আমরা কেন সাত্ত্বিক আহার গ্রহণ করব? 

20240627_071023

♦অসাবি দেবং গোঋজীকমন্ধো ন্যস্মিন্নিন্দ্রো জনুষেমুবোচ।

বোধামসি ত্বা হয়র্শ্ব য়জ্ঞৈবোধা ন স্তোমমন্ধসো মদেষু॥

(সামবেদ ৩১৩) অথবা (সামবেদ ৯/৩/১)

🍎সরলার্থঃ আহার সেটিই উত্তম যা কিনা উৎপাদন করা হয়েছে। আহার ভূমিমাতা থেকে উৎপন্ন শস্যাদিরই করা উচিত, সাথে গোদুগ্ধ। এই আহারই সাত্ত্বিক ও দৈবী সম্পত্তির জন্মদাতা। এই সাত্ত্বিক ভোজনে নিশ্চিতভাবেই, স্বভাবতই ইন্দ্রিয়সমূহের শাসক হওয়া যায়, দাস নয়। অর্থাৎ সাত্ত্বিক ভোজন দ্বারা ইন্দ্রিয়সমূহকে বশীভূত করা যায়। পক্ষান্তরে রাজসিক ও তামসিক আহার ইন্দ্রিয়ের দাসত্বের কারণ। প্রভু উপদেশ দিচ্ছেন শীঘ্রতাযুক্ত ইন্দ্রিয়রূপ অশ্বযুক্ত মানব ! তোমাকে যজ্ঞসমূহ দ্বারা জ্ঞানযুক্ত করি। ভক্ত বলছেন, সাত্ত্বিক আহারের আনন্দে বিহ্বলিত আমাদের স্তুতি সমূহকেও জ্ঞাত হও। অর্থাৎ, সাত্ত্বিক আহারী মানব প্রভুকে বিস্মৃত হয় না। বরং সর্বদা স্মরণ করে।

★ব্রীহিমন্নং যবমত্তমথো মাষমথো তিলম ।

এষ বাং ভাগো নিহিতো রত্নেধেয়ায় দন্তৌ মা হিংসিষ্ট পিতরং মাতরং চ।।

(অথর্ববেদ ৬।১৪০।২)

— হে দন্ত! অন্ন খাও যব খাও মাষ কালাই এবং তিল খাও তোমার এই ভাগ উত্তম পদার্থ ধারনের জন্য স্থাপন করা হয়েছে হে দন্ত! পিতা ও মাতাকে হিংসিত করো না [মাংসাহার থেকে দূরে থাকো]

এবং বেদ মন্ত্রে সেই পরমেশ্বরের কাছে প্রার্থনা করা হচ্ছে যে, আমাদের দন্ত যেন ব্যাঘের ন্যায় না হয়। কারন বাঘের দন্ত সর্বদা মাংসাহার করে থাকে। সে জন্য আমাদের দন্ত কে ব্যাঘের ন্যায় না করে কল্যাণকারী করো।

★যৌ ব্যাঘ্রাববরূঢৌ জিঘত্সতঃ পিতরং মাতরং চ।

তৌ দন্ত ব্রহ্মণস্পতে শিবৌ কৃণু জাতবেদঃ।।

(অথর্ববেদ ৬।১৪০।১)

— যে দন্ত ব্যাঘ্রের ন্যায় পিতা ও মাতাকে খাওয়ার জন্য চেষ্টা করে সেই দাঁত কে হে সর্বব্যাপক জ্ঞানের পরিপালক কল্যাণকারী করো।

অর্থাৎ বেদ আমাদের সর্বদাই কল্যাণকারী হওয়ার নির্দেশ দিচ্ছেন। যাতে করে আমাদের কাছ থেকে কেউ যেন কষ্ট না পায়। আমরা যেন নিরীহ প্রাণীদের হিংসা না করি। কারন, “অহিংসা পরম ধর্ম ” (মহাঃ আদিঃ অঃ ১১, শ্লোঃ ১৩) এবং “হিংসা অধর্মস্তথহিত” (মহাঃ শান্তিঃ ২৭২, শ্লোক ১৮) হিংসা অধর্ম এবং অহিতকর। “প্রাণিনামবধস্তাত সর্বজায়ান্” (মহাঃ কর্ণ পর্ব, অঃ ২৬৯, শ্লোক ২৩) অর্থাৎ প্রাণীদের বধ না করাই শ্রেষ্ঠ ধর্ম।

★জীবিতুং যঃ স্বযং চেচ্ছেত্ কথং সোন্যং প্রঘাতয়েত।

যদ যদাৎমসি চেচ্ছেত তত পরস্যাপি চিন্তয়েত।।

(মহাঃ শান্তি পর্ব, অঃ ২৫৯, শ্লোক ২২)

