স্কন্দ পুরাণ অনুসারে, বিষ্ণুভক্ত ইন্দ্রদ্যুম্ন পুরুষোত্তমক্ষেত্র পুরীধামে কিভাবে জগন্নাথদেব,
বলদেব,সুভদ্রা ও সুদর্শনের বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সে সমন্ধে আলোচনা করুন???( ১ম পর্ব)
সামবেদীয় ছান্দোগ্য উপনিষদ ৭/১/২ অনুসারে পুরাণসমূহ হল পঞ্চম বেদ “ইতিহাসপুরাণং পঞ্চমং বেদানাং” ইতিহাস (রামায়ন ও মহাভারত) এবং পুরাণসমূহ(অষ্টাদশ পুরাণ) হল পঞ্চম বেদ।বেদের লিপিকার পরমেশ্বর ভগবানের শক্ত্যাবেশ অবতার শ্রীল ব্যাসদেব অষ্টাদশ পুরাণ শাস্ত্র লিপিবদ্ধ করেন।স্কন্দ পুরাণ হল অষ্টাদশ পুরাণ শাস্ত্রের মধ্যে একটি।
স্কন্দ পুরাণ,বিষ্ণুক্ষেত্র, পুরুষোত্তম ক্ষেত্র মাহাত্ম্য, প্রথম অধ্যায় থেকে সপ্তবিংশ অধ্যায় পর্যন্ত বিষ্ণুভক্ত রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন পুরুষোত্তম ক্ষেত্র পুরীধামে কিভাবে জগন্নাথদেব (শ্রীকৃষ্ণ),বলদেব (বলরাম),সুভদ্রা ও সুদর্শনের বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তার বিস্তৃত বর্ণনা রয়েছে।আমরা অধ্যায়ভিত্তিক ধারাবাহিক ভাবে তা জানার প্রচেষ্টা করব।
স্কন্দ পুরাণ,বিষ্ণুক্ষেত্র, পুরুষোত্তম ক্ষেত্র মাহাত্ম্য, প্রথম অধ্যায়ের ১- ৫ নং শ্লোকের বর্ণনা অনুসারে, “একসময় মুনিগণ মহর্ষি জৈমিনি ঋষিকে সম্বোধন করে প্রশ্ন করেন, হে মহাত্মা, আপনি সকল শাস্ত্রজ্ঞ ও সমুদয় তীর্থের মাহাত্ম্য অবগত। ইতিপূর্বে তীর্থকতন প্রস্তাবে পরম পবিত্র পুরুষোত্তম ক্ষেত্রের কথা উল্লেখ করেছেন। এই ক্ষেত্রে স্বয়ং নারায়ণ দারুময় কলেবর পরিগ্রহপূর্বক বিরাজমান আছেন। সে ক্ষেত্রটি কোন ব্যাক্তি নির্মাণ করেন, তা সবিস্তারে আমাদের কাছে বর্ণনা করুন?সেই সাক্ষাৎ নারায়ণ স্বয়ং ভগবান পরমপুরুষ হয়েও কি কারনে দারুময়রুপে সেই ক্ষেত্রে বিরাজমান আছেন?আপনার নিকট তা শ্রবনে আমাদের কৌতুহল হয়েছে,সে কারনে আপনি পরমবাগ্মী ও সর্বলোকের গুরু।এরপর জৈমিনি ঋষি মুনিগনকে সম্বোধন করে বলতে লাগলেন,
“জৈমিনি উবাচ।শৃনুধ্বং মুনয় সর্বেব রহস্যং পরমং হি তৎ।অবৈষ্ণনাং শ্রবণে ভক্তিস্তত্র ন জায়তে।। ৬।।যস্য সঙ্কীর্ত্তনাদেব সকলং লীয়তে তম।স্কন্দেন কথিতং পূর্ব্বং শ্রুত্বা শম্ভোমুখাম্বুজাৎ।।৭।।সমক্ষৎ সিদ্ধদেবৌব সভায়াং মন্দরোদরে।অহমপ্যগমং তত্র দেবদেবং সমচ্চির্তুম।যথাশ্রুতং কথয়তো দেবানাং পুরতো ময়া।।৮।।”
অনুবাদঃ “জৈমিনি বললেন,হে মুনিগণ,সেই পরমরহস্য ক্ষেত্রের বিবরন শ্রবণ করে অবৈষ্ণব বা অভক্তদের ভক্তি লাভ হয় না।পুরাকালে কার্তিকেয় মহাদেবের মুখপদ্ম হতে শ্রবণ করে মন্দরপর্বতে সিদ্ধগণ দেবগণের সভাতে তা বর্ণনা করেন,যা শ্রবণ করে তমগুণ দূরীভূত হয়।আমি তখন সেই দেবদেব মহাদেবের পূজা করার নিমিত্তে সেখানে গমন করেছিলাম।তাই আমি তা কার্তিকের মুখ থেকে শ্রবণ করেছিলাম,তা এখন অবিকল বর্ণনা কর়ছি,শ্রবণ করুন।”
এরপর ৯-৪৪ নং শ্লোক পর্যন্ত প্রথম অধ্যায়,২য়-৫ম অধ্যায় পর্যন্ত পুরুষোত্তম ক্ষেত্রের মাহাত্ম্য বর্ণিত হয়েছে।
৬ষ্ঠ অধ্যায়ে মুনিগণ জৈমিনি ঋষিকে বললেন,হে দ্বিজশ্রেষ্ঠ! কোন দেশে সেই পুরুষোত্তম ক্ষেত্রটি বিদ্যমান,যেখানে নারায়ন সাক্ষাৎ দারুরুপী প্রকাশিত? এর উত্তরে জৈমিনি বললেন,উৎকল ( বর্তমান নাম উড়িশ্যা বা পুরী) নামে একটি পরমপবিত্র বিখ্যাত দেশ আছে,তাতে অনেক তীর্থ ও পূণ্যস্থান বর্তমান।সেই দেশটি দক্ষিণ সমুদ্রের তীরে অবস্থিত।সেখানের লোকসকল সদাচারে বিখ্যাত।
৭ম অধ্যায়ের ১-৭৮ শ্লোকের বর্ণনা অনুযায়ী,
মুনিরা জৈমিনি ঋষিকে প্রশ্ন করেন,হে মহর্ষি কোন যুগে ইন্দ্রদ্যুম্ন রাজা ছিলেন? কোন দেশে ওনার নগর? তিনি কি প্রকারে পুরুষোত্তম ক্ষেত্রে গমন করেন? কি নিমিত্তে বিষ্ণুবিগ্রহ নির্মাণ করেন? এই সকল যথার্থরুপে বিস্তৃত ভাবে বর্ণনা করুন।
“জৈমিনি উবাচ।আসীৎ কৃতযুগে বিপ্রা ইন্দ্রদ্যুম্নো মহানৃপ।সূর্য্যবংশে স ধর্ম্মাত্মা সৃষ্ট পঞ্চমপুরুষ।।৬।।”
অনুবাদঃ “জৈমিনি বললেন,সত্যযুগে সূর্য্যবংশে জাত ইন্দ্রদ্যুম্নো নামে এক রাজা ছিলেন।সেই ধর্মাত্মা ব্রহ্মার পঞ্চম পুত্র।”
তিনি সত্যবাদী,সদাচারী, নিষ্পাপ ও সাত্ত্বিকশ্রেষ্ঠ।তিনি প্রজাদেরকে সন্তানের ন্যায় প্রতিপালন করতেন।তিনি ছিলেন জিতেন্দ্রিয় এবং বৈষ্ণব। পারমার্থিক মুক্তিকামনায় ইন্দ্রদ্যুম্ন রাজসূয় মহাযজ্ঞ এবং শত অশ্বমেধ যজ্ঞ করেছিলেন।এইরুপ সকল গুনবিশিষ্ট পৃথিবীপালক সেই রাজা দ্বিতীয় অমরাবতীর ন্যায় সর্বরত্নযুক্ত সুবিখ্যাত অবন্তী নগরীতে বাস করতেন।তিনি সে নগরে বাস করে কায় মনো বাক্যে বিষ্ণুর প্রতি অচলাভক্তি প্রদর্শন করেছিলেন।
একদা নরপতি ( ইন্দ্রদ্যুম্ন রাজা) দেবার্চ্চনগৃহে শ্রীপতি বিষ্ণুর পূজার সময়ে পন্ডিত এবং তীর্থযাত্রা প্রস্তাবকারীগণসহ পুরোহিতকে সমাদরে জিজ্ঞাসা করলেন,
“আদৃতো ব্যাজহারেদং জ্ঞায়তাং ক্ষেত্রমুত্তমম।
যত্র সাক্ষাৎ জগন্নাথং পশ্যাম্যেতেন চক্ষুষা।।”১৮।।
অনুবাদঃজানেন উত্তম ক্ষেত্রধাম কোথায়? যেখানে সাক্ষাৎ জগন্নাথদেবকে এই চর্মচক্ষুদ্বারা দর্শন করা যায়?
পুরোহিত সেই বিষ্ণুভক্ত নৃপশ্রেষ্ঠ কতৃর্ক এইপ্রকার জিজ্ঞসিত হয়ে তীর্থযাত্রিদের প্রতি দৃষ্টিপাতপূর্বক প্রশ্ন করেন,হে তীর্থযাত্রীগণ,আপনারা সর্বদা তীর্থ পর্যতন করেন,আপনারা ধার্মিক ও বহুদেশদর্শী,এই রাজা যা আদেশ করছেন, তা কি আপনারা শ্রবণ করেছেন?
“রাজন্ননেকতীর্থানি ব্যচাবিষমহং প্রভো।আশৈশবাৎ ক্ষিতিতলে শ্রুতান্যন্যৈশ্চ তীর্থগেঃ।।২২।।ওড্রদেশ ইতি খ্যাতে বর্ষে ভারতসংজ্ঞকে দক্ষিনস্যোদধেস্তীরে ক্ষেত্র পুরুষোত্তম।।২৩।।”
অনুবাদঃ” তীর্থযাত্রীগনের মধ্যে একজন বললেন,হে রাজন, আমি শিশুকাল থেকে এই ভূমন্ডলে বহু তীর্থ ভ্রমন করে়ছি এবং অন্যান্য তীর্থগামী ব্যাক্তির নিকটেও শুনে়ছি যে,এই ভারতবর্ষের বিখ্যাত ওড্রদেশের ( বর্তমান নাম উড়িষ্যা/পুরী) দক্ষিণ সমুদ্রের তীরে শ্রীপুরুষোত্তম নামে উত্তম ক্ষেত্র আছে।”
তার মধ্যে নীলগিরি নামে এক পর্বত আছে।তার চতুর্দিক বনে আবৃত।তার অগ্রভাগে চতুর্দিকে একক্রোশ পরিমাণ এক কল্পবৃক্ষ আছে,ঐ বৃক্ষের ছায়াস্পর্শে ব্রহ্মহত্যার পাপ বিনষ্ট হয়।তার পঞ্চিমে রৌহিন নামে বিখ্যাত এক কুন্ড আছে।
“তস্য প্রাকৃতমাস্থায় নীলেন্দ্র মনিনির্ম্মিতা।। ২৬।।
তনু শ্রীবাসুদেবস্য সাক্ষন্মুক্তি প্রদায়িনী।২৭।।”
অনুবাদঃ “সেখানে অথাৎ ঐই কুন্ডের তীরে নীলকান্তমণি নির্মিত ভগবান বাসুদেবের মুর্তি বিদ্যমান।।তা সাক্ষাৎ মুক্তিপ্রদ।”
যে ব্যাক্তি সেই কুন্ডে স্নান করে পুরুষোত্তমকে সেবা করে, সে সহস্র অশ্বমেধ যজ্ঞের ফল প্রাপ্ত হয়ে মুক্তিলাভ করে।তার পঞ্চিমদিকে শবরদীপক নামে বিখ্যাত একটি শ্রেষ্ঠ আশ্রম আছে,যেখানে সাক্ষাৎ জগন্নাথ ( বিষ্ণু)শঙ্খ,চক্র,গদা ধারণপূর্বক অবস্থান করছেন।হে রাজন,আপনি বিষ্ণুভক্ত এবং সতত দৃঢ়ব্রত,এজন্য আপনাকে উপদেশ দেওয়ার নিমিত্তে এ স্থানে আমি আগমন করেছি।এক্ষণে আপনার নিকট ধন ও ভূমি প্রার্থনা করতে আসিনি।আমার এ কথা অলীক বিবেচনা না করে পুরুষোত্তমস্থ পুরুষোত্তমের ভজনা করুন।সেই জটিল তপস্বী এই উপদেশ দান করে সকল দর্শকদের নিকট হতে সত্ত্বর অন্তর্ধান হলেন।রাজা নিতান্ত বিস্ময়ে ব্যাকুল হলেন যে,আমি এখন কিরুপে জীবন নির্বাহ করব? এইরুপ চিন্তা করে রাজা পুরোহিতকে বললেন,হে ব্রাহ্মণশ্রেষ্ঠ আমি বিস্ময়কর এ বৃত্তান্ত শ্রবন করে যে স্থলে সেই গদাধর আছেন, সেখানে আমার বুদ্ধি সত্ত্বরগামিনী হয়েছে।পুরোহিত বললেন, আমি প্রতিজ্ঞা করছি,যাতে সেই সাক্ষাৎ মুক্তিদাতা কেশবকে চর্মচক্ষু দ্বারা দর্শন করতে আপনি পারেন,তা আমি অবশ্যই করব।সেই মহাপূণ্য পুরুষোত্তম ক্ষেত্রে আমরা সকলে গমন করে তাতে বাস করতে পারি,সেরুপ যত্ম করব।ব্রাহ্মণের সেই বাক্য শ্রবণ করে রাজা বললেন,আপনার নিকট এরুপ বাক্য শ্রবণ করে সেইক্ষেত্রে ভগবানের নিকট বাস করব,এই প্রতিজ্ঞা করছি।অতত্রব আপনার ভ্রাতা সেখানে গমন করে আমাদের মঙ্গল বিধান করুন।রাজা এ কথা বলে অন্তঃপুরে অত্যন্ত আনন্দচিত্তে গমন করেন।
এরপর পুরোহিত সেই সকল ব্যাক্তিকে রাজার আজ্ঞাক্রমে যথাযোগ্য সন্মান সহকারে স্বীয় আশ্রমে বিদায় দিলেন।এরপর ভ্রাতা বিদ্যাপতিকে স্বস্ত্যায়নপূর্বক শুভক্ষণে প্রেরণ করেন।
জৈমিনি বললেন,হে বিপ্রগণ, বিদ্যাপতি রথে আরোহন করে জগন্নাথদেবকে চিন্তা করতে করতে বায়ুবেগে গমন করতে লাগলেন।হে বিপ্রগণ, বহুদিন গত হলে অপরাহ্ণে পথিমধ্যে ভূমন্ডলের পবিত্রতাজনক ও ভূবনের মঙ্গলজনক ওড্রদেশ( বর্তমান উড়িষ্যা) দর্শন করলেন।এই প্রকারে বন,গিরি,দূর্গ ও পথসকল দর্শন করতে করতে সূর্যাস্ত্র সময়ে মহানদীর তীরে উপস্থিত হলেন।হে বিপ্রগণ! বিদ্যাপতি রথ থেকে ভূমিতে আরোহন করে আহ্নিক ক্রিয়া সমাপন করে,সন্ধ্যা উপাসনা সম্পন্ন করে মধুসূদনকে চিন্তা করলেন এবং রথপৃষ্টে স্থিতিপূর্বক রাত্রিযাপন করেন।এরপর বিদ্যাপতি প্রাতঃকৃত্য সমাপন করে গোবিন্দকে চিন্তা করতে করতে রথে আরোহন করে সে স্থান প্রস্থান করলেন।তারপর উভয়দিক পথ দর্শন করতে করতে শ্রোত্রিয়,যাজ্ঞিক ও ব্রহ্মতেজস্বীদিগের যুপকাষ্ঠ দ্বারা শোভিত গ্রামে আগমন করেন।হে দ্বিজগন!ব্রাহ্মণ( বিদ্যাপতি) কিছুদূর গিয়ে নীলাচল পর্বত দেখলেন,ঐই পর্বতটি কল্পবটশোভিত,চতুর্পাশ্বে কাননশ্রেণী।ঐই পর্বতে সাক্ষাৎ মুর্তিমান বিষ্ণুর বাসস্থান। “
… চলবে।
জয় জগন্নাথ। হরে কৃষ্ণ। প্রনাম।
সদগুন মাধব দাস।
সেবক – স্বধর্মম্ : Connect to the inner self And, ° স্বধর্মম্ : প্রশ্ন করুন | উত্তর পাবেন।