এই প্রসঙ্গে যামুনাচার্য তার স্তোত্ররত্ন-১২ তে খুব সুন্দরভাবে বর্ণনা করেছেন-
“হে ভগবান! মহামুনি ব্যাসদেব, নারদ আদি ভক্তেরা তোমাকে পরমেশ্বর ভগবান বলে জানেন। বিভিন্ন বৈদিক শাস্ত্র উপলব্ধির মাধ্যমে তোমার গুণ, রূপ, লীলা আদি সম্বন্ধে অবগত হওয়া যায় এবং জানতে পারা যায় যে, তুমিই পরমেশ্বর ভগবান। কিন্তু রজ ও তমোগুণের দ্বারা আচ্ছাদিত অভক্ত অসুরেরা কখনই তোমাকে জানতে পারে না, কারণ তোমার তত্ত্ব হৃদয়ঙ্গম করতে তারা সম্পূর্ণ অসমর্থ। এই ধরনের অভক্তেরা বেদান্ত, উপনিষদ আদি বৈদিক শাস্ত্রে অত্যন্ত পারদর্শী হতে পারে, কিন্তু তাদের পক্ষে পুরুষোত্তম ভগবানকে জানতে পারা সম্ভব নয়।” (যামুনাচার্য- স্তোত্ররত্ব: ১২)
এখানে একটি বিষয় স্পষ্ট যে, ঐসমস্ত ব্যক্তিদের বেদ-বেদান্তের বিষয়াদি তোতাপাখির মতো মুখস্থ-ঠোঁটস্থ-পকেটস্থ থাকলেও, কেবলমাত্র তাদের চেতনা তম কিংবা রজগুণ দ্বারা আবৃত থাকায়, তারা পরমেশ্বর ভগবানের এজগতে প্রকাশিত লীলা সমূহ বুঝতে না পেরে ভগবানকে তাদেরই মতো একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে বিবেচনা করে। তাদেরকে উদ্দেশ্য করে ভগবান বলেন-
“বুদ্ধিহীন মানুষেরা, যারা আমাকে জানে না, মনে করে যে, আমি পূর্বে অব্যক্ত নির্বিশেষ ছিলাম, এখন ব্যক্তিত্ব পরিগ্রহ করেছি। তাদের অজ্ঞতার ফলে তারা আমার অব্যয় ও সর্বোত্তম পরম ভাব সম্বন্ধে অবগত নয়।” (ভ:গী: ৭/২৪)
“আমি যখন মনুষ্যরূপে অবতীর্ণ হই, তখন মূর্খেরা আমাকে অবজ্ঞা করে। তারা আমার পরম ভাব সম্বন্ধে অবগত নয় এবং তারা আমাকে সর্বভূতের মহেশ্বর বলে জানে না।” (ভ:গী: ৯/১১)
এখানে দেখা গেলো ঐসকল ব্যক্তিদের অসুর, বুদ্ধিহীন, মূর্খ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এমনকি যারা তম রজ গুণ দ্বারা প্রভাবিত নয় কিন্তু সত্ত্বগুনে স্থিত, সেইসব ব্যক্তিরাও অনেকক্ষেত্রে ভগবানের লীলা সমূহ দর্শন করে বিভ্রান্তিতে পড়ে ভগবানকে বুঝতে পারেন না, জানতে পারেন না। যেমন- পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বাল্যলীলাতে আমরা দেখতে পাই ইন্দ্র এবং ব্রহ্মাজিও সাময়িকভাবে বিভ্রান্ত হয়েছিলেন। একথা ভগবান নিজেও স্বীকার করে বলেছেন-
“দেবতারা বা মহর্ষিরাও আমার উৎপত্তি অবগত হতে পারেন না, কেন না, সর্বতোভাবে আমিই দেবতা ও মহর্ষিদের আদি কারণ।” (ভ:গী: ১০/২)
জড় কলুষমুক্ত না হলে পদ্মপলাশলোচন পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে জানতে পারা যায় না। তাহলে কিভাবে জানা যায় দর্শন করা যায়?
“অনন্য ভক্তির দ্বারাই কিন্তু এই প্রকার আমাকে তত্ত্বত জানতে, প্রত্যক্ষ করতে এবং আমার চিন্ময় ধামে প্রবেশ করতে সমর্থ হয়।” (ভ:গী: ১১/৫৪)
শ্রীকৃষ্ণকে পরমেশ্বর ভগবান, পরব্রহ্ম হিসেবে তারাই জানেন যাদের হৃদয় নির্মল, যাদের তাঁর প্রতি অন্যন্য শ্রদ্ধা ভক্তি রয়েছে৷ তাদের কাছেই তিঁনি তার স্বরূপ প্রকাশ করেন। ঠিক যেমন করে সূর্য উদিত হলেই দর্শন করা যায়। তেমনিভাবেই পরমেশ্বর ভগবান তার ভক্তদের কাছে নিজেকে প্রকাশ করেন। আবার মাঝেমাঝে মেঘের আবরণ আমাদের সূর্যকে দেখতে দেয়না, একইভাবে পরমেশ্বর ভগবানের গোবিন্দম্ আদি রূপও তাঁর যোগমায়া শক্তি দ্বারা আবৃত থাকার ফলে আমরা দর্শন করতে পারিনা। আমাদের চেতনা মায়ার এই আবরণ থেকে মুক্ত হলেই পরমেশ্বর ভগবান তাঁর আদি স্বরূপের দর্শন প্রদান করেন। সেই রূপ দর্শন করে অর্জুন নিজেও সাক্ষ্য ঘোষণা করেছেন- “তুমি পরম ব্রহ্ম একমাত্র জ্ঞাতব্য” (ভ:গী: ১১/১৮)।
✍️ প্রবীর চৈতন্য চন্দ্র দাস