উপরিউক্ত মন্ত্রগুলি দ্বারা এটা স্পষ্ট যে, বেদ কোন নির্দোষ পশু কে হত্যার উপদেশ করে নি।বরং উপদেশ করেছে, পশুস্ত্রাঁয়েথাঙ (যজুর্বেদ ৭/৬/১১) অর্থাৎ পশুদের রক্ষা করো এবং তাদের বর্ধিত করো।কারন বেদ সর্বদাই কল্যাণময়।

মহাভারতের_অনুশাসন_পর্বের, ১০০তম অধ্যায়ের, ৩৭, ৪১, ৪৩, ৪৭, ৪৮, ৪৯ নং শ্লোকে #পিতামহ_ভীষ্ম শরশয্যায় শায়িত অবস্থায় #যুধিষ্ঠিরকে উপদেশ দিয়ে বলেছেন-

“যারা সৌন্দর্য, সাস্থ্য, বল, আয়ু, বুদ্ধি, স্মরণ শক্তি চান তারা মাংস আহার ত্যাগ করেন। মনু বলেছেন, যিনি মাংস আহার ও পশু হত্যা করেন না তিনি সর্বজীবের মিত্র ও বিশ্বাসের পাত্র। নারদ বলেছেন, যে পরের মাংস খেয়ে নিজের পেশী বৃদ্ধি করেন সে অশেষ কষ্ট ভোগ করে। মাংসাশী লোক যদি মাংসাহার ত্যাগ করে তবে সে যে ফল পায় বেদ অধ্যায়ন ও সকল যজ্ঞের অনুষ্ঠান করেও কেউ সেই ফল পায় না। মাংস ভোজনে আসক্তি জম্মালে তা ত্যাগ করা অতীব কঠিন। মাংস বর্জন ব্রত পালন করলে সকল প্রাণী অভয় লাভ করে। যদি মাংসভোজী না থাকে তবে কেউ পশুহনন করে না, মাংসখাদকের জন্যই পশুঘাতক হয়। যে পরমাংস দ্বারা নিজ মাংস বৃদ্ধি করতে চায় তার চেয়ে ক্ষুদ্র আর নৃশংস কেউ নেই!”

মনুসংহিতায় মাছ-মাংস ভক্ষণে কি ভয়ংকর পাপ ও শাস্তি এবং আমিষাহার বর্জনে কি পুন্য লাভ হয় তার সুস্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে-

মনুসংহিতায় মাছ ভক্ষণ নিষিদ্ধঃ

★যো যস্য মাংসমশ্লানি স তন্মাংসাদ উচ্যতে। 

মৎস্যাদঃ সর্বমাংসাদস্তম্মান্মত্‍স্যান্ বিবর্জয়েৎ।। 

🔴[ মনুসংহিতা ৫/১৫ ]🔴

~ যে যার মাংস খায় তাকে ‘তন্মাংসাদ’ অর্থাৎ তার মাংসভোজী বলে (যেমন, বিড়াল ইঁদুরের মাংস খায়, তাই বিড়াল ‘মূষিকাদ’, নকুল অর্থাৎ বেজী ‘সর্পাদ’); কিন্তু যে ‘মৎস্যাদ’ অর্থাৎ মাছ-ভোজী, তাকে সর্বমাংসভোজী বলা চলে। (এমন কি তাকে ‘গো-মাংসদ’ও বলা যায়)। অতএব মৎস্য-ভোজনে যেহেতু সমস্ত প্রকার মাংস ভক্ষণের সমান বিষম পাপ হয়, তাই সর্বতভাবে মৎস্যভক্ষণ করা থেকে বিরত থাকবে ।।

মনুসংহিতায় মাংস ভক্ষণে পাপ ও ভয়ংকর শাস্তি

★মাংসভোজীরা মৃত্যুর পর যাদৃশ্য দুঃখসহ দুঃখরাশি ভোগ করে।(মনু সংহিতা ৫/৩৪)

★যে ব্যক্তি হিংসাদিশূণ্য হরিণ এবং হরিণের ন্যায় হিংসাশূণ্য অন্যান্য পশুকে আপন সুখের জন্য হত্যা করে সে কি জীবিত অবস্থায়, কি পরলোকে উভয়েই সুখ পায় না।(মনুসংহিতা ৫/৪৫)

★যিনি প্রাণীদিগকে বন্ধন-ধাদি দ্বারা কষ্ট দিতে ইচ্ছা করেন না ও যিনি সকলের হিতকামী, তিনি অত্যন্ত সুখভোগ করেন। (মনুসংহিতা৫/৪৬)

★যিনি কাহাকেও হিংসা করেন না, তিনি যা ধ্যান করেন, যে কিছু ধর্মের অনুষ্ঠান করেন,এবং যে বিষয়ে মনােনিবেশ করেন—সেই সমুদয়ই অনায়াসে লাভ করিয়া থাকেন।

(মনুসংহিতা ৫/ ৪৭)

★প্রাণি হিংসা না করিলে মাংস উতপন্ন হয় ,প্রাণিবধও নরকের কারণ,অতএব মাংস ভক্ষন করবে না(মনুসংহিতা ৫/৪৮)

★শুক্রশোশিত দ্বারা মাংসের উতপত্তি।অতএব ইহা ঘৃণিত; বধ ও বন্ধন নিষ্ঠুর হৃদয়ের কর্ম;ইহা নিশ্চিত করিয়া সাধুরা বিহিত মাংস ভক্ষনেও হইতেও নিবৃত্ত হয়;অবৈধ মাংস ভক্ষনের কথা আর কিই বা বলিব?(মনুসংহিতা ৫/৪৯)

★যিনি পশুবধ করতে অনুমতি দেন, যিনি অস্ত্রাদির দ্বারা পশুর অঙ্গপ্রতঙ্গ খন্ড খন্ড করেন, যিনি পশু বধ করেন, যিনি সেই প্রাণীর মাংস ক্রয় করে, যিনি তা বিক্রয় করেন, যিনি মাংস পাক করেন, যিনি পরিবেশন করেন এবং যিনি মাংস ভক্ষণ করেন তারা সকলেই সেই পশুর ঘাতক রূপে অভিহিত হন ৷ (মনুসংহিতা ৫/৫১)

★যে ব্যক্তি শতবর্ষ ব্যাপিয়া বৎসর বৎসর অশ্বমেধ যজ্ঞ করেন এবং যে ব্যক্তি যাবজ্জীবন মাংস ভোজন না করেন,এই উভয়েরই পূর্ণফল সমান। (মনুসংহিতা ৫/৫৩)

★ইহলোকে আমি যার মাংস ভক্ষন করিতেছি,পরলোকে সে আমাকে ভক্ষন করবে।পন্ডিতেরা মাংস (মাং-আমায়,সঃ-ভক্ষন করিবে) শব্দের এইরূপ ব্যাখা করেছেন।(মনুসংহিতা ৫/৫৫)

শ্রী বিষ্ণুপুরাণে জীবহত্যা ও  মাংসাহারের শাস্তির বর্ণনা: 

১) ভ্রুণহত‍্যাকারী, গো-বধকারী শ্বাসরুদ্ধকর রোধ নরকে যায়।

♦[বিষ্ণুপুরাণ ২য় খন্ড, ৬ষ্ঠ অধ্যায়, শ্লোক ৭]🏵

২) পশুপাখি পালন করে তার মাংস ভক্ষণ করে জীবনধারণকারী, মাংস বিক্রেতা পূয়বহ নরকে মলভক্ষণ করে।

♦[বিষ্ণুপুরাণ ২য় খন্ড, ৬ষ্ঠ অধ্যায়, শ্লোক ২০-২১]🏵

৩) ধীবর বা জেলেরা রুধিরান্ধ নরকে যায়।

♦[বিষ্ণুপুরাণ ২য় খন্ড, ৬ষ্ঠ অধ্যায়, শ্লোক ২২]🏵

৪) মেষ (ভেড়া )পালন করে ভক্ষণকারী, পশুপাখি শিকারীরা বহ্নিজাল নরকে অগ্নিদগ্ধ হয়।

♦[বিষ্ণুপুরাণ ২য় খন্ড, ৬ষ্ঠ অধ্যায়, শ্লোক ২৬]🏵

৫)”যদি যজ্ঞে বলিদান করলে পশুর স্বর্গপ্রাপ্তি হয়, তাহলে যজমান তাঁর পিতাকে কেন মেরে ফেলেন না?”

♦[বিষ্ণুপুরাণ, ৩/১৮/২৮]🔴

৬)স্বর্গার্থং যদি বো বাঞ্ছা নির্বাণার্থমথাসুরা। 

 তদলং পশুঘাতাদিদুষ্টধর্মৈৰ্নিবোধত৷৷ 

♦( বিষ্ণুপুরাণ ৩।১৮।১৭)🔴

অনুবাদ:  হে অসুরগণ ! যদি তোমাদের স্বর্গ বা মোক্ষের আকাঙ্ক্ষা থাকে, তাহলে পশুহিংসা ইত্যাদি দুষ্কর্ম ত্যাগ করে বোধ প্রাপ্ত করো৷৷

এবার আপনারাই বিবেচনা করুন যে কোন অবস্থাতেই বলি বা পশু হত্যা করা বা তাদের মাংসাহার করা উচিত কি না?

Avatar of Navanila

Navanila

Writer & Admin

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments