস্ত লীলাবিলাসের ভবিষ্যদ্বাণী কল্কিপুরাণে বিস্তারিতভাবে বর্ননা রয়েছে। ভন্ডরা গোজামিল করে সত্যকে ঢাকা দিয়ে অসত্য প্রচারে সফল হয়ে যায় বারবার কিন্তু, হিন্দু সমাজ গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। হিন্দু সমাজ তাদের সন্তানাদিকে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, জর্জ, ব্যারিস্টার ইত্যাদি বানাতে কলেজ, ভার্সিটিতে পাঠায় অতঃপর অনেকেই অতিশিক্ষার ঠেলায় ভন্ডদের পাল্লায় পড়ে ধর্মান্তরিত হয়ে যায়। ছেড়ে যায় পরিবার পরিজন। অনেক সুকৃতির/সৌভাগ্যের ফলে জন্ম থেকে প্রাপ্ত ধর্ম-সংস্কৃতিকে ঘৃণাও করতে শুরু করে। অথচ দোষটা আমাদের এই পরম পবিত্র সংস্কৃতির নয়, দোষটা ঐসব পিতামাতার যারা নিজ বৈদিক ধর্ম ও সংস্কৃতির সাথে কখনোই পরিচয় করাননি, বরং নিজেরা করেছেন বৈদিক সংস্কৃতির নামে অবৈদিক অপসংস্কৃতির চর্চা, যা দেখে দেখে সন্তানদের মনে সুক্ষ্মভাবে তৈরি হয় নিজের ধর্মের প্রতি অবিশ্বাস।

অপরপক্ষে, বেদাদি শাস্ত্র সমূহ সম্পূর্ণরূপে অভ্রান্ত। যা কেবল সত্য নয়, পরম সত্যেরও সন্ধান দেয়। শাস্ত্রের ভূত-ভবিষ্যৎ বর্ণনায় যা বারবার প্রমাণিত হয়েছে। যেসমস্ত বিষয় তথাকথিত জাগতিক বিজ্ঞানেরও কল্পনাতীত, তা সম্পর্কে পূঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দেয়। বিজ্ঞান যেখানে জড় বস্তু, জড় পদার্থ জড় জগত নিয়ে বিশ্লেষণ করছে সেখানে বৈদিক শাস্ত্র আমাদের চিন্ময় পদার্থ, চিন্ময় জগতের সুস্পষ্ট ধারণা দেয়।আসুন খুবই সংক্ষিপ্ত আকারে জেনে নিই বৈদিক শাস্ত্রাদিতে ভগবানের কল্কি অবতার সম্পর্কে কী কী বলা হয়েছে- বৈদিক শাস্ত্র অনুসারে, কল্কি অবতার অবতীর্ণ হবেন কলিযুগের অন্তে এবং তাঁর বিভিন্ন লীলা বিলাস সম্পাদনার মাধ্যমে (দুষ্টের দমন/নিধন, শিষ্টের পালন ও ধর্ম সংস্থাপন) পুনরায় সত্যযুগের স্থাপনা করবেন।

শ্রীমদ্ভাগবতে বর্ণনা করা হয়েছে, “পূর্বোল্লিখিত এ সমস্ত অবতারেরা হচ্ছেন ভগবানের অংশ বা কলা অবতার। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবান স্বয়ং। যখন নাস্তিকদের অত্যাচার বেড়ে যায়, তখন আস্তিকদের রক্ষা করার জন্য ভগবান এ ধরাধামে অবতীর্ণ হন।”

– (শ্রীমদ্ভাগবত: ১/৩/২৮)

 

ভগবান কল্কিদেবের আগমন সম্পর্কে শাস্ত্রের বিশেষ কিছু ভবিষৎ বাণী:

“যিনি কলিযুগের অন্তে অশুদ্ধ পাপীদের তীক্ষ্ণ খড়গ দ্বারা ছেদন করে সত্যযুগের ধর্ম সংস্থাপন করেন, সেই কল্কি অবতারকে নমস্কার করি।”

– (বৃহন্নারদীয় পুরাণ: ২/৪০)

“শ্রৌত ও স্মার্ত ধর্ম অত্যন্ত বিপ্লবপ্রাপ্ত ও কলি ক্ষীণপ্রায় হলে, যিনি চরাচরের গুরু ও আদিভূত, যিনি অন্তময়, সর্বময়, ব্রহ্মময় ও পরমাত্মাস্বরূপ, সেই ভগবান বাসুদেব স্বাংশরূপে শম্ভল গ্রামের প্রধান ব্রাহ্মণ বিষ্ণুযশার গৃহে অষ্টৈশ্বর্যসম্পন্ন, অসীমশক্তি ও মাহাত্ম্যশালী কল্কিরূপে অবতীর্ণ হয়ে ম্লেচ্ছ, দস্যু ও দুরাত্মাদিগের ক্ষয় করবেন।”

– (বিষ্ণুপুরাণ: ৪/২৪/২৬)

“কলিযুগের অন্তে আমি কল্কি অবতার রূপে অবতীর্ণ হব। ”

– (ভবিষ্যপুরাণ: ২য় খণ্ড/প্রতিসর্গ পর্ব/১৬/২৮)

“তারপর যুগসন্ধিকালে, অর্থাৎ কলিযুগের অন্তে নৃপতিরা যখন দস্যুপ্রায় হয়ে যাবে, তখন ভগবান কল্কি অবতার নামে বিষ্ণুযশ নামক ব্রাহ্মণের পুত্ররূপে অবতরণ করবেন।”

– (শ্রীমদ্ভাগবত: ১/৩/২৫)

“মহাবীর্য ও মহানুভব কল্কির মননমাত্রই সমুদয় বাহন, কবচ, বিবিধ আয়ুধ ও ভুরিভুরি যোদ্ধা উপস্থিত হবে। তিনি ধর্ম বিজয়ী সম্রাট হয়ে পর্যায়কুল লোক সকলের প্রতি প্রসন্ন হবেন। ক্ষয়কারী ও যুগপরিবর্তক সেই দীপ্তপুরুষ উত্থিত ও ব্রাহ্মণগণ পরিবৃত হয়ে সর্বত্রগত ম্লেচ্ছগণকে উৎসারিত করবেন।”

– (মহাভারত: বনপর্ব/১৬১/৯৩-৯৭)

“যখন অনার্যরা রাজ্যপদ অধিকার করে নিষ্ঠাবান ব্যক্তিদের শোষণ করতে শুরু করবে, তখন ভগবান কল্কি বিষ্ণুযশার পুত্র এবং যাজ্ঞ্যবন্ধের শিষ্য হিসেবে সেসকল অনার্যদের তাঁর অস্ত্র দ্বারা বিনাশ করবেন। তিনি চার বর্ণ ও আশ্রম সমন্বিত নীতি প্রতিষ্ঠা করবেন। তারপর আবার জনগণ সত্য ও ন্যায়ের পথে ফিরে আসবে।”

– (অগ্নিপুরাণ:১৬/৭-৯)

“ভগবান কল্কি ম্লেচ্ছদের বিনাশ করে সকল দুরাবস্থা অপসারণ করে কলিযুগের অবসান ঘটাবেন। তিনি সকল ব্রাহ্মণদের একত্রিত করে পরম সত্য প্রতিস্থাপন করবেন। তিনি ধ্বংসপ্রাপ্ত সকল প্রকার জীবনধারা সম্বন্ধে অবগত থাকবেন এবং ব্রাহ্মণ তথা ধার্মিক ব্যক্তিদের ক্ষুধা অপসারণ করবেন। তিনি হবেন জগতের একমাত্র নিয়ন্ত্রক। তাঁকে কেউ নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না এবং তিনিই হবেন বিশ্বের বিজয়পতাকা।”

– (পদ্মপুরাণ:৬/৭১/২৭৩-২৮২)

“তখন পৃথিবীতে অরাজকতা বিরাজ করবে। সর্বত্র অযাচিত কার্যসকল- যেমন, চৌর্যবৃত্তি ও লুটতরাজ বৃদ্ধি পাবে। সেসময় বিষ্ণুযশা নামে এক ব্রাহ্মণের পরিবারে ভগবান নারায়ণ আবির্ভূত হবেন। তিনি এক সুবৃহৎ অশ্বে সওয়ার হয়ে হাতে তরবারি ধারণপূর্বক পৃথিবীতে ম্লেচ্ছদের বিনাশ করবেন। এভাবে পৃথিবী শ্লেচ্ছদের থেকে মুক্ত হবে।”

– (ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ: প্রকৃতি খণ্ড ৭/৫৮-৫৯)

 

আবির্ভাব কালের বর্ণনা:

“মাধব মাসের শুক্লপক্ষের দ্বাদশী তিথিতে ভগবান কল্কি এজগতে আবির্ভূত হবেন।”

– (কল্কি পুরাণ: ১/২/১৫)

 

কল্কিদেবের রূপলাবণ্য:

“তাঁর অভয় কান্তি নীল মেঘের ন্যায়। তাঁর বাহুদ্বয় সুদীর্ঘ (অর্থাৎ আজানুলম্বিত) ও সমুন্নত। শিরোদেশে স্থিরবিদ্যুৎতুল্য সূর্যসম দীপ্ত কিরীট বিরাজিত। তাঁর মুখমণ্ডল সূর্যের ন্যায় দীপ্তিমান কুণ্ডল দ্বারা শোভিত। সেই বদনকমল আনন্দালাপে বিকশিত ও মৃদু মৃদু হাসিতে শোভিত। তাঁর করুণ কটাক্ষপাতে বিপক্ষকুল অনুগ্রহ লাভ করে। তাঁর বক্ষস্থলের মনোরম চন্দ্রকান্তমণিযুক্ত হার দ্বারা শতদলের আনন্দ বর্ধন করে। তাঁর বস্ত্র ইন্দ্রধনুর ন্যায় সৌন্দর্য বিস্তার করে। তাঁর দেহ সর্বদা নানাবিধ মণির জ্যোতিতে সমুদ্ভাসিত। তাঁর বক্ষস্থলে বিরাজিত কৌস্তুভমণির শোভা যেন শ্যামলকান্তি মেঘের মধ্যে পূর্ণচন্দ্র। দেবগণ, গন্ধর্বগণ ও জনগণ কল্কিকে এইরূপে দর্শন করেন।”

– (কল্কিপুরাণ:৩/১৯/৪-১১)

“তাঁর তেজপুঞ্জ অদিত্যতেজকেও পরাভূত করে। তাঁর সর্বাঙ্গ মহামণিসমূহে বিভূষিত। সেই প্রভু কমলাপতি (কল্কি) তমালসদৃশ নীলবর্ণ, পীতবসন (হলুদবস্ত্র), রমণীয় পদ্মপলাশলোচন, আজানুলম্বিত বাহু, প্রসারিত ও উন্নত বক্ষবিশিষ্ট, শ্রীবৎসচিহ্নে চিহ্নিত ও কৌস্তুভমণির কান্তিদ্বারা শোভিত।”

– (কল্কিপুরাণ: ২/২/২১)

 

পারিবারিক পরিচয়:

“ভগবান কল্কি স্বয়ং বলেছেন- “চার ভ্রাতা মিলে কলিকে বিনাশ করব।”

– (কল্কিপুরাণ ১/২/৫)

“কল্কির পূর্বে তাঁর জ্যেষ্ঠ তিন ভ্রাতা জন্মগ্রহণ করবেন। তাঁদের নাম কবি, প্রাজ্ঞ ও সুমন্ত্র।”

– (কল্কিপুরাণ ১/২/৩১)

“কল্কিদেবের দুই পত্নী”

– (কল্কিপুরাণ ৩/১৬/৫)

“কল্কিদেবের চার সন্তান”

– (কল্কিপুরাণ ২/৬/৩৬ এবং ৩/১৭/৪৪)

 

ভগবান কল্কিদেব’র অপ্রাকৃত কার্যাদি:

“বিশ্বের অধীশ্বর ভগবান কল্কিদেব তাঁর দেবদত্ত নামক শ্বেত অশ্ব চালিয়ে ও এক হাতে তরবারি নিয়ে তাঁর ভগবত্তার আটটি ঐশ্বরিক শক্তি প্রদর্শনপূর্বক সমগ্র পৃথিবী ভ্রমণ করবেন। তাঁর অসীম জ্যোতি প্রদর্শন করে এবং অত্যন্ত দ্রুতবেগে অশ্ব চালিয়ে তিঁনি রাজার বেশধারী লক্ষ লক্ষ চোরদের নিধন করবেন।”

– (ভা: ১২/২/১৯-২০)

 

লীলাবিলাসের সময়সীমা:

“কল্কি ভ্রাতা, পুত্র, জ্ঞাতি, সম্বন্ধী ও আত্মীয়বর্গসহ সহস্রবর্ষ (এক হাজার বছর) শম্ভলে অবস্থান করবেন।”

– (কল্কিপুরাণ ৩.১৮.২)

 

অতএব, কল্কি অবতার সম্পর্কিত উপরোক্ত সংক্ষিপ্ত বর্ণনাসমূহ পড়ে খুব সহজেই বুঝতে পারা যায় কল্কি অবতার কি আবির্ভূত হয়েছেন নাকি নয়। বৈদিক শাস্ত্রের বর্ণনায় চতুর্যুগের বর্তমান কলিযুগের শেষ প্রান্তে ভগবান স্বয়ং কল্কি অবতারে অবতীর্ণ হবেন, সেই সময় এখনো উপস্থিত হয়নি। তাই যারা নিজ নিজ মতাদর্শ প্রচারের স্বার্থে কল্কি অবতারকে নিজ মতপথের প্রবর্তক হিসেবে গণ্য কর‍তে চায় তাদের কুযুক্তি গুলোকে সহজেই খণ্ডন করতে পারা যায়। এজন্য গোজামিলের দ্বারা বিভ্রান্ত না হয়ে আমাদের সাথেই থাকুন।

– প্রবীর চৈতন্যচন্দ্র দাস
Avatar of Prakash Chandra Deb

Prakash Chandra Deb

Writer & Admin

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments