আর্য কে?!

06642ebf-0fab-4c81-b920-a0ddb5713141
আর্য সম্বন্ধে আলোচনার পূর্বে প্রথমে জেনে রাখা আবশ্যক, মহর্ষি মার্কন্ডেয় কলিযুগের লক্ষণ বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন:
“এই জগৎটাই বিপরীত হইয়া যাইবে, নীচ উচ্চ হইবে এবং উচ্চ নীচ হইবে ৷”
– (মহাভারত: বনপর্ব ১৬১/৬৪)
তাই আজকাল দেখা যায় একদল ব্যক্তি আচরণে অনার্য কিন্তু, নিজেকে আর্য প্রমাণ করতে উঠেপড়ে লেগে যায়। কেউ কেউ আবার নিজেকে আর্য প্রমাণ করতে নামের পাশে আর্য শব্দটি জুড়ে দেন, অথচ তাদের আচরণ সম্পূর্ণই ভিন্ন, ঠিক যেন অনার্যদের মতন। কিন্তু কি জানি! কি মনে করে সেই সমস্ত ব্যক্তিরা নিজেকে আর্য (শ্রেষ্ঠ) দাবী করেন, আমার বোধগম্য নয়। এই “আর্য কে” এ নিয়ে বহু আলোচনা হতে পারে কিন্তু যদি আমরা সারবস্তুর দিকে আলোকপাত করি, তবে তা স্পষ্ট জ্বলজ্বল করে উঠবে। তাই মূল বিষয়ে আসা যাক। মহাভারতে খুব সুন্দরভাবে সংজ্ঞায়িত করে বলা হয়েছে আসলে কে আর্য।
ন বৈরমুদ্দীপয়তি প্রশান্তং ন দর্পমারোহন্তি নাস্তমেতি।
ন দূর্গতোস্মীতি করোত্যকার্যং তমার্যশীলং পরমাহুরার্যাঃ।।
– (মহাভারত:উদ্যোগ পর্ব,৩৩/১১২)
“যে শান্ত, বৈরিতাকে উদ্দীপ্ত করেনা, গর্ব করেনা, হীনতা দেখায় না তথা ‘আমি বিপত্তিতে পড়েছি ‘ এমন ভেবে অনুচিত কর্ম করেনা, সেই উত্তম আচরণকারী ব্যাক্তিকে আর্য বলে।”
তাই যদিও দেখতে পাওয়া যায় কিছু লোক অতি আবেগে নামের পাশে আর্য শব্দ জুড়ে দেন। নামের পাশে আর্য লাগালেই কেউ আর্য হয়ে যায় না, তার জন্য যোগ্যতা অর্জন করতে হয়। অনেককেই দেখা যায় বেদ-জ্ঞান নিয়ে বাকচাতুর্যতা প্রদর্শন করে অন্যদিকে সেই শিক্ষা আচরণ করে না, করতে পারে না, ভন্ডামি করে বেড়ায় তা অবিলম্বে বন্ধ করা উচিত। কারণ এটা বেদ নিন্দার সমতুল্য, অর্থাৎ নাস্তিকতা। যোগ্যতা হলে যেকেউ আর্য হিসেবে এমনিতেই পরিগনিত হবে। সেই সমস্ত তথাকথিত আর্যরা এও জানেন না যে-
অবিদ্যায়ামন্তরে বর্তমানাঃ
স্বয়ং ধীরাঃ পণ্ডিতন্মন্যমানাঃ।
দন্দ্রম্যমাণাঃ পরিযন্তি মূঢ়া
অন্ধেনৈব নীয়মানা যথান্ধাঃ।।
– (কঠোপনিষদ: ১/২/৫)
“যারা অবিদ্যা-পরিবেষ্টিত হয়ে নিজেদের প্রজ্ঞাবান ও শাস্ত্রবিশারদ মনে করে অভিমান করে, এই সব কুটিল স্বভাব অবিবেকী ব্যক্তিরা বিভিন্ন লোকে পরিভ্রমণ করতে থাকে, যেমন অন্ধের দ্বারা পরিচালিত অন্ধ ব্যক্তিরা ঘুরতে থাকে।” (নচিকেতার প্রতি যমরাজ)
বাংলা সাহিত্যের একজন বিখ্যাত কবি হরিশ্চন্দ্র মিত্রও স্ব-প্রণোদিতভাবে নিজেকে যারা শ্রেষ্ঠ ঘোষণা করেন কিংবা ভেবে থাকেন তাদের সম্বন্ধে বলেছেন-
“আপনারে বড় বলে, বড় সে নয়
লোকে যারে বড় বলে, বড় সে হয়।
গুনেতে হইলে বড়, বড় বলে সবে
বড় যদি হতে চাও, ছোট হও তবে।”
তো এই বাক্যগুলোই এই কলিযুগের পতিত পাবন অবতারী পরমেশ্বর ভগবান শ্রীচৈতন্যদেব এর ভাবাদর্শের মূলনীতি-
“তৃণাদপি সুনীচেন তরুরোপি সহিষ্ণুণা।
অমানিনা মানদেন কীর্তনীয়ঃ সদা হরিঃ।।
– (শিক্ষাষ্টকম্-৩)
যিনি নিজেকে সকলের পদদলিত তৃণের থেকেও ক্ষুদ্র বলে মনে করেন, যিনি বৃক্ষের মতো সহিষ্ণু, যিনি মান শূন্য হয়েও অন্য সকলকে সম্মান প্রদর্শন করেন, তিনি সর্বক্ষণ ভগবানের দিব্যনাম কীর্তনের অধিকারী।
শ্রীচৈতন্য-চরিতামৃতে (অন্ত্য: ৪/১০২-১০৩) হরিদাস সম্বন্ধে বলা হয়েছে-
“আপনে আচরে কেহ না করে প্রচার।
প্রচার করেন কেহ, না করেন আচার ॥
‘আচার’, ‘প্রচার’, নামের করহ ‘দুই’ কার্য।
তুমি সর্ব গুরু, তুমি জগতের আর্য ॥”
বৈদিক শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য কৃষ্ণভক্তি আচার প্রচারকারীই হলেন আর্য। প্রকৃতপক্ষে এটাই আর্য হিসেবে গড়ে উঠার বেদ নিহিত মূলমন্ত্র।
অতএব, আজকাল যাদের দেখা যায় কোনোরূপ প্রামাণিক পরম্পরা ব্যতীতই মনগড়াভাবে বৈদিক শিক্ষানুশীলন করে অন্যকে শুধু জ্ঞানই দিয়ে যান, কিন্তু নিজে তা আচরণ পর্যন্ত করতে পারেন না, তারা আর্য নন।
অপরপক্ষে, কেউ যদি বৈদিক শিক্ষা মহাপ্রভু নির্দেশিত পন্থা,
“বল কৃষ্ণ; ভজ কৃষ্ণ; কর কৃষ্ণ শিক্ষা”
আচরণ করেন এবং অন্যকে সেই শিক্ষা গ্রহণ করতে অনুপ্রাণিত করেন প্রকৃতপক্ষে তিনিই হলেন আর্য।
– প্রবীর চৈতন্যচন্দ্র দাস

Pravira Caitanya Candra Das

Writer & Admin

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